প্রতীক্ষার সাতাশটি বছর

প্রতীক্ষার সাতাশটি বছর

নেলসন মান্ডেলা
নেলসন মান্ডেলা

দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে এই সাতাশ বছরের গুরুত্ব অপরিসীম, আবার এই সাতাশ বছরটা কেমন দারুণভাবে জড়িয়ে গেলো দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গেও।

যে নেলসন মান্ডেলা না থাকলে টেম্বা বাভুমাদের হয়তো আজও ওই বেসিল ডি অলিভেরার মতো অন্য কোথাও গিয়ে ক্রিকেট খেলতে হতো, তিনি সাতাশ বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ঠিক একইরকম ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটেরও আইসিসি ট্রফি জয়, ঠিক ওই সাতাশ বছর পর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটাও এক অশ্বেতাঙ্গ অধিনায়কের হাত ধরে, এও যেন আরেক মুক্তিপ্রাপ্তি। বর্ণবৈষম্যের পর ক্রিকেটের মূলস্রোতে ফিরে আসার পর কখনও ‘বেনোজল’, কখনও টাই ম্যাচ, কখনও অঙ্কে ভুল, আবার কখনও বা ব্রায়ান লারা বা গ্রান্ট এলিয়টের পারফরম্যান্সের সামনে হেরে যাওয়া।

বেসিল ডি অলিভেরার প্রসঙ্গে একটা কথা মনে এল। তখন ইমেইল বা অন্যান্য সমাজ মাধ্যম না থাকায় তাঁকে কোন পরিচিতকে ক্রিকেট খেলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য  চিঠি লিখতে হয়েছিল। এমনকি সদ্য সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ছেড়ে ইংল্যান্ড চলে আসতে হয়েছিল ক্রিকেট খেলতে, প্রায় ভিক্ষা করতে হয়েছিল দেশ ছেড়ে ক্রিকেট খেলতে ইংল্যান্ড আসার জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ৪৪ টেস্ট খেলে নিজের কেরিয়ার শেষ করেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে টেম্বার অধীনে এই জয় কেন গুরুত্বপূর্ণ? কেন আজ হঠাৎ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে লিখতে বসে বর্ণবৈষম্যকে টেনে আনা?

বিজয়ী দঃ আফ্রিকা দল

মনে পড়ে, কোভিডের ঠিক পরে লর্ডসে দাঁড়িয়ে মাইকেল হোল্ডিংয়ের দেওয়া ইন্টারভিউটা? নাড়িয়ে দিয়েছিলো হুইসপারিং ডেথ-এর ওই কান্নাটা, দেখিয়ে দিয়েছিলো শ্বেত-অধ্যুষিত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও কতটা গভীরভাবে বেঁচে রয়েছে বর্ণবৈষম্য! আর ক্রিকেট তো সমাজ বা জীবনের বাইরের কিছু নয়। খাতায় কলমে তো দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিদায় নিল বর্ণবৈষম্য কিন্তু আসল চিত্রটা কী? কী বলছেন পল অ্যাডামস? ঠাট্টা করে কী নামে তাঁকে ডাকতেন সতীর্থরা? প্রকাশ্যে লেখা যাবে না। নিজের সতীর্থরা কেমন ব্যবহার করতেন সেই দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ টেস্ট ক্রিকেটার মাখায়া এনতিনির সঙ্গে? এই সেদিনের ঘটনা, যোদ্ধা কিনা জানিনা তবে এক বর্তমান নাইট অস্বীকার করেছিলেন ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার’ আন্দোলনে সামিল হয়ে ম্যাচের আগে হাঁটু গেড়ে বসতে! পরে চাপের মুখে পড়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন!

হোল্ডিং হয়তো জানলে কষ্ট পাবেন যে এই অর্থপিশাচ পৃথিবীতে তার সাধের জামাইকা থেকে উঠে আসা রাসেল এই ঘটনা জানার পরও সেই ‘মহান’ খেলোয়াড়কে সতীর্থ বানিয়ে খেলে চলেছেন কোন প্রকাশ্য প্রতিবাদ ছাড়াই? করতে পারতেন হোল্ডিং বা অর্থ-এর কাছে হেরে না গিয়ে আফ্রিকা লীগে খেলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা ভিভরা?

আর এই পরিস্থিতিতেই সেদেশের ক্রিকেট অধিনায়ক হলেন টেম্বা! স্থানীয় ভাষায় যার মানে ‘আশা’, যেকোন পিছিয়ে পড়া মানুষের বাঁচার শেষ অস্ত্র।

বাংলার জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো কে অনুপ্রেরণা করে কিনা জানিনা তবে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে বিশ্ব ক্রিকেটে তিন মহাশক্তিধরে দেশের দাদাগিরির কাছে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফর্ম্যাট, পয়েন্ট পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে একাধিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার পর থেকে টেস্ট ক্রিকেট একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। একইসঙ্গে ভুলে গেলে চলবে না বিগত তিনটে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সাইকেলে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কোনো ‘দাদা’ই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, এমনকি এক ‘দাদা’ (ইংল্যান্ড) তো এখনো ফাইনালের মুখই দেখেনি। আর ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া অবশ্যই বাড়তি কৃতিত্বের দাবি রাখে।

এখানে এই তিন মহাশক্তিধর দেশ ব্যবসা এবং ব্রডকাস্টিং সংক্রান্ত বিষয়কে শিখণ্ডী করে অধিকাংশ সময়েই এইসব দেশগুলোতে বেশি টেস্টের সিরিজ খেলতে যায় না, এতোটাই তাচ্ছিল্য। জানলে অবাক হবেন সিকি শতাব্দী পার হয়ে এলেও এই শতাব্দীতে ভারত এখনও দক্ষিণ আফ্রিকায় চার টেস্টের সিরিজ খেলতে যায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই বা তিন টেস্টের সিরিজই বরাদ্দ থাকে এই সমস্ত দেশগুলির সূচীতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের ফাইনালে উঠে আসতে অসুবিধে হয় না। যদিও সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রিকেট বোর্ডগুলোও এরজন্য খানিকটা দায়ী, তারাও বর্তমানে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে চলেছে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগগুলোকে। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাদে বাকি দলগুলো আইসিসি ট্রফির স্বাদ পাচ্ছে এই লাল বলের ক্রিকেটের হাত ধরেই।

রাবাডা এবং মার্কো জেনসেন

আর এখানেই বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে গেলো এবারের লর্ডসের ফাইনাল, একদিকে নিউট্রাল ভেন্যুতে টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও গ্যালারি দেখে মনে হলো না যে হোম টিম খেলছে না। কল্পনা করুন ভারতের কোনো মেট্রো সিটিতে অস্ট্রেলিয়া বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে, দর্শকাসনে কত শতাংশ ভরবে? অন্যদিকে উপযুক্ত পরিস্থিতি এবং অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যেন হৃদয় দিয়ে ক্রিকেটটা খেললো দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথমে ফিল্ডিং করার সুযোগ পেয়ে অস্ট্রেলিয়াকে একদিকে যেমন খুব অল্প রানের মধ্যে বেঁধে রাখলো, তেমনই একটা ছাড়া বড় কোনো পার্টনারশিপ হতে দেয়নি ইনিংসে তারা। এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই ফাইফার নেওয়া রাবাডা এবং মার্কো জেনসেনের।

 

ব্যাট করতে নেমে অবশ্যই তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো যার মূলে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট্রিক কামিন্স যিনি সর্বদাই বড় মঞ্চে পারফর্ম করেছেন, সেটা পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপই হোক বা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। এরপরে চতুর্থ ইনিংসে যখন তিনশোর কাছে রান চেজ করতে হচ্ছে ক্রিকেটের মক্কায়, তখন এই দুজনের কীর্তি সম্পর্কে কথা যতো বলা হবে ততোই কম – এইডেন মার্করাম এবং প্রোটিয়া অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। 

হ্যাঁ পিচ হয়তো শেষ দুইদিনে তুলনায় সহজ হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু যেভাবে তারা দায়িত্ব নিয়ে এবং ক্রিকেটের প্রাথমিক ধাপগুলিকে মেনে অজিদের বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনেন তা সকল অংশেই প্রশংসার দাবি রাখে। ফাইনালে গেলে যে অজি দল হয়ে ওঠে আরও অপ্রতিরোধ্য, যারা এই শতকে একটি টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল বাদে সবকটিই জিতেছে, সেই দলের বিরুদ্ধে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চে জয়লাভ ক্রিকেটের দরবারে এই আনকোরা দক্ষিণ আফ্রিকার কদর আরও কিছুটা বাড়িয়ে দেবে। প্রথমবারের জন্য বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয় এবং তারই সাথে সাতাশ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এভাবেই তারা আবারও একটি আইসিসি ট্রফি অর্জন করলো। এই শতকে একটি টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল ছাড়া যে কয়টি আইসিসি ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল সবকটি জিতেছিল।

 

ফাইনাল চলাকালীন লর্ডসের মাঠ ও স্টেডিয়াম – চিত্র সৌজন্য  – উইলোর উইল পত্রিকা ও ইউটিউব চ্যানেল 

তবে এই জয়ের বাইরেও যা না বললে নয় তা হলো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফর্ম্যাট ও তার সূচী সম্পর্কিত ত্রুটি। আমরা একদিকে যখন দেখি একই সাইকেলের মধ্যে ইংল্যান্ডকে খেলতে দেখা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ভারতের বিপক্ষে অন্যদিকে দেখা গিয়েছে বিগত সাইকেলে ভারতের বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এবং সবকটি টেস্ট সিরিজই দুই ম্যাচের বেশি নয়। অর্থাৎ এইখানে একটা কোথাও গিয়ে সূচীগত বৈষম্য তৈরী হয়েছে,দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াকে দেখা গেছে ভারতের মোকাবিলা করতে, ইংল্যান্ডের মাঠে অ্যাসেজ খেলতে বা নিউজিল্যান্ডে খেলতে যেতে। এই যে তিন প্রধানকে অন্য দলের তুলনায় কঠিন প্রতিপক্ষের সামনাসামনি হতে হচ্ছে তাতেই গলদটি স্পষ্ট, ভারতও শেষ ধাপে নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার কাছে আটকে না গেলে হয়তো ফাইনালে তারাও যেতে পারতো এবার।

এখানে মূল বক্তব্য, এই ত্রুটি সংশোধনের দিকে শুধুমাত্র আগামীদিনে আইসিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করা, এর মানে আদৌ  টেম্বার দক্ষিণ আফ্রিকার অর্জনকে হেয় করা নয়।

আবার চলতি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সাইকেলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে খেলতে হবে ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া – তিন তথাকথিত মহাশক্তিধরের বিরুদ্ধেই। ফলে বোঝাই যাচ্ছে খুব সহজ হতে যাচ্ছে না তাদের জন্য এই সাইকেলটা। তবে আশার কথা এটাই যে এবার তারা ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া দুই দেশের বিরুদ্ধেই দেশের মাঠে তিন টেস্টের সিরিজ খেলবে যদিও ভারতের সঙ্গে সেই দুই টেস্টেরই।
সে যাই হোক, বাঙালি তথা কলকাতাবাসীর কাছে খুশির খবর এটাই যে আসন্ন নভেম্বরে ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ফরম্যাটের চ্যাম্পিয়নরা ইডেনে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলতে আসছে। উস্কে দিচ্ছে ৩৪ বছর আগের স্মৃতি। না এই ৩৪, সেই ৩৪ নয়। ৩৪ বছর আগের এক নভেম্বরে বর্ণবৈষম্যের নির্বাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এই ইডেনেই খেলতে এসেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা, এবার আবার আসছে আইসিসি ট্রফি না জেতার এক অন্যধরনের নির্বাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর।
সেই ইডেনে, যেখানে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের পুনরায় পথ চলা। তারপর দীর্ঘ ৩৪ বছর কেটে গেলেও আক্ষরিক পরিবর্তন হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে কিন্তু ২৭ বছর পর আবার মুক্তির স্বাদ পাওয়া ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা কি আবার নতুন করে শুরু করবে তাদের প্রিয় ইডেন থেকে যার পূর্বভাগে থাকবে শুধুই ‘আশা’, থুড়ি টেম্বা! যাঁকে নিয়ে, যাঁর চেহারা নিয়ে শুধু শ্বেতাঙ্গরা নয়, এই সর্বজ্ঞানী বাঙালিও কিছুদিন আগে পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করতো, এখন বোধহয় করে না।

১৯৯১ সালে ইডেনের সেই দিন
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, নেশায় ক্রিকেট। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললে ইট ক্রিকেট,স্লিপ ক্রিকেট। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন ক্রিকেট দেখার শুরু, বাবা বলেছিলেন, প্রকৃত ক্রিকেট বুঝতে হলে গাভাসকার এবং বয়কটের কমেন্ট্রি শুনতে এবং বুঝতে হবে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এখনও ক্রিকেট দেখে চলা এবং সামান্য কিছু কাজ করার চেষ্টা যার প্রথম ফসল ছিল ২০২১-এ প্রকাশিত উইলোর উইল নামক ক্রিকেট পূজাবার্ষিকী আর আপাতত চলছে উইলোর উইল -এর ইউটিউব চ্যানেল (https://youtube.com/@willowrwill_cricket?si=tPGZsqxsFNkcQoZj)। স্বপ্ন অবশ্যই ক্রিকেট নিয়ে আরও কাজ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *