দ্য সেভেন্থ সিল, সেই চিরন্তন দাবাড়ুরা
L
সমস্ত চরাচর মহামারীর অশুভ জ্যোৎস্নায় ভেজা ভেজা, সাদাকালো আকাশে ধূসর চিল উড়ছে। একজন নেহাৎ নারী, সন্দেহ করা হচ্ছে স্বয়ং শয়তানের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ! পুড়িয়ে মারা হবে। মানুষ যেমন করে ভাবতে ভালোবাসে, কৃচ্ছতাই বুঝি আরোগ্যের একমাত্র উপায়, নিজেদের শরীরে নিজেরাই এঁকে নিচ্ছে নিগ্রহের চিহ্ন, ঠিক সেই সময় একজন নাইট মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলতে বসলেন সাগরকিনারে। জিতলে মৃত্যু হেরে যাবে, হারলে শীতল অন্ধকার টেনে নিয়ে চলে যাবে কোথায় না কোথায়!
দাবা নিয়ে যতগুলো সিনেমা হয়েছে, ইঙ্গার বার্গম্যানের দ্যা সেভেন্থ সিল বোধহয় সবচেয়ে আলোচিত। উনিশশো সাতান্ন সালের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি চিরকালীন সিনেমাপ্রেমীদের কাছে অনেকটা বাইবেল-স্বরূপ যেন। সেসব থাক আপাতত, আমরা দাবায় ফিরে আসি।
দুটো তো পক্ষ থাকে দাবা খেলার, এই সিনেমায় একপক্ষে মানুষের প্রতিভূ সেই নাইট (অ্যান্তোনিয়াস ব্লক) আর অপরপক্ষে স্বয়ং মৃত্যু। গোটা সিনেমা জুড়ে থেকে থেকে এসেছে সেই চিরন্তন ক্রীড়ার দৃশ্য, আর দুজন ক্রীড়ানক। কোথাও মৃত্যু এগিয়ে আসছে, নিপুণ দানে ডুবিয়ে দিচ্ছে প্রতিপক্ষের নৌকো, কোথাও নাইট মৃত্যুকে ছলনা করে এগিয়ে যাচ্ছে আঁধারের কালো রাজকীয়তার দিকে। একদিকে সাদা, জীবনের প্রতীক। আরেকদিকে কালো, অবধারিত অবশ্যম্ভাবীর প্রতিভূ। ঠিক আমাদের জীবনের মতো।
সিনেমার আরো কিছু চরিত্র যেমন গানার, মিয়া, জফ, কারিন ইত্যাদি। কিন্তু গল্পের মূল চরিত্র আসলে সেই নাইট, গানার, মিয়া কী স্বয়ং মৃত্যুও নয়। গল্পের মূল চরিত্র ওই দাবাখেলার বোর্ড, ওই আদিম এবং অনন্ত দ্বন্দ্ব, যেখানে কোথাও মৃত্যু এগিয়ে যাচ্ছে, কোথাও প্রাণ খুঁজে নিচ্ছে বাঁচার রসদ। জফ আর মিয়াকে দেখে, তাদের ছোট্ট শিশু সন্তান দেখে বাঁচার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠছে বিষাদগ্রস্ত নাইটের। কোথাও আবার গির্জার কনফেশন রুমে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে স্বয়ং মৃত্যুর। মৃত্যুও আসে, নিরাবরণ নিরাভরণ স্বীকারোক্তির রূপ ধরে। একদিকে স্ত্রীর বিচ্ছেদে কাতর পুরুষ দুঃস্থ চরাচরের প্রতি আনাচে কানাচে খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রেম, পরমুহূর্তে আবার সেই পুরুষই নির্দ্বিধায় হিংস্র হয়ে উঠছে অচেনা অজানা মানুষের ওপর। নিছক মুহূর্তের বিনোদনের জন্য। গোটা সিনেমা জুড়েই এই সাদা আর কালোর দ্বন্দ্ব। কোথাও জিতে যায় আলো, পরমুহুর্তেই কোথাও আরেক কদম এগিয়ে আসে মৃত্যুর বোড়ে।
জফ একজন অভিনেতা, সে হাসে, গায়। মিয়া, তার স্ত্রীকে ভালোবাসে। তাদের একটা ছোট্ট শিশু ভোলানাথ আছে। সে এখনও ভালো করে হাঁটতে শেখেনি। জফ খালি বকবক করে আর মাঝে মাঝে এমন কিছু দেখতে পায়, যা আসলে নেই। হয়তো বা আছে। জফের মতন চোখ না থাকলে দেখা যায় না। যেমন সে দেখতে পায় মাদার মেরি ছোট্ট যিশুকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে সুন্দর একটা রোদ্দুরের মধ্যে। তার ভারী ইচ্ছে জাগলিং করতে করতে একদিন ওপরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া বলটা ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। যে মানুষের প্রতিভূ হয়ে দাবাখেলায় নামে মৃত্যুর সঙ্গে সে এই চিরন্তন আটপৌরে স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখবে বলেই নামে। কারণ দিনের শেষে রাজা মরে যায়, রানির জায়গা হয় ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এই ছোট্ট ছোট দুঃখ সুখের গল্পগুলোই আসলে মানবসভ্যতার আসল ইতিহাস। যা ভীষণভাবে সংরক্ষণযোগ্য।
দাবা খেলায় মূল হল রাজাকে রক্ষা করা। অথচ সেই খেলাতেই রাজার ক্ষমতা সবচেয়ে কম। যে কোনও দিকে একঘর মোটে যেতে পারে সে। ঠিক একটা একবগ্গা মানুষের মতো। যে কোনও দিকেই সে চলে যেতে পারে। কিন্তু রিপুর প্রতি অন্ধত্ব তাকে ঠিক ওই একপায়ের বেশি এগোতে দেয় না। অথচ চরাচরের সমস্ত আয়োজন, হাতি-ঘোড়া-নৌকো-সেপাই, এমনকি সবচেয়ে ক্ষমতাবান রানি, যিনি ইচ্ছেমতো যে কোনও দিকে যে কোনও ঘর পর্যন্ত চলে যেতে পারেন, এদের সবার ভূমিকা শুধু সেই উন্নাসিক রাজাকে রক্ষা করার। যেমন মানুষের শত সহস্র আয়োজন, অভিযান কেবল নিজের মনে গড়ে ওঠা নিজের মাথার উষ্ণীষকে উন্নত রাখার। যেন সেটুকু নুয়ে গেলে তার অস্তিত্বের ভারী সে এক অবমাননা। ওপ্রান্তের প্রতিপক্ষ, হোক সে যশ কী নিছক আমোদ অথবা নীল মণির কোনো নারী, খিলখিল করে হেসে উঠে বলবে, চেকমেট!
আসলে মানুষ যন্ত্রণা চেনে, মহামারী চেনে, নারী পুরুষের আকর্ষণ বিকর্ষণ চেনে, যিশুর যন্ত্রণাকাতর মুখের অবয়ব চেনে, কিন্তু মানুষ মৃত্যুকে চেনে না। আর চেনে না বলেই আজীবন তার থেকে পালিয়ে বেড়ায়। সময় অতিক্রান্ত হলে মৃত্যু যখন ডাকতে আসে, মানুষ আড়াল খোঁজে। হয়ত বাড়িয়ে দেয় দাবার ছক। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সিনেমায় জীবনের অন্তিম লগ্নে যে দাবা খেলার কথা আছে, সেটা প্রতীকী। আসলে এই খেলা মানুষের জন্ম থেকে শুরু হয়। যখন থেকে তার কাছে রক্ষা করার মতন এক রাজা প্রস্তুত হয়ে যায়। সেই কারণেই দাবা খেলার দৃশ্য বারবার ফিরে ফিরে আসে। যে খেলা শুরু হয়েছিল সাগরের ধারে, খেলা চলতে থাকে খোলা মাঠের মধ্যে, কখনও বা ঘনঘোর জঙ্গলের ভিতর। যে গাছের ডালে আশ্রয় নেয় মানুষ রাতের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে বলে, মৃত্যু যখন সেই গাছ কাটতে আসে কাতর স্বরে বলে ওঠে, আর কোনও উপায় নেই!
মহান শিল্পের একটা বিশেষত্ব হলো নিশ্চুপ থেকে উচ্চকিত হওয়া। যেখানে আগন্তুকের চেয়ে পথের সন্ধান চাইতে গিয়ে গানার দেখে আগন্তুকের চোখের কোটরে মৃত্যুর কালো গহ্বর, যেখানে লাস্যময়ী রমণী অবহেলা এবং অবলীলায় অন্য পুরুষের সথে হারিয়ে যায় সবুজ অন্ধকারে আদিম খেলায়। যেখানে যাজক স্বয়ং অসহায় নারীকে আগুনে বলি দেন, মৃতদেহের হাত থেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মানুষ খুলে নেয় হাতের বালা। ছটফট করতে করতে মারা যাওয়ার দৃশ্যেও যখন এক ফোঁটা জল এগিয়ে দেওয়ার নেহাত মানবিক স্বভাব ভুলে যায় ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সেখানে কোথাও ঈশ্বরের আলো নেই। অথচ ঠিক সেই কারণেই সমগ্র দৃশ্যপটে এক কল্যাণের তৃষ্ণা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। আমরা মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকি, সমস্ত বিষাদ এবং তুচ্ছতা নস্যাৎ করে একবার যেন কালো রাজার চারপাশে দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহের মতন ঘিরে দাঁড়াক শুভ্র আলোর যোদ্ধারা।
অথচ দিনের শেষে মৃত্যু ঠিকই জিতে যায়। মাথা নামিয়ে নেন অ্যান্তোনিয়াস ব্লক। সমস্ত আয়োজন ধন্য করে মৃত্যু এক চিলতে হেসে বলে, পরেরবার যখন দেখা হবে, তখন তোমার আর আমার বন্ধন চিরন্তন।
নাইট ঘরে ফিরে এসেছে। অপেক্ষায় থাকা নারীর কাছে। সঙ্গে আরও চারজন বন্ধু আছে তার। খাবার টেবিলে বসে তাঁরা যিশুর পুনরুত্থানের গল্প করছেন। আর আতঙ্কে অধীর হয়ে নাইট দেখছেন দরজায় অনাহুত অতিথি। মৃত্যু তাদের নিতে এসেছে। মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে না, মৃত্যু সবসময় কথা রাখে।
সেই চিরন্তন গল্পগুলো, যার ভার ছিল জফ, মিয়া আর তাদের শিশু ভোলানাথের কাঁধে, তাদের ক্যারাভান তখন এসে দাঁড়ায় সেই সাগরের ধারে। জফ অনেককিছু দেখতে পায়। মিয়া মাঝে মাঝে খোঁটা দেয় তাকে। নিজের চোখে না দেখে সেই বা কী করে বিশ্বাস করে! সে কোলে তুলে নেয় অনাগত আগামীর সোনার তালকে। আর জফ অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে কী করে মৃত্যুর হাতে হাত রেখে ওই দূর দিগন্ত দিয়ে চলে যাচ্ছে সেই নাইট, তার প্রিয় নারী আর তার বন্ধুরা। দেখে মনে হচ্ছে তাদের জীবনের যত প্রশ্ন ছিল, যত উত্তর ছিল, সব তুচ্ছ হয়ে গেছে সেই নিবিড় নটরাজ ভঙ্গির কাছে। যেন খেলা ভেঙে গেছে, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বোড়ে, গজ, নৌকো, মন্ত্রী আর যাঁকে রক্ষার এই এতো আয়োজন, সেই রাজা। তখন মনে হয়, এই খেলা, একঘর এগিয়ে একঘর পিছিয়ে আসা, কোথাও পাহাড়, কোথাও মন্দ্র জলধি, কোথাও অন্ধকার, কোথাও দাবানল, সত্য বুঝি শুধু খেলার নামে এই লীলাটুকুই। তারপর একদিন সব রাজার রাজা এসে খেলা সাঙ্গ করেন। বলেন, এবার ঘরে ফেরার পালা।
সেভেন্থ সিল দাবা খেলার মোড়কে জীবনের গল্প বলে। অন্ধকারের উৎকট রূপ দেখিয়ে আলোর মহিমা দেখায়। দাবা খেলাকে কেন্দ্রে রেখে এর আগেও অনেক সিনেমা হয়েছে, আজও হচ্ছে, পরেও হবে। কিন্তু জীবনের সঙ্গে, মৃত্যুর সঙ্গে, আশার সঙ্গে, কুয়োবোঝাই অন্ধকারের সঙ্গে এভাবে সম্পৃক্ত করে মহাজীবনকে দাবার ছকের রূপকে দেখানো – এটা বোধহয় একমাত্র বার্গম্যানই পারেন। সেজন্যই বোধহয় তিনি রয়ে যাবেন। ঠিক যেমন সিনেমাপ্রেমীদের মনে রয়ে যাবে দ্য সেভেন্থ সিল, ঠিক যেমন রয়ে যাবে সাদা আর কালো বাহিনীর লড়াই, ঠিক যেমন রয়ে যাবে দাবা খেলাটা।
অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্টে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখা
.