চিরচেনা প্রফুল্ল রায়

সাহিত্য জগতে নক্ষত্র পতন। নক্ষত্র পতন আসলে কোনও মৃত্যু নয়, মৃত্যু তো কেবল শোকের রেশ বহন করে। তারপর যা পড়ে থাকে তা স্মৃতিচারণ। নক্ষত্র নিজের অন্তরে ধারণ করে রাখে এমন এক আলো যা উত্থান পতনের রীতি না মেনেই ছড়িয়ে পড়ে, দূর হতে দূরান্তে বিনাশ ঘটায় অন্ধকারের।
আসা যাওয়া কেবল নশ্বর দেহের। রক্তমাংসের দেহে প্রাণ দেন ঈশ্বর, সেই প্রাণ যিনি সৃষ্টিকর্মে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তিনি হন কালজয়ী। সাহিত্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালজয়ী লেখক শ্রদ্ধেয় প্রফুল্ল রায়। সম্প্রতি ১৯শে জুন ২০২৫ তারিখে আমরা তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে। থেকে গেছে তাঁর বিপুল সাহিত্য কীর্তি।
লেখকের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার পূর্ব পাকিস্তানে, অধুনা বাংলাদেশ। ছোটবেলা কেটেছে ঢাকায়। ১৯৫০ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে তিনি সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। এদিকে ছিল ওঁর মামার বাড়ি। সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। তবে এপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় যাতায়াত লেগেই থাকত। সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন বহু চর্চিত উপন্যাস কেয়া পাতার নৌকা–য়, যা তৎকালীন জীবন সংগ্রামের সচিত্র দলিল হয়ে থেকে গেছে পাঠকের মনে।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য তিনি পাকাপাকি ভাবে এপার বাংলায় থাকতে শুরু করেন, রচিত হয় তাঁর নবজীবনের সংগ্রামচিত্র।
কর্মযোগী এই মানুষটি বাউণ্ডুলে ছিলেন না মোটেও, শুধুমাত্র নিজের দেশ ও সমাজকে জানার আগ্রহে সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু জায়গায়। দেখেছেন, অনুভব করেছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রা, শুনেছেন তাদের জীবনকাহিনি। তারপর লিপিবদ্ধ করেছেন সেই সব জীবনচিত্র। সেইজন্যই তাঁর যাবতীয় লেখা ছবির মত প্রাঞ্জল, বাস্তবের মাটি লেপা স্নিগ্ধ, অকৃত্রিম। মানুষের সংগ্রাম খুব কাছ থেকে দেখার খিদে তাঁকে সর্বদা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত বলেই প্রত্যন্ত এলাকায় ছুটে যেতেন বারংবার। জীবন সংগ্রামের আঁচে উত্তপ্ত হৃদয় থেকে গলে বেরিয়ে আসত এক একটা মর্মস্পর্শী কাহিনী।

নাগাল্যান্ডের আদিবাসী গ্রামে গিয়ে থেকেছেন বেশ অনেকদিন, সময় কাটিয়েছেন সেখানে গ্রামবাসীদের সঙ্গে। বিহারের অস্পৃশ্য মানুষের হাহাকার জল এনেছে তাঁর চোখে। আন্দামানের আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা উঠে এসেছে কলমের ডগায়। শক্তিশালী কলমের আঁচড়ে রচিত সেইসব কাহিনি চিরস্থায়ী দাগ কেটেছে মানব হৃদয়ে। জীবনের ছবি তুলে ধরতেন জাদুকরী দক্ষতায়, সম্মোহিত করতে জানতেন আপামর পাঠককে। একানব্বই বছরের জীবনকালে রচনা করেছেন বহু গল্প ও উপন্যাস।
১৯৫৬ সালে নাগাল্যান্ডে বসে লিখেছিলেন প্রথম উপন্যাস পূর্বা পার্বতী। তাঁর লেখা প্রায় একশত পঞ্চাশটি গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কেয়া পাতার নৌকো – এক কালজয়ী উপন্যাস। এটি রচিত হয়েছিল দেশভাগের পর উদ্বাস্তুদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস শত ধারায় বয়ে যায়। লিখেছিলেন মানুষের সম্পর্ক ও তাদের আবেগকে ভিত্তি করে।
তাঁর লেখার সারল্য, গভীরতা, এবং আবেগ উদ্বেলিত করেছিল গ্রাম, শহর নির্বিশেষে সকল মানুষের হৃদয়। উত্তাল সময়ের ইতিকথা বা ছিন্নমূলের ঘরবসত উপন্যাসগুলো তো শুধু গল্পকথা নয় এক উত্তাল সময়ের জ্বলন্ত দলিল, সেগুলোও থেকে যাবে চিরকাল। চিত্রনাট্য লেখাতেও তাঁর দক্ষতা চোখে পড়ার মত। উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘এখানে পিঞ্জর’ (১৯৭১), ‘একান্ত আপন’ (১৯৮৭), ‘পৃথিবীর শেষ স্টেশন’ (১৯৯৩), প্রভৃতি।
পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার, বাংলা সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার, মোতিলাল পুরস্কার ইত্যাদি।
শুধুমাত্র পুরস্কারের মাপকাঠিতে নয়, পাঠকের হৃদয়ে, চিরস্থায়ী আসন পেতে অধিষ্ঠান করবেন লেখক প্রফুল্ল রায়। উত্তরসূরীদের মধ্যে বেঁচে থাকবে তাঁর সত্ত্বা। ১৯শে জুন ২০২৫ আমরা শুধুমাত্র সশরীরে তাঁর উপস্থিতটুকু হারিয়েছি। প্রফুল্ল রায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনি যে নক্ষত্র, চিরকালীন।
নক্ষত্রের যেদিন মৃত্যু হবে, আমরা সকলেই কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে যাব।
———-
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।