জীবনের উপন্যাস

বই: ক্রান্তিকাল
লেখক: প্রফুল্ল রায়
প্রকাশনা: ১৯৯৮, দে‘জ পাবলিশিং
মূল্য: ১৫০ টাকা
‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের’ দেশ আমাদের এই ভারতবর্ষ। ভৌগোলিক দিক থেকেও ভারতবর্ষ যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনই জনগোষ্ঠীর দিক থেকেও বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সামাজিক প্রথা, পোশাক-পরিচ্ছদ সবেতেই রয়েছে বৈচিত্র্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’ ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও যুগ যুগান্তর ধরে ভারতবাসীর স্বপ্ন, আত্মা, যে সূত্রে গাঁথা তা হল আমরা ভারতীয়। বহুবার বহু শতক ধরে এখানে আছড়ে পড়েছে ভিনদেশীয়দের আক্রমণ। শক, হূণ, পাঠান, মোগল, ব্রিটিশদের নিপীড়ন আর অত্যাচারে রক্তে লাল হয়েছে ভারতের মাটি। কিন্তু রক্তেভেজা সেই মাটিতেই লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন দেশে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সাফল্যের মূল মন্ত্র ছিল একতা – ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি।
এই একতা নিরবচ্ছিন্নভাবে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন ‘সাম্য’ নামক যে ফেভিকল, সেটি কিন্তু অধরাই রয়ে গেছে। তাই তো স্বাধীনতার সাতটি দশক পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও দেখা যায় ভারতবর্ষে মাত্র অল্প কিছু অঞ্চল সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। আবার অনেক অঞ্চলই উন্নতির স্রোত থেকে পিছিয়ে আছে বহু যোজন দূরে। বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আজও রয়ে গেছে। এখনও কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য দু’মুঠো ভাত তাদের কাছে আজও কল্পনাতীত। ক্ষমতাশীল স্বার্থপর মানুষ স্বার্থ বুঝে আজ এক পক্ষ কাল আরেক পক্ষকে সমর্থন করে শুধুমাত্র নিজেদের কাজ হাসিল করে নেয়। আর এই রাজনৈতিক রং-তামাশার মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ আরও অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। নেতা, মন্ত্রীদের প্রতিনিয়ত মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, লোক দেখানো শান্তি চুক্তি, আর্থিক অসচ্ছলতা, অসাম্য, দারিদ্র্যের ফলে যুবকসমাজ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের:
লোকালয়ে লুট হচ্ছে নিসর্গ-নিয়ম।
কেউ কিছু বলছে না-
কষ্টবন্দি মানুষেরা যার যার অমূলক স্বপ্নের আঠায় একা একা জড়িয়ে রয়েছে…
(রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ)
এই ‘কষ্টবন্দি মানুষের’ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চোখে নতুন স্বপ্ন দেখা, উত্তর-পূর্বের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী যুবক রাজীব পুলিশের তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়ে ব্রিটিশ আমলের এক নেটিভ স্টেট, প্রতাপপুরের প্রাচীন রাজপ্রাসাদে। সশস্ত্র রাজীবের সামনে পড়ে তার সমস্ত কথা মেনে চলতে বাধ্য হয় সুবর্ণা এবং তার কন্যা দেবী। সুবর্ণার কাছে রাজীব এই প্রাসাদে বেশ কিছুদিন থাকার জন্য আশ্রয় চায়। সুবর্ণাকে হুমকি দেয় এই বলে যে সে যেন রাজীবের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না নেয়। সমগ্র বাড়িটিকে সে হস্টেজ হিসেবে রাখে। বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দারা হলেন সুবর্ণার দাদাশ্বশুর শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং শ্বশুর সংগ্রামনারায়ণ। আর দুই কাজের লোক, মায়া এবং হরেন।

কাহিনির প্রথম দৃশ্য বলিউডি সিনেমা ‘শক্তি‘-র অ্যাংরি ইয়ংম্যান অমিতাভের পিস্তল হাতে মৌসুমির বাড়িতে প্রবেশ করার দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু জীবন সিনেমা নয়। প্রতিবাদী কথাকার সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায় মানুষের কথা বলেন, তাদের সমস্যার কথা বলেন। দেশভাগের ক্ষত, যন্ত্রণা নিয়ে তিনি লিখেছিলেন কেয়া পাতার নৌকো, শতধারায় বয়ে যায়, আর উত্তাল সময়ের ইতিকথা – যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকালীন শ্রেষ্ঠ ট্রিলজি হিসেবে স্বীকৃত।
ক্রান্তিকাল উপন্যাসের কাহিনি যত এগোতে থাকে লেখকও রাজীবের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন ভারত সরকারের প্রতি উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের ক্ষোভের কারণ। সেটা কি শুধুমাত্র এইসব অঞ্চল ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে পিছিয়ে থাকা বলে? কী সেই কারণ যার ফলে আজ তাদের জাতিগত পরিচয় বিপন্ন? কেন উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূমিপুত্ররা নিজেরাই নিজেদের দেশে বাস্তুহারা হয়ে যাচ্ছে? কেন তারা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে হয়ে পড়ছে সংখ্যালঘু?
শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যন্ত্রণার কথাই নয়, এই উপন্যাসে উঠে এসেছে নিজেদের মান-সম্মান খোয়ানো রাজ পরিবারের সদস্যদের কষ্টের কথাও। এক সময়ে প্রতাপপুর ছিল স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। এখানে দুই চরিত্র শৌর্যেন্দ্রনারায়ণ এবং সংগ্রামনারায়ণ রাজ পরিবারের অধীশ্বর। অভিমানে এবং মর্যাদাহানির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরকার থেকে দেওয়া সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে তাঁদের পূর্বপুরুষ। বৈভব, রোশনাই, জৌলুস–সব হারালেও রাজরক্তের আভিজাত্য, অহংকার, স্বাভিমান হারায় না সংগ্রামনারায়ণ। তিনি যেন ‘জলসাঘর‘ সিনেমার বিশ্বম্ভরবাবুরই এক প্রতিভূ।
উপন্যাসে সুবর্ণা চরিত্রটিকে লেখক পরম মমতায় অতি যত্ন সহকারে নির্মাণ করেছেন। নিজের জীবনে এক দগদগে ক্ষত নিয়েও মানবিকতার প্রতিমূর্তি হয়ে সুবর্ণা একদিকে সামলান চাকরি, সমাজসেবা, আর তার পাশাপাশি স্মৃতি বিনষ্ট হয়ে প্রায় শিশু দাদাশ্বশুর ও হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত শ্বশুরমশাইরও যত্ন নেন। ভালোবাসা, স্নেহ, দয়া, মায়া, মমতা – এই মানবিক বোধগুলো হারানো রাজীবের মধ্যে কি পরিবর্তন হবে সুবর্ণার সংস্পর্শে এসে? এ কি শুধু রাজীবের ক্রান্তিকাল, নাকি সুবর্ণারও? চিরকালীন ভারতবর্ষের ধ্যান-ধারণার কথা শুনে আসা সুবর্ণা নতুন করে, নতুনভাবে ভারতবর্ষের কথা জানতে পারে রাজীবের মুখে। যে ভারতবর্ষের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে ‘আরেকটি ভারতবর্ষ।’
লেখকের লেখনির কথা নতুন করে আর বলার নেই। সহজ সরল সাবলীল ভাষার মাধ্যমে তিনি বারবার পাঠককে পৌঁছে দিয়েছেন প্রান্তিক মানুষের কাছে। কেয়া পাতার নৌকো যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন তিনি কীভাবে শুনিয়েছেন ভিটেমাটি ছেড়ে, কাঁটাতার পেরিয়ে আসা ‘উদ্বাস্তু’ উপাধিকারীদের যন্ত্রণাময় জীবনের কথা। তবে ক্রান্তিকাল তাঁকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান এনে দিয়েছে। ২০০৩ সালে তিনি এই বইয়ের জন্য পেয়েছিলেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।
এ বই পড়ার পর এক অদ্ভুত রেশ রয়ে যায় মনে। কাহিনির পরিসমাপ্তি অপ্রত্যাশিত হলেও এ যেন এক সমাপ্তিহীন সমাপ্তি, এক নতুন যাত্রাপথের শুরু। সে যাত্রাপথ মসৃণ হবে নাকি কন্টকময়, তা আগামী ভারতবর্ষই বলতে পারবে। আমাদের প্রত্যেকেরই কাম্য জাতিভেদের সীমা, নানান বিশ্বাস ও সংস্কারের সীমা, ভৌগোলিক সীমা, আর্থিক সঙ্গতি বা অসঙ্গতির সীমা… এমন শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা এবং অতিক্রম করে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবোধ আর চেতনাকে জাগ্রত করে, একসূত্রে ‘ভারতবাসী‘ হিসেবে গ্রথিত থাকতে। স্বার্থপর, ক্ষুদ্র মানসিকতাসম্পন্ন কিছু লোকের ষড়যন্ত্র ভারতমাতাকে বারবার রক্তাক্ত করছে। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের অজ্ঞতা আর ভ্রান্ত মনোভাবকে নির্মূল করে বহু বীর শহীদের বুকের রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বহুমূল্যের স্বাধীনতার সঠিক মর্যাদা দিয়ে, বিভেদের মধ্যে সাম্য, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, আর অখণ্ডতা রক্ষা করার অঙ্গীকার করতে হবে। তার জন্য সমবেত হয়ে কবিগুরুর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে শপথ নিতে হবে –
পোহায় রজনী, জাগিছে জননী
বিপুল নীড়ে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
আসলে ভারতবর্ষ এমন এক দেশ এখানে “যতই ঘৃণা বা ক্ষোভ থাক কেউ বোধহয় কাউকে ফেলে চলে যেতে পারে না। অদৃশ্য এক বন্ধন তাদের জড়িয়ে ধরে রাখে। করুণা, মমতা উদারতা যাই বলুন এটাই ভারতবর্ষের আসল দিক” (ক্রান্তিকাল, প্রফুল্ল রায়)। কিন্তু এই সর্বংসহা ভারতবর্ষের মতো যার এত করুণা, মায়া, আর সহানুভূতি রয়েছে সেই দেশ কেন রাজীবের মত মূল স্রোত থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া যুবকদের জন্ম দেয় বারবার? উপন্যাস পাঠ শেষে এই প্রশ্ন রয়ে যায় মনে…
———-
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।