আলোকোজ্জ্বল ইডেন, রোশনাই এবং বঙ্গ টিটোয়েন্টি বিপ্লব
বিগত জুন মাসের সতেরোটা দিন যাবৎ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগ। এখন সময়ের সঙ্গে প্রত্যেক রাজ্যই এখন নিজেদের ডিভিশন ক্রিকেটের পাশাপাশি এই টিটোয়েন্টি লিগ শুরু করেছে। ২০১৬ সালে এই বিপ্লব প্রথম আনে তামিলনাড়ু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। এরপর কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র যোগ দেয় এতে। সিএবির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। করোনা পরবর্তী সময়ে তারা রক্স বেঙ্গল টিটোয়েন্টি চ্যালেঞ্জ শুরু করেছিল এবং ঠিক তার পরবর্তী বছর স্পনসর হিসেবে আসে ‘বাইজুস্’। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই যে সমস্যা প্রকট হয় তা হলো টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয় বর্ষায়। অধিকাংশ খেলাই হয় বৃষ্টিতে পুরোপুরি বন্ধ, নয়তো ওভার সংকোচন করে হতো। এর ফলে প্রতিযোগিতার মান উচ্চস্তরে ওঠেনি।
ফলে তার পরের দুই বছর টিটোয়েন্টি লিগ বন্ধ করে ২০২৪ সাল থেকে আবার এই লিগ শুরু হয়। তবে এবার টুর্নামেন্ট পুরোপুরি হয় ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আদলে। ড্রাফটিং এর মাধ্যমে খেলোয়াড় নির্বাচন করে নিজেদের দল সাজায় আটটি দল। উল্লেখ্য সিএবিই প্রথম যারা মহিলাদের জন্য আলাদা টিটোয়েন্টি লিগ তৈরী করে। এটির দেখাদেখি এই উদ্যোগে এগিয়ে আসে মহারাষ্ট্রও। দুটো সংস্করণই অনুষ্ঠিত হয় ১১-২৮ জুন সময়কালে।
বাংলার বিভিন্ন নামী ক্রিকেটার থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ভালো করা ক্রিকেটার বা অখ্যাত ক্রিকেটার- ড্রাফটে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করান সবাই এবং নাম ওঠে শুধুমাত্র তাঁদেরই যারা মরশুমে ডিভিশন ক্রিকেটে নির্দিষ্ট শতাংশ খেলা খেলেছেন। এই ড্রাফটিং অনুষ্ঠিত হওয়ার তিন সপ্তাহের মাথায় দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম বল গড়ায়। ছেলেদের খেলা অনুষ্ঠিত হয় ইডেন গার্ডেনসে এবং মহিলাদের ক্রিকেট হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে।
ফাইনাল:
বিগত ২৮শে জুন ইডেন গার্ডেনসে মহিলা এবং পুরুষ উভয় দলেরই ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরের ম্যাচে মহিলারা এবং রাতের ম্যাচে খেলেন পুরুষরা।
মহিলাদের খেলায় প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে ১০৪ রান তোলে কলকাতা টাইগার্স। অধিনায়ক মিতা পাল কার্যত দলের ব্যাটিংকে একা টানেন এবং ওপেন করতে নেমে ৫২ বলে ৫১ রান করেন। জবাবে ব্যাট করতে নেমে মালদা স্ম্যাশার্স দল প্রথম চারটি উইকেট হারিয়ে ফেলে ২২ রানে। সুকন্যা পরিদা এবং মমতা কিস্কু অপরাজিত এবং হৃষিতা বসুর ব্যাটিং বাকি থাকলেও খেলায় বাধ সাধে বৃষ্টি। ডাকওয়ার্থ লুইস নিয়মে ১৬ রানে জিতে টানা দ্বিতীয় শিরোপা পায় কলকাতা টাইগার্স।



অন্যদিকে পুরুষদের ফাইনালে মুর্শিদাবাদ কিংসকে ৯ রানে হারিয়ে জয়লাভ করে হাওড়া ওয়ারিয়র্। শুরুতে আদিত্য পুরোহিতের ঝোড়ো ব্যাটিং এবং মিডল ওভারে অরিন্দম ঘোষ এবং শাকির হাবিব গান্ধীর ব্যাটিং হাওড়া ওয়ারিয়র্সকে ২০ ওভার শেষে ১৫০ রানে পৌঁছে দেয়। জবাবে মুর্শিদাবাদ কিংস ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ক সুদীপ ঘরামিকে হারায় কম রানে। ফর্মে থাকা সুদীপ ১৬ রানে ফিরে গেলে এবং অগ্নিভ পান স্বল্প স্কোর করলে চাপে পড়ে মুর্শিদাবাদ। তখন এগিয়ে আসেন তন্ময় প্রামাণিক। রানাঘাটের বাসিন্দা এই ইস্টার্ন রেলের খেলোয়াড় বাংলার অন্যতম সেরা টিটোয়েন্টি ক্রিকেটার হলেও আলোচিত নাম হতে পারেননি কোনোদিনই। তাকে মুর্শিদাবাদ কিংস কোনো কারণে এই বছর ফাইনালের আগে কোনো ম্যাচ দেয়নি। সেই তন্ময় মরশুমে প্রথম সুযোগ পেয়ে ৩৩ বলে ৪৮ করেন এবং তার ইনিংসের দৌলতে হারের ব্যবধান কমিয়ে ৯ রানে আনে কিংস। হাওড়ার বোলার কনিষ্ক শেঠ নেন ৩টি উইকেট।

বাংলার প্রাপ্তিসমূহ:
এই ফ্রাঞ্চাইজি টিটোয়েন্টি প্রত্যেক রাজ্য শুরু করেছে মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত একটা টানটান প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট দিয়ে পরীক্ষিত ক্রিকেটারদের রাজ্য দলে নিয়ে আসা এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো আইপিএল দলের স্কাউটদের চোখে নিজের রাজ্যের ক্রিকেটারদের তুলে ধরা। এই লিগ থেকে লাইমলাইট পেয়েছেন অনেক ক্রিকেটার। তামিলনাড়ু থেকে যেমন এসেছেন শাহরুখ খান, গুরুস্বামী অজিতেশ, গুরজাপনীত সিং, কর্ণাটক থেকেও এসেছেন অভিনব মনোহর, রবিচন্দ্রন স্মরণ বা মহারাষ্ট্রের সাহিল পারেখের বা মধ্যপ্রদেশের অক্ষত রঘুবংশীর নামও করা যায় এই লিস্টে।

এই মরশুমে বাংলার সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি নুরউদ্দিন মন্ডল। শিলিগুড়ি স্ট্রাইকার্স দলের এই ডানহাতি পেসার দলে থাকতে সান্নিধ্য পেয়েছেন ঋদ্ধিমান সাহা, অনুষ্টুপ মজুমদারের মতো ক্রিকেটারের। নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে তার প্রশংসা করেছেন অনুষ্টুপ। ক্রিকেটের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা আজ নুরকে এনে দিয়েছে প্রচারের আলোয়। তার খেলায় হাতেখড়ি সঞ্জয় দের কাছে যিনি ময়দানে খোকা স্যার নামে পরিচিত। এরপরে নুরউদ্দিন যান দেবেশ চক্রবর্তীর কাছে। বাংলার একাধিক নামী ক্রিকেটার যেমন সুদীপ ঘরামি, সন্দীপন দাসের কোচ দেবেশ চক্রবর্তী। তার কাছে ক্রিকেট শিক্ষা লাভের পর নুরউদ্দিন খেলেন সিএবির বয়সভিত্তিক খেলা। বড়বাজার এলাকায় একটা ছোট হাউজপেন্টের দোকান চালাতেন নুরের বাবা। অনেক ছোটো বয়স থেকেই দোকানে বাবার সঙ্গে যেত সে। কিন্তু দুপুর হলেই ছুটে যেত ময়দানে। সেই থেকে কঠোর অনুশীলনকে সম্বল করেই আজ বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টিতে বাজিমাত করেছেন তিনি। ৮টি ম্যাচে ১৮টি উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী এই পেসার।
এরপরে টুর্নামেন্টে সফল হওয়া যার নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় তিনি শ্রেয়ান চক্রবর্তী। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে তার অভিষেক ২০২০ সালে বিদর্ভের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরে শাহবাজ আহমেদ এবং প্রদীপ্ত প্রামাণিকের উপস্থিতি তাকে সঙ্গত কারণেই করেছে উপেক্ষিত। তারপর থেকে টাউন ক্লাব এবং ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ভালো পারফর্ম করলেও শিকে ছেঁড়েনি তার। একজন ভালো বাঁহাতি পেসার, লোয়ার অর্ডারে ভালো ব্যাটার এবং অসাধারণ একজন ফিল্ডার- ক্রিকেটের তিনটে দিকেই ধারাবাহিকতা রেখে চলেছেন শ্রেয়ান। বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগে মোট ৯টি ম্যাচ খেলে তার দল হাওড়া ওয়ারিয়র্স।

প্রথমদিকে প্রথম এগারোয় প্রথম পছন্দ ছিলেন না তিনি। দলের কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী জানান কারণটা। উইকেট শুরুর দিকে পেসার সহায়ক থাকায় কখনো হাওড়া ওয়ারিয়র্স খেলেছে তিন পেসারে আবার একটি ম্যাচে খেলে চারটে পেসার নিয়ে। কিন্তু পিচ আসতে আসতে স্লো হতে থাকলে স্পিনারের প্রয়োজন হয় এবং দলে আসেন শ্রেয়ান।
প্রথম ম্যাচেই রাঢ় টাইগার্স দলের বিরুদ্ধে ৩ ওভার বল করে মাত্র ২ রান দিয়ে ৪টি উইকেট নেন তিনি। তার উইকেটগুলি ছিল প্রদীপ্ত প্রামাণিক, অভিষেক দাস, গৌরব চৌহান এবং আশুতোষ কুমারের। একমাত্র মুর্শিদাবাদ কিংসের বিরুদ্ধে গ্রুপ ম্যাচ ছাড়া বাকি সব ম্যাচে উজ্জ্বল শ্রেয়ান ৫টি ম্যাচে ১০টি উইকেট নিয়ে শেষ করেন টুর্নামেন্ট।
ব্যাটারদের মধ্যে যে দুজনের নাম করতেই হয় তারা করণ লাল এবং আদিত্য পুরোহিত। করণ লাল সিনিয়র বাংলার হয়ে খেলছেন প্রায় তিন বছর। কিন্তু তার ব্যাট কথা বলতে শুরু করে বিগত সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফি থেকে। ৩৩৮ রান করে টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হন তিনি। এইবারের বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগে কলকাতা টাইগার্স দলের হয়ে ৯ ইনিংসে ৩০৬ রান করে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক তিনিই। নিজের টিটোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের ওপর প্রচুর কাজ করেছেন এই খড়গপুর নিবাসী ক্রিকেটার। তিনি স্পিনারের বিরুদ্ধে জোরের সাহায্যে রিভার্স সুইপ বা স্কুপ যেমন খেলতে পারেন তেমনই ব্যাকফুটে যে কোনো দিকে শট খেলায়ও তিনি সিদ্ধহস্ত।
অন্যদিকে আদিত্য পুরোহিত এমন একজন যিনি ড্রাফটিংয়ে ছিলেন উপেক্ষিত। হাওড়া ওয়ারিয়র্স দলের দুজন ক্রিকেটার অসুস্থ হওয়ায় এবং যুবরাজ দীপক কেশ্বনীর চোট লাগায় পরিবর্ত হিসেবে দলে আসেন এই খেলোয়াড়। মহামেডান ক্লাবের এই ক্রিকেটার লাল বল এবং সাদা বলের ক্রিকেটে বিভিন্ন বড়ো ম্যাচে রান করলেও এখনো বাংলার হয়ে খেলেননি। গত বছর অফ সিজনে নিজের বৌবাজারের বাড়ি থেকে এসে বাংলার সম্ভাব্য দলের প্র্যাক্টিস সেশনে যোগ দিতেন কিন্তু থেমে যেতে হয়েছে ওখানেই। রঞ্জি ট্রফির প্রথম পনেরোয় আসতে পারেননি তিনি। কিন্তু এই বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগে সুযোগ পেয়েই তার কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার কাজ ছিল পাওয়ারপ্লেতে দলকে ঝোড়ো একটা রান উপহার দেওয়া। সেই আদিত্য টুর্নামেন্ট শেষ করলেন ১৮৩ স্ট্রাইক রেটে ১৮৫ রান করে। টুর্নামেন্টে ন্যূনতম ১০০ রান করা ৩২ জন ক্রিকেটারের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
মহিলাদের মধ্যে বাংলার অন্যতম সেরা ক্রিকেটাররাই উৎকৃষ্ট পারফরমেন্স করেছেন। কলকাতা টাইগার্স অধিনায়ক মিতা পাল টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তিনি করেছেন ৩১৫ রান যা পরবর্তী সর্বোচ্চ রানের থেকে প্রায় শতাধিক বেশী। ২০১ রান করে দ্বিতীয় স্থানে হাওড়া ওয়ারিয়র্সের ধারা গুজ্জার এবং ১৯২ রান করে তৃতীয় স্থানে মালদা দলের মমতা কিস্কু।
তবে উইকেটশিকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন হারবার ডায়মন্ডস দলের অরিক্তা মান্না। সিএবি পরিচালিত মহিলাদের ক্লাব ক্রিকেটে রাজস্থান ক্লাবের হয়ে খেলেন অরিক্তা। সেই দলের হয়ে টিটোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় ৪ ম্যাচে ৭টি উইকেট নেন তিনি এবং শক্তিশালী কালীঘাট দলের বিরুদ্ধে ৩ উইকেট নিয়ে নজরে আসেন। তার আগে ওয়ান ডে টুর্নামেন্টেও কৃপণ বোলিং করেন। অরিক্তা বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগে মোট ১২টি উইকেট নিয়েছেন যা প্রথম স্থানে থাকা জাহানভী পাসোয়ানের থেকে ৪টি উইকেট কম।
মহিলাদের মধ্যে ৫ বা তার বেশী উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ইকোনমি সুস্মিতা গাঙ্গুলীর। নিজের অফ ব্রেক বোলিংয়ের জালে ব্যাটারদের রান আটকে দিতেন মুর্শিদাবাদ কুইন্স দলের এই বোলার এবং অপরদিকে জাহানভী পাসোয়ান, তনুশ্রী সরকার, নম্রতা চন্দ্ররা নিজেদের মুনশিয়ানা দিয়ে উইকেট এনে দিতেন দলকে।
বাংলার মহিলা ক্রিকেট দল বিগত কিছু বছরে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলছে। মিতা পাল, ধারা গুজ্জার, পর্ণা পাল, সুস্মিতা গাঙ্গুলী, হৃষিতা বসু প্রমুখ ক্রিকেটার যেমন ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করছেন, তেমনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করছেন তিতাস সাধু, রিচা ঘোষের মতো ক্রিকেটার। এছাড়াও ব্যাট হাতে তনুশ্রী সরকার, বল হাতে বিদিশা দের কৃপণ বোলিং অবশ্যই আশা যোগাবে বাংলাকে।
পুরুষ এবং মহিলা ক্রিকেটে এই কয়েকটি প্রাপ্তি ছাড়াও যেটি সবচেয়ে বড়ো বিষয় তা হলো জুনিয়র ক্রিকেটারদের বড়ো মঞ্চের অভিজ্ঞতা হওয়া। পুরুষদের ক্রিকেটে আমরা ইতিমধ্যেই দীপক ঘোষ, রোহিত প্রমুখদের দেখেছি ভালো খেলতে। এছাড়াও চন্দ্রহাস দাস, অগ্নীশ্বর দাস, আশুতোষ কুমার এবং ইতিমধ্যেই বাংলার কনিষ্ঠতম রঞ্জি ক্রিকেটার অঙ্কিত চ্যাটার্জিকে আমরা এগিয়ে আসতে দেখেছি। এই টুর্নামেন্ট বাংলার বয়সভিত্তিক দলকে আরো শক্তিশালী করেছে।
কিছু অপ্রাপ্তি এবং আরো যা হতে পারতো:
কথায় বলে পারফেক্ট জিনিসটা একটা মিথ। শতচেষ্টা সত্ত্বেও খুঁত থাকবেই। নিখুঁত কাজ সম্ভব নয় কোনোদিনই। বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগের শেষেও থেকে যায় কিছু প্রশ্ন। এতো কিছু সত্ত্বেও যেন টিটোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বভারতীয় স্তরে আলোচনা হয়না বাংলার কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে। তাদের খেলার ধরণ যেন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতেই ব্যর্থ।গত বছর আইপিএলে বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি লিগ থেকে আইপিএলে দল পাননি নতুন কোনো ক্রিকেটার। সেই আকাশদীপ, মুকেশ কুমার, অভিষেক পোড়েল, শাহবাজ আহমেদরাই খেলেছেন আইপিএল।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যে যেখানে আকছার ২০০ রানের ইনিংস দেখা যায়, সেখানে আজও বাংলায় গড়ে ১৫০ রান ওঠে। দিল্লী প্রিমিয়ার লিগে ২৫০ রানের গণ্ডিও টপকায় দলগুলি, উঠে আসেন প্রিয়াংশ আর্যর মতো খেলোয়াড়। আধুনিক টিটোয়েন্টি অনেকাংশেই ব্যাটিং নির্ভর। স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছুটিয়ে ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে রান করেন ব্যাটাররা। সেই জায়গায় হাই স্কোরিং বা স্ট্রোক খেলার উপযুক্ত উইকেট না পেলে প্রতিযোগিতায় যে অন্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে যাবেন বাংলার খেলোয়াড়রা তা বলাই বাহুল্য।
বর্তমানে টিটোয়েন্টি ক্রিকেটে অন্যতম শক্তিশালী দলগুলি হলো পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক। নিজেদের ঘরোয়া ক্রিকেটে টিটোয়েন্টির গুরুত্ব বাড়িয়ে তারা একাধিক উৎকৃষ্ট খেলোয়াড় তৈরী করেছে। অপরদিকে বাংলার লক্ষ্য ছিল প্রধানত রঞ্জি ট্রফি নির্ভর। সুপার ডিভিশন ফরম্যাটে লিগ পরিচালনায় বাংলার লাল বলের ক্রিকেট হয়েছে অনেক বেশী প্রতিযোগিতামূলক। সুপার ডিভিশন খেলার ধারা বহু রাজ্যে হয়েছে সমাদৃত। এই সিস্টেম শুরু হওয়ার পর বাংলা দুইবার খেলেছে রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল, একবার খেলেছে সেমিফাইনাল। তবে সাদা বলের ক্রিকেটে বাংলা ২০২১ অবধি অন্য রাজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল পিছিয়ে। ফলে কিছু শক্তিশালী রাজ্যকে হারালেও সর্বাঙ্গীণ ফলাফল আসছিলো না। কিন্তু শেষ দুই বছরে চিত্রটা অন্য। বাংলা ধারাবাহিকভাবে সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফি এবং বিজয় হাজারে ট্রফি- দুটি টুর্নামেন্টেই নকআউট স্তরে খেলেছে। এর কারণ কিছু সিদ্ধান্তের বদল এবং সাদা বলের ক্রিকেটে অভিষেক পোড়েল, করণ লাল, ঋত্বিক রায়চৌধুরী, সুদীপ ঘরামির মতো নব্যদের উত্থানের সঙ্গে ঋত্বিক চ্যাটার্জী, সায়ন ঘোষের মতো অভিজ্ঞদের মিশ্রণ।
তবে মহিলাদের টুর্নামেন্টেও সমস্যা হিসেবে দেখা গিয়েছে রান না ওঠার ব্যাপারটা। ১৬ দিন ব্যাপী টুর্নামেন্টে মাত্র একটি ম্যাচে ১৫০ রানের গণ্ডি টপকেছে কোনো দল। ২৫শে জুন দুপুরের হাওড়া ওয়ারিয়র্স এবং মালদা স্ম্যাশার্স ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে হাওড়া দল ১৫৪ তুললে সেই রান এক বল বাকি থাকতে তাড়া করে জিতে যায় মালদা দল। বর্তমানে মহিলা ক্রিকেটে রান উঠছে আগের থেকে বেশী। আন্তর্জাতিক হোক বা ঘরোয়া, যে কোনো পর্যায়েই রান তুলছেন ক্রিকেটাররা। তাদের মধ্যে বল স্ট্রাইকিং অ্যাবিলিটি বেড়েছে বেশ অনেকটাই। সেখানে রান কম ওঠা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ২০ ওভারের খেলায় ১২০ রান না ওঠা একটা চিন্তার জায়গা অবশ্যই। মহিলাদের ক্লাব টিটোয়েন্টিতেও বিদ্যমান ছিল এই সমস্যা তবে কিছু ম্যাচে ১৮৬, ১৭৬ বা ১৭১ উঠতেও দেখা গিয়েছে। এই জায়গায় ব্যাট হাতে হয়তো পরেরবার আরো ভালো করার লক্ষ্য থাকবে ক্রিকেটারদের।
উপসংহার
বেঙ্গল প্রো টিটোয়েন্টি বাংলার একটা বড়ো ভরসা ও আশার জায়গা। অনেকেই আশা রাখেন যে আগামী কিছু বছরে হয়তো বাংলা সাদা বলের ক্রিকেটে একটি পাওয়ারহাউস হয়ে উঠবে। জুনিয়র খেলোয়াড়দের উত্থান এবং সিনিয়রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যাওয়ার যে প্রবণতা তা এই আশায় প্রাণের সঞ্চার করে। তবে এই কিছু খামতির জায়গায় যদি কাজ করা হয়, বাংলার ক্রিকেটের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সম্ভব। ইতিমধ্যেই জুনিয়র ক্রিকেটার না থাকা নিয়ে একটা সমস্যার জায়গা তৈরী হয়েছিল তার কিছুটা কমেছে গত বছরের অনূর্ধ্ব-১৯ ব্যাচের কিছু ক্রিকেটার আসায়। এখন এই ফ্রাঞ্চাইজি টিটোয়েন্টির দৌলতে বাংলার এই খেলোয়াড়রা আরো পরীক্ষিত। বছরের পর বছর এই প্রতিযোগিতামূলক খেলা হলে বাংলার ক্রিকেটারদের নিয়ে আশায় বুক বাঁধা নেহাতই অমূলক নয়।