জলে জঙ্গলে

জলে জঙ্গলে

সুন্দরবন

মাস তিনেক আগেই সুন্দরবনের একটা প্রোগ্রাম ছিল। একটা বড়ো গ্রুপের সঙ্গে যাওয়া, কিন্তু সেটা হল না আবহাওয়ার কারণে। ডিসেম্বর মাস, তাও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস, সাগর উত্তাল। উদ্যোক্তারাই বাতিল করে দিলেন প্রোগ্রাম। মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেল সেই মুহূর্তে, তবে রিস্ক নিয়ে কে যায়! ভাবলাম যা হয় তা সম্ভবত মঙ্গলেরই জন্য। কিন্তু অযাচিতভাবে সপ্তাহখানেক পরেই এসে গেল আরেকটা সুযোগ সেই সুন্দরবন যাওয়ারই। এখন আর দুর্যোগের কোনও সম্ভাবনা নেই। যদিও এই নিয়ে বোধহয় পাঁচ কি ছ’বার আমার সুন্দরবন যাওয়া। লোকে বলবে, ‘পাগল নাকি… একই জায়গায় পাঁচ-ছ’বার!’  কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমি সুন্দরবনের প্রেমে পড়ে গেছি, বারবার সুন্দরবন হলেও আমার কিছু যায় আসে না। প্রত্যেকবারই আমার প্রেমিকাকে যেন নতুন চোখে দেখি। তাছাড়া দেখার চোখ তো পালটে যায়! মনের ভাবনা পালটে যায়! তাই এই সুযোগ ছাড়া গেল না।

একটা পরিচিত গ্রুপ প্রোগ্রামটা করছে। তাই ঝুলে পড়লাম ওদের সঙ্গে। আমার নিজের সঙ্গী বলতে ছিল আমার ভাই এবং ভাইয়ের স্ত্রী।

দিনটা এসে গেল দেখতে দেখতে। শীতলা মন্দির স্টপ বলে গড়িয়াতে একটা জায়গা আছে, কয়েকজনকে নিয়ে গাড়ি আসবে সেখানে সাতটা পনেরো নাগাদ। আমাকে তার আগে সেখানে পৌঁছতে হবে। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ভোর পাঁচটায়। কিন্তু উঠে পড়লাম সাড়ে চারটে। মোটামুটি তৈরি হয়ে সাড়ে ছটার মধ্যে বেরিয়ে গেলাম। সকালে রিকশা পাওয়া খুব দুষ্কর। তাও পেয়ে গেলাম বাড়ি থেকে দু’পা হাঁটতেই। যাক শুরুটা ভালোই হল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শীতলা মন্দির চলে গেলাম। দু’দিন হল বেশ ঠান্ডা পড়েছে। বাসটা আসবে ৪৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে। ফোন করে জানলাম, গাড়ি লেট করছে। সুতরাং অপেক্ষা…

প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ দেখলাম, দূর থেকে আসা একটা গাড়ি থেকে কেউ একজন হাত নাড়ছে। কাছাকাছি আসতেই গাড়ির নম্বর দেখে চিনতে পারলাম, ওটা আমাদেরই গাড়ি। ভাবলাম, গাড়ি দাঁড়াবে, আমি উঠে যাব ধীরে সুস্থে। কিন্তু ওমা, ও দেখি আমাকে পাস করে চলে গেল। কী ব্যাপার! গাড়ি ছুটছে, আমি ছুটছি, মানে জোরে জোরে হাঁটছি লাগেজ নিয়ে। বেশ টেনশনে পড়ে গেলাম। একটু রাগও হল। আমার দৃষ্টির বাইরে গাড়িটা চলে গেল। আমি লাগেজ নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। এবার দৌড়ে নয়, ধীরে, টেনশন-ফ্রি হয়ে। গাড়ির সঙ্গে আমি পারব কেন! নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছে। গাড়ি ঠিক দাঁড়াবে।

হঠাৎ দেখলাম, একটি ছেলে হাসিহাসি মুখে আমার দিকে ছুটতে ছুটতে আসছে। আমি বললাম, কী ব্যাপার, আমাকে ফেলে চলে যাবে নাকি! ছেলেটি বলল, ‘না না দাদা, আপনি যেখানে ছিলেন ওখানে গাড়ি দাঁড়াতে দেবে না, তাই…’ ছেলেটি আমার হাত থেকে লাগেজ নিয়ে সামনে চলতে থাকল। আমি ওকে ফলো করলাম। এই ছেলেটিই বাসের লোক, আমাদের ট্যুর গাইড, নাম বাপ্পা। ভারিমিষ্টি ছেলে। আমার সব রাগ টেনশন ধুয়ে গেল।

বাসের কাছে এলাম। ট্রাভেলার বাস। দেখলাম, একজন সুদর্শন ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। ভাবটা এইরকম – বেশ টেনশনে পড়েছিলেন তো! বুঝলাম, আমরা একই বাসের যাত্রী।  আমিও টেনশন বিহীন একটা হাসি দিলাম। তারপর গাড়িতে উঠে পড়লাম সকলেই।

পুরো বাস ভর্তি লোক। সামনেই একটা সিট ছিল, সেখানেই বসে পড়লাম। বাপ্পা আমার লাগেজটা ড্রাইভারের বাঁদিকে রেখে দিল। তারপর গুনে নিল গাড়ির লোকজন। সবসমেত চব্বিশ জন। শুনলাম, পেছনে একটা টাটা উইঙ্গার আসছে চোদ্দ জনকে নিয়ে। তার মানে, দুটো গাড়ি মিলিয়ে সবসমেত ৩৮ জন যাত্রী।

বাপ্পা ফোন করে পেছনের গাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে নিল। দু’মিনিট বাদেই গাড়ি ছুটে চলল রকেটের গতিতে। ছাড়া ছাড়া কথা হচ্ছে বাসের মধ্যে, শুনতে পাচ্ছি। কেউ বলছে, ওই দেখো কলাগাছ, কেউ বলছে, কী দারুণ ধানখেত। যেন কলাগাছ, ধানখেত কেউ কোনোদিন দেখেনি। আমি চুপচাপ দেখে চলেছি আর হাসছি। সকালের পরিবেশ ভারি মনোরম। আমার বাঁদিকের সিটে-বসা মানুষটির দিকে চোখ গেল। তিনি বেশ তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছেন। মনে মনে ভাবলাম, জীবনের এক-তৃতীয়াংশ তো ঘুমে চলে যায়, আর বেড়াতে এসে এখানেও… যাই হোক, যে যেভাবে জীবন এনজয় করে করুক!  

একটা ছোট্ট ব্রিজ এল, এটার নাম উত্তরভাগ ব্রিজ। আমার ডানদিকে অন্য একজন লোক বসে আছেন। অন্য সিটে। তিনি বোধহয় উদ্যোক্তাদেরই একজন। মাঝে মাঝে সামনে বসা ছেলেটির সঙ্গে কানে কানে কথা বলছেন। বোধহয় কোনো গাইডলাইন দিচ্ছেন। কথাবার্তা থেকেই জানলাম ভালো মাছ পাওয়া যায় এখানে। 

তালদি ছাড়িয়ে গাড়ি একটা জায়গায় দাঁড়াল। এখন চা পানের বিরতি। পেছনদিকে আরেকটা গাড়ি আসছে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সামনে চায়ের দোকান। রাস্তার ধারে। পেছনের গাড়ি এসে গেছে। তাহলে আরও দশ মিনিট অপেক্ষা। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম।

রাস্তার পাশে একটা মাছের গাড়ি এসে গেল। সবাই মাছ দেখতে লেগে গেল। কেউ নিশ্চয়ই মাছ কিনবে কিনা জানি না, তবে দেখতে তো অসুবিধে নেই। এইসব জার্নির মজাই আলাদা। সবাই যেন খুব ছেলেমানুষ হয়ে যায়। চায়ের দোকানের লোকটির মুখও বেশ খুশিখুশি। হাসছেন, কথা বলছেন আর চা দিয়ে চলেছেন। যা বিক্রি হবে আজ, অন্তত পঞ্চাশ কাপ তো বটেই! আজকের দিনটা দোকানদারের ভালোই যাবে।

মোটামুটি আধঘন্টা কাটালাম চায়ের দোকানে।  তারপর আবার বাসে চেপে ছুট।

ক্যানিং স্টেশন ছাড়ালাম। মাতলা নদী এসে গেল। অপূর্ব সুন্দর রাস্তা। এই জায়গাটা বেশ চওড়া। সম্ভবত আর আধঘন্টায় পৌঁছে যাব লঞ্চঘাটে।

সোনাখালি লঞ্চঘাট থেকে কিছুটা দূরে বেশ জনবহুল রাস্তায় যখন আমাদের গাড়ি এল, তখন সকাল ৯:৩৫। এবার কিছুটা হন্টন, কারণ, গাড়ি আর এগোলে জ্যামের মধ্যে পড়ে যাবে। ফলে গাড়িকে তখনকার মতো বিদায় জানালাম। ব্যবস্থা সেরকমই।  

লঞ্চঘাট এসে গেল। গাইড বাপ্পা এবং তার দু’একজন অ্যাসিসট্যান্ট প্রথমেই চেঁচিয়ে ঘোষণা করে দিল, “আপনাদের বড়ো লাগেজ একটা জায়গায় রেখে লঞ্চের কাছে চলে আসুন, লাগেজ আমরা নিয়ে আসব!” সেটাই করলাম আমরা। তারপর লঞ্চের কাছে চলে গেলাম।

কত যে লঞ্চ চারপাশে তার শেষ নেই। সবাই বেড়াতে এসেছে, উইকএন্ড বলে কথা! আমাদের লঞ্চের নাম ছিল ‘ইউরেকা’। একজন আবার মজা করে বলে উঠল, সেরকম কাউকে উদ্দেশ্য করে নয় – বলুন তো ‘ইউরেকা’ শব্দটা প্রথম কে বলেছিলেন এবং কোন অবস্থায় বলেছিলেন? আমরা কেউ কেউ হেসে উঠলাম। সবারই বয়স বেশ কিছুটা কমে গিয়েছিল মনে হয়।

ঘাট থেকে লঞ্চে ওঠার প্রচেষ্টা বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম। কেউ লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠে গেল, সেটা মূলত অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে। কিন্তু বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটা কমবেশি কসরতের ব্যাপার। যাই হোক, উঠে গেলাম সকলে। লঞ্চের গ্রাউন্ড ফ্লোরে বড়ো লাগেজগুলো ডাম্প করে রাখা হল। আমরা উঠে গেলাম ওপরে অর্থাৎ ফার্স্ট ফ্লোরে। লঞ্চের দুধারে টেবিল পাতা। প্রত্যেক টেবিলকে ঘিরে চারটে করে চেয়ার। আমরা যে যার পছন্দসই জায়গায় বসে গেলাম। 

একটু বাদেই লঞ্চ ছাড়ল। আশপাশে আরও কিছু লঞ্চ চলতে লাগল এক-এক করে। ব্রেকফাস্ট এসে গেল টেবিলে টেবিলে। লুচি, আলুরদম, মিষ্টি। আহা! ভারি পছন্দের খাবার। খাচ্ছি আর চারপাশে দেখছি… শুধু জল আর জল। উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা মাঝে মাঝে উন্মাদনায় পৌঁছে যাচ্ছে। একজন বলে উঠলেন, “মনে হচ্ছে, আর ফিরব না বাড়িতে। এইভাবেই ভেসে যাব।”

লুচি-আলুরদম কিছুটা মুখে দিয়ে হেসে বললাম, “কেন, কী হল আবার?”
উত্তর এল, “দূর, আমার তো কোনো পিছুটান নেই! কী হবে ফিরে!”
“তাই? আপনার বউ, ছেলেমেয়ে?”
“ওসবের বালাই নেই মশাই? ব্যচেলর?”
“না না, ডিভোর্স হয়ে গেছে দু’বছর হল।”

বুঝলাম, গল্প শুরু হল! মুক্তি চায় সকলে। পায় কি?

ভদ্রলোক বলে চললেন, “আমার মা এখন নার্সিংহোমে। অবশ্য ভালো আছেন এখন। দাদা আছেন কাছাকাছি, তবুও একটা চিন্তা, তাই না?”
“হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। তাহলে ফিরতে তো আপনাকে হবেই!”

ভদ্রলোক লুচির টুকরো মুখে দিয়ে হাসলেন।

লঞ্চ চলেছে। একটানা লঞ্চের আওয়াজ। মাঝে মাঝে নদীর পারটা কাছে চলে আসছে, আবার কখনো-বা দূরে সরে যাচ্ছে। হাওয়া বইছে জোরে। মাফলার জড়িয়ে আছি। তবে মাঝে মাঝে যখন গরম লাগছে, মাফলার খুলে রাখছি। সব টেবিলগুলোই ভর্তি চারজন করে। টেবিলগুলো হাসছে যেন। আমি সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, এখন তো প্রায় অন্তহীন চলা। একটু সার্ভে করে আসি। লঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। লঞ্চের দু’ধার দিয়েই বাইরেটা বেশ ভালো দেখা যায়। দুপাশেই নদীর পার এখন বেশ দূরে। তাই একইরকম দেখতে দু’পাশ। আমার ডানদিকের টেবিলে বসা বয়স্ক একজন ভদ্রলোক তার পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে বললেন, “ভালো করে চাদরটা জড়িয়ে নাও, ঠান্ডা লাগবে।”
ভদ্রমহিলা উত্তরে বললেন, “আমার গরম লাগছে, এখন চাদর লাগবে না!”
ভদ্রলোক একটু রাগত ভাবে চাপা স্বরে বললেন, “শেষে বাড়িতে ফিরে খ্যাক খ্যাক করে কাশলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না!”  
ভদ্রমহিলা বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেশ যাও, বলব না!”

আমি অন্য টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেমোরি গেম খেলা হচ্ছে সেখানে। অন্য টেবিল থেকে গান শুনতে পেলাম। আমি এগোতে থাকলাম সামনে। কিছুটা এগিয়ে আর টেবিল নেই। লঞ্চের দু’ধারে রাখা সারি সারি কয়েকটা চেয়ারে বসে আছেন পুরুষ এবং মহিলা যাত্রী। তারা কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলছেন না। শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন নিঃশব্দে। হয়তো প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলছেন মনে মনে। কেউ কেউ আবার চোখ বুজে আছেন।       

আমরা মাতলা নদী ধরে চলেছি। ফিরে এলাম আমার সিটে। কিছু ছবি তুললাম। একটু বাদেই আমুদি মাছভাজা এসে গেল। ঘড়িতে তখন পৌনে বারোটা। ব্রেকফাস্ট করেছি ঘণ্টা দেড়েক আগে। বাড়িতে থাকলে এইসময় কি আর খেতে হয়! কিন্তু এখন তো বেড়ানো, তাও আবার জলের ওপর দিয়ে ভ্রমণ। চলছে আড্ডা। তাই বাড়ির নিয়ম আগামী দু’দিন থাকছে না। আমুদি মাছভাজা কখনো খাইনি। বেশ কাঁটা লাগছিল, সাবধানে খেতে হয়। আমার উলটোদিকের ভদ্রলোক বেশ মেজাজে খাচ্ছেন দেখলাম। বললাম, “কাঁটা লাগছে না?”

বললেন, “হ্যাঁ, তা একটু লাগছে, তবে ভালো লাগছে।“  

দুপুর একটা নাগাদ গোসাবাতে আমাদের লঞ্চ ভিড়ল ঘাটে। আমাদের নামতে হবে। বাপ্পা বলে উঠল, “এবার আমরা নামব। হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো দেখতে যাব!”
একজন ভদ্রমহিলা বললেন, “সেটা কি কাছেই?”
বাপ্পা বলল, “না না, বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হবে।”
“ও বাবা! তাহলে আমি নামছি না!”
আরও দু’একজন বলল, “না না, আমিও নামছি না!”
বাপ্পা বলল, “যারা নামবেন, তারা চলে আসুন সামনে!”

ঘাটে লাগানো হল লঞ্চ। এবার ধাপে ধাপে কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে আমরা উৎসাহী পাবলিকরা উঠে গেলাম ওপরে। আরও কয়েকটা লঞ্চ সেই মুহূর্তে এসে গেছে। সেগুলোর থেকেও লোক নামছে। লোকে লোকারণ্য। সবাই হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো দেখতে যাবে। বাপ্পা এবং ওর সঙ্গীসাথীরা আমাদের আগে ওপরে উঠে চেঁচিয়ে বলল, “‘ইউরেকা’ লঞ্চের যাত্রীরা এখানে একপাশে দাঁড়ান, নাহলে হারিয়ে যাবেন!” আমরা সেখানে একধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছবি তুললাম।

লঞ্চ থেকে নেমে বাজারের মধ্য দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হয় হ্যামিলটন বাংলোতে পৌঁছতে। গুগল তথ্য অনুযায়ী ১৯০৩ সালে গোসাবায় প্রায় ৯০০০ একর জমি কেনেন স্কটল্যান্ডের স্যার ডানিয়েল হ্যামিলটন। সেখানে বিভিন্ন সমবায় সমিতি, ব্যাঙ্ক, চালকল, গ্রামীণ পুনর্গঠন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রায় এক কিলোমিটার ব্যবধানে দুটি বাংলো আছে – তার একটি ‘হ্যামিলটন বাংলো,’ অন্যটি ‘বেকন বাংলো!’ দুটি বাংলোই মাটি থেকে চার ফুট মতন উঁচুতে। মূল কাঠামো মায়ানমার থেকে আনা সেগুন কাঠের। 

হ্যামিলটন বাংলোর কাছে পৌঁছিয়ে বাংলোর আশপাশের পরিবেশ দেখে বেশ হতাশ হলাম। প্রচণ্ড ভিড়। মনে পড়ে, বেশ কিছু বছর আগে এসেছিলাম এখানে। তখন বেশ নিরিবিলি পরিবেশ ছিল। এইরকমই একটা শীতের দিনে… কিন্তু আজ যেন মেলা বসে গেছে চারপাশে। বাংলোর সামনেই একটা বিরাট পুকুর, দিঘিই বলা চলে। পুকুরের বাঁদিক ধরে বাংলোর কাছাকাছি যাওয়া যায়। আমি দূর থেকেই বাংলো দর্শন করলাম। কারণ, বাংলোর ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। শুধু শুধু কাছে গিয়ে কী করব! দূর থেকেই দেখলাম, বাংলোর সিঁড়ি বেয়ে লোকজন কিছুটা উঠছে ছবি তুলছে, আবার নেমে আসছে। এছাড়া রয়েছে একাধিক ডাব-বিক্রেতার সমাবেশ। ৪০-৫০ টাকায় ছোটোবড়ো ডাব বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। ভাবলাম, হ্যামিলটন সাহেব সেই কবে এসেছিলেন, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেই কবে, কিন্তু তাঁর দৌলতে এইসব গরীব মানুষেরা কিছু না হলেও ডাব বিক্রি করে তাদের জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে। চারপাশের মানুষদের দেখে মনে হচ্ছিল, তারা ডাব খেতেই এসেছে, সাহেবের বাংলো দেখতে আসেনি।

ওখান থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে আমরা ‘বেকন বাংলো’তে পৌঁছলাম। সবাই বলছিল রবীন্দ্রনাথের বাড়ি। ভাবলাম, এখানেও রবীন্দ্রনাথ! সেই কত বছর আগে! আসলে তা নয়। হ্যামিলটন সাহেবের আমন্ত্রণে ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ গোসাবায় এসেছিলেন এবং ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর এই বাংলোতে ছিলেন। বিরাট চত্বর জুড়ে জায়গাটা, পার্কের মতন। বাচ্চাদের খেলার জন্য দোলনা আছে। একপাশে রবীন্দ্রনাথের দাঁড়ানো অবস্থায় বিরাট মূর্তি। মাইকে রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে। পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে পার্কে ঢুকতে হয়। তবে বাংলোতে ঢোকা নিষিদ্ধ।     

এখানেও লোকের ভিড় লাগামছাড়া। শুধু তো আমরা নয়, অন্য লঞ্চের যাত্রীরাও এসেছে। পার্ক থেকে বেরিয়ে এবার লঞ্চের দিকে যাওয়া। গাইড বাপ্পা কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়েছিল। ও বোধহয় আর ভেতরে ঢোকেনি কিংবা ঢুকেছিল, ঠিক জানি না। আমাকে দেখে হাত নেড়ে বলল, “দাদা, এখানে অপেক্ষা করুন, আমাদের লোকেরা আসবে, তারপর একসঙ্গে যাব!” এখানেও ডাবের সমারোহ – ৪০-৫০ চলছে। বেশ গরম লাগছিল তখন। ডাব খেলাম একটা। বেশ তৃপ্তি পেলাম। .

সবাই একত্র হয়ে লঞ্চঘাটে চলে গেলাম তারপর। লঞ্চে উঠলাম সকলে। এখন আর প্রোগ্রাম নেই। সোজা ‘পাখিরালয়।’ সেখানেই আমাদের হোটেল ঠিক করা আছে।

পাখিরালয়ের ঘাটে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধে ছ’টা বোধহয়। অন্ধকারের মধ্যে লঞ্চ থেকে নামা। সে এক অভিজ্ঞতা বটে! আমাদের মধ্যে বেশ অনেকেই সিনিয়র সিটিজেন। বাপ্পা আর তার সঙ্গীরা লঞ্চ থেকে ঘাটে নামার সময় হেল্প করল। আমাদের বড়ো লাগেজগুলো ওরাই নামাল। তারপর আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল। আমার বাঁহাতে একটা সাইড ব্যাগ আর ক্যামেরা, ডানহাতে ভারী লাগেজ। সেই নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে লাগলাম। ঘাটের সিঁড়িগুলো অদ্ভুত। তিন ধাপ চওড়া সিঁড়ি ধরে উঠে, তারপর সমতলে কিছুটা হেঁটে গিয়ে আবার তিন ধাপের সিঁড়ি। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু যেটা বিপজ্জনক ছিল সেটা হচ্ছে, সিঁড়িগুলোর দু’ধারে কোনো রেলিং নেই। বছর তিরিশেক আগে কিংবা তারও বেশি, ঘাটের চেহারা যা ছিল আজও তেমনটাই আছে। অথচ কত বছর ধরে টুরিস্টরা যাতায়াত করছে এখানে। ডাইনে বা বাঁয়ে টাল খেয়ে সাইড দিয়ে পড়ে গেলে পনেরো-বিশ ফুট নীচে। মৃত্যু না হলেও হাড়গোড় ভেঙে একেবারে দফারফা হয়ে যেতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের হাতে ভারী লাগেজ। সত্তরের কাছাকাছি কিংবা সত্তরের ওপর মানুষের সংখ্যা অনেক। অনেকক্ষণ লঞ্চে বসে থাকার পর হঠাৎ অন্ধকারে এমন অবস্থার মুখোমুখি হওয়াটা বেশ রিস্কি। তাও আবার লটবহর নিয়ে।

বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ওপরে উঠলাম কোনোরকমে। তারপর একটা মেঠো জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম, একটা জংশন মতন, যেখান থেকে ডাইনে-বাঁয়ে দু’দিকে খুব বেশি হলে আড়াই থেকে তিন ফুট চওড়া মেঠো রাস্তা চলে গিয়েছে। এবড়োখেবড়ো। রাস্তাটির দু’পাশে খাদের মতো নীচে নেমে গেছে। চলতে গিয়ে একটু বেসামাল হলে যে কোনও দিকে পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাতে মৃত্যু নয়, তবে ভালোরকম দুর্ঘটনা ঘটাও বিচিত্র নয়।  

আমরা কোনদিকে যাব বুঝতে পারছিলাম না। কেউ বলছে বাঁদিকে, কেউ ডানদিকে। গাইডদের তখন আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না। হাতে ভারী লাগেজ। সেটা রেখে দিলাম মাটিতেই। তারপর সেই অল্প আলোর মধ্যেই গাইডদের মধ্য থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, “বাঁদিকে চলুন!” তখন সবাই বাঁদিকের পথ ধরলাম। কিছুটা হেঁটেই দেখলাম একটা মেঠো ঢালু রাস্তা নেমে গিয়েছে। জিনিসপত্র নিয়ে বেশ ব্যালান্স করেই নামতে হল। সকলেই বিরক্ত। তার পরেও প্রায় মিনিট দশেক হেঁটে হোটেলে পৌঁছলাম। রিসেপশন কাউন্টারের সামনে অনেকগুলো চেয়ার পাতা ছিল। লাগেজগুলো মেঝেতে রেখে আমরা চেয়ারগুলোতে ধপ করে বসে পড়লাম ক্লান্ত শরীরে। কিছুক্ষণ বাদেই নজরে এল, বাপ্পা রিসেপশন কাউন্টারের ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছে। অর্থাৎ কে কোন ঘরে যাবে, সেটা ঠিক হতে চলেছে।

মিনিট দশ-পনেরো বাদেই নাম ধরে রোলকলের মতো ডাক এল, সেই সঙ্গে রুম নম্বর বলে দেওয়া হল। ঘরের চাবি হাতে নিয়ে আমরা সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগলাম।

মোটামুটি দশ বাই দশ ঘরের সাইজ। ফারনিশড। অ্যাটাচড বাথরুম। ফ্রিজ গিজার সব আছে। জিনিসপত্র ঘরের একপাশে রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। অনেক সকালে বেরোতে হয়েছিল, স্নান করে যাইনি, এই সুযোগে স্নানপর্ব সেরে নিলাম। কিছুক্ষণ বাদে ফোনে ডাক এল, নীচে নাচ-গান হচ্ছে, সুতরাং…

গিয়ে দেখলাম, অনুষ্ঠান চলছে… কাছাকাছি গ্রামের স্থানীয় সাত-আট জনের একটি ছেলেমেয়ের দল এসেছে, তারাই পারফর্ম করছে। একজনই গায়ক, বাকিরা নাচছে। প্রায় আট-দশটা গান হল, সেইসঙ্গে নাচ। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, প্রতিটি গানেরই দু-তিন লাইন গাওয়া হচ্ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একাধিক বার। গান এবং নাচের স্থায়িত্ব খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট। এটাই বোধহয় রেওয়াজ এরকম পরিস্থিতিতে। আমাদের অনেকেই ভিডিও রেকর্ডিং করল সেই নাচের। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের বয়স্কদের মধ্যে অনেকেই তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচল। বেড়াতে এলে সবাই বোধহয় শিশু হয়ে যায়। অনুষ্ঠান চলল প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের মতো। আমাদের তরফ থেকে বকশিস দিল প্রায় সবাই। এটাই ওদের একটা ভালো ইনকাম। ডিনার সারা হল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ।

সকালে ঘুম ভাঙল চারটে নাগাদ। একটু এপাশ ওপাশ করে পাঁচটা নাগাদ উঠে পড়লাম।‌ গিজার চলছে না, অথচ লাইট জ্বলছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, পাওয়ার নেই… ইনভার্টার, ফলে নো গিজার। স্নান হল না। ক্ষতি নেই। কোথাও সাত সকালে বেরোতে হলে, বিশেষত শীতকালে, স্নান না করে বেরোনোটা আমি অভ্যেস করে নিয়েছি। বরং ফিরে এসে ধীরে-সুস্থে স্নান করা যায়। 

সকাল আটটায় বেরোনোর কথা ছিল, কিন্তু বেরোনো হল সাড়ে আটটারও পরে। বেশ কিছুটা হেঁটে লঞ্চে পৌঁছলাম, তবে এবার অন্য পথ দিয়ে। গতকাল সন্ধেবেলা যে-পথ দিয়ে লঞ্চ থেকে হোটেলে এসেছিলাম, তুলনায় তার থেকে এটা অনেক ভালো। কেন যে এই পথ দিয়ে আসা হল না গতকাল, সেটা বুঝলাম না। বোধহয় জানা ছিল না। যাই হোক, লঞ্চে যখন পৌঁছলাম, তখন ন’টা বাজে। কয়েকজন তখনো এসে পৌঁছয়নি।

মোটামুটি ন’টা কুড়ি নাগাদ লঞ্চ ছাড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই ব্রেকফাস্ট দেওয়া হল। লুচি-আলুরদম, সেইসঙ্গে মিষ্টি। এটা বোধহয় পেটেন্ট, এরকম ধরনের বেড়ানোতে টিফিন মানেই লুচি-আলুরদম। বাইরের জল আর জঙ্গল দেখতে দেখতে খাওয়া। সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য ব্যাপার। একটু বাদেই আমাদের লঞ্চের পাশে অন্য একটা লঞ্চ এসে গেল, ওরাও যাচ্ছে। ওটাতে হিন্দি-ভাষী কিছু লোকের সঙ্গে আমাদের লঞ্চের কিছু লোকের কথাবার্তা হাতনাড়া চলল। সবারই মুখে হাসি। এইভাবেই তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাইরে এসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সংগ্রহ করি।

আমাদের আজকের প্রোগ্রাম ছিল সজনেখালি, সুধন্যখালি আর দোবাংকি দর্শন। কিন্তু ভুল ভাঙল যখন প্রায় এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত। খেয়াল করলাম, আমাদের লঞ্চটা চলেছে তো চলেছেই। লঞ্চের প্রত্যেকটা টেবিলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, আমরা কোথায় চলেছি! এখনও কি আমাদের আকাঙ্ক্ষিত জায়গাগুলো আসেনি? বা আর কতক্ষণ বাদে আসবে? লঞ্চ তো চলেছে! ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল গাইডদের মধ্যে যারা ছিলেন। একসময় বাপ্পা এসে আমাদের খবর দিল, “আমরা আগামীকালের প্রোগ্রামটা আজকে করতে বাধ্য হলাম!”
সমস্বরে বলে উঠলাম, “কেন?”

বাপ্পার কথাতে জানা গেল, আজকের জায়গাগুলোতে অসম্ভব ভিড়ের কারণে টিকিট পাওয়া গেল না।  ফলে সেটা আগামীকাল করা হবে। জানা গেল, এখন আমাদের লঞ্চ ঝড়খালির দিকে যাচ্ছে।

প্রায় একটা নাগাদ ঝড়খালি ফেরিঘাট-এ পৌঁছলাম। ঝড়খালির মূল আকর্ষণ ‘বাঘ উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।’ জঙ্গলে সংঘর্ষের কারণে কিংবা লোকালয়ে মানুষের আক্রমণে কোনো বাঘ যদি আহত হয়, তাকে উদ্ধার করে এই কেন্দ্রে রাখা হয়। তাদের শুশ্রূষা চলে এবং সুস্থ হয়ে গেলে তাদের আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ফেরিঘাটে নেমে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। দু’পাশে কিছু স্থানীয় দোকান নজরে এল। সেখানে মধু এবং নানারকম দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যায়। সেসব ছাড়িয়ে আমরা লোহার ব্যারিকেড দেওয়া বিরাট এক ঘেরা জায়গায় সামনে চলে এলাম। সেটাকে বাঁদিকে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদেই দেখতে পেলাম আমাদের দলের কিছু লোক ‘বাঘ’ ‘বাঘ’ বলে হুড়মুড়িয়ে ছুটে গেল লোহার বেড়াটার সামনে। ওদেরকে অনুসরণ করলাম। লোহার ব্যারিকেডের সামনে কিছু জংলা জায়গা। সেটা ছাড়িয়ে লম্বা সরু জলাশয় চলে গিয়েছে আড়াআড়ি ভাবে। জলাশয়ের ওপারে একটা বিরাট খাঁচা। খাঁচার মধ্যে বিস্তৃত খোলা জায়গায় একটা বাঘ ধীরে সুস্থে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখা গেল। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলে কথা! আমাদের থেকে তিরিশ-চল্লিশ মিটার দূরে তিনি আছেন। কয়েকটা ছবি নিলাম। সত্যি বলতে কী, তেমন মন ভরল না। প্রথমত তিনি খাঁচার মধ্যে, তার ওপর জেনেই তো গেছি, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ নন। এমন বাঘ দেখে মন ভরে কি! অন্তত আমার তেমন মন ভরল না। পরপর আরও দুটো খাঁচায় দেখলাম দুটো বাঘ। খাঁচার বাইরে জলাশয়ের পাশে দুটো কুমির দৃশ্যমান হল।  এইভাবে ওই ঘেরা জায়গাটা পুরো এক চক্কর মারলাম। তারপর আমাদের কিছু ছবি তুলে দিল বাপ্পা।

এল আমাদের ঘোরাঘুরির শেষ দিন। তিনটে জায়গার যাওয়ার কথা। সজনেখালি, সুধন্যখালি, আর দোবাংকি। আজও ওই একই রুটিন ছিল। সকাল সকাল বেরোনোর কথা, কিন্তু বেরোতে বেরোতে প্রায় ন’টা হয়ে গেল। তবে একটা সুবিধা ছিল বেরোনোর সময় – হোটেল থেকে লঞ্চ পর্যন্ত হেঁটে যেতে আমাদের লাগেজগুলো নিজেদের নিয়ে যেতে হয়নি, আলাদা ভ্যানের ব্যবস্থা ছিল। হোটেল ছেড়ে যাচ্ছি আজই, কিছু ছবি তোলা হল হোটেলের সামনের লনে। তারপর হেঁটে সোজা লঞ্চ। ব্রেকফাস্ট লঞ্চেই সারা হল।

প্রথম ভিজিট হল সজনেখালি। ওরে বাপরে বাপ! লোকের ভিড় কাকে বলে! গতকাল নাকি সাংঘাতিক ভিড়ের কারণে আমাদের বুকিং হয়নি, কিন্তু আজকের ভিড়ও তো সাংঘাতিক। কত কত গ্রুপ এসেছে তার সীমা-পরিসীমা নেই। আমাদের গ্রুপের লোকেরা একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। গাইড বাপ্পা আমাদের সকলের জন্য কাউন্টার থেকে পারমিট করিয়ে আনল, যেটা না হলে ভেতরে ঢোকা যাবে না। প্রায় মিনিট পনেরো হয়ে গেল পারমিট জোগাড় করতে। তারপর ঢুকে গেলাম জঙ্গলে। জঙ্গল বলতে আমরা খাঁচার মধ্যে, কংক্রিটের রাস্তা ধরে সকলে এগিয়ে চললাম। আমাদের চলার পথের দু’পাশে মোটা জাল লাগানো। জালের বাইরে জঙ্গল। জালের ফাঁক দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা। তেমন কিছু নজরে এল না। এত ভিড়ের মধ্যে সত্যিই কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখনকার সজনেখালি আর আজকের সজনেখালির মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। তখন পরিবেশটাই ছিল নিঝুম, চুপচাপ। এখন এটা একটা পপুলার বেড়ানোর জায়গা হয়ে গেছে।

ওয়াচ টাওয়ার এসে গেল কিছুক্ষণ বাদেই। উঠলাম ঘোরানো সিঁড়ি ধরে। ওয়াচ টাওরারের দেওয়ালের একটা খাঁজে বিরাট এক মৌমাছির চাক নজরে এল। ছবি নিলাম। বাইরের জঙ্গল দেখলাম। কিন্তু মানুষের হইচই যেন জঙ্গলের নিস্তব্ধ পরিবেশকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছিল। ফলে বেশিক্ষণ ওয়াচ টাওয়ারে থাকলাম না। নেমে এলাম।

সজনেখালি থেকে সুধন্যখালি যাওয়া এবার। কিন্তু গাইডরা খুব একটা উৎসাহ দেখাল না সুধন্যখালি যাওয়ার ব্যাপারে। ফলে আমাদের লঞ্চ সোজা চলে গেল দোবাংকি ফেরিঘাটের দিকে। পথে অপূর্ব সব প্রাকৃতিক দৃশ্য নজরে এলাম। ছবি নিলাম কিছু।  

দোবাংকি ক্যাম্পের ঘাটের কাছাকাছি আমাদের লঞ্চ যখন এল তখন গিজগিজ করছে আরও কয়েকটা লঞ্চ। ঘাটের যে জায়গায় লঞ্চটা পৌছলে ঘাটে নামতে সুবিধা হয়, সেই জায়গায় আরও দু’তিনটে লঞ্চ ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো দিয়ে লোক নামতে শুরু করেছে। ফলে আমাদের লঞ্চটা ওই লঞ্চগুলোর পেছনে পড়ে গেছে। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার থাকল না।

প্রায় মিনিট কুড়ি বাদে আমরা ঘাটে নামতে পারলাম। ঘাটে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি নিলাম। আমাদের লঞ্চের লোকেরা এক জায়গায় জড়ো হতে কিছু সময় লাগল। তারপর ঘাটের সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠলাম। এবার দীর্ঘ কংক্রিটের সমতল রাস্তা ধরে হেঁটে চলা। আমাদের চলার পথের দুটো ধার মোটা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। অর্থাৎ যথেষ্ট সুরক্ষিত। জালের বাইরে দুপাশেই বাইরে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম ওখানে। ছবিও তুললাম। দূরে বেশ কিছু পাখি নজরে এল। আর, সম্ভবত বন্য শুয়োর। এছাড়া তেমন কিছু নজরে এল না। সত্যি বলতে কি, গোটা সুন্দরবন হচ্ছে জল আর জঙ্গলের অপূর্ব মিশ্রণ। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই ছাপিয়ে যায় সবকিছুকে। জন্তু জানোয়ার বিশেষ করে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেখা পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। এই ধারণা নিয়ে সুন্দরবন এলে তবেই সুন্দরবন উপভোগ্য হবে। তবে আরও কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে যাওয়া যেতে পারত, কিন্তু দু’দিনের জার্নিতে এর বেশি কিছু করা যায় না।

এরপর আমাদের ফেরার পালা বাড়ির দিকে। সেই অন্তহীন জল আর জঙ্গল ছুঁয়ে লঞ্চের এগিয়ে চলা। দেখলাম, কারোর তেমন আর উৎসাহ নেই। লঞ্চের ডেকে এলোমেলোভাবে চেয়ারে বসে এলিয়ে পড়েছে সবাই। কেউ কারোর সঙ্গে তেমন আর কথা বলছে না। দিনের আলো কমে আসছে ক্রমশ। কয়েকটা নীল আলো জলে উঠল হঠাৎ। কেমন যেন মায়াবী মনে হল সবকিছু। এই দু’দিন কত হইচই করেছি, খাওয়াদাওয়া করেছি, ছবি তুলেছি প্রাণভরে, কত উৎসাহ, আর এখন… সত্যিই, এই তো  জীবন… কখনও দপ করে জ্বলে ওঠে কিছু সময়ের জন্য, আবার কালের নিয়মে কেমন যেন সবকিছু থিতিয়ে যায়! একটা সময় আবার তেড়েফুঁড়ে উঠি, বলি, ‘অনেক হয়েছে, এবার জেগে ওঠো ভাই।’ এইভাবেই জোয়ারভাটার মতন কেটে যায় আমাদের গোটা জীবনটা।

———-

ছবিঃ লেখক                           

৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইয়ের রিভিউ। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। এছাড়া খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *