বর্ষাভেজা নির্জন ঋষি

জঙ্গলের ভিতর থেকে যে সোঁদাগন্ধ আসছিল তার সঙ্গে গ্রাম বাংলার সোঁদাগন্ধের কোনও মিল নেই। এ অনেক বেশি বুনো। অন্ধকার পথ স্যাঁতস্যাঁতে। খানিক আগেই যে চার পায়ে হেঁটে গিয়েছে তার গায়ের ঘ্রাণ স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। পথ নামছে ৪৫ ডিগ্রিতে। কোলাখামে এবার যে হোমস্টেতে এসে উঠেছি, তার গা বেয়েই পথ চলেছে গন্তব্যের দিকে। যদিও প্রায় সকাল এগারোটা তবু সূর্যের উপস্থিতি মোটে উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। ছাঙ্গে ওয়াটার ফলস্ থেকে ফিরে আলুর পরোটা, দই, আচার খেয়ে সবে জল খাচ্ছি, হোটেলের ম্যানেজার সদা হাস্যমুখ মানুষটি বললেন, “ম্যাডাম বারিশ আসার আগেই বেরিয়ে পড়ুন। তাহলে দোপহরের ভিতর পৌঁছে যাবেন।”
ওর কথা শুনে ছাঙ্গে ফলস্ হাইকিং আমাদের চূড়ান্ত সফল হয়েছে। কফি খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম ফলে সম্পূর্ণ নির্জন ছাঙ্গে ফলসে আমরা তিনজন ও আমাদের সঙ্গী দুই সারমেয় ছাড়া কেউ ছিল না। এক কিলোমিটার নির্জন পাহাড়ি পথে হেঁটে চলেছি তিনজন হঠাৎ পীযূষ আমাদের থামতে বলল, চোখ বাঁ দিকের পাহাড়ের গায়ে। ঘন সবুজ রঙা বিশাল সাপ হেলেদুলে ঢুকে যাচ্ছে জঙ্গলে। সারা শরীর শিরশির করে উঠল। ফিরে এসে শুনেছিলাম খুবই বিষাক্ত ওই সবুজ সাপ। আরও কিছু দূর যাবার পর দেখা হল এক পাহাড়ি ঝোরার সঙ্গে। বিপুল তার বিস্তার। ভারি সুন্দর সে স্থান। কেউ কোথাও নেই আমরা তিনজন সবুজ বনের মাঝে ছড়িয়ে থাকা পাথরের আঁচলে খুঁজে পেলাম জীবনের উৎস। আরও একটু এগিয়ে পথ সরু হয়ে নেমে গেল নীচে। টিকিট কাটার জায়গা থাকলেও অত সকালে কেউ আসেনি। আমরা নামতে শুরু করলাম। সুন্দর পথ। বাঁদিকে বাঁশ দিয়ে রেলিং মতো করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রায় নশো মিটার নীচে নামার পর তার সঙ্গে দেখা হল। পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছাঙ্গে। ওর রূপ দেখে পাগল হওয়া অনিবার্য। এরপর দীর্ঘ সময় আমরা তিনজন মেতে উঠেছিলাম ওর সঙ্গেই। কুসুমরঙা সকালে যে অবর্ণনীয় আনন্দ পেয়েছি তা আমাদের হোমস্টের ম্যানেজারে জন্যেই। তাই এক্ষেত্রেও ওর কথাকে প্রাধান্য দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঋষির সাক্ষাৎ পাবার আশায়। সঙ্গে জল, ছাতা, শুকনো কিছু খাবার, কাজু, কিসমিস, ও বিস্কুট।
পথ খুবই সংকীর্ণ। বাঁ দিকে পাথুরে মাটির জগঝম্প দেওয়াল কুঁদে থাকার জায়গা করে নিয়েছে বন্য কেউ। ডানদিকে নীচু জমি জঙ্গলাকীর্ণ। বাঁধানো পথের ফাটলে স্ট্রবেরি গাছ, লতানো আরও কিছু গাছ। বেশ খানিকক্ষণ চলার পর হঠাৎ বাঁদিকে চাষের জমি দেখা দিল। জমিতে কর্মরত গামবুট পরা পুরুষ। জোঁক এ অঞ্চলে প্রচুর তাই সকলেই বড়ো বড়ো গামবুট পরে চলাফেরা করে। রাস্তা সামান্য ডাইনে মোচড় খেতেই থমকে দাঁড়ালাম আমরা। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। পরপর ধাপে ধাপে বাড়িগুলি নেমে গিয়েছে। শেষতম বাড়িটির গেটে বড়ো বোগেনভেলিয়া গোলাপি রঙের সমারোহ নিয়ে স্বাগত জানাল আমাদের। গত এক সপ্তাহ কোলাখামে সূর্য ওঠেনি। ফলে স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তা। কালচে পথে হলুদ, গোলাপি ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে। মনে হল আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন গ্রামদেবতা। অল্প কিছু মানুষজন কৌতূহলী হয়ে আমাদের দেখছেন। সুদৃশ্য বোগেনভেলিয়া যাঁর দরজায়, তিনি এগিয়ে এলেন, আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বাড়িতে বসে এক কাপ চা খাবার জন্য। কথা দিলাম ফেরার পথে নিশ্চয়ই আসব। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পাহাড় থেকে বয়ে আসা জলকে পাইপের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়েছে। অপূর্ব সে ব্যবস্থা। এমনকি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলটিও বর্তমান। আমরা আরও সরু পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। গরম বাড়ছে যত নীচে নামছি কিন্তু আকাশ মেঘলা।
এবার জঙ্গল ঘন হয়ে এল, পথ আরও সংকীর্ণ। যদিও বুঝলাম এপথে মানুষের নিয়মিত যাতায়াত আছে। মানুষ তার চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে রেখেছে। বামপাশে আবারও চাষের জমি। মূলত শাক, বিনস, বাঁধাকপি, ও ভুট্টা। কোথাও কোথাও আলুও রয়েছে। একটি ম্যাগনোলিয়া গাছের তলায় আমরা বিশ্রামের জন্য বসলাম। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট হাঁটছি। জল, কাজুবাদাম ও ডেয়ারি মিল্ক চকোলেট অল্প করে তিনজনেই খেলাম। তবে আকাশের অবস্থা ভালো নয়, তাই এগোনই শ্রেয়।

দশ মিনিট পরেই রাস্তা শেষ হয়ে গেল অথচ ঋষির দেখা নেই। ছোটো বড়ো পাথরের বিস্তৃত ভূমি জঙ্গলের ভিতর। অন্ধকারাচ্ছন্ন রহস্যময়। আমার মন চাইছে না আর যাই। কিন্তু তবু রহস্যের হাতছানি এড়িয়ে যেতে পারলাম না। পাথরে পা দিয়ে নেমে পড়লাম ধীরে ধীরে। একটি সরু ধারা বয়ে চলেছে ঝরঝর করে। জঙ্গলের ঘন সবুজ রং, তার মাঝে পাথরের সমারোহ এক আশ্চর্য জগৎ তৈরি করেছে। আমরা ধারার কাছাকাছি আসতেই ডানদিকে বিস্তৃত নদীখাত দেখতে পেলাম। এগিয়ে যেতেই হতবাক। সাদা পাথরের সমারোহ। যতদূর চোখ যায় শুধু পাথর আর পাথর। মাঝখানে নীলচে বর্ণের ঋষি। তার স্বচ্ছ জল তবু বড্ড রিক্ত নদীখাত। নির্মোহ হয়ে বয়ে চলেছে ঋষি।
ঋষিখোলা নদী। আমরা তিনজন প্রায় শূন্য নদীখাতের ভিতর দাঁড়িয়ে। অপর পাড়ে পাথুরে জমি ধীরে ধীরে আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গলাকীর্ণ সেই পাড়ে কে যে আড়াল থেকে আমাদের দেখছে কে জানে। আকাশ কালো হয়ে এল। ধ্যানস্থ সে মৌন সাদা পাথরের গায়ে মৃত গাছেদের কঙ্কাল। যে কোনও মুহূর্তে বিপুল জলরাশি যেন ধেয়ে আসবে। রহস্যে মোড়া ঋষিখোলা ছেড়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে লাগলাম। ফেরার পথে রাস্তা দ্রুত শেষ হয়ে আসে। কিন্তু অজানা মানুষ যখন অপেক্ষায় থাকে তখন মনে হয়, ভালোবাসি আমি এই পৃথিবী, ভালোবাসি।
বয়স্ক মানুষটি সাদর আপ্যায়ন করলেন। তাঁর হোমস্টের ঘাসের বাগানে টেবিল চেয়ারে বসলাম। আমি চায়ের স্বাদ বুঝি না কিন্তু গন্ধ বুঝি। অপূর্ব সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। সঙ্গে ছিল বাড়িতে তৈরি বিস্কুট। আমি একটা বিস্কুট খেলাম আর গল্প শুনলাম। বহু বছর আগে কোলাখামে বাস করতেন কেবল সাধু সন্ন্যাসীর মতো কিছু মানুষ। তাঁরা ছিলেন নিরামিষভোজী। ধীরে ধীরে সাধারণ গৃহী মানুষ বসবাস শুরু করলেও তাঁরা মাছ, মাংস খেতেন না। বহু বছর পর যখন কোলাখাম ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে উন্মোচিত হল, আনাগোনা বাড়ল টুরিস্টের। তখন মাছ, মাংস একটু একটু করে জায়গা করে নিল। চাহিদা বাড়লেও আজও কোলাখামে পাঁঠার মাংস প্রায় পাওয়া যায় না বললেই হয়। মানুষটি খুব ধীরে ধীরে বললেন, “এই পথ সহজ নয় তাই টুরিস্ট খুব কম। অথচ আমাদের গ্রাম কি কম সুন্দর বলুন?”
উত্তর দিতে পারিনি। সত্যিই তো কী ভীষণ সুন্দর নির্জন এই গ্রাম। ওঁর বাগানের ঘাসে বসে যতদূর চোখ যায় সবুজ জঙ্গল আর পাহাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। ডেকে চলেছে পাখি। আর রয়েছে ফুল।
একটা সময় উঠতে বাধ্য হলাম। এবার ঝমঝমিয়ে নামবে বোধহয়। কিন্তু দ্রুত উপরে উঠতে মন চাইছিল না। ফিরতে চাইলেই কি আর ফিরতে পারব এখানে? মনটা বিষণ্ণ হয়ে আসছিল। হোমস্টেতে ঢুকতে ঢুকতে বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। ঘরে বসে গরম গরম খিচুড়ি, ডিমের অমলেট, আলুভাজা খেতে খেতে কাঁচের জানলা দিয়ে জলছাপের মতো পাহাড় দেখলাম। বৃষ্টি ধরে এলে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় ম্যানেজার বাবু যোগ দিলেন। বললেন, “ম্যাডাম আগে যদি বলতেন তাহলে বড়োভাইয়ের ওখানে লোকাল খাবার দিয়ে লাঞ্চ এ্যারেঞ্জ করতাম, দারুণ অভিজ্ঞতা হত!”
আমি তো অবাক, সে কী! এমন হয় জানলে আমি নিশ্চয়ই সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতাম। যাই হোক এবারে সেই অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলেও পরেরবার নিশ্চিত রূপে সেই অভিজ্ঞতা হবে। চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম ঋষিখোলা নদীর কথা। সে নিশ্চই এখনও মৌন হয়েই বয়ে চলেছে ওই সাদা পাথুরে জমি ছুঁয়ে।
———
কী ভাবে যাবেন: ভারতবর্ষের যেকোনও স্হান থেকে চলে আসা যায় রেল, সড়ক, বা বিমানপথে NJP. সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে আসুন কোলাখাম। 3500/4000 টাকা ভাড়া পড়বে।
কোথায় থাকবেন: আমরা ছিলাম দা হিমালয়ান রিট্রিটে। এর অবস্থান ভালো। দুটো হাইকিং এখান থেকে খুব সহজেই করা যায়। ছাঙ্গে ওয়াটার ফলস্ আর ঋষিখোলা নদী। ভাড়া সিজন অনুযায়ী পরিবর্তন হয়। এছাড়া আপার কোলাখামে বহু হোটেল, হোমস্টে রয়েছে।
দর্শনীয় স্হান: কোলাখাম থেকে আপনি সহজেই দেখে নিতে পারবেন, লাভা, রিশপ, কালিম্পং।
———-
ছবিঃ লেখক
6 Comments