৪৮ নম্বর ডাউটি স্ট্রিট: চার্লস ডিকেন্স-এর বাড়ি
“It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness …”, ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত এক কালজয়ী উপন্যাস “A Tale of Two Cities” উপন্যাসের দুই শহরের একটাতে, অর্থাৎ লন্ডনে, ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে বেড়াতে যাওয়ার সময় এই বাড়িটা দেখবার বাসনা মাথাতে ছিল। সেই সফরকালে একদিন সকালে বেরিয়ে রাস্তায় কিঞ্চিৎ ঘুরপাক খেয়ে খুঁজে নেওয়া গেল সেই বাড়িটা। তাই নিয়েই বলি আজকের দু’চার কথা।
সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য লন্ডনের এই বাড়িটা এক দর্শনীয় গন্তব্য। চার্লস ডিকেন্স (Charles Dickens)-এর একসময়ের আবাসস্থল, যা এখন একটি জাদুঘর – লেখকের জীবনকালে তিনি যে অনেক বাড়িতে থেকেছেন, তার মধ্যে সম্ভবত আজও এটা একমাত্র বাড়ি যা টিঁকে আছে। এই বাড়ি তাঁর জীবন এবং সাহিত্যকর্মের এক আকর্ষণীয় কেন্দ্র। ১৯২৫ সালের জুন মাসে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এই সংগ্রহশালা একটা দাতব্য ট্রাস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডিকেন্স-এর জীবন এবং কাজের কিছু ঝলক দেখবার জন্য এটি এখনও সেরা জায়গা। বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াবার সময়, গাইড আমাদের প্রতিটি ঘরে নিয়ে যান এবং ভেতরের প্রদর্শনী সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন।
ডিকেন্স ১৮৩৭ সালে, তাঁর বয়স তখন বছর-পঁচিশ, এই বাড়িতে চলে আসেন। ভাড়া-নেওয়া এই বাড়িতে, তিনি মাত্র তিন বছর বাস করেছিলেন। তখনও তিনি তেমন কিছু খ্যাতিলাভ করেননি, লিখতেন ‘বোজ’ (Boz) ছদ্মনামে। তবে তাঁর সেরা কিছু রচনা যেমন “দ্য পিকউইক পেপারস”(The Pickwick Papers), “অলিভার টুইস্ট” (Oliver Twist), “নিকোলাস নিকোলবি” (Nicholas Nickleby) এবং আরো কয়েকটি ছোট ছোট রচনা এখানে থাকবার সময়েই লেখা।

ডাউটি স্ট্রিট (Doughty Street) ছিল বেশ ভদ্রসভ্য এলাকা, কিন্তু সেই সময়ে কাছাকাছি পাড়াগুলোর বস্তি-এলাকায় দরিদ্র মানুষজন এবং কিছু অপরাধীদের বাস ছিল। পার্শ্ববর্তী স্যাফ্রন হিল (Saffron Hill) অঞ্চলের আদলেই তিনি “অলিভার টুইস্ট”-এর ফ্যাগিনের ডেরা (Fagin’s Den)গড়ে তোলেন। শহরতলির এই নিকাশিব্যবস্থাবিহীন, জলকাদায় মাখামাখি দুর্গন্ধময় পাথুরে রাস্তা, ঘোড়ার গাড়ির চাকার কর্কশ শব্দ, ঘোড়ার চিঁহি-চিঁহি ডাক – এইসব মিলিয়ে তৈরি এক বিশৃঙ্খল আবহ ফুটে ওঠে তাঁর এইসময়কার উপন্যাসগুলোতে।
ডিকেন্স এই বাড়িতে বাস করা শুরু করেন যে বছর মহারাণী ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেই বছরই ৬ই জানুয়ারি ১৮৩৭ তাঁর প্রথম পুত্র চার্লস জুনিয়র (Charles Junior) জন্ম নেয়। স্ত্রী ক্যাথরিন (Catherine) ও সদ্যোজাত পুত্র এবং ক্যাথরিন-এর বোন মেরি হোগার্থ (Mary Hogarth) এঁদের সঙ্গে ডিকেন্স এই বাড়িতে চলে আসেন। তাঁর আগের বাড়ির তুলনায় এই বাড়িটা বেশ বড়সড় ছিল, তাঁর শৌখিন, আড়ম্বরপূর্ণ ও ফ্যাশনদুরস্ত রুচির প্রতিফলন বলা যায়। কিছু ঘর তিনি পুনর্নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং অনেক আসবাবপত্র ও কার্পেট কিনেছিলেন যা এখনও সেখানে সযত্নে রাখা আছে।
তিনতলা এই বাড়িটা তাঁর সময়ে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। নিচের তলায় হলঘর ও ডাইনিং রুম রয়েছে যেখানে ক্যাথরিন ডিনার পার্টির আয়োজন করতেন। আর আছে পূর্বমুখী এক মর্নিং রুম যেখানে সূর্যের প্রথম রশ্মি প্রবেশ করত।

যে বেসমেন্টে গৃহস্থালির বেশিরভাগ কাজ করা হ’ত সেখানে রান্নাঘর, ওয়াইন সেলার এবং ওয়াশ হাউস রয়েছে। এই ঘরগুলোর দৈনন্দিন কার্যকলাপের আদল প্রায়শই তাঁর উপন্যাসগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – ওয়াশ হাউসে ছিল তামার এক বড়সড় গামলা, যা কাপড় ধোয়া ও জল গরম করবার কাজে লাগত, আর বছরে একবার এটা পুডিং ভাপানোর জন্য ব্যবহৃত হ’ত – “আ ক্রিস্টমাস ক্যারল” (A Christmas Carol) উপন্যাসে এমন একটা দৃশ্যের বর্ণনা রয়েছে যেখানে মিসেস ক্র্যাচিট (Mrs. Cratchit) পরিবারের জন্য ক্রিসমাস পুডিং নিয়ে ওয়াশ হাউস থেকে বেরিয়ে আসছেন।

দোতলায় ড্রয়িং রুম এবং তাঁর স্টাডি রুম রয়েছে। স্টাডি রুমের বেশিরভাগ বইই তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংস্করণ, যার মধ্যে আছে প্রথম সংস্করণ ও বিদেশী অনুবাদ, আর রয়েছে নানা পত্রপত্রিকা যেখানে তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে তাঁর পাণ্ডুলিপির সম্পূর্ণ সংগ্রহ, হাতে-লেখা উপন্যাসের খসড়াগুলো এবং তাঁর সমস্ত প্রকাশিত রচনাও রয়েছে।


তিনতলায় তাঁর প্রিয় শ্যালিকা মেরি-র শোওয়ার ঘর ছিল। দুর্ভাগ্যবশত পরিবারটি এই বাড়িতে আসবার কয়েক সপ্তাহ পরেই ১৮৩৭ সালের মে মাসে মেরির আকস্মিক মৃত্যু হয়। এটা এক বড় ধাক্কা ছিল ডিকেন্স ও ক্যাথরিনের। মাস্টার বেডরুমের পাশেই ডিকেন্স-এর ড্রেসিং রুম অবস্থিত। ১৮৩৮ এবং ১৮৩৯ সালে ঐ মাস্টার বেডরুমেই ক্যাথরিন দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।


লেখকের বেশিরভাগ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, যেমন খোদাই-করা রূপোর-টুপি-ওয়ালা হাঁটার লাঠি, তাঁর মনোগ্রাম করা রূপোর-তৈরি মশলার বাক্স এসব ছাড়াও সেই সময়ে ব্যবহৃত বাসনপত্র ইত্যাদি সাজানো রয়েছে এই সংগ্রহশালার অনেক মূল্যবান জিনিসপত্রের মধ্যে।
আমরা সেদিন ঐ বাড়িতে প্রায় ঘন্টাদেড়েক ছিলাম। একতলায় রয়েছে এক ক্যাফেটেরিয়া আর তার লাগোয়া এক ছোট্ট সুন্দর সাজানো বাগান। সেখানে বসে চা-বিস্কুট খেতে খেতে কিছুক্ষণ খুব ভাল সময় কাটাই। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে এই বাড়িটা আমার লন্ডন-ভ্রমণের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

1 Comment