সাহিত্যিক শ্রীপ্রফুল্ল রায় মহাশয় সমীপেষু
প্রিয় লেখক,

দিদির কাছে চিমটি খেয়েছিলাম। মুখ ঝামটে চুল ঝাঁকিয়ে বারো বছরের বড়ো দিদি, বলেছিল, “পারলি? একলা দেখে এলি? আমি বড় হয়েছি ওঁকে ঘিরে। উনি আমার লেখক!”
দিদির হিংসে হয়েছিল। দিদি আপনার অন্ধ ভক্ত। আপনার বই গোগ্রাসে গিলত। খেতে বসেও পড়েই যেত। বিজ্ঞানের বইয়ের ফাঁকে রেখে পড়ত। ছোট্ট আমি বলে দিতাম বাবাকে। কী এমন ছিল আপনার লেখায়? একজন সতেরো বছরের কিশোরী বুঁদ হয়ে থাকত? বুঝেছি অনেকদিন বাদে। তখন আমি একুশ। গহন মনের গোপন দরজা একটা একটা করে খুলতেন অদ্ভুত জাদুকরি প্লট আর ভাষা দিয়ে। একটা দরজা খুলছে – পৌঁছে যাচ্ছে অন্য দরজায় – সে দরজা খুলবে কখন? পাঠক অধীর অপেক্ষায়! লেখার আলোচনা অনেক করেছে রথী মহারথীরা। সে আলোচনার ধৃষ্টতা থাকুক। বরং আজ আপনাকে গল্প শোনাই। এক আশ্চর্য সন্ধ্যার গল্প। আপনাকে প্রথম দেখার গল্প।
আজাদগড় – তিনতলার উপর ফ্ল্যাট। ২০১৮ সালের জুন মাস। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আপনাকে চুপি চুপি বলি, প্রথম দেখায় হতাশ হয়েছিলাম। অগোছালো ছোট্ট বাড়ি, ছোট্ট বসার ঘরের একপাশে খাট। অনেক বইখাতা। লম্বা শরীরের আপনি হাঁটা চলা করছিলেন পায়ের গোড়ালিতে ব্যান্ডেজ। ঘরে উপস্থিত দু’জন বিখ্যাত লেখক জিজ্ঞেস করছে, “প্রফুল্লদা, হয়েছে কী?” আপনি লম্বা লম্বা হাত দুলিয়ে এধার ওধার করতে করতে বলে যাচ্ছেন, “ও কিছু না। ও কিছু না!”
আপনি কথা বলছেন কিন্তু ফিরেও তাকাচ্ছেন না নতুন আগন্তুকের দিকে। অমন কত আসে রোজ। বিরক্ত করে। লেখকের নিভৃত যাপনে উটকো লোক বিরক্তিকর বইকি। চেনা সূত্রে গিয়েছিলাম তাই কিছু বলেননি বোধকরি? একটা ছবিতে বারবার চোখ আটকে যাচ্ছিল। শুনলাম, আপনার স্ত্রীর ছবি। এলোমেলো বই পত্রের মধ্যে মুখ টিপে হাসছিলেন। সেই ছবির দিকে আঙুল তুলে বললেন, “দেখে রাখছে আমাকে চিন্তা নেই!”
নিতান্ত গোবেচারা গোছের আমি জড়োসড়ো হয়ে প্রণাম করলাম। আমার বড় হয়ে ওঠার পথে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র স্যার (সরকার), শঙ্খ ঘোষ, আরও অনেকে। যাদবপুরের বাংলা বিভাগের গমগমে সেমিনারে আপনি অনুচ্চারিত। সিনেমার লেখক নিয়ে যাদবপুরের মাথাব্যথা ছিল না। তাতে কী! আপনার কাউকে লাগে না। বিগহাউজ বা নামি প্রকাশকের চাইতে অনেক বড় ছিল জনপ্রিয়তা। জড়োসড়ো আমির দিকে হঠাৎ চোখ পড়লে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে ততোধিক নরম সুরে বললেন, “নাম কী?”
সঙ্গী পরম উপকারী লেখক বন্ধু বলে উঠলেন, “জয়তী রায়। একেবারে নতুন। একটিমাত্র বই প্রকাশ হয়েছে। থাকে বিদেশে।”
মাথা আমার নীচু। পরিচয়ের কিছুই নেই। দৃপ্ত, সোজা সটান চলাফেরায় নায়কের মত ভঙ্গিতে নিতান্ত সাধারণ পোশাকে মোড়া সাহিত্যের এভারেস্ট সামনে দাঁড়িয়ে, অনেক নীচে তৃণগুচ্ছসম আমি ভেবে চলেছি – এই তিনি? সিনেমা হল কাঁপিয়ে দিচ্ছে একের পর এক নভেল, শারদীয়ার জন্যে হুমড়ি খেয়ে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার পাঠক – ‘প্রফুল্ল রায়’ নাম দেখলে সেই বই কেনা হবে। শারদীয়া কোন প্রকাশনার সেটা বিচার্য নয় – ‘প্রফুল্ল রায়’ আছেন কী? প্রশ্ন সেইখানে। নজর এড়িয়ে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ভারি সুন্দর দেখতে। ভেবেছিলাম, ট্যারা চোখে এক পলক দেখে নেব। ওমা! দেখি, সরাসরি তাকিয়ে আছেন। ভরাট গলায় বললেন, “জয়তী? দেশে ফিরে জয় করবে!”
পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পাল্টে, “কই? চা কই?”
ঘরের লেখকরা ব্যস্ত হয়ে বারণ করতে লাগল। কীসের চা? লাগবে না। দাদা কথা বলছেন এই যথেষ্ট। আবার চা কীসের? আমি কিছু শুনছি না… কানে ভাসছে কথাগুলো! দেশে ফিরে আসতে হবে? আরও লিখব ভবিষ্যতে? সে কী কথা? সঙ্গী লেখক মিচকি হেসে বললেন, “জ্যোতিষ বিদ্যায় অগাধ জ্ঞান দাদার!”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ গো। যা বলেন মিলে যায় অক্ষরে অক্ষরে!”
বৃষ্টি ঝেঁপে এল। বন্ধ জানালার কাচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বর্গের জল। কোন অজানা মেঘ গলে আদর ঝরে পড়ছে টুপটুপ জল। বিজ্ঞান ভেদ করেছে সমস্ত রহস্য। অজানা টজানা কেউ বলে না। কেউ মাথাও ঘামায় না। কী জানি! মনে হয়, কোথাও আছে অজানা শক্তি, যার নাগাল বিজ্ঞান এখনও পায়নি। ছোটো বয়েস থেকে কলমে বিরাজমান সরস্বতী আপনার, এমন সগৌরবে রাজত্ব করছেন, একটার পর একটা সফল লেখা – এমনি এমনি হয় নাকি? বিখ্যাত লেখকের কাছে বসে উপদেশ শুনে অথবা দিনরাত লিখে গেলে শ্রমিক হয়ে ওঠা যায়, রাজা নয়। অলৌকিক দৈব শক্তি নেমে আসবে যোগ্য কলমের কাছে!
বৃষ্টির কারণে হোক বা আড্ডার মুড, চা নিয়ে আপত্তি করল না কেউ। শুরু হয়ে গেল গল্প। আমি ততক্ষণে দাদা সম্বোধন করেছি। মহাকাব্য নিয়ে পড়াশুনো করেছেন প্রচুর। সীতা নিয়ে কথা বললেন। তখন আমি বিড়ালের মিউ মিউ। এখনকার মত গর্জন করে সীতা নিয়ে বলার মতন সাহস ছিল না। অচিরে আগ্রহ হারিয়ে গেল ওঁর। দেখলাম, অনবরত কিছু করছেন। চা খাচ্ছেন, চট করে পাশের পড়ে থাকা পাণ্ডুলিপির খাতায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে অনেক মজার গল্প করলেন। বিখ্যাত কিছু লেখকের জীবনে মহিলা ফ্যানদের অত্যাচার কীভাবে তাদের নাজেহাল করে ছেড়ে দিত – মৃদু মৃদু স্বরে বলছেন, আর মৃদু মৃদু হাসছেন। লক্ষ করলাম, ঠোঁট অল্প ফাঁক করে কথা বলেন, গলা উচ্চগ্রামে নয়, গোটা গোটা বাক্য বলেন, মজার গল্পে হেসে গড়িয়ে পড়ছে অন্যেরা, উনি মুচকি হাসছেন। দর্শনপ্রার্থীরা চেয়ারে বসলেও উনি খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছেন। সেইসময় কাজ করছি how to motivate our daily life – লোকজনের ভঙ্গি দেখা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আপনি ব্যক্তিগত মানুষ হিসেবে সরল – এটা বলে দিচ্ছে শরীরের ভাষা। স্ত্রীর প্রসঙ্গ একবার না এনেও তিনি জড়িয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছিল ছবিটিকে বারবার আঙুল বুলিয়ে অদৃশ্য ধুলো মুছে দেবার জন্যে। মায়াময় দৃশ্যকল্প। ঘরের মধ্যে বিরাজমান সাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে প্রাঞ্জল আলোচনা করছিলেন। বললেন, “লেখা নিয়ে এত আবদার আসে, ফোন ধরতে ভয় করে!”
“কখন লেখেন?” আমার প্রশ্ন।
“বাজার নিজে হাতে করি। মাছ খেতে ভালবাসি। বাসবী অনেকরকম মাছ রান্না করত। সাজিয়ে দিত। তারপরে… সারাদিন লেখা। আর কী!”
ঘরের মধ্যে হঠাৎ নীরবতা। মৃত্যু যেন অনন্ত সমাপ্তি চিহ্ন। তারপরে কথা হয়ে ওঠে অনর্থক বোঝা। শেষে বললেন, “ভারতের নানান জায়গা ঘুরেছি। মানুষ দেখেছি। তাদের একেবারে তাদের মতো করেই বুঝে লিখেছি। মহাকাব্য কিন্তু মানুষের কথা বলে। অযথা জ্ঞানের ভার যুক্ত সংস্কৃত ভাষায় উপদেশ দিয়ে জর্জরিত করো না। বুঝতে চেষ্টা করো। পরিস্থিতির শিকার কীভাবে হয়ে উঠছে!”
দাদার কন্যা উঁকি দিলেন দুই তিনবার। আমাদের আর কিছু চাই না দেখে পর্দা টেনে দিলেন। বৃষ্টি ধরে গেছে, পর্দা ফেলতে হবে আমাদেরও। প্রণাম করলাম আরেকবার। আজ মনে হয় সেদিন ভাগ্যিস বারণ না শুনে প্রণাম করেছিলাম। বলতে তো পারব – ইতিহাস ছুঁয়েছি নিজের হাতে!
ভালো থাকবেন। আবার ফিরে আসবেন অভাগা দেশে। প্রফুল্ল রায়ের মত কোহিনূর হারিয়ে ফেলার দুঃখ নিয়ে অপেক্ষা থাকবে দেশবাসীর!
———-
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।