বিজ্ঞাপনে মেয়েরা: একটি পর্যালোচনা

বিজ্ঞাপনে মেয়েরা: একটি পর্যালোচনা

একুশ শতকের মুক্ত নারীর দিকে তাকিয়েই মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছিলেন-

“করতলগত আমলকী এই দুনিয়া,
বোতাম টিপলে মেয়ের হাতের মুঠোয়।
একদিন যাকে অক্ষরজ্ঞান দাওনি,
তার হাতে আজ কম্পিউটার বিশ্ব।”

অন্তঃপুরবাসিনী থেকে খোলা আকাশের দখল নেওয়ার এই ক্ষমতায়নের ইতিহাস যেমন সত্য, তেমনই আজও যে নারীর স্বাধীনতা, অধিকার এমনকি জীবনটুকু রক্ষা করার জন্যও প্রতি মুহূর্তে তাকে লড়াই করতে হয়, সেকথাও সত্য। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটা তাই শুধু কর্মজগতে নারীর অংশগ্রহণের আলোচনার মধ্যে দিয়ে বিচার করা চলে না। তাকে দেখতে হয় সমাজে নারীর অবস্থান, নারী বিষয়ক সমাজভাবনার মধ্যে দিয়ে।

চলতি বছরে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞাপনে মেয়েরা’ গ্রন্থের লেখক যশোধরা গুপ্ত মনে করেন, সমাজে মেয়েদের অবস্থানকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা যায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। তাই তিনি তাঁর এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন মুদ্রিত মাধ্যমে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ভাষ্যে সমকালীন নারীভাবনা ও লিঙ্গসম্পর্কের ইতিহাসটি খুঁজতে চেয়েছেন। তবে এই বই প্রকাশের আগে ২০২৪ এ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিজ্ঞাপনে বাঙালি বইটি। তারই পরবর্তী ধাপ হিসেবে যশোধরা গুপ্ত কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনে নারী বিষয়ে।

লেখক মনে করেন সব দেশে, সব কালেই নারীর দৈহিক ও মানসিক গুণাবলীকে বিজ্ঞাপনে পণ্যায়িত করা হয়েছে। যখন পণ্যের লক্ষ্য ক্রেতা পুরুষ তখন তো বটেই, এমনকি যখন পণ্যের লক্ষ্য ক্রেতা নারী, তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই বইয়ের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হল লেখক নিছকই পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপনের অংশ তুলে ধরে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেননি। তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন সাহিত্য ও ইতিহাসের উপাদানের আলোচনার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনে ফুটে ওঠা আখ্যানের সঙ্গে সামাজিক বাস্তবতার তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন। সাহিত্যকে বলা হয় সমাজজীবনের দর্পণ। আর বিজ্ঞাপন? সে কি কেবল মুখ ঢেকে দেয়? নাকি মুখ ফুটিয়েও তোলে?

ভুললে চলে না বিজ্ঞাপনের মূল উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক। তাই বিজ্ঞাপনকে তার আবেদন পৌঁছে দিতে হয় বৃহৎ সংখ্যক সম্ভাব্য ভোক্তার দিকে। যে ভাবনা সমাজের বড় অংশের মানুষের অপরিচিত বা অগ্রহণযোগ্য তাকে তুলে ধরার কাজটা সাহিত্যিক বা সমাজকর্মী করতে পারেন, কিন্তু বিজ্ঞাপন সংস্থা সচরাচর করবেন না। তবে, সমাজভাবনার যা কিছু চেনা ধরণ যাকে বলে স্টিরিওটাইপ তার ভিন্ন কোনও বক্তব্যও যে অনেক সময় উঠে আসতে দেখা যায়, সেকথাও যশোধরা গুপ্ত উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যায় তা কম।
লেখক জানিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে একবিংশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য বিশেষ করে নারীরাই হয়ে উঠতে থাকেন। এর কারণ খুঁজতে হবে লিঙ্গ-ইতিহাসের মধ্যেই।

আলোচ্য বইয়ের লেখক মনুসংহিতার পুরুষতান্ত্রিক বিধান থেকে, নবজাগরণের যুগের মনীষীদের নারীভাবনা বিষয়ক লেখাপত্র, এমনকি অতি সাম্প্রতিক কালের লিঙ্গ-ইতিহাসের গবেষণা নিয়েও আলোচনা করেছেন।
ভারতীয় সমাজে পুরুষতন্ত্র যেভাবে নারীদের ওপর তার আধিপত্যকে যুগের পর যুগ ধরে জারি রেখেছে, সেই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। পুরুষতন্ত্রের জন্মলগ্ন থেকেই নারী ও পুরুষের মধ্যে কর্মবিভাজনের সূত্রপাত। অর্থনীতি ও সমাজের মূল ক্ষেত্রগুলি থেকে নারীদের বঞ্চিত করে রাখা হলেও পুরুষতন্ত্র নারীর প্রতিরোধকে প্রশমিত করতে তাকে সান্ত্বনা স্বরূপ কিছু সীমিত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দান করে। তার মধ্যেই প্রধান গৃহস্থালি। নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং প্রচলিত সামাজিক বিধিবিধান সেই স্বাধীনতার লক্ষণরেখাটি রক্ষা করেছিল। গৃহকর্মের যাবতীয় দায়দায়িত্ব নারীদের ওপর তখনও ছিল, এখনও আছে। আজকের নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে এবং তাঁর কন্ঠস্বর ও মতামতের মূল্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। কিন্তু গৃহকর্ম এখনও লিঙ্গনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি। তাই মোটের ওপর যা দাঁড়িয়েছে তা হল নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের কোনও পরিবারের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগান রাখার দায়িত্ব এবং সেই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব দুটোই নারীর।

তবু নারীকে সৌন্দর্য, সতীত্ব ও মাতৃত্বের ধারণা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিজ্ঞাপন। লেখক দেখিয়েছেন, বিজ্ঞাপনের ভাষ্যে নারী যখন প্রেয়সী রূপে কাম্য, তখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তার সৌন্দর্য, লাবণ্য ইত্যাদির ওপর। বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রী, বস্ত্র, অলঙ্কারের বিজ্ঞাপনে তাই বিম্বিত হন আকর্ষণীয় রূপে। আবার সে যখন মাতৃ রূপে আরাধ্য তখন তার স্বাস্থ্য ও শক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তাই টনিক বা ওষুধের বিজ্ঞাপনে চিত্রিত হন ঘরোয়া, মাতৃসুলভ চেহারার নারী। আবার বোরোলিনের মতো যে সকল পণ্য নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই ব্যবহার্য হতে পারে, তার বিজ্ঞাপনের আবেদন পৌঁছোচ্ছে নারীর কাছে এই বলে যে সকলের খেয়াল রাখা বাড়ির মহিলারই দায়িত্ব।

নারীকে সৌন্দর্য, সতীত্ব ও মাতৃত্বের ধারণা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপনের ভাষায় নারী-পুরুষের সম্পর্কের দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন লেখক। নারীকে দেখা হয়েছে পুরুষের নানারকম চাহিদার জোগান দেওয়ার কাজে। কখনও তা শিশুসুলভ আবদার আবার কখনও প্রভুসুলভ আদেশ। কর্মজীবী নারীদের উদ্দেশ করে কাপর কাচার সাবান, বাসন মাজার সাবান, রান্নার মশলা, বাসনপত্রের বিজ্ঞাপনের ভাষ্য মনে করিয়ে দেয় নারী ইতিহাসের জনপ্রিয় দ্বৈত বোঝা তত্ত্ব।

১৩৬৭ বঙ্গাব্দের শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে বর্তমান সময়ের টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের চিত্র তিনি সাজিয়েছেন এই বইতে। পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, লিঙ্গভাবনার নিরিখে আদৌ কতটা এগিয়েছে আমাদের সমাজ? তার উত্তরও রয়েছে বিজ্ঞাপনে মেয়েরা বইয়ের পাতায়। সমাজ সংস্কৃতির অন্য সবক্ষেত্রের মতোই বিজ্ঞাপনের ইতিহাসও স্থানু নয়, নারীভাবনাও অপরিবর্তনীয় নয়। চেনা ছকের বাইরে কথা বলতে চাওয়া, ভাবতে শেখানোর বিজ্ঞাপন কি আমাদের চোখে পড়েনা? হরলিক্সের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনে ডাক্তার স্ত্রীর জন্য স্বামীকে খাবার তৈরি করে দিতে দেখা যায়। আবার কোনও বিজ্ঞাপনে কিশোরীকে দেখা যায় গাড়ি সারানোর কাজে। লেখক জানিয়েছেন প্রথম দর্শনে ধাক্কা খেলেও পরবর্তীতে দর্শক এই ভাবনাকে গ্রহণ করেছেন।

হরলিক্সের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনে ডাক্তার স্ত্রীর জন্য স্বামীকে খাবার তৈরি করে দিতে দেখা যায়

কিন্তু লেখকের এই ব্যাখ্যাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। বিজ্ঞাপনের এই নতুন ধরণ কি সত্যিই দর্শকের মনে ধাক্কা দিয়ে নতুন ভাবনাকে তৈরি করতে চেয়েছে? নাকি সমাজমনে সেই ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হতে আগেই শুরু করেছিল আর বিজ্ঞাপনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে? যেটাই হয়ে থাকনা কেন, নারীভাবনার নিরিখে এ এক ইতিবাচক পরিবর্তন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আলোচ্য বইয়ের লেখক তাই এই ইতিবাচকতার রেশ রেখেই তাঁর আলোচনা শেষ করেছেন।

 

বিজ্ঞাপনে মেয়েরা
যশোধরা গুপ্ত
প্রথম সংস্করণ
প্রকাশক – খসড়া খাতা
প্রথম প্রকাশ – কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২৫
মুদ্রিত মূল্য – ৪৫৫ টাকা

নারী-ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক-ইতিহাসচর্চায় আগ্রহী গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *