বহুমুখী জয়ন্ত নারলিকার

বহুমুখী জয়ন্ত নারলিকার

পুনেতে “মারাঠি বিদ্বান পরিষদ”-এর কথা অনেকেই জানেন। মহারাষ্ট্রের এই জনপ্রিয় সংগঠনটি মারাঠি ভাষায় বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই সংগঠন একবার মারাঠি ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। ২০০০ শব্দের মধ্যে লিখতে হবে আর যে কোনও সাধারণ মানুষ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। সেরা কল্পবিজ্ঞান গল্প লেখককে পুরস্কৃত করা হবে। অনেক লেখার সাথে এক নবীন লেখকের গল্প জমা পড়েছে। গল্পের নাম ‘কৃষ্ণ বিবর’ অর্থাৎ ইংরেজিতে ব্ল্যাক হোল। ওই লেখকের এটাই প্রথম লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্প। লেখকের নাম নারায়ণ বিনায়ক জগতাপ (Narayan Vinayak Jagtap)। একেবারেই নতুন লেখক, কারণ এঁর নাম আগে কোথাও শোনা যায়নি। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে বিচারকমণ্ডলী সেরা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি হিসেবে নির্বাচিত করলেন ‘কৃষ্ণ বিবর’- কে। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি সেই লেখককে আরও কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখতে আত্মবিশ্বাস যোগাল। এই গল্পটি পড়ে সেই সময় নামকরা মারাঠি লেখিকা তথা মারাঠি সাহিত্য সম্মেলন-এর সভাপতি দুর্গা ভাগবত ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন যে মারাঠি ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের মতো নতুন নতুন ভাবনার কাহিনি মারাঠি সাহিত্যের জন্য খুব উৎসাহ ব্যঞ্জক ব্যাপার। এই প্রশংসা লেখককে আরও উৎসাহিত করে তুলল। এরপর তিনি একের পর এক কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখে চললেন। শুধু মারাঠি ভাষাতেই নয় লিখলেন ইংরেজি ভাষাতেও কল্পবিজ্ঞানের বই। লিখে চললেন উপন্যাস এবং ছোট গল্প ইংরেজি, হিন্দি এবং মারাঠি ভাষাতে। বই হিসেবেও সেসব প্রকাশিত হল। আর সেই লেখক ২০১৪ সালে মারাঠি ভাষায় লেখা তাঁর আত্মজীবনী ‘চার নগরান্তলে মাজে বিশ্ব’ -এর জন্য পেলেন সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার। নিশ্চয়ই তিনি একজন নামকরা সাহিত্যিক। কিন্তু নারায়ণ বিনায়ক জগতাপ নামে সত্যি কোন‌ও সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক আছে নাকি? না, এই নাম আসলে জগৎ বিখ্যাত ভারতীয় জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী (Astrophysicist) জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর। প্রতিযোগিতায় তিনি ছদ্মনামে লিখেছিলেন। কেন? আসলে তিনি যখন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন স্থির করেন তখন তিনি ভারত তো বটেই বিশ্বের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী। সুতরাং স্বনামে লিখলে বিচারকমণ্ডলী নাম দেখে প্রভাবিত হতে পারেন ভেবে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। লক্ষণীয়, তাঁর ছদ্মনামের তিনটি শব্দের আদ্যক্ষর তাঁর আসল নামের তিনটি শব্দের আদ্যক্ষরের ঠিক বিপরীত – নারায়ণ বিনায়ক জগতাপ (NVJ) আর জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর (JVN)। তাঁর নাম ও পদবির মাঝে থাকা মধ্যনাম ‘বিষ্ণু’ আসলে তাঁর প্রচলিত মারাঠা রীতিতে বাবার নাম। পাছে তাঁর হাতের লেখা বিচারকমণ্ডলী চিনে যান সে জন্য প্রতিযোগিতার গল্পটি তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ ড. মঙ্গলা নারলিকরকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তাঁর নিজের বাড়ির ঠিকানাও দেননি পাছে সবাই বুঝতে পারেন। জয়ন্ত নারলিকরের বহুমুখী প্রতিভার এ হল মাত্র একটি নিদর্শন।

এক সাক্ষাৎকারে বিজ্ঞানী নারলিকর বলেন যে তাঁর সমস্ত কল্পবিজ্ঞানের বইয়ের মধ্যে সেরা হল মারাঠি ভাষায় লেখা “উজাভ্য সন্দেচা গণপতি”, যার অর্থ হল ডান দিকে শুঁড়যুক্ত গণেশ। এমনিতেই গণেশের শুঁড় সবসময় বাম দিকে থাকে। কাহিনির মূল উপজীব্য হল এমন একটি মেশিন যা কেউ ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে তার ডান দিক ও বাম দিক বদলা বদলি করে দেয়। কাহিনি শুরু করেছেন তিনি ক্রিকেটের একটি ঘটনা দিয়ে। একজন বোলারকে তার দেশ জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই ওই বোলারের পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছিল না। সব সময় ডান হাতে বল করলেও বোলারটি স্থির করল জীবনের শেষ ম্যাচটিতে সে বাম হাতে বল করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা তার বোলিং বুঝতেই পারল না। ফলে ঝটপট সবাই আউট হয়ে গেল। আর তার ফলে তার বোলিংয়েই তার দেশ টেস্ট ম্যাচ জিতে গেল।

ক্রিকেট খেলার কথা যখন এসেই গেল তখন জয়ন্ত নারলিকরের ক্রিকেটপ্রীতির কথা কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি অসম্ভব ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন। চল্লিশের দশকে তিনি যখন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই তিনি ক্রিকেট খেলার ভক্ত। নিজেও সুযোগ পেলে ক্রিকেট খেলেছেন। তাঁর নিজস্ব ব্লগে ক্রিকেট প্রেমের কথা বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন। সেসব থেকে দু’একটি নমুনা পেশ করা যাক। তিনি ১৯৫৯ সালের জুন ও আগস্ট মাস জুড়ে ইংল্যান্ডে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সফরে একটি টেস্ট ম্যাচের কথা স্মরণ করেছেন। সেই ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন দত্তা গায়কোয়াড়, যিনি প্রাক্তন ভারতীয় ওপেনার অংশুমান গায়কোয়াড়ের বাবা। বিপক্ষে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ছিলেন পিটার মে। নারলিকর লর্ডসে জুনের ১৮ তারিখ থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের খেলা দেখতে যেতে মনস্থ করেন। তিনি তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। নটিংহ্যামে আয়োজিত প্রথম টেস্টে ইতিমধ্যে ভারত ইংল্যান্ডের কাছে হেরে ১-০ তে পিছিয়ে পড়েছে। লর্ডস টেস্টে প্রথম দিনের খেলায় ভারত ১৬৮ রানে সবাই আউট হয়ে যাওয়ার পর ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নেমে তিন উইকেট হারিয়ে ৫০ রান করেছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা ট্রেন-পথ পেরিয়ে খেলা শুরু হওয়ার আগেই তিনি লর্ডসে পৌঁছে গেলেন কিন্তু কাউন্টারে কোনও টিকিট পেলেন না। স্বভাবতই আশাহত হয়ে পড়লেন নারলিকর, কিন্তু হাল ছাড়লেন না। তিনি এগিয়ে গেলেন লন্ডন মেট্রোপলিটনের একজন পুলিশের কাছে। কোনও টিকিট পাওয়া যাবে কিনা বা কোথায় গেলে পাওয়া যাবে জানতে চাইলেন। নারলিকরকে চূড়ান্ত বিস্মিত করে সেই পুলিশটি একটা খাম তুলে দিলেন নারলিকরের হাতে। খাম খুলে দেখে তো নারলিকর অবাক। ভেতরে রয়েছে বিনামূল্যে মাঠে ঢুকে খেলা দেখার একটি টিকিট। জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলেন যে কোনও এক ভদ্রলোক ওইদিন মাঠে আসতে পারবেন না বলে তাঁর টিকিটটি ওই পুলিশকর্মীর হাতে দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন যে যদি কোনও ভারতীয় ছাত্র খেলা দেখতে আসে তাঁকে যেন তিনি সেটি দিয়ে দেন। মাঠের বাইরে থাকা অনেক পুলিশকর্মীর মধ্যে যাঁর কাছে গিয়ে নারলিকর সাহায্য চাইলেন একমাত্র তাঁর কাছেই ছিল ওই টিকিটটি। পুরো ঘটনাটিকে কাকতালীয় ছাড়া আর কীইবা বলা যায়! তিনি লিখেছেন, ওই টেস্টে আট উইকেটে ইংল্যান্ড জিতে গিয়েছিল। প্রতিটা দলের রান, ব্যাটসম্যানদের রান সব তাঁর স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে রয়েছে। এ থেকে শুধু তাঁর প্রবল স্মৃতিশক্তিই নয়, ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্র‌হও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আর এক জায়গায় তিনি ১৯৬৫ সালের ৮ জুলাই থেকে লিডসে শুরু হওয়া নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের তৃতীয় টেস্টের একটি দুর্দান্ত ঘটনার কথা স্মরণ করেছেন। ওই সময় নারলিকর লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বন্ধু কুমার চিত্রের আমন্ত্রণে তাঁর বক্তৃতা শুনতে গিয়েছেন। কিন্তু দুই বন্ধু পরিকল্পনা করলেন যে ৮ জুলাই তাঁরা মাঠে গিয়ে খেলা দেখবেন। কিন্তু সমস্যা হল ওইদিনই কুমার চিত্রের বক্তৃতা রয়েছে। নির্ধারিত বক্তৃতা কীভাবে বাতিল করবেন? অগত্যা তিনি লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর টি জি কাউলিং-এর কাছে গিয়ে দরবার করলেন বক্তৃতার দিন পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু কাউলিং কড়া ধাতের মানুষ। প্রথমে তো কিছুতেই তাঁদের অনুরোধ মঞ্জুর করবেন না। অনেক অনুরোধের পর অবশ্য মঞ্জুর হয়েছিল। তারপর দুই বন্ধু মাঠে গেলেন খেলা দেখতে। কিন্তু হঠাৎ তাঁদের নজরে পড়ল তাঁদের থেকে দুটো সারি সামনে দর্শকাসনে বসে রয়েছেন প্রফেসর কাউলিং আর তিনি ইংল্যান্ডের প্লেয়ারদের সমানে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করে চলেছেন! (https://www.jvnarlikar.blog/p/my-flirtations-with-cricket)

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চলাকালীন সময়ে ক্রিকেট নিয়ে তাঁর আরও একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনি উল্লেখ করেছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমসাময়িক ভারতীয় গবেষক ছাত্ররা মিলে একটি ক্রিকেট দল তৈরি করেছিলেন। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন তাঁর বন্ধু কুমার চিত্রে। তিনি করতেন স্পিন বোলিং। আর নারলিকর লেগ ব্রেক বল করতেন। তাঁরা প্রায়শই বিভিন্ন দলের সাথে প্রীতি ম্যাচ খেলতেন। তবে পাকিস্তানের ছাত্রদলের সাথে খেলা ছিল সবথেকে উত্তেজনাপূর্ণ। চার্চিল কলেজ ময়দানে ভারত ও পাকিস্তানের গবেষক ক্রিকেট দলের ম্যাচ হতে চলেছে। কিন্তু সেই দলে পাকিস্তানের একজন খেলোয়াড় কম পড়েছে। তাহলে ম্যাচ হবে কী করে? যেহেতু প্রীতি ম্যাচ তাই নারলিকর তাঁর ব্রিটিশ সহকর্মী বন্ধু জন ফকনারকে পাকিস্তানের হয়ে খেলতে অনুরোধ করলেন। ফকনার সম্মত হতেই খেলা হল, কিন্তু সেই ম্যাচে ফকনারের দুর্দান্ত পারফরমেন্সই হারিয়ে দিল ভারতকে। বহু বছর পরেও নারলিকর এ দুঃখ ভুলতে পারেননি।

সমাজ থেকে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞান দূর করে এক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তুলতে নারলিকর ছিলেন সদা সচেষ্ট। আর বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য তাঁর ভূমিকাও ছিল প্রশ্নাতীত। জ্যোতিষবিদ্যার বিপক্ষে তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ কলম ও কন্ঠস্বর বার বার গর্জে উঠেছে। তিনি সবসময় মুক্তমন ও যুক্তিবাদের সপক্ষে থেকেছেন। ‘ন্যায়’ ও ‘সমতা’  শব্দগুলো নিছক পুঁথিগত কোনও শব্দ নয়, তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে এই দুটি শব্দের যথার্থতা বার বার প্রতিভাত হয়েছে। তিনি শিক্ষিত ও শহুরে মানুষদের মধ্যে জ্যোতিষবিদ্যার ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে খুব চিন্তিত ছিলেন। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে তাঁর চিন্তা আরও বেড়েছে কারণ যুবক-যুবতীরাও জ্য্যোতিষবিদ্যায় দিন দিন প্রবলভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। তিনি আহ্বান করেন যে সবার জ্যোতিষবিদ্যাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা ও যুক্তি দিয়ে বিচার করা উচিত। তিনি বলেন যে সামাজিক মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন না হলে ভারতে বৈজ্ঞানিক মেজাজ (Scientific Temper) গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে নারলিকর তাঁর “Scientific Edge” বইতে রাজা রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলনের কথা শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করে বলেছেন যে তিনি বুঝেছিলেন বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা এবং সামাজিক মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন ব্যতীত সামাজিক উন্নতি কখনওই সম্ভব নয়। ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব নিয়েও তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁর মতে, ধর্ম ও বিজ্ঞান কখনওই যেন তার সীমা অতিক্রম না করে অন্যের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে। তবে ধর্মকে যেমন বিজ্ঞানের নানা বিষয় গ্রহণ করতে হবে তেমনই বিজ্ঞানকেও বিনম্র হতে হবে। বিজ্ঞানকে মনে রাখতে হবে যে এখনও জাগতিক বহু বিষয়ের ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়নি।

জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর

 

মহারাষ্ট্রে কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ নরেন্দ্র দাভোলকার-সহ এম এম কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসারে, গৌরি লঙ্কেশ প্রমুখ যুক্তিবাদী মানুষের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, কুসংস্কার, অসহিষ্ণুতা এবং যুক্তিবাদীদের ওপর আক্রমণের মোকাবিলা করতে হলে দেশবাসীর মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। আর এজন্য নিবিড় প্রচার চালাতে হবে। তাঁর মতে, প্রাচীনকাল থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা সংস্কার আমাদের মনের মধ্যে শেকড় গেঁথে রয়েছে। আমাদের মনের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদ প্রবেশ করার ক্ষেত্রে এগুলোই প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। আমাদের মজ্জাগত অন্তর্নিহিত সংস্কারকে ডিঙিয়ে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি যদি গড়ে তুলতে না পারি তবে সমাজের প্রগতি কখনওই সম্ভব নয়। তবে ভারতবর্ষে কাজটা যে খুবই কঠিন তা তিনিও মনে করতেন। তিনি বলেছেন, বয়স্ক মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী চেতনা জাগ্রত করা মুশকিল। আর এজন্য নারলিকর স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদী চেতনা গড়ে তুলতে আহ্বান করেছেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে দেশ যখন স্বাধীন হয়নি তখন জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন দেশের কল্যাণ করতে হলে মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মেজাজ (Scientific Temper) গড়ে তুলতেই হবে। নারলিকরও বিশ্বাস করতেন যে দেশের জনগণের উন্নতির জন্য এছাড়া অন্য কোনও পথ নেই, যদিও এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা সেই লক্ষ্য থেকে বহু দূরে পড়ে রয়েছি। তিনি প্রায়শই একটা কথা বলতেন – “বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমাদের কুসংস্কারগুলো মানতে বাধ্য নয়, কিন্তু আমরা একে (বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে) সততার সাথে বুঝতে বাধ্য।” (The universe is not obliged to follow our prejudices. But we are obliged to understand it honestly.)

জয়ন্ত নারলিকর কিন্তু কেবল তাত্ত্বিক আলোচনায় বা লেখালেখিতে যুক্তিবাদের বিকাশ বিষয়ে তাঁর ভাবনাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, রীতিমতো হাতেকলমে পরীক্ষা করে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছেন। তেমনই একটি পরীক্ষার কথা জানতে পারা যায় তাঁর এক সাক্ষাৎকার থেকে। জ্যোতিষবিদ্যা যে ভণ্ডামির নামান্তর তা প্রমাণ করার জন্য ১০০ টি মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চার জন্মকোষ্ঠী এবং অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন ১০০ টি বাচ্চার জন্মকোষ্ঠী সংগ্রহ করেন এবং সেগুলিকে একসঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তার মধ্যে থেকে ৪০টি করে জন্মকোষ্ঠী র‍্যানডম তুলে নিয়ে দুটি গ্রুপ তৈরি করেন। এদিকে ৫০ জন জ্যোতিষীকে আহ্বান করা হয় এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য। শেষমেশ ৩০ জন অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেককে যে কোনও একটি গ্রুপের ৪০ টি জন্মকোষ্ঠী বিশ্লেষণ করে বলতে বলা হয় যে সেগুলোর মধ্যে কোন কোন জন্মকোষ্ঠী মানসিক প্রতিবন্ধী ও বুদ্ধিসম্পন্ন বাচ্চার তা জানাতে হবে। নারলিকর বলেন যে ৪০ টির মধ্যে ২৮ টি সঠিক বললে সংখ্যাতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী তা তাৎপর্যপূর্ণ হত। কিন্তু কোনও জ্যোতিষী ১৮-২০ টির বেশি সঠিক বলতে পারেননি। নারলিকর বলেন, শুধু ওই পরীক্ষাই নয়, আরও নানা পরীক্ষার মাধ্যমে জ্যোতিষবিদ্যার অসারতা প্রমাণ করা দরকার। তাঁর প্রস্তাব ছিল, প্রতিটি বিদ্যালয়ে সপ্তাহে অন্ততঃ একটি পিরিয়ড কুসংস্কার দূরীকরণের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ করা দরকার। ওই ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা মন খুলে নানা কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা করবে, প্রশ্ন করবে, উত্তরও বলবে। কিন্তু এই অভাগা দেশে নারলিকরের সেই ভাবনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা আজও সুদূর পরাহত।  

স্কুলের কথা যখন এল তখন জয়ন্ত নারলিকরের শৈশব ও স্কুলজীবনের কথা কিছু বলতেই হয়। ১৯৩৮ সালের ১৯ জুলাই মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে এক অতি উচ্চশিক্ষিত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকর ছিলেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধানও। মা সুমতি নারলিকরও ছিলেন বিদুষী মহিলা। সংস্কৃতে ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। ফলে বাবা ও মা উভয়ের দিক থেকে তিনি আশৈশব পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তাঁর মামাও ছিলেন একজন নামী গণিতজ্ঞ। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যাল থেকে গণিতে স্নাতক হওয়ার পর তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য দু’বছর জয়ন্তদের কোয়ার্টারে ছিলেন। ছোট্টো জয়ন্ত তাঁকে “মোরু মামা” বলে ডাকতেন কারণ তাঁর নাম ছিল মোরেশ্বর। তিনি ছোট্টো জয়ন্তের সাথে অঙ্কের মজার খেলা খেলতেন। বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো বোর্ডে তিনি প্রায়ই জয়ন্তের জন্য একটা অঙ্ক লিখে বলতেন যে যদি জয়ন্ত সমাধান করতে পারে তো জয়ন্ত জিতবে, আর না পারলে তিনি জিতবেন। ছোট্টো জয়ন্ত এই চ্যালেঞ্জ নিতেন এবং ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে সমাধান করে দিতেন।

বাবা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ‌ওয়ায় তাঁরা সপরিবারে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত কোয়ার্টারে থাকতেন। ফলে তাঁর বাবার কাছে প্রায়শই অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের আনাগোনা থাকত। তাঁদের সাথে ছোট্ট জয়ন্তের কখনো কখনো গল্প গুজব হত, কখনো কখনো তাঁরা জয়ন্তকে অঙ্ক বিষয়ে নানা গল্প শোনাতেন, কখনো কখনো মজার অঙ্কের সমাধান করতে বলতেন। এভাবেই ছোট্ট জয়ন্ত বিশেষ করে গণিত শিক্ষার একটা চমৎকার পরিমণ্ডল পেয়েছিলেন। আর তাই তিনি বেনারসের সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজের স্কুলে পাঠ শেষ করে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি পাড়ি দেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেমব্রিজের প্রতি জয়ন্ত  নারলিকরের আগ্রহ ছিল বরাবর কারণ তাঁর বাবাও ওই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতক হয়েছিলেন। তাঁর বাবা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন যে কলেজে পড়েছিলেন জয়ন্তও সেই ফিৎজউইলিয়াম কলেজে ভর্তি হন।

এখান থেকে জয়ন্ত ১৯৫৯ সালে গণিতে ট্রাইপোস হন। এই ডিগ্রির জন্য তিনটি ভাগ রয়েছে। একটি হল পিওর গণিত, আরেকটি হল অ্যাপ্লায়েড গণিত। তৃতীয় ভাগে পছন্দসই বিষয় নির্বাচন করা যেত। এই বিভাগে জয়ন্ত পছন্দ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞান। কারণ কেমব্রিজে পড়ার সময় তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল-এর কয়েকটি বক্তৃতা শুনে প্রবল ভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ফলে তিনি ফ্রেড হোয়েলের লেখা জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত বই ছাড়াও লাইব্রেরিতে গিয়ে এই বিষয়ে নানা বই পড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি নিজের আগ্রহ আর‌ও বাড়িয়ে তোলেন। তৃতীয় বিভাগে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে সর্বাধিক নম্বর প্রাপককে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাইসন মেডেল দেওয়া হত। জয়ন্ত নারলিকর সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এই মেডেল অর্জন করেন। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হল যে জয়ন্তর পিতা বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকরও কেমব্রিজে টাইসন মেডেল অর্জন করেছিলেন। পিতা ও পুত্রের এই পদক অর্জনের ঘটনা এখন‌ও দ্বিতীয়টি আর নেই। 

জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল-
জয়ন্তর পিতা বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকর

ট্রাইপোস ডিগ্রি অর্জনের পর ফ্রেড হোয়েলকে দ্রোণাচার্যের মতো গুরু মেনে আসা জয়ন্ত নারলিকর এবার তাঁর কাছেই গবেষণা শুরু করলেন। ১৯৬৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করার পরের বছর তিনি কিংস কলেজ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে অতিরিক্ত একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৬ সালে ফ্রেড হোয়েল কেমব্রিজে ইনস্টিটিউট অফ থিয়োরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি প্রতিষ্ঠা করলে জয়ন্ত নারলিকর প্রথম থেকেই সদস্য হিসেবে সেখানে যোগদান করেন। আর এভাবেই ফ্রেড হোয়েলের সাথে যৌথ গবেষণার মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুনিয়াকে আলোড়িত করা এক নতুন তত্ত্ব হাজির করেন যা “হোয়েল-নারলিকার তত্ত্ব” নামে পরিচিত।

কী এই “হোয়েল-নারলিকার তত্ত্ব”? এক কথায় বলা যায় এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ হিসেবে যে “বিগ ব্যাং তত্ত্ব” বেশিরভাগ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেনে নিয়েছেন “হোয়েল-নারলিকর তত্ত্ব” হল তার বিকল্প তত্ত্ব। বিগ ব্যাং তত্ত্বে বলা হয় প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি অতি ক্ষুদ্র, উত্তপ্ত ও ঘন বিন্দু থেকে প্রবল বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে। নারলিকরের মতে, যদি তাই-ই হয় তাহলে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ক্রমশঃ কমে যাওয়ার কথা কারণ কোনো বস্তু যদি প্রসারিত হয় তাহলে তার ঘনত্ব কমতে বাধ্য। তাহলে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর ধরে এই মহাবিশ্বের ঘনত্ব একই রয়েছে কী করে? আর তাহলে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের নক্ষত্রগুলোকেও আমরা দেখতে পাচ্ছি কী করে? হোয়েল-নারলিকার তত্ত্বে বলা হয়েছে এই মহাবিশ্ব একটি ধারাবাহিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রসারিত হচ্ছে। এটা হল “Steady state of universe”। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে মহাবিশ্বের ঘনত্ব অপরিবর্তনীয় যদিও মহাবিশ্ব কিন্তু প্রসারণশীল। সেটা কীভাবে সম্ভব? এই তত্ত্বে বলা হয়েছে মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার জন্য যতটুকু ঘনত্ব ক্রমশঃ কমছে সেই হারে মহাবিশ্বে নতুন বস্তু তৈরি হয়ে সংযোজিত হয়ে চলেছে। আর তার ফলে মহাবিশ্বের ঘনত্ব অপরিবর্তনীয়। তাই আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগেকার নক্ষত্রগুলোকেও এখনও দেখতে পাই। যদিও এই তত্ত্ব বিশ্বের সিংহভাগ জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্রহণ করেননি।

কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রেও জয়ন্ত নারলিকরের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁকে বলা হয় স্ব-মহাকর্ষীয় তন্ত্রের (Self-gravitating system) প্রবক্তা। এই তত্ত্বের মূল কথা হল মহাকর্ষীয় বিভিন্ন বস্তুর মধ্যেকার মহাকর্ষীয় বল এতটাই শক্তিশালী যে মহাকর্ষীয় তন্ত্রের (Gravitation system) বস্তুগুলোকে এক জায়গায় ধরে রেখেছে এবং পরস্পর থেকে সরে যেতে বাধা দিচ্ছে। ছায়াপথের সক্রিয় কেন্দ্রকের (Active Galactic Nuclei = AGN) উপরেও জয়ন্ত নারলিকরের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে। ছায়াপথের কেন্দ্র অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল হওয়ার কারণ সেখানে রয়েছে বিশালাকার কৃষ্ণগহ্বর, আর তা সক্রিয়ভাবেই বস্তু উৎপাদন করে চলেছে। তাঁর “ম্যাগনেটিক ফিল্ড ইজেকশন মডেল” জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে তীব্র চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে ছায়াপথ থেকে কোয়াসার ও অন্যান্য ঘনবস্তুগুলি বাইরে পরিত্যক্ত হয়। আর তার ফলে ছায়াপথ লাল রঙ বিকিরণ করতে থাকে। পরবর্তীকালে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ISRO) উদ্যোগে জন্মসূত্রে শ্রীলঙ্কার গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্জীববিজ্ঞানী নলিন চন্দ্র বিক্রমসিংঘের সাথে যৌথ গবেষণায় নারলিকর অধিক উচ্চতায় বেলুন উড়িয়ে জীবের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। তাঁরা পৃথিবীর ৪১ কিলোমিটার উপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে তিন প্রকার জীবাণুর সন্ধান পেয়েছিলেন। এই জীবাণু হল তিন প্রকার ব্যাকটেরিয়া। এদের মধ্যে একটির নাম দেওয়া হয় ISRO-র নামে – ব্যাসিলাস ইসরোনেনসিস (Bacillus isronensis)।  জয়ন্ত নারলিকরের এইসব কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রয়েছে।

ইংল্যান্ডে জয়ন্ত নারলিকরের কর্মকাণ্ড আমাদের দেশের অগোচরে যে ছিল না তার প্রমাণ ১৯৬৫ সালে তিনি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান পদ্মভূষণ লাভ করলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র ২৭ বছর। এ এক অনন্য নজির! জয়ন্ত বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন যে দেশে ফিরে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে তাঁর জন্য উপযুক্ত জায়গা হতে পারে টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR)। পরমাণু বিজ্ঞানী হোমি জাহাঙ্গির ভাবার উদ্যোগে এবং শিল্পপতি জে আর ডি টাটার অর্থানুকূল্যে ১৯৪৫ সালে মুম্বাইতে ভারতের প্রথম পরমাণু শক্তি প্রকল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থাপিত হয় TIFR। আর ১৯৭২ সালের মধ্যে TIFR বিশ্বের অন্যতম অগ্রণী পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সুতরাং গবেষণার জন্য নারলিকরের প্রথম পছন্দ ছিল TIFR। ১৯৭২ সালে তিনি দেশে ফিরে TIFR-এ যোগ দিলেন। তাঁর ভাবনা ছিল TIFR-এ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ গড়ে তুলবেন। বিদেশে সহজলভ্য অনেক বিষয় এখানে সেই সময় সহজলভ্য না হলেও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল। তাঁর হাতে তৈরি হলেন দেশের এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিবান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৮৮ সালে তাঁর হাতে তৈরি জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা সংস্থা Inter-University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA) বর্তমানে কেবল ভারতের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি বিশ্বের দরবারেও অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় টেলিস্কোপের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সুযোগ নেই। উন্নত টেলিস্কোপ যেমন অত্যন্ত দামী তেমনই অনেক ক্ষেত্রে তার অনিয়মিত বা ভুলভাল ব্যবহারে তা নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে পুনেতে অবস্থিত এই IUCAA-তে দেশের নানা প্রান্তের জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষকরা এখানে উন্নত টেলিস্কোপ ব্যবহারের সুযোগ পেতে পারে। তাছাড়া এখানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে তথ্য সরবরাহ ও আদানপ্রদান করতে পারে এবং গবেষণা করতে পারে। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আসল স্থপতি হলেন জয়ন্ত নারলিকর।  আর এরই স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। এছাড়া Astronomical Society of India তাঁকে গোবিন্দ স্বরূপ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দিয়েও সম্মানিত করে।

বিজ্ঞানীরা সাধারণতঃ সবসময় খুব আত্মকেন্দ্রিক, গুরুগম্ভীর ও চিন্তাশীল থাকেন বলে আমাদের ধারণা। জয়ন্ত নারলিকর কিন্তু নানা ক্ষেত্রের মানুষের সাথে মিশতে পারতেন, চুটিয়ে গল্পগুজব করতে পারতেন। তাঁর সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক কাউকেই তিনি ফেরাতেন না। ব্যস্ত থাকলে পরে দেখা করার সময় বলে দিতেন কিন্তু কাউকে হতাশ করতেন না। আর সুযোগ পেলেই বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা করতে ছাড়তেন না। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডি জে সইকিয়ার সাথে একবার সস্ত্রীক জয়ন্ত নারলিকর দেখা করে বিদায় নেওয়ার সময় তাঁকে রামায়ণের গল্প অবলম্বনে বলেন – রামরাজ্যে একদিন একটা কুকুর এসে রাজা রামচন্দ্রের কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলল যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক সাধু তাকে নাকি অকারণে লাথি মেরেছে। রামচন্দ্র সাধুকে ডেকে পাঠালেন। সাধু স্বীকার করল যে কুকুরের অভিযোগ সত্য, কিন্তু তার লাথি মারার কারণ হল সে অকারণে সকাল থেকে তার পিছু নিয়েছে। সে যে বাড়িতে ভিক্ষা করতে যাচ্ছে সেখানেই কুকুরটি তার পিছু পিছু যাচ্ছে। কুকুরটি দেখতে খুবই কদাকার ও হিংস্র। ফলে তাকে ভিক্ষা দেওয়ার জন্য যখনই কোনও মহিলা দরজা খুলছেন কুকুরটিকে দেখে তাকে ভিক্ষা না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। আর তাই সে সকাল থেকে অভুক্ত রয়েছে। সাধু স্বীকার করল যে ক্ষুধার তাড়নায় রাগে সে কুকুরটিকে লাথি মেরেছে যদিও কুকুরটির সরাসরি কোনও দোষ নেই। আর তাই রাজা তাকে যে শাস্তি দেবেন সে তা মেনে নেবে। এবার রামচন্দ্র কুকুরটিকে বললেন, তুমি সাধুর কী শাস্তি চাও? কুকুরটি বলল, আপনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করুন আর সাধুকে তার উপাচার্য করে দিন! একথা শুনে বিস্মিত রামচন্দ্র বললেন, তুমি কি শাস্তির বদলে সাধুকে পুরস্কার দিতে চাও? তখন কুকুরটি বলল, তা একেবারেই নয়। উপাচার্য হলে সে শিখবে কী করে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হয় আর সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সর্বদা চিন্তিত থাকবে। এটাই চরম শাস্তি! এমন সূক্ষ্ম রসিকতাবোধ কিন্তু খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।

এত বড়ো মাপের বহুমুখী প্রতিভাধর বিজ্ঞানী হয়েও জয়ন্ত নারলিকর কিন্তু শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। দেশের সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞানমুখী ও কুসংস্কারমুক্ত করতে তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়েছিলেন স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে। মারাঠি ভাষার গণিতের স্কুলপাঠ্য বই লেখেন “Ganitachyaa Sopya Vata” এবং ইংরেজিতে লেখেন “An Easy Access to Basic Mathematics”। কল্পবিজ্ঞানের বই লিখেছেন ইংরেজিতে The Return of Vaman, The Adventure এবং The Comet । হিন্দিতে লিখেছেন ‘পার নজর কে’। আর মারাঠি ভাষায় লিখেছেন আটটি বই। এছাড়া তাঁর লেখা অন্যান্য বিজ্ঞানধর্মী ও সাহিত্যধর্মী বইয়ের সংখ্যাও কোনও সাহিত্যিকের চেয়ে কম নয়।

 

জীবন অবিনশ্বর নয়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ভারতের গর্ব জয়ন্ত নারলিকরের ৮৬ বছরের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটেছে গত ২০ মে, ২০২৫। কিন্তু তাঁর তত্ত্ব, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর কাজ, তাঁর পরিকল্পনা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁর স্বপ্ন অবিনশ্বর। আর তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় আমাদের – উত্তর প্রজন্মের।  

যৌবনে বক্তৃতারত
ক্লান্তিবিহীন শিক্ষক
বেড়ে ওঠা, স্কুলের পড়াশুনা কাকদ্বীপে। লেখালেখি,গানবাজনার চর্চা শৈশব থেকেই। ১৯৯২ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বর্তমানে কাকদ্বীপের কাছে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সংগঠক। ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটিকা, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *