মানুষের খোঁজে এক কথাকার
সম্প্রতি চলে গেলেন লেখক প্রফুল্ল রায়। দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে অজস্র পুরস্কার আর পাঠকের অকুন্ঠ ভালোবাসা পেয়েছিলেন তিনি। দেশভাগের ব্যথাতুর অনুভব আর প্রান্তিক রুখা সুখা ভূমির ভুখা মানুষের কাহিনি অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছিলেন পাঠকের দরবারে। তাঁর ভাষায় বলতে গেলে…
দেশভাগের বৈষম্য, নৈরাশ্য, নৈরাজ্য এবং গভীর তামাশার মধ্যে মানুষকে তার স্বমহিমায় আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি। এত ক্ষয় ও ধংসের মধ্যে যেখানে মনুষ্যত্বের এতটুকু স্ফুলিঙ্গ চোখে পড়েছে আমার লেখায় তা ধরতে চেয়েছি। (প্রফুল্ল রায়, সেরা ৫০টি গল্প, পৃ-৫)
ঔপন্যাসিক প্রফুল্ল রায়ের পাশাপাশি ছোটো গল্পকার প্রফুল্ল রায়কে খুঁজলেও আমরা সেই এক বলিষ্ঠ জীবনবোধকে নানা রঙে রেখায় ফুটে উঠতে দেখব। অথচ, সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক জানেন উপন্যাসের বহুতল বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের তুলনায় ছোটোগল্পের নির্দিষ্ট পরিসরে তা প্রকাশ করা কতটা কঠিন। কিন্তু সব্যসাচী প্রফুল্ল রায় অনায়াসে সেই কাজটি করে গেছেন।
গল্পসমগ্র (খণ্ড ১) পড়তে গিয়ে এমন কয়েকটি গল্পের সন্ধান পেয়েছি যা লেখকের ‘মানুষ’ খোঁজার তাগিদকে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মোট আঠেরোটি গল্পের এই সংকলনের প্রথম গল্পটির শিরোনাম ‘এক রমণীর গল্প।’ মণিময়দা আর নীলিমাবৌদির সুখী দাম্পত্যের পথে ক্যান্সার নামক মারণ রোগের ছোবলকে প্রাথমিক পর্যায়ে যাবতীয় বিপর্যয়ের কারণ মনে হলেও গল্প যত এগোয় পাঠক তত অনুভব করেন নরনারীর নামহীন সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার উদারতাহীন সমাজকাঠামো, ভণ্ড পারিবারিক ঐতিহ্য, মিথ্যে মর্যাদাবোধ, ক্যান্সারের চেয়েও ভয়ংকর। লেখকের সঙ্গে শেষ দৃশ্যে পাঠকের চোখও তাই ভিজে যায়।
আজকের ভারতের রাজনৈতিক দর্শন বলে লুটেপুটে খাওয়ার জন্যেই রাজনীতির দ্বারস্থ হয় ক্ষমতালোভী নরকের কীটেরা। ‘মেরুদণ্ড’ গল্পটি তার সার্থক উদাহরণ। স্বাধীনতা সংগ্রামী আদর্শবান ভূপতিমোহনকে দলে টানতে চায় ধুরন্ধর ব্যবসাদার পলিটিক্যাল ক্ষমতার দখলদার নিশিকান্ত। বহু চেষ্টাতেও যা সম্ভব হচ্ছিল না আর্থিক দৈন্য, নকশাল আন্দোলনে সামিল হওয়া বড় ছেলে রণেশের শয্যাশায়ী দশা ও স্ত্রী লীলাবতীর পঙ্গুত্ব তা সম্ভব করে তুলল। একমাত্র মেয়ে সবিতার কলেজে একটি চাকরির বিনিময়ে ভূপতিমোহন শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যান। কিন্ত শেষে যা ঘটে তা বোধহয় সিনেমার চিত্রনাট্যেই সম্ভব। ভরা সভায় নিশিকান্তর মুখোশ টেনে খুলে ফেলেন ভূপতিমোহন। ভ্রষ্ট রাজনীতির ঘোলাজলে তারুণ্যের জাগরণ ঘটে।
এত বড়ো দেশের নানা রাজ্যে বিচিত্র প্রতিবেশে দীর্ঘদিন কাটানো লেখক জীবনের এমন অনেক রং এমন অজস্র ঘটনাক্রম দেখেছেন যা শহুরে মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না। ‘বাঘ’ গল্পটি তেমনি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। মহারাষ্ট্রের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার প্রান্ত দেশের তুলো চাষীদের জীবনে উৎসব আসে গণপতি বাপ্পার মঙ্গল আগমন ঘিরে। হতদরিদ্র ঘুনুরাম তিন মাসের খোরাকি আর সম্বৎসরের চারজোড়া কাপড়ের লোভে, বহু কষ্ট সহ্য করে, চান্দা থেকে নেমপুরা হাজির হয় এই উৎসবের মরসুমে। উদ্দেশ্য ‘বাঘ সেজে’ পাহাড়ি গ্রামের মানুষগুলোর মনোরঞ্জন। প্রতিবারের মতো ‘কালো ময়ূরী’ রতির বাবা শিবলনাথের ডেরায় আশ্রয় নেয় ঘুনুরাম। রতির বন্য সৌন্দর্যে মাতোয়ারা মানুষটি প্রতিবছর যে আপ্যায়ন পায় এবার আর তা কপালে জোটে না। কারণ, অসলি চিতাবাঘের খাঁচা নিয়ে হাজির হয়েছে সুদর্শন যুবক শম্ভা। আসল বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘ-সং ঘুনুরাম প্রেমের জয়ধ্বজা ওড়াতে পারে কি? প্রফুল্ল রায় পাঠককে এক বিস্ময় ভূমিতে দাঁড় করিয়ে রেখে যান।
প্রান্তিক দুর্বল মানুষ প্রবল প্রতিপক্ষের হাতে বার বার অপদস্থ হয় এমন পরাজয়ের গল্প লেখক কিন্তু সবসময় লেখেননি। ‘রাজপুত’ গল্পে মোতিয়া ঘোড়ার পালক হীরালাল দু’মুঠো অন্নের কাঙাল হলেও দেহব্যবসায় নামতে অনিচ্ছুক বিলাখীর মেয়ে কুন্তাকে নারীমাংসলোভী জোতদার ধনেশ্বর ব্রাহ্মণের কামনার লেলিহান আগুন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। লেখক চকিতে যেন আধুনিক পৃথ্বীরাজ- সংযুক্তার অমর প্রেমকথা নতুন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন।
নিছক রোমান্টিক গল্প ‘বিরুদ্ধপক্ষে’ ঝগড়া হয়ে ওঠে প্রেমের ভিত, আবার ইগোর পাহাড় ঠেলে বাবা মায়ের সন্তানের জন্য জুড়ে যাওয়ার গল্প ‘মলির জন্য’ পাঠক সাধারণকে মানসিক তৃপ্তি দেয়।
প্রফুল্ল রায়ের পঞ্চাশটি শ্রেষ্ঠ গল্প-এ অসামান্য বিচিত্র অগণিত মানুষ দেখার চোখ নর-নারীর সম্পর্কের তলদেশ থেকে ডুব সাঁতার দিয়ে তুলে আনে মণিমুক্তা। ‘চোর’ গল্পটি তেমনি এক সর্বহারা নারীর হৃদয়ছেঁড়া ভালোবাসার গল্প। রূপসী আকলিমা আর ইলিশ মাঝি রাজিবুল মেঘনার তীরে বেঁধেছিল সুখের ঘর। লুঠেরা খলিল এক গহন রাতে লুঠে নেয় আকলিমাকে। বহুদিন পর ধর্ষিতা অপমানিতা জীবনবিধ্বস্ত আকলিমার সঙ্গে দেখা হয় রাজিবুলের। না! প্রেমপূর্ণতা পায় না তাদের, তবে আকলিমার প্রতিশোধ কাঁদায় পাঠককে।
সমাজ যাদের ছুঁড়ে ফেলেছে দূরে সেইসব শরীর বেচা মেয়েদের কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধার অশ্রুজল চিকচিক করে ওঠে ‘শেষযাত্রা’ গল্পে। পসারহীন ডাক্তার ভুবন চক্রবর্তী আর কেষ্টভামিনীর আশ্রয়ে থাকা পঁচাশটি দেহপসারিনী মেয়েদের পিতাপুত্রীর সম্পর্ক এ গল্পের সম্পদ।
সোনাইবিবির বিলের আশ্চর্য বাদিয়া জগৎ আর তার নেশা ধরানো জৈবিক আকর্ষণ শঙ্খিনী চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছে। ‘নাগমতী’ গল্পে একদা দুর্ধর্ষ বেদে রাজাবাবুর ঘর বাঁধবার সাধ পঙ্খিনীর শান্ত চোখের তারায় আশ্রয় খুঁজে পায় ঠিকই কিন্তু পূর্ণতা পায় না। এক নিঃসীম হাহাকার গল্পের পরতে পরতে পাক দিয়ে ফেরে রাজাবাবু আর শঙ্খিনীর ভয়াল ভয়ংকর মৃত্যুতে।
দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু মানুষের নিরন্তর শিকড়ের অনুসন্ধান, প্রফুল্লরায়ের উপন্যাসের কথাবস্তু হয়েছে বারবার। ‘বিদেশী,’ ‘জনক,’ অনুপ্রবেশ,’ ‘রাজা যায় রাজা আসে,’ ‘মাঝি,’ ‘ধুনিরামের দুই সঙ্গী,’ সহ মোট ১৭টি গল্পে দেশভাগজনিত বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী উদ্বাস্তু জীবনের ভুক্তভোগী লেখক অতি সন্তর্পণে বাস্তবটুকু তুলে ধরেছেন। জীবন্ত ঘটনার হৃদয়বিদারক বর্ণনায় তাই তিনি বার বার সফলতা পেয়েছেন।
১৯৪৬-’৪৭-এর দুঃসময়ের প্রতিনিধিত্ব করে ‘মাঝি’ গল্পটি। এ গল্পের নায়ক ফজল সাতকুড়ি টাকা রোজগার করতে চায় সলিমাকে বউ করে ঘরে আনার জন্যে। সলিমার বাপ বড় চামার, টাকা না পেলে মেয়ে দেবে না। আর সেই প্রেক্ষাপটেই একদিন কিছু বেশি পয়সার আশায় ফজল তারপাশা ঘাটে হাজির হয় কেরায়ায় আশায়। সেখানেই পাশের গ্রামের ইয়াসিন শেখ এক বোরখা পরিহিতা নারীকে নিয়ে হাজির হয় চর ইসমাইলে যাবে বলে। ফজল এমন দুর্দিনে অত দূরের পথ যেতে প্রথমে রাজি না হলে দশ টাকা ভাড়ার কড়ারে রাজি হয়। আনন্দে মাঝির মন নেচে ওঠে। কারণ আর ঐ দশটি টাকা হলেই পণের টাকা পূরণ হবে। সলিমা হবে তার।
নৌকা চলতে শুরু করে। ছইয়ের ভেতর থেকে অসহায় নারীর কান্না ভেসে আসে। ফজল টের পায় ইয়াসিনের সঙ্গের মহিলা তার বিবি নয়। ইয়াসিনের হাত থেকে নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে মেয়েটি যখন আর্তচিৎকার করতে থাকে তখন ফজল প্রতিরোধটুকু গড়ে তোলে। শেষপর্যন্ত ইয়াসিনকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। অসহায় মেয়েটির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে ফজল জানতে পারে তাঁতি বাড়ির মেয়েটির স্বামী দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হলে ইয়াসিন তাকে লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটিকে বাঁচাতে ফজল তার সবটুকু সঞ্চয় ভেঙে ইন্ডিয়া যাওয়ার স্টিমারের টিকিট কেটে দেয়, কর্পদকশূন্য ফজল পণের টাকাটুকু সলিমার বাবাকে তুলে না দিতে পারলেও অপর ধর্মের মেয়েটিকে বাঁচিয়ে চিরকালীন মনুষ্যত্বের প্রতীক হয়ে পাঠকের হৃদয়ে থেকে যায়।
‘রক্তকমল’ গল্পে গ্রাম্য স্বভাবকবি নাজিম দাঙ্গার বীভৎসতার মধ্যে দাঁড়িয়েও বাংলাভাষা আর তার ঐতিহ্যকে বুক দিয়ে আগলাতে চায়। মুসলমান চাষী ঘরের ছেলে নাজিম মনসামঙ্গল আর মেয়েলি ব্রতকথায় খুঁজে পায় বাঙালির নিজস্ব কন্ঠস্বর। ১৯৭১-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পটি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রামী ঐতিহ্যকে, ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার দুঃসাহসিক রূপকথাকে, পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরে।
‘রাজা যায় রাজা আসে’ গল্পে প্রফুল্ল রায় এক ঐতিহাসিক সত্যের বাস্তব দিকটি উদ্ঘাটন করেছেন। দরিদ্র নিরন্ন রাজেকের হঠাৎ রাজা হওয়ার উপাখ্যান এই গল্প। বৈকুন্ঠ সাহার পরিবার ইন্ডিয়া পালানোর আগে হতদরিদ্র ‘আহাম্মুক’ রাজেককে তাদের ভিটেমাটি বিস্তৃত জমিজমা মাঠ পুকুর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যায়। পরম যত্নে দীর্ঘ আটমাস ধরে রাজেক সেই সম্পত্তি আগলে রাখে। দরিদ্র সরল রাজেকের বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়ায় ধূর্ত ধনী তোরাব আলি মোক্ষম এক চাল দেয়। বারবার সসম্মানে রাজেককে নিজের ভিটেয় নিমন্ত্রণ করে আনে পাতে সাজিয়ে দেয় – “পাঁচ-ছ রকমের মাছ, মাংস, পায়েস, পাতক্ষীর, বড় বড় মোহন বাঁশি কলা, পুরু সরওলা হলুদ বর্ণ ঘন দুধ।” তোরাবের নিজের মেয়ে রাজেকের স্বপ্নসুন্দরী কামরুনের সঙ্গে বিয়ের কথা একরকম পাকা হয়ে যায়। তোরাব আলি মেয়ে দিয়ে বৈকুন্ঠ সাহার সম্পত্তি গ্রাস করতে চায়। ঠিক তখনই ফিরে আসেন বৈকুন্ঠ সাহা সঙ্গে মুর্শিদাবাদের আমিন সাহেব। বিষয়ী লোক বৈকুন্ঠ সম্পত্তি বিনিময় করবেন আমিন সাহেবের সঙ্গে। তাসের ঘরের মতো মুহূর্তে ভেঙে যায় রাজেকের দিবাস্বপ্ন… “দ্যাশখান দুভাগ হয়, সাহারা ভুঁইমালিরা যুগিরা গ্রাম ছাড়া যায়, দ্যাশের এক রাজা যায়, আরেক রাজা আসে, তাতে তর কী রে, তর কী?” রাজেকের মতো হতদরিদ্র মানুষের এই আত্মধিক্কারেই শেষ হয় গল্প।
প্রফুল্ল রায়ের তিনটি গল্প ‘জনক,’ ‘বিদেশী,’ ও ‘অনুপ্রবেশ,’ দেশভাগ জনিত জটিলতা ও সম্পর্কের বাঁক বদলকে অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরে। ‘জনক’ গল্পের রক্ষণশীল সংস্কারবদ্ধ শেখরনাথ ত্রিশ বছর আগে মীরপুরের দাঙ্গায় একমাত্র কন্যা ‘খুকু’কে হারিয়েছিলেন। দাঙ্গাবাজেরা তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়, সেই আগুনে পুড়ে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। বহুকষ্টে এপার বাংলায় এসে অতীতকে ভুলে শেখরনাথ ছেলে-বৌ সন্দীপ শোভনা আর একমাত্র নাতি রাজাকে নিয়ে নিজের মতো বাস করেন। হঠাৎ সেই নিস্তরঙ্গ জীবন উত্তাল হয়ে ওঠে। খুকু ত্রিশ বছর পর বহু খোঁজাখুজি করে বাবার কাছে এলে শেখরনাথ কিছুতেই তার মুখোমুখি হতে চান না। তাঁর আজন্ম লালিত সংস্কার বাধা দেয়। ছেলের শ্লেষাত্মক বাক্যবাণ যা পারে না, পিতৃহৃদয়ের হাহাকার শেষ পর্যন্ত তাই করতে বাধ্য করে। বিধর্মী জামাই হারুণ যে খুকুর রক্ষাকর্তাও বটে। তাকে আর কন্যাসন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে নেন শেখরনাথ। সংস্কারের বদ্ধজলার ক্রমমুক্তি আসে নাটকীয় ভাবে।
‘বিদেশী’ গল্পে পাঁচবন্ধুর খোঁজে আসা বাজিতপুরের ৭৬ বছরের আলতাফের চোখ দিয়ে আমরা মনুষ্যত্ব এবং বন্ধুতার অপমৃত্যু দেখি। ধনী ব্যবসায়ী অম্বিকা এককালের বন্ধু আরেক ধনবান আলতাফকে বাড়িতে ডেকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারলেও তার প্রস্তাবে রাজি হতে পারে না। আদর্শবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী একদা বন্ধু মণিমোহনকে সে ঘৃণা আর করুণাই করে। তার সুন্দরী গুণী মেয়ে সোনার সঙ্গে ছেলের বিবাহ দেওয়ার মতো উদারতা দেখানো তার কাছে মূর্খামি।
‘অনুপ্রবেশ’ গল্পটি আজকের দেশহীন রাষ্ট্র পরিচয়হীন শরণার্থী মানুষের রোজনামচা। উর্দুভাষী মুসলিম জনগণ স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রাত্য। তাই বহুকষ্টে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে তারা পৌঁছে যায় কোনও এক কালের পিতৃভূমি ইন্ডিয়ায়। দাঙ্গা বিধ্বস্ত বিহারের কোনও এক গ্রাম মনপথল থেকে শরনার্থী হয়ে ঢাকা চলে গেছিল ফরিদের পিতামহ। স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে সেই ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নেয় ফরিদের মতো অজস্র মানুষ। আর ভোটের রাজনীতি করা ক্ষমতালোভী রামবনবাস চৌবে ও আজিবলাল সিং এদের নিয়ে রাজনীতির পাশা খেলে। আজকের ভারতীয় রাজনীতির জনপ্রিয় শব্দ ‘ঘুসপেঁটিয়া’ ঘুরে মরে গল্পের প্রতিবেশের আনাচে কানাচে। ফরিদের আত্মজিজ্ঞাসা – “কে সে? ভারতীয় মুসলমান? পাকিস্তানি? বাংলাদেশী?”
প্রফুল্ল রায়ের ছোটো গল্পের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে আমরা এই বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, শুধু দেশ কাল নয় মানুষ আর তার অন্তর্লোকের সীমাহীন বিস্ময় মনুষ্যত্ববোধের চকিত আলোর ঝলকানি তাঁর গল্পগুলির প্রাণসম্পদ। সাম্প্রদায়িকতা বিধ্বস্ত, ভূমিহীন শরণার্থী মানুষের মিছিলে আজ যখন গোটা বিশ্ব পর্যুদস্ত তখন এই লেখকের রচিত মানবিক গল্পগুলি তাদের রচনাকৌশল, অদ্ভুত প্রতিবেশ বিচিত্র চরিত্র নিয়ে আমাদের বিলুপ্তপ্রায় মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। শেখায়, মানুষই শেষ কথা বলে… সেই নানান প্রতিকূলতার অবসানে জয়যুক্ত হয়। ধর্ম বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস,রাজনীতির কারবারিদের ঘৃণ্য চক্রান্ত যতই তাকে বিপর্যস্ত করুক না কেন!
————-
গ্রন্থপঞ্জী
রায়, প্রফুল্ল। (১৯৭৮)। পঞ্চাশটি শ্রেষ্ঠ গল্প। কলকাতাঃ দে’জ পাবলিকেশন।
রায়, প্রফুল্ল। (১৯৭৫+?)। গল্পসমগ্র, ১, ২। কলকাতাঃ দে’জ পাবলিকেশন।
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।