‘মুক্তির দশক’ এবং ওভাল-মাঠে ভারত: ফিরে দেখা

‘মুক্তির দশক’ এবং ওভাল-মাঠে ভারত: ফিরে দেখা

কেনিংটন (বর্তমানে কিয়া) ওভাল-এর গরিমা

ইংল্যান্ড স্বদেশে তাদের সর্বপ্রথম টেস্ট-ম্যাচ খেলে ওভাল-এ, ১৮৮০ মরশুমে, অজিদের বিরুদ্ধে – পাঁচ উইকেটে জয়লাভ করে, আরো দুই সহোদরের সঙ্গে টেস্ট-অভিষেক হয় ডব্ল্যু জি গ্রেস-এর এবং অভিষেক-ইনিংসেই তিনি শতরান (১৫২) করেন। এরপর ১৮৮২ মরশুমে অজিদের সাত রানে জয়লাভ করা সেই রুদ্ধশ্বাস ওভাল-টেস্ট উপলক্ষেই ‘অ্যাশেজ’ শব্দটার প্রথম আবির্ভাব।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে এই ওভাল-মাঠ থেকেই টেস্ট-রঙ্গমঞ্চকে বিদায় জানিয়েছেন তিন যুগের তিন দেশের তিন দিকপাল ব্যাটার – জ্যাক হবস (১৯৩০), ডন ব্র্যাডম্যান (১৯৪৮), ভিভ রিচার্ডস (১৯৯১)। আর আমাদের সচিন তেন্ডুলকর তাঁর শততম টেস্ট-ম্যাচটাও খেলেছেন এই মাঠেই (২০০২)। হয়ত এইসব নানা কারণেই ঐতিহ্যমণ্ডিত এই ওভাল-টেস্ট দিয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শেষ হয় ইংল্যান্ডের টেস্ট-ক্রিকেট মরশুম।

এবারের ইংল্যান্ড-সফরেও ভারতের পাঁচ-ম্যাচের টেস্ট-সিরিজের শেষও হবে এখানেই। আর আগামী ১০ই জুলাই ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক যুগপুরুষ সুনীল গাভাস্কর-এর জন্মবার্ষিকী যাঁর অন্যতম সেরা টেস্ট-ইনিংসটাও এই মাঠেই। তাই ইচ্ছে হ’ল এই ওভাল-মাঠে সত্তর দশকে আমার ছাত্রজীবনের ভারতীয়-দলের দুই গৌরবময় ক্রিকেটীয় কীর্তি নিয়ে কিঞ্চিৎ স্মৃতিচারণ করবার – দশক শুরুর ১৯৭১ মরশুম আর দশক শেষের ১৯৭৯ মরশুম। আসুন ফিরে দেখি।

২৪শে অগাস্ট, ১৯৭১ – ভারতের হাতে স্বদেশে প্রথমবার পরাজিত পরাক্রমশালী ইংল্যান্ড

বিখ্যাত স্বাধীনতা-সংগ্রামী বালগঙ্গাধর তিলক নাকি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় একাত্মবোধ জাগাতে ১৮৯৩ সালের গণেশ চতুর্থী অনুষ্ঠান কাজে লাগিয়েছিলেন। আর ১৯৭১ সালের ২৪শে অগাস্ট গণেশ চতুর্থীর সন্ধেবেলায় বম্বেতে ঘরের রেডিও-ঘিরে-বসে-থাকা ১৫ বছরের কিশোর দিলীপ ভেঙ্গসরকার, আর কলকাতার তৎকালীন পাওয়ার-কাট-বিঘ্নিত অন্ধকারে পাশের-বাড়ির-ট্রানজিস্টর-রেডিওতে-কান-পাতা ১২ বছরের এই অধম – দু’জনকে, এবং দেশে-বিদেশে আমাদের মতন আরো অনেক ভারতীয়কে  মিলিয়ে দিয়েছিল ওভাল-টেস্টের শেষ-লগ্ন। সেদিনই কি প্রথমজন দেড় দশক বাদে সেদেশেই আরেক টেস্ট-সিরিজ-বিজয়ী ভারতীয়-দলের অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠার প্রেরণা পেয়েছিলেন? তিনিই জানবেন, তবে আমার তো তেমনই মনে হয়।

হাতি-ঘোড়া যোগাযোগেই কি সাফল্য?

১৯৭১ সালের ওভাল-টেস্টে জয়ী ভারতীয় একাদশের অধিনায়ক-সমেত ছ’জন ক্রিকেটার ছিলেন বম্বে-র – ব্যাটিং-ক্রম অনুযায়ী – সুনীল গাভাস্কর, অশোক মানকড়, অজিত ওয়াদেকর (অধিনায়ক), দিলীপ সরদেশাই, একনাথ সোলকার, ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার (উইকেটরক্ষক) – অর্থাৎ প্রথম সাতজন ব্যাটারের মধ্যে পাঁচ-নম্বরের গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ-কে বাদ দিলে সবাই ‘মুম্বইকর’। বম্বের সবচেয়ে বড় উৎসব নিঃসন্দেহে গণপতি-পুজো, আর ২৪শে অগাস্টের সেই দিনটাও ছিল গণেশ চতুর্থী।

সত্তর দশকেও ভারত বললেই সাধারণ পাশ্চাত্যদেশীয়দের মনে যেসব প্রাণীর ছবি ভেসে উঠত তার মধ্যে একটা ছিল হাতি। আমাদের সিদ্ধিদাতা দেবতাও হলেন গণেশ যাঁর মাথাটা/মুখটা হাতির মতন। সেই সিদ্ধিদাতার উপস্থিতিতেই ওভালে ভারতীয় ক্রিকেটের এক বড় সিদ্ধিলাভের বিজয়যাত্রার শুরু! মানে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ২৩শে অগাস্ট ওভালের মাঠে সিরিজের তৃতীয়-তথা-শেষ টেস্ট-ম্যাচের চতুর্থ দিন। লাঞ্চের পরে প্রথম ইনিংস শেষে ৭১ রানে এগিয়ে-থাকা ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে নড়বড়ে ২৪/৩ স্কোর নিয়ে যখন ব্রায়ান লাকহার্স্ট ও বেসিল ডি’ওলিভেইরা ব্যাট করতে নামলেন, তখন মাঠে উপস্থিত ছিল ‘বেলা’ নামে এক সুসজ্জিত হস্তিশাবক যাকে কিছু অত্যুৎসাহী ভারতীয় সমর্থক নিয়ে এসেছিলেন। গল্পকথা মনে হ’লেও এটা যে সত্যি, তার প্রমাণ আছে মিহির বোস এবং অরুণাভ সেনগুপ্ত এঁদের মতন সুপরিচিত ক্রিকেট-ঐতিহাসিকদের লেখায়।

 

সেদিন লাঞ্চের ঠিক আগে পরপর দু’বলে চন্দ্রশেখর ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জন এডরিচ ও কিথ ফ্লেচার -কে। অধিনায়ক ওয়াদেকর-এর হয়ত মনে পড়ে গেছিল যে এরই কয়েকমাস আগে, ১০ই মার্চ, পোর্ট-অফ-স্পেনের মাঠে ক্যারিবিয়ান-সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট-ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে সেলিম দুরানি -র হাতে গ্যারি সোবার্স ও ক্লাইভ লয়েড এই দুই ব্যাটার-বধ, যা ভারতকে ম্যাচ-জয়ের পথে এগিয়ে দিয়েছিল।
এডরিচ যে দ্রুতগতির বলে বোল্ড-আউট হন, সেটা ডেলিভারি করতে যাওয়ার আগে মিড-অফের ফিল্ডার সরদেশাই নাকি চন্দ্রশেখর-কে চেঁচিয়ে বলেন “মিল রীফ”, আর সেটা শুনেই নাকি চন্দ্রশেখর অমন ডেলিভারিটা করেন। ‘মিল রীফ’ ছিল ডার্বি-জেতা ঘোড়দৌড়ের দ্রুতগামী এক নামী ঘোড়া। সেদিন চন্দ্রশেখর-এর হ্যাট-ট্রিকও হয়ত হয়ে যেতো যদি সেই সরদেশাই-ই স্লিপে ডি’ওলিভেইরা-র ক্যাচটা ধরে ফেলতেন।
এইসব মিলিয়ে এটা কেমন যেন একটা বিচিত্র হাতি-ঘোড়া যোগাযোগ ব’লেই আমার মনে হয়!

ফারুখ-কে নিয়ে ফয়সালার ফায়দা (এবং জিমি-র যাতনা!)
১৯৭০-৭১ মরশুমে ভারতের ঘরোয়া-ক্রিকেটে অংশগ্রহণ না করায় তৎকালীন প্রধান উইকেটরক্ষক ইঞ্জিনিয়ার-কে ওয়েস্টইন্ডিজ-সফরে দলে রাখা হয়নি, গেছিলেন পোছিয়া কৃষ্ণমূর্তি ও রুসি জিজিবয়, টেস্ট-সিরিজে কৃষ্ণমূর্তি খেলেছিলেন। ল্যাঙ্কাশায়ার-দলের-হয়ে-কাউন্টি-খেলা ইঞ্জিনিয়ার যাতে ইংল্যান্ড-সফরে টেস্ট-ম্যাচগুলোয় ভারতের হয়ে খেলতে পারেন, এমন ব্যবস্থা হওয়ার কারণে ইংল্যান্ড-সফরে গেলেন কৃষ্ণমূর্তি ও সৈয়দ কিরমানি আর বাদ পড়লেন উঠতি মিডিয়াম-পেসার মহিন্দর (জিমি) অমরনাথ – দুর্ভাগ্য জিমি-র যে ১৯৬৯-৭০ মরশুমে মাদ্রাজের পঞ্চম-তথা-শেষ টেস্ট-ম্যাচে অজিদের বিরুদ্ধে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক অভিষেক ক’রেও তাঁকে আরো পাঁচ/ছ’বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরবর্তী আন্তর্জাতিক-ম্যাচ খেলবার জন্য।
উইকেটের পেছনে ও সামনে ইঞ্জিনিয়ার-এর ভূমিকা এই টেস্ট-সিরিজে ছিল গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত ওভাল-টেস্টে ওঁর ৫৯ ও ২৮* রানের ইনিংস দু’টো। প্রথম ইনিংসে একটাও বাউন্ডারি না মেরে ১২৪ মিনিটে ১১১ বল খেলে ওঁর ঐ ইনিংসটা ভারতকে লড়বার রসদ দিয়েছিল, ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের ৩৫৫ রানের সম্মুখীন হয়ে ২৮৪ রান তুলতে।

একনিষ্ঠ এক্কি

প্রথমে বল হাতে ১৫-৪-২৮-৩, তারপর ব্যাট হাতে নিজের ৪৪ রান (১২৯ মিনিটে ১২৫ বল খেলে) ও দলকে ১২৫/৫ থেকে ২২২/৬ অবস্থায় টেনে নেওয়া ইঞ্জিনিয়ার-এর সঙ্গে। পরে ধরেন ফ্লেচার ও নট এঁদের দু’টো ক্যাচ, যার দ্বিতীয়টা (ভেঙ্কটরাঘবন-এর বলে) তো একটা আইকনিক ক্যাচ। সোলকার-এর এই তিন-ভূমিকাকে অবশ্য ছাপিয়ে গেছিল চন্দ্রশেখর-এর ১৮.১-৩-৩৮-৬, ‘bowling spell of the century by an Indian cricketer’ (Wisden-এর মতে)। আবার অধিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ ক’রে একটা কায়দা ক’রে সোলকার আরেকটা ছোট গেমসম্যানশিপ-এর খেল দেখিয়েছিলেন। সেটা কেমন? শোনা যাক।

অ্যালান নট ব্যাট করবার সময় গার্ড নিয়ে বেল দিয়ে মাটিতে আঁচড় কেটে নিতেন। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৯/৪ অবস্থায় তিনি ক্রিজে এসে গার্ড নিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটতে গিয়ে দেখেন বেল তো নেই, অগত্যা অভ্যাসবিরুদ্ধভাবে তিনি ব্যাট দিয়েই আঁচড় কাটতে বাধ্য হলেন। তার ঠিক পরেই শর্ট-লেগের ফিল্ডার সোলকার নিজের পকেট থেকে আগেভাগেই-সরিয়ে-রাখা বেল-দু’টো বের ক’রে স্টাম্পের ওপর বসিয়ে দিলেন। এমন চটপট এটা ঘটেছিল যে অনেকেই তা খেয়ালও করতে পারেননি! এর ফলে নির্ভরযোগ্য লড়াকু ব্যাটার নট-এর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটেছিল কিনা তা সঠিক জানা নেই, তবে মিনিট-দশেকের মধ্যেই তিনি শর্ট-লেগে সোলকার-এর হাতে সেই অসাধারণ ক্যাচে আউট হয়ে যান – ম্যাচের একটা বড় মোড়-ঘোরানো মুহূর্ত।

Snowy ‘dogs’ Sunny!

ওভাল-টেস্টের প্রথম ইনিংসে জন স্নো-র একটা কম-লাফানো বাউন্সার গাভাস্কর-এর শরীর ঘেঁষে চলে যায়। সাময়িকভাবে শরীরের ভারসাম্য-হারানো ব্যাটার-এর গলার সোনার হারটা ছিঁড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেছিল। শর্ট-লেগে ফিল্ডিং-রত ইংল্যান্ড অধিনায়ক রে ইলিংওয়ার্থ সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ফেরত দেওয়ার সময় নাকি বলেন, “ওহে ছোকরা, টেস্ট-ম্যাচ খেলবার সময় গায়ে সোনার গয়না রেখোনা!”
ঐ ইনিংসে ভারত যখন ২১/১, তখন একটা কালো ল্যাব্রাডর কুকুর হঠাৎ মাঠে ঢুকে প’ড়ে স্নো-এর পদচিহ্নগুলো শুঁকতে শুঁকতে পিচের পাশে গাভাস্কর-এর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রবল কুকুরভীতিসম্পন্ন সানি নেহাতই নির্বিকার ভাব দেখিয়ে উল্টোদিকে তাকিয়ে থাকলেও তাঁরই কথায় মনে মনে তিনি “was literally shivering.” আর কুকুরটাকে পুলিশ ‘গ্রেপ্তার’ ক’রে সরিয়ে নেওয়ার একটু পরেই তিনি আউট হয়ে যান, যদিও তাঁর নিজের মতে, ঐ বিলিতি-সারমেয়টি নয়, স্নো-এর একটা ভাল বলই তাঁকে বোল্ড-আউট ক’রে দেয়!
দ্বিতীয় ইনিংসে গাভাস্কর এলবি-আউট হন, স্নো-এর বলেই, ব্যক্তিগত শূন্য রানে। এই আউটের ডেলিভারিটা নিয়ে মাঠে-হাজির তিন খ্যাতনামা প্রত্যক্ষদর্শীর তিন মত। যেসব অতি-সুনিশ্চিত-স্বভাবের ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শী অহরহ বলে থাকেন, “আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম”, এই ব্যাপারটা তাঁরা কেমনভাবে নেবেন তা অবশ্য আমি ঠিক জানিনা!

  • জন আর্লট-এর মতে: ওটা লেগ-স্টাম্পের বাইরে থেকে লেট-আউটস্যুইং হয়ে উইকেটে ঢুকে এসেছিল।
  • সুন্দর রাজন-এর মতে: ওটা অফ-স্টাম্পে পিচ পড়েছিল।
  • স্বয়ং গাভাস্কর-এর মতে: ওটা লেগ-স্টাম্পের বাইরে পিচ পড়েছিল। এই আউটটা নিয়ে তাঁর “Sunny Days” বইতে তিনি ইংরেজ আম্পায়ারদের আম্পায়ারিংয়ের মান সম্বন্ধে কটাক্ষও করেছেন।

নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন নিশ্চিত অধিনায়ক!

“লক্ষ্যে যে আমরা পৌঁছে যাব, এ ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলামI”, বলেছিলেন ওয়াদেকর। আগের দিনের ৪৫ রানে অপরাজিত ব্যাটার ম্যাচের শেষ দিন সকালেই নিজে রান-আউট হয়ে গেলেও (৭৬/৩) তিনি দলীয় ব্যাটারদের বলেছিলেন ধীরেসুস্থে খেলে বাকি রানগুলো তুলে ফেলতে। সেই কাজটাই যখন মাঠের মধ্যে করছিলেন সরদেশাই, বিশ্বনাথ ও ইঞ্জিনিয়ার, তখন মাঠের বাইরে দলনায়ক কী করছিলেন?
আউট হয়ে ফিরে এসে সাজঘরে ঘুমিয়ে পড়েন ভারতীয় অধিনায়ক। ভারতীয় ইনিংসের বাকি সময়টাতে তিনি নাকি ঘুমিয়েই ছিলেন। ম্যাচের শেষে ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজার কেন ব্যারিংটন এসে তাঁকে ডেকে তোলেন এবং জানান যে ভারত জিতে গেছে। তখন ওয়াদেকর-এর প্রতিক্রিয়া ছিল: “I always knew we’d win.”
মাঠের উচ্ছ্বসিত দর্শকদের ভিড় ঠেলে সাজঘরে পৌঁছতে খেলোয়াড়দের কিছুটা সময় লেগেছিল। আর তারপর বিজয়ী অধিনায়ক ও তাঁর দল মিলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দর্শকদের তুমুল অভিনন্দন গ্রহণ করেছিলেন। সেই ছবি তো ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য জায়গা ক’রে নিয়েছে।

 

ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন

  • ঐ টেস্ট-সিরিজে এরাপল্লি প্রসন্ন একটা ম্যাচেও সুযোগ না পাওয়ায় খুবই অপ্রসন্ন ছিলেন। তবে কয়েকটা ক্ষেত্রে ভারতের ভাগ্যদেবী কিন্তু বেশ সুপ্রসন্ন ছিলেন, যদিও তাতে ভারতের জয়ের কৃতিত্ব কিছু কমে যায়না। অবশ্য এটা বলা মুশকিল যে জনৈক জ্যোতিষীর পরামর্শে ইংল্যান্ড-সফরের বিমানযাত্রা দু’দিন পিছিয়ে দিয়ে ‘শুভদিন’ ১৭ই জুন ক’রে দেওয়াতেই এইসব ‘সুফল’ (প্রথমটা বাদে) পাওয়া গেছিল কিনা!
  •  ভারত ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মের দ্বিতীয়ার্ধে খেলেছিল, যখন (প্রথমার্ধের তুলনায়) আবহাওয়া কম ঠান্ডা ও কম স্যাঁতস্যাঁতে ছিল, ফলে স্পিনারদের কম অসুবিধে হয়েছিল।
  •  লর্ডস-এর প্রথম টেস্টের শেষদিনে যখন বৃষ্টির জন্য খেলা পরিত্যক্ত হয়, ১৮৩ রান তাড়া করতে নেমে তখন ভারত ১৪৫/৮, সোলকার-এর সঙ্গে খেলছেন বেদি ও ব্যাট করতে বাকি চন্দ্রশেখর – হারের সম্ভাবনাই বেশি ছিল।
  •  ম্যাঞ্চেস্টার-এর দ্বিতীয় টেস্টের শেষদিনে যখন বৃষ্টির জন্য খেলা শুরু করাই যায়নি, চতুর্থ ইনিংসে ৪১৯ রানে পিছিয়ে থাকা ভারত তখন ৬৫/৩, ফিরে গেছেন গাভাসকর, মানকড় ও ওয়াদেকর – হারের সম্ভাবনাই প্রবল ছিল।
  •  ওভাল-এর তৃতীয় টেস্টের চতুর্থ দিনে ৭১ রানে এগিয়ে-থাকা ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩/০ রানের মাথায় লাকহার্স্ট-এর স্ট্রেট-ড্রাইভ বোলার চন্দ্রশেখর-এর হাত ছুঁয়ে নন-স্ট্রাইকিং উইকেটে লেগে ভাল-ফর্মে-থাকা আক্রমণাত্মক ওপেনার জন জেমসন-কে রান-আউট করিয়ে দেয়। [প্রসঙ্গত, প্রথম ইনিংসেও জেমসন ৮২ রান ক’রে রান-আউট হয়েছিলেন – ইংল্যান্ডের মাঠে একই টেস্ট-ম্যাচে দু’ইনিংসেই রান-আউট-হওয়া একমাত্র ক্রিকেটার উনিই। ওঁর জন্ম ১৯৪১ সালে, বম্বে-তে, আর ওঁর বাবার জন্ম মহীশূরে ও মা’র জন্ম মহারাষ্ট্রে।]

 

শেষবেলায় ‘বেলা’-র কথা বলি। ওভাল-টেস্টের শেষদিনেও মাঠে সে হাজির ছিল যখন আবিদ আলি-র বাউন্ডারিতে বিপক্ষে-৩৩:১-বাজি-থাকা [১৯৮৩ বিশ্বকাপে যেটা ৬৬:১ ছিল] ভারতীয় দল চারদিনে (দ্বিতীয় দিনটা বৃষ্টিতে খেলা হয়নি) প্রথম দিনেই ৩৫৫ রান তুলে প্রথম ইনিংসে ৭১ রানে এগিয়ে-থাকা ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০১ রানে (একসময় ৭২/৮ ছিল) শেষ ক’রে দিয়ে চার উইকেটে জেতে – ইংল্যান্ডের মাঠে প্রায় চার দশক বাদে ভারতের প্রথমবার টেস্ট-ম্যাচ ও টেস্ট-সিরিজ জয়।

কাকু-জেঠু জমানার হালচাল!

এখনকার সময়কার ক্রিকেটপ্রেমীদের জ্ঞাতার্থে এবার একবার চট ক’রে নজর বুলিয়ে নিই তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘কাকু-জেঠু জমানা’-র অর্থকরী, সফর ব্যবস্থাপনা-সুবিধে সংক্রান্ত কয়েকটা বিষয়ের ওপর:

  • সফরকারী ভারতীয় দলের ১৭ জন ক্রিকেটারের মধ্যে মাত্র ছ’জনের নিজস্ব গাড়ি ছিল – আব্বাস আলি বেগ, বেদি, ইঞ্জিনিয়ার, প্রসন্ন, সরদেশাই, ওয়াদেকর।
  • সফরকারী ক্রিকেটারদের মাথাপিছু দৈনিক পকেট-খরচের পরিমাণ ছিল তিন পাউন্ড। [১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড-সফরকারী ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে যেটা ছিল এক পাউন্ড!]
  • ওভাল-টেস্ট শেষ হওয়ার পরদিনই সফরকারী দল হোভ-শহরে সাসেক্স কাউন্টি-দলের বিরুদ্ধে প্রথম-শ্রেণীর তিন-দিনের ম্যাচ খেলতে নেমেছিল।

আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে (বছরটা মনে নেই) দূরদর্শনের পর্দায় “Sunil Gavaskar Presents” সিরিজের ওভাল-১৯৭১ এপিসোডটা যাঁরা দেখেননি, তাঁরা পারলে ভিডিওটা দেখে নেবেন – সেই জয়ের স্বাদটা মন্দ লাগবেনা!

৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯ – মাত্র ন’রানের জন্য রান-তাড়ার বিশ্ব-রেকর্ড ভারতের হাতছাড়া

চতুর্থ ইনিংসের চমৎকার

বলুন তো টেস্ট-ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে চারশো-বা-তার-বেশি রান তাড়া ক’রে ম্যাচ জেতার ঘটনা আজ পর্যন্ত কতবার ঘটেছে, আর কোন কোন দল সেটা করেছে? পরিসংখ্যানপ্রিয় ক্রিকেটপ্রেমীরা হয়ত চটপট উত্তর দিয়ে দেবেন। গর্বের বিষয় যে চার সদস্যের এই তালিকায় ভারত (১৯৭৫-৭৬) আছে – অস্ট্রেলিয়া (১৯৪৮), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০২-০৩) ও দক্ষিণ আফ্রিকা (২০০৮-০৯) এদের সঙ্গে।

কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করি যে টেস্ট-ক্রিকেটে চতুর্থ ইনিংসে চারশো-বা-তার-বেশি রান কতবার উঠেছে? তাহলে হয়ত অত চটজলদি উত্তরটা আসবেনা। উত্তরটা হ’ল ২১ বার – আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবোয়ে ছাড়া বাকি ন’টা টেস্ট-খেলিয়ে দেশের প্রত্যেকেরই এই কৃতিত্ব আছে – ১৯২৪-২৫ মরশুম থেকে ২০২১-২২ মরশুম এই প্রায় এক শতক সময়ে। ঐ চারবার জয় বাদে বাকি ১৭ বারের মধ্যে ছ’বার ড্র হয়েছে, আর ১১ বার রান-তাড়া-করা দল হেরে গেছে।

এই ব্যাপারে ভারতের ছবিটা কেমন? ভারত মোট তিনবার এই কাজটা করেছে [অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এদেরই সমান, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দু’বার ক’রে আর বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা একবার ক’রে] – আর সেই তিনবারের মধ্যে জয়-পরাজয়-ড্র এই তিনদিকে ‘সমবণ্টন’। তবে এই ব্যাপারে ভারতের চারটে বিশেষত্ব আছে:

  • সবকটা কীর্তিই বিদেশে (অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এদেরই মতন) – ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড
  • সবকটা মাঠই ‘ওভাল’ – পোর্ট-অফ-স্পেন-এর কুইন্স পার্ক ওভাল, অ্যাডিলেড ওভাল, লন্ডনের কেনিংটন ওভাল
  • সবকটাতেই দলের অধিনায়ক স্পিন-বোলার – বেদি (প্রথম দু’বার) ও ভেঙ্কটরাঘবন
  • সবকটা ঘটনাই সাড়ে-তিন বছরেরও কম সময়ে হয়েছে – ১৯৭৬-এর এপ্রিল থেকে ১৯৭৯-র সেপ্টেম্বর

চতুর্থ কৃতিত্বটা কিন্তু আর কোনও দেশের নেই – বাকি আটটা দেশের মধ্যে আর কেউ ভবিষ্যতেও তেমনটা পারবেনা। আরও খেয়াল রাখতে হবে যে এই সময়ে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ‘সুবিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডব’-এর কেউই হয়ত তখনও স্কুলের প্রথম শ্রেণীতেও ওঠেননি – তখন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের মূল ভরসা ছিলেন দুই খর্বকায় ভদ্রলোক, যাঁরা ছাড়াও ঐ তিনটে ম্যাচেই খেলেছিলেন একজন পটকা-পরিহিত বাঁ-হাতি স্পিনার।

তো একবার ফিরে দেখি ১৯৭৯ সালের আজকের দিনটাকে – ১৯৭১-এর পর ওভাল মাঠে আবার সেদিন ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক গৌরবগাথা লেখা হয়েছিল, যার প্রধান রচয়িতা ছিলেন সাড়ে-পাঁচ-ফুটেরও কম উচ্চতার ছোটখাটো চেহারার এক ভারতীয় ওপেনার।

শেষদিনের ৩৫৩/৮

সেই ইংল্যান্ড-সফরে, ১৯৭৯ বিশ্বকাপ ও চার-ম্যাচের টেস্ট-সিরিজ খেলতে, ভারতীয় দল-নির্বাচনে অন্তত দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বদল নিয়ে বেশ জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল – অধিনায়ক পদ থেকে গাভাস্কর-এর ও প্রধান উইকেটরক্ষকের ভূমিকা থেকে কিরমানি-র অপসারণ। জোর গুজব ছিল যে এই দু’জনের সঙ্গে নাকি কেরি প্যাকার-এর World Series Cricket (WSC)-এ যোগদানের ব্যাপারে WSC-প্রতিনিধিদের আলাপ-আলোচনা চলছিল আর স্বাভাবিকভাবেই সেটা ভারতীয় ক্রিকেট-কর্মকর্তাদের একেবারেই মনঃপূত হয়নি। তা সে যাকগে!

এবার সোজা চলে যাই সেই দিনের সকালে। সিরিজে ০-১ পিছিয়ে ওভাল চতুর্থ-তথা-শেষ টেস্ট-ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ৪৩৭ রানে পিছিয়ে-থাকা ভারত পঞ্চম-তথা-শেষ দিনে মাঠে নামছে ৭৬/০ (গাভাস্কর ৪২*, চেতন চৌহান ৩২*) – জিততে গেলে সারাদিনে তুলতে হবে ৩৬২ রান, নাহলে উইকেট বাঁচিয়ে সময় কাটিয়ে ড্র করতে হবে। বিপক্ষ-অধিনায়ক মাইক ব্রিয়ারলি-র হাতে রয়েছে ভালজাতের বোলিং-আক্রমণ – পেসার-ত্রয়ী বব উইলিস, ইয়ান বথাম, মাইক হেন্ড্রিক এবং স্পিনার ফিল এডমন্ডস – আর রয়েছে ক্রিকেট-ইতিহাসের ভরসা যে ৪৩৮ রান তাড়া ক’রে টেস্ট-ম্যাচ জয় তখনও হয়ে ওঠেনি (আজও হয়নি!), তাই ১০০:১ ছিল ভারতের জয়ের স্বপক্ষে বাজির দর!

গাভাস্কর-চৌহান জুটি দিনটা ভালই শুরু করলেন কিন্তু হাড়-কেপ্পন হেন্ড্রিক ছ’ওভার বল ক’রে দিলেন মাত্র ১১ রান। তারপর অবশ্য ইংল্যান্ডের একটা ঝটকা লাগল, কাঁধের পেশিতে টান ধরায় হেন্ড্রিক মাঠ ছাড়তে বাধ্য হলেন। বাকি ম্যাচটাতে আর খেলতেই পারেননি – ব্রিয়ারলি-র হাতের একটা জোরালো অস্ত্র কমে গেল।

 

প্রথম তিন ঘন্টায় ভারত যোগ করল ১৩৭ রান, কোনও উইকেট না খুইয়ে। পার্ট-টাইম স্পিনার পিটার উইলি খুবই রান চাপছিলেন, তাই ঝুঁকি নিতে গিয়ে উইলিস-এর বলে চৌহান গেলেন (৮০) – ভারত ২১৩/১, আরো ২২৫ রান চাই, হাতে আছে ন’টা উইকেট আর তিনটে ঘন্টা যার মধ্যে শেষ ঘন্টায় ‘বাধ্যতামূলক’ ২০ ওভার।
এই সময়ে এগিয়ে এলেন গাভাস্কর – ‘ভি’-এর মধ্যে খেলে, কভার থেকে মিড-উইকেট এই অঞ্চল দিয়ে মূলত ড্রাইভ-শটগুলোর মাধ্যমে ইংরেজ বোলিংয়ের ওপর আক্রমণ চালাতে লাগলেন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্তে রেখে প্রয়োজনীয় গতিতে ইনিংসটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখছিলেন। উল্টোদিকে ভেঙ্গসরকার যথাযথ সহায়তা করছিলেন। মনে হচ্ছিল ৪৩৮ হয়ে যেতেই পারে। তবে ভেঙ্গসরকার-এর (৫২ রান, ১৩৯ বল, ১৫২ মিনিট) আরেকটু আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করা উচিত, বেতারে ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে অনেক ভারতীয় সমর্থকেরই মনে হচ্ছিল।
ইংল্যান্ডের বোলিং-আক্রমণকে কেমন অসহায় দেখাচ্ছিল, ব্রিয়ারলি এক এক ক’রে স্লিপ-ফিল্ডারদের সরিয়ে দিচ্ছিলেন কভার বা মিড-অফ অঞ্চলে। ভারত মসৃণভাবে ৩০০ ছাড়িয়ে গেল, চা-বিরতির সময় ৩০৪/১, আরো ১৩৪ রান চাই, হাতে আছে ন’টা উইকেট আর দেড়টা ঘন্টা যার মধ্যে শেষ ঘন্টায় ‘বাধ্যতামূলক’ ২০ ওভার। 

এর পরবর্তী আধ ঘন্টায় ব্রিয়ারলি যা করেছিলেন সেটাকে ‘অখেলোয়াড়োচিত’ বলবেন নাকি ‘সুকৌশলী’ বলবেন, তা নিয়ে বিতর্কটা প্রাচীন। তিনি ওভার-রেট ঢিমে ক’রে দিলেন – আধ ঘন্টায় ইংল্যান্ড মাত্র ছ’ওভার বোলিং করল। ঐ সময়টাতে আরো গোটাদুয়েক ওভার হ’লে ভারত হয়ত আরেকটু সুবিধে পেতে পারত।

যখন শেষ ২০ ওভার শুরু হয়, তখন ভারত ৩২৮/১, আরো ১১০ রান চাই, হাতে আছে ন’টা উইকেট – জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে উঠেছে। গাভাস্কর চালিয়ে খেলছেন আর ভেঙ্গসরকার তাঁকে সুযোগ ক’রে দিচ্ছেন – ৪৩৭ রানের পুঁজিও তখন যেন ইংল্যান্ডের কম পড়ছে। দ্বিশতরান পূর্ণ করলেন গাভাস্কর, মাঠে-ঢুকে-ঘিরে-ধরা দর্শকদের সরাতে হ’ল।

শেষ ১২ ওভারে যখন ৭৩ রান বাকি, এডমন্ডস-এর বলে ভেঙ্গসরকার-এর ক্যাচ বথাম ফেলে দিলেও, এক রান বাদেই আরেকটা ক্যাচ ধরে নিলেন। আর এর পরেই ঘটনার মোড় অনিশ্চিতভাবে ঘুরতে শুরু করল। হয়ত এই অনিশ্চয়তার ভাবনা থেকেই ভারতীয় অধিনায়ক ভেঙ্কট ব্যাট করতে পাঠালেন অনভিজ্ঞ কপিল দেব-কে, অভিজ্ঞ বিশ্বনাথ-এর জায়গায়। ভেঙ্কট বোধহয় রানের গতি বাড়াতে চেয়েই ‘মারকুটে’ ব্যাটার নামালেন, কিন্তু তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে কপিল ফিরে গেলেন পরের ওভারেই। এরপরেও অধিনায়ক নামালেন ঐ-সিরিজেই-টেস্ট-অভিষিক্ত যশপাল শর্মা-কে. বিশ্বনাথ তখনও সাজঘরে অপেক্ষমাণ! যদিও তখন ওভার-প্রতি গড়ে সাতের কাছাকাছি রান দরকার ছিল, সানি ও ভিশি একসঙ্গে খেললে হয়ত সেটাও হয়ে যেত। কিন্তু …
যাহোক যশপাল লেগে থাকলেন আর গাভাস্কর লক্ষ্যের দিকে নজর রেখে চালাতে থাকলেন। যখন আট ওভারে ৪৯ রান বাকি, শেষ বাজি হিসেবে ব্রিয়ারলি নিয়ে এলেন বথাম-কে। সেই ওভার শুরু হওয়ার আগে ক্লান্ত গাভাস্কর একটা জলপানের বিরতি নেন: “It may have been his first mistake of the day. It allowed England a few vital moments to gather their thoughts and might just have broken his concentration.”, লিখেছিলেন “The Cricketer” পত্রিকার বিখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক জন উডকক। কে জানত যে সেই ওভারেই মিড-অনে ডেভিড গাওয়ার-এর হাতে ক্যাচ দিয়ে গাভাস্কর ফিরে যাবেন (২২১ রান, ৪৪৩ বল, ৪৯০ মিনিট) এক মহাকাব্যিক ইনিংস শেষে!
অবশেষে ভিশি নামলেন, দু’টো চারও মারলেন – কিন্তু ব্রিয়ারলি-র হাতে এক ‘সন্দেহজনক’ ক্যাচে তিনিও ফিরলেন। বথাম তখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছেন, অনভিজ্ঞ যজুর্বিন্দ্র সিং-কে তিনি ফেরত পাঠালেন ২৭ রান বাকি থাকতে। ঘাভরি-র ব্যাটের হাত উন্নততর হলেও এবার নামলেন অধিনায়ক ভেঙ্কট নিজে, কিন্তু তাঁকে বথাম রান-আউট ক’রে দিলেন আর যশপাল-কে ফেরালেন এলবিডব্ল্যু ক’রে। গুরুত্বপূর্ণ সেই শেষ লগ্নে একটা রান-আউট আর চার ওভারে ১৫ রান দিয়ে তিনটে উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচটা ঘুরিয়ে দেন তিনি – মনে রাখতে হবে যে চৌহান ও ভেঙ্গসরকার এঁদের ক্যাচ দু’টোও তিনিই ধরেছিলেন!
আট উইকেট হারিয়ে ম্যাচটার তখন এমন পরিস্থিতি যে চাররকম সম্ভাব্য ফলের যেকোনও একটা হতে পারে। সাজঘরে ব্যাটে-নড়বড়ে বেদি আর সঙ্গে ঐ-সিরিজেই-টেস্ট-অভিষিক্ত উইকেটরক্ষক ভরত রেড্ডি, এই অবস্থায় সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া ঘাভরি-রও বোধহয় আর কোনও পথ ছিলনা। শেষ ওভারে ১৫ রান চাই এই অবস্থায় আর ঝুঁকি না নিয়ে ভারত যোগ করল ছ’টা রান, ৪২৯/৮ দিয়ে শেষ হ’ল। আরও ন’টা রানের জন্য অধরা রয়ে গেল এমন এক কীর্তি যা হয়ত সাড়ে-চার দশক বাদেও আজ অবধি বিশ্ব-রেকর্ড হয়ে থাকত!

ভেঙ্কট-এর ভুল বা বথাম-এর বাহাদুরি না হ’লে (তবে কেমন হ’ত)

ব্যাটিং-ক্রম নিয়ে ভেঙ্কট ঐ তিনটে ‘ভুল’ বা শেষ ঘন্টায় বথাম অমন ‘বাহাদুরি’ না করলে বোধহয়:

  • ভারত একটা বিশ্ব-রেকর্ডের অধিকারী হ’ত।
  • সানি-র ইনিংসটা সর্বকালের সেরা তিন (নিদেনপক্ষে পাঁচ) টেস্ট-ইনিংসগুলোর মধ্যে জায়গা পেত।
  • অধিনায়ক ব্রিয়ারলি-র সঙ্গে অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড-এর ‘নির্বুদ্ধিতা’-র তুলনা চলত।
  • ভেঙ্কট হয়ত অন্তত আরো দুয়েকটা সিরিজে ভারতের অধিনায়ক থাকতেন।

দ্রুত রান তাড়া করতে কপিল-কে আগেভাগে ব্যাট করতে পাঠিয়ে ভেঙ্কট কি ১৯৭৮-৭৯ মরশুমের করাচি-টেস্টের শেষদিনে পাক-অধিনায়ক মুস্তাক মহম্মদের ‘চাল’ অনুকরণ করতে গেছিলেন? নিয়মিত কাউন্টি-ক্রিকেট-খেলা এবং রান-তাড়া-করতে-অভিজ্ঞ ইমরান খান-এর সঙ্গে তৎকালীন ‘অনভিজ্ঞ’ কপিল-এর এমন সমতার আশা নিয়ে যদি ভেঙ্কট সেই চেষ্টা করে থাকেন, সেটা বোধহয় খুব ক্রিকেটীয় যুক্তিসঙ্গত ছিলনা।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে যে “The Art of Captaincy” বইতে ব্রিয়ারলি লিখেছেন যে ঐ ব্যাটিং-ক্রম বদলানোটা যে একটা ভুল হয়েছিল এটা কেবলমাত্র ওঁর নিজের মনগড়া আন্দাজ নয়। আর পরবর্তীকালে যজুর্বিন্দ্র বলেছেন: “Venkat panicked. There were five of us padded up and none of us knew which of us was next in.”

সানি ও বথাম সংবাদ – মাঠের বাইরে

ম্যাচের শেষে স্মারক হিসেবে বথাম নাকি দু’টো স্টাম্প তুলে নিয়েছিলেন, একটা নিজের জন্য আর অন্যটা? সেটা সানি-র জন্য, যিনি সর্বকালের সেরা টেস্ট-ইনিংসগুলোর অন্যতম একটা ইনিংস সেদিন খেলেছিলেন!

ম্যাচের আগে এক সকালে বথাম নাকি সানি-কে বলেন, “আমি গতরাতে স্বপ্নে জানলাম যে আমাদের দু’জনের মধ্যে একজন ম্যাচের শেষ দিনে একটা দ্বিশতরান করবে!” – সানি নাকি সে কথায় বিশেষ পাত্তা দেননি। ঐ দ্বিশতরানের ইনিংসটার জন্য তিনিই ম্যাচের-সেরা নির্বাচিত হবেন, এটা যদি উনি তখন জানতেন!

চিত্রসূত্র

লেখকের ব্যক্তিগত পুস্তক-সংগ্রহ” ও “ইন্টারনেট”

 

কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", ২০২৪ সালে এসেছে “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে। সাম্প্রতিককালে ক্রিকেট-সম্বন্ধীয় বাংলা YouTube ভিডিও-চ্যানেল “উইলোর উইল”-এর কথকের ভূমিকাও পালন করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *