আমেরিকার জনজীবন, আমেরিকার লাইব্রেরি
The three most important documents a free society gives are a birth certificate, a passport, and a library card. (E. L. Doctorow)

নিজের বার্থ সার্টিফিকেট করানোর স্মৃতি আমার নেই, স্বাভাবিকভাবেই। বিদেশে আসার সম্ভাবনায় পাসপোর্ট করিয়েছিলাম, বেশ খানিক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল বৈকি। আমেরিকায় এসে গাড়ি চালাতে শিখে টুকটুক করে অফিস আর গ্রোসারি স্টোরের পরেই যেখানে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটা হচ্ছে স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি। কোন ফর্ম ভরা নেই, কোন সদস্য চাঁদা নেই, কার্ড করানো হয়ে গেল নির্বিঘ্নেই। এই নির্ঝঞ্ঝাট মসৃণ পরিষেবা প্রদানের পিছনে কর্মীদের কী পরিমাণ নিরলস পরিশ্রম চলতে থাকে, সেটা টের পেলাম নিজে লাইব্রেরিতে কাজ করা শুরু করার পরেই।
সম্প্রতি লাইব্রেরিকর্মীদের একটি সেমিনারে উঠে এল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামটি, কারণ আমেরিকার প্রথম ফ্রী পাবলিক লাইব্রেরি চালু করার কৃতিত্ব এই ভদ্রলোকের। সেমিনারটির পরেই এই বিষয়ে কৌতূহল বাড়লো, একটু বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম।
১৭২৭ সালে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন গড়ে তোলেন Junto নামে একটি বিতর্ক তথা আলোচনা সভা, অপর নাম লেদার এপ্রন সোসাইটি। বারোজন সদস্য নিয়ে শুরু এই সভায় প্রতি শুক্রবার ব্যবসায়ী ও শিল্পীরা মেতে উঠতেন সমাজ, রাজনীতি, বিজ্ঞান, নিয়ে নানান আলোচনায়। এই জ্ঞানচর্চার প্রয়াসকে আরো বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ করতে ১৭৩২ সালে উনি শুরু করলেন লাইব্রেরি কোম্পানি অফ ফিলাডেলফিয়া, প্রতিষ্ঠিত হল আমেরিকার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি – সংগ্রহে ছিল মূলত ব্যাকরণ ও অভিধান, অ্যাটলাস, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ও কৃষি সম্পর্কিত বই। শুধু পাঠ বা জ্ঞান আহরণ নয়, মতামত বিনিময় এবং চিন্তার আদানপ্রদান ছিল এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য।

এখানে বলে রাখা ভাল, আমেরিকার গ্রন্থাগারের ইতিহাস নিয়ে পড়তে গেলে, কী ধরনের বই ঠাঁই পাবে গ্রন্থাগারের তাকে, এই প্রসঙ্গ বার বার উঠে আসে। এবং দেখা যায়, গ্রন্থাগারিক প্রথমদিকে চেয়েছেন, নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ, সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ, ও ন্যায়নীতির প্রচার, এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে বই বেছে নেওয়া হোক। কিছুটা যেন ‘নাটক নভেল পড়ে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে,’ জাতীয় মনোভাব। সাধারণ জনগণ কিন্তু বরাবর চেয়েছেন মানুষের জীবনের সুখদুঃখ হাসিকান্নার গল্প পড়তে, এমনকি ফ্রি পাবলিক লাইব্রেরিতে হালকা গল্পের বই না পেয়ে তাঁরা দ্বারস্থ হয়েছেন স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে ঘুরে ঘুরে বই ধার দেওয়া circulating libraryর কাছে। এই নালিশ আবার মহিলাদের বিরুদ্ধে বেশি ছিল, গল্পের বইয়ের নেশায় Mary Sprague নামে এক ভদ্রমহিলা নাকি সেলাইয়ের দোকানেও বই ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। মানুষের দাবির কাছে হার মেনে লাইব্রেরিগুলি অবশ্য শেষমেশ গল্পের বই রাখা শুরু করে।
গল্পের বইয়ের প্রতি আগ্রহ থাকলেও, কার্যত দেখা যায়, কোন গল্প যে কোথায় পাঠকপ্রিয় হবে, আর কোথায় নয়, সেই বিষয়টিও সমাজ ও সময়ের দর্পণ হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, দাসপ্রথার তীব্র ও বাস্তব ছবি আঁকা উপন্যাস আংকেল টমস কেবিন প্রবল জনপ্রিয় হয় উত্তর আমেরিকার রাজ্যগুলোতে, কিন্তু দক্ষিণে সেই বইটিই evil বা শয়তানের কীর্তি বলে ঘৃণিত হয়।
আমেরিকার ইতিহাসে কিন্তু মহিলাদের লাইব্রেরিতে আসা নিয়ে কোনরকম নিষেধাজ্ঞার কথা জানতে পারিনি। তবে, নিষেধাজ্ঞা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ওপর। শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীর কার্ড ধার করে, তার জন্যই বই নিতে এসেছি, এমন ভান করে নিজের পড়ার জন্য বই নিয়েছেন বহু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, এমন ঘটনার কথা জানা যায়। এবং, এর সমাধানস্বরূপ ১৮৩০ দশকে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ গড়ে তোলেন নিউ ইয়র্কের ব্ল্যাক ফিনিক্স সোসাইটি এবং তার মিটিং রুম – তাঁদের সসম্মানে বসে পড়াশোনা করার পরিসর। ১৮৫৯ সালে ওপেন রিডিং রুমে শুরু হয় নানা বিষয়ে গুণী অতিথিদের বক্তৃতা ও আলোচনা সভা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলে বিজ্ঞান, প্রভাব ফেলে গ্রন্থাগারেও। মুদ্রণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি, মুদ্রিত বই তথা কাগজের প্রাপ্তি ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি, উঁচু মানের কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা, চশমার প্রচলন, এইসবই আরো জনপ্রিয় করে তোলে লাইব্রেরিগুলিকে। দেখা যায়, আমেরিকান রেভেলুশনের আগেই লাইব্রেরির সংখ্যা পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। প্রথমে বইয়ের যোগানের জন্য ইংল্যান্ডের ওপর ভরসা করলেও, ১৭৩৩ সালে কানেকটিকাটে বুক কোম্পানি অফ ডারহাম বই প্রকাশ করা শুরু করে। প্রথম লাইব্রেরি ভবন তৈরি হয় ১৭৫০ সালে রোড আইল্যান্ডে।
আমেরিকার প্রাণভোমরা, তার বিশাল অধিবাসী জনতা, তাদের নতুন দেশ নতুন জীবনকে মানিয়ে নিতে লাইব্রেরিকে আপন করে নিয়েছেন। ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়াসে, সাধারণ মার্কিনী রোজকার জীবনযাত্রা শিখে নিতে, বৃহত্তর সমাজের মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার স্পৃহায়, তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন লাইব্রেরিতে। এছাড়াও, গৃহহীন বা homeless মানুষের সারাদিনের আশ্রয় রূপেও চিরকাল কাজ করে এসেছে আমেরিকার লাইব্রেরি।
দেশের ভবিষ্যত, দেশের শিশু কিশোর, তারা আসবে না লাইব্রেরিতে? ১৮৮৩ সালে শিকাগোর এক শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শনিবার স্থানীয় লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে শিশু কিশোরদের লাইব্রেরি আসার রেওয়াজ বাড়ল। ১৮৯৩ সালে মিনেসোটা লাইব্রেরি শুরু করে তাদের শিশু বিভাগ। কী পড়বে বাচ্চারা? ঠিক হয়, উদ্দেশ্য হবে not censorship but selection। শিশুরা আসুক, বইপত্র নাড়াচাড়া করুক, ভালোমন্দের বিচার আপনিই গড়ে উঠবে, জোর করে বাধা দিয়ে বাছবিচার করে লাভ নেই কিছু।
১৮৫১ সালে Young Mens’ Christian Association (YMCA) লাইব্রেরি শাখা খোলা শুরু করে সারা দেশে। ১৮৯৩ সালে Cataloging আর Dewey Decimal System-এর আগমন আরো সংগঠিত আরো সুস্থিত করে তোলে লাইব্রেরি পরিষেবাকে।
আচ্ছা, এত যে বেড়ে চলেছে লাইব্রেরির সংখ্যা, ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে, কাউকে তো প্রয়োজন যে দায়িত্ব নিয়ে নজর রাখবে সবার কার্যকলাপে, গড়ে তুলবে সবার জন্য নিয়মকানুন। সেই উদ্দেশ্যেই ১৮৭৯ সালে তৈরি হলো আমেরিকা লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন – ALA। “The best reading for the greatest number for the least cost” ছিল এই সংস্থার মূলমন্ত্র, যা আজও বজায় রয়েছে।
আমেরিকার জনজীবনে, তার সামাজিক পরিকাঠামোয়, তার জ্ঞানচর্চা ও মানবিক আদানপ্রদানে, ধারাবাহিকভাবে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে লাইব্রেরিগুলি। রাজনৈতিক উত্থানপতনে কখনও পুঁজির অভাব ঘটেছে, কখনো ঘটেছে বই নির্বাচনের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়ি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে, প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে, আধুনিক যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করে এখনও প্রাসঙ্গিক ও জরুরি হয়ে আছে লাইব্রেরি। আজ আর লাইব্রেরি শুধু কিছু বই দিয়ে সাজানো একটি বাড়ি নয়। আমেরিকার প্রতিটি শহরে লাইব্রেরি এখন একটি কমিউনিটি সেন্টার – স্কুলফেরত পড়ুয়া, সদ্যজাতর পাসপোর্ট করাতে আসা নতুন বাবামা, কম্পিউটার ব্যবহার করতে আসা বৃদ্ধ, মিটিং করতে আসা স্থানীয় ব্যবসায়ী – সবাইকে নিয়ে ভরে থাকে ঘরগুলো। আর হ্যাঁ, চুপচাপ নিস্তব্ধ quiet libraryর জায়গা ধীরে ধীরে নিয়ে নিচ্ছে এইরকম গমগম করা multiuser library।
যাঁর কথা না বললে আমেরিকার লাইব্রেরির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি শিল্পপতি এন্ড্রু কার্নেগি। এন্ড্রু তাঁর নিজের উদ্যোগে এবং নিজের বিপুল আর্থিক অনুদানের দ্বারা আমেরিকায় গড়ে তুলেছিলেন ১৬০০ র বেশি লাইব্রেরি। তাঁর কথা দিয়েই তাই আমেরিকার গ্রন্থাগারের এই আলোচনা শেষ করা যাক।
Whatever agencies for good may rise or fall in the future, it seems certain that the free library is destined to stand and become a never-ceasing foundation of good to all the inhabitants.
———-
তথ্যসূত্র:
Pettegree, A., & der Weduwen, A. (2021). The library: A fragile history. NYC: Basic Books.
Wiegand, W. A. (2015). Part of our lives: A people’s history of the American public library. Oxford, UK: Oxford University Press.
———-
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।