চাঁদা: পুজোর অন্যতম অনুষঙ্গ

চাঁদা: পুজোর অন্যতম অনুষঙ্গ

ঠিক সক্কালবেলা, খয়েরের ছোপধরা দাঁতের হাসি দেখতে কেমন লাগে? 

না না, খয়ের কোনো দোষ করেনি। ‘পানাসক্ত’ মানুষের হাসি নিয়েও মোটেই মন্দ বলছি না। কিন্তু তারপরেই লালচে রঙের পাতলা যে কাগজটা নাকের সামনে পতপত করে উড়বে সেটা দেখে সত্যিই কান্না পাবে। ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ মার্কা অনুভূতি বিনবিন করে জমবে ঠিক টাকের মাঝখানে। ট্যাবলা সুবলদের মুখের ওপর সাঁ করে চোখ চালিয়ে ওই গোলাপি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম, তলায় লেখা “দুর্গাপূজার চাঁদা বাবদ সানন্দে গৃহীত হল।” শুধু টাকার পরিমাণটা এখনও বসেনি। 

“কাকু চাঁদাটা?” 

সবকটাকে চিনি ভালো করে। এরাই বছর পাঁচেক আগে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে আসত। “সরস্বতী” বানান ভুল বললে দশ টাকার বদলে আট টাকা চাঁদা দিতাম। কিন্তু এই দুর্গাপুজোর চাঁদা তো দশ টাকায় হবে না। পাশে আরও দুটো শূন্য বসবে হয়ত। ‘সরস্বতী’ বানান ধরার বয়স এদের পেরিয়ে গেছে, তাই গোঁফ নাচিয়ে প্রশ্ন করলুম, “চাঁদা নিয়ে পুজো তো করছ, বলো দিকি প্রথম বারোয়ারি পুজো কবে কারা করেছিল?”

ও হরি! দমবার পাত্র নয় এরা। বাবুল বলে ছেলেটা বেশ পড়াশোনা করে। এগিয়ে এসে হেসে বলে, “তা আর জানিনা? গুপ্তিপাড়ায়, বারোজন ব্রাহ্মণ মিলে প্রথম বারোয়ারি পুজো শুরু করে।”

“হুম। কেন সে পুজো শুরু হল সেটা জানিস?”

ওদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে আমিই লেকচার দেবার কায়দায় শুরু করলাম, “বারোয়ারি, মানে বারো ইয়ারি। বারোজন ব্রাহ্মণ মিলে প্রথম বারোয়ারি পুজো শুরু করে। হ্যাঁ, হুগলীর গুপ্তিপাড়ায়। শুধু রাজা বা ভূস্বামীর বাড়িতে পুজো হত তখন।  

“সালটা ছিল ১৭৯০। আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কাশফুলে আর শিউলিতে সেজে উঠেছে প্রকৃতি। এমনই এক আশ্বিনের শারদ বিকেলে বসে পুকুর পাড়ে বসে গল্পে মজলিস ছিলেন ১২ জন বন্ধ‌ু। হরেক রকম আড্ডার বিষয়ে আলোচনার মাঝেই উঠে এসেছিল সেকালের বাবুদের দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ। ক্ষোভ ফেটে বেরিয়ে এল সকলের যেন সকলের চোখে মুখে! আর সেই ক্ষোভ থেকেই জন্ম নিল চিরপরিচিত বারোয়ারি পুজো।

“বুঝলি তো, সেকালের বাবুদের বাড়িতে ধুমধাম করে দু্র্গাপুজো হত। আলোর রোশনাই, ঢাকের আওয়াজে গমগম করত গোটা এলাকা। কিন্তু সেই দুর্গা মা-কে দেখার অধিকার ছিল না সবার। দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির সদর দরজায়, হাতে চাবুক নিয়ে। যাদের খাতির করে ডাকা হত, সেই অতিথিদেরই একমাত্র অধিকার ছিল এই দুর্গাঠাকুর দেখার। সাড়ম্বরে স্বাগত জানানো হত তাঁদের। তার বাইরে, সাধারণ গরিব মনুষজন যদি ভুলবশত ঢোকার চেষ্টা করত বাবুদের বাড়িতে, তাহলেই পিঠে পড়ত চাবুক। আরতির প্রদীপে সজল চোখে মা দুর্গা দেখতেন তার গরিব সন্তানরা মার খেয়ে ফিরে যাচ্ছে ।

“সেই রাগ-দু্:খ-ক্ষোভ থেকেই জন্ম নিল বারোয়ারি পুজো। ১৯৭০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন ব্রাহ্মণ বন্ধ‌ু মিলে পুজো করবেন বলে ঠিক করেন। সেই শুরু। ধনীর অঙ্গন ছেড়ে পুজো নেমে এল জনসাধারণের কাছে। সেই শুরু। তবে, হুগলির গুপ্তিপাড়ার আদর্শ অনুসরণ করে মফঃস্বলে বেশ কিছু এলাকাতেও শুরু হয় বারোয়ারি পুজো। কিন্তু বারোয়ারি পুজোর ঢেউয়ের আঁচ কলকাতায় এসে পৌঁছতে সময় লেগেছে আরও ১০০বছর। 

 “কলকাতায় এ ধরনের পুজো প্রথম শুরু হয় কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথের বাড়িতে। পরে আর্থিক অনটন-সহ আরও বেশ কিছু কারণে ওই এলাকার বেশ কিছু মানুষ চাঁদা তুলে পুজো করতে শুরু করেন ১৯১০ সাল থেকে । ভবানীপুরের সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার এই পুজোয় বহু মানুষ অংশ নিয়েছিলেন । তারপর থেকেই এটি বিখ্যাত বারোয়ারি পুজো নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।  

“ভবানীপুরের সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বারোয়ারি পুজো আয়োজিত হয় শহরের বুকে। ১৯১১ সাল থেকে শুরু হয় শ্যামপুকুর আদি সার্বজনীন দু্র্গোৎসব, শ্যামবাজারের শিকদারবাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান অর্থাৎ যেটি বর্তমানে বাগবাজার সার্বজনীন।”

বলতে বলতে আমার চোখ গেল বাইরে। সোনামুঠি রোদ উৎসবের আলোয় সাজিয়ে তুলছে এই মধ্যবিত্ত পাড়াকে। বাল্বের মালায় সাজছে হতশ্রী বাড়িগুলো। শ্যাওলা রঙের সানসেটে লুটিয়ে থাকা শুকোতে দেওয়া লাল শাড়ির মত মনকেমন করে দেওয়া মিঠে রোদ। হয়ত প্রথমবারের সেই বারোয়ারি পুজোয় গাঁ-গঞ্জের আদুর গায়ের কালো ছেলেটা এমনিই ভালোলাগার রোদ মেখে ঢাকের তালে নেচেছিল। ওদের সাদা চোখে ছিল অনেকটা শরৎ-আকাশ। পাড়াঘরের ঝি বৌরা ঘোমটার আড়াল থেকে মায়ের মুখখানা দেখে মনে মনে ভেবেছিল নিজের আটবছুরে কন্যের মুখ, বলেছিল, “আমার ছোট্ট মেয়েটা আর বছর পরের ঘরে গেল গো। তুমি তাকে রককে কোরো মাগো।”

“কাকু চাঁদাটা?” 

“ও হ্যাঁ, সেই যে বারো জন বামুন বারোয়ারি পুজো শুরু করল, এই চাঁদার অত্যাচারটাও তাদেরই অবদান। তারাও টাকা তুলেই পুজো করেছিল কিনা।” বিরক্ত হয়ে বললাম।

“তাহলে? এই যে বলেন আগের সব ভালো ছিল। এখন সব খারাপ।”

“মোটেই ভালো নয়। সেকালেও লোকজন বেশ বিরক্ত হত।” ওদের দাঁড় করিয়ে ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ পেড়ে আনলাম। আরও কিছু বই আনলাম। এবার জমিয়ে বসে শুরু করলাম বলা…

 “ঠিক যখন পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষার সবে মেলবন্ধন ঘটছে দেশিয় সংস্কৃতির সঙ্গে, তখনকার নব্য ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে সমাজে দুর্গাপূজা করতে চাঁদা তোলা বা ‘চাঁদা সাধা’র সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন কালীপ্রসন্ন। পুজোর নামে চাঁদা আদায় করে বারোয়ারি মাতব্বররা তথা ঊনিশ শতকের বাবুসমাজ নিজেদের আমোদ-প্রমোদের স্রোতে ভাসিয়ে দিত। যাত্রা, গান, বাঈনাচ, খেমটা ইত্যাদি ছিল এই আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ-উল্লাসের প্রধান লক্ষ্য। হুতোম লিখেছিলেন –

বারোজন একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজো করার প্রথা মড়ক হতেই সৃষ্টি হয় – ক্রমে সেই অবধি ‘মা’ ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ার দলে গিয়ে পড়েন। মহাজন, গোলদার, দোকানদার ও হেটোরাই বারইয়ারি পূজার প্রধান উদ্যোগী। সংবৎসর যার যত মাল বিক্রি ও চালান হয়, মণ পিছু এক কড়া বা পাঁচ কড়ার হিসেবে বারইয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ও ইয়ারগোছের সৌখিন লোকের কাছেই ঐ টাকা জমা হয়; তিনি বারইয়ারি পূজার অধ্যক্ষ হন – অন্য চাঁদা আদায় করা, চাঁদার জন্য ফেরা ও বারইয়ারি সং ও তামাশার বন্দোবস্ত করা তারই ভার হয়।

“চাঁদা চাইতে গেলে কী হত? হুতোম লিখেছেন, ‘গলাধাক্কা তামাসা ঠোনাটা ঠানাটা সইতে হল!’ শুধু তাই নয়, ‘অনেক চোটের কতা কয়ে বড় মানুষদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন!’  

“তখনকার পুজোর মুখে সকাল হতে না হতেই পুজোর উদ্যোক্তারা চাঁদার জন্য দরজায়-দরজায় হানা দিয়ে অনুরোধ-উপরোধ-হম্বিতম্বি সব রকমের অস্ত্রই প্রয়োগ করতেন। তবে গোড়ার দিকে ব্যাপারটা খুব একটা সহজ ছিল না। অনেকক্ষণ চাঁদার জন্য দাঁড়িয়ে থেকে দু’একটা বেয়াড়া রকমের দারোয়ানি ঠাট্টাও হজম করতে হত চাঁদা আদায়কারীদের। চাঁদা রশিদে কাটা হত না অবশ্য। ছোট্ট কাপড়ের বাক্স বা ঝুলি নিয়ে ঘুরে চাঁদা তোলা হত। শুধু টাকা নয়, ফলমূল তরি তরকারিও দেওয়া হত বারোয়ারি দুর্গোৎসবের চাঁদা হিসাবে। 

“চাঁদা দিতে না চাওয়া গৃহস্থের ওপর নানা উপদ্রব আসত। এই যেমন এখনও চওড়া ঝুলফি শ স ষ সবকটাকেই দন্তমূলীয় উচ্চারণে এনে শাসায়, ‘মাসিমা, ভালো হবে না বলছি। আমরা সব পাড়ার ছেলেপিলে, একডাকেই পাবেন। চটালে কিন্তু বিপদ সামলাতে পারবেন না!’ তারপরেই হয়ত দেখা গেল, চাঁদা না দেওয়া বাড়ির নতুন চুন করা দেওয়ালে কালি লেপা। তখনও হত এসব। হয়ত অন্যভাবে। কীভাবে জানিস? এই দেখ! ১৮২০ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। এখানে লিখছে,  

হিন্দুস্থানের মধ্যে শরৎকালীন দেবীপূজা অনেক স্থানে হয় বিশেষত গঙ্গা নদীর উভয় পার্শ্বে অধিক সমারোহ হয়। যদি কোন ভাগ্যবান হিন্দু এপূজা না করে তবে রীতি আছে যে রাত্রিকালে প্রতিমা আনিয়া লোকেরা সঙ্গোপনে তাহার চণ্ডীমণ্ডপে রাখিয়া যায়। পরে গৃহস্থ ব্যক্তি ধর্মভয়ে কিংবা লোকভয়ে যেরূপে হয় তাঁহার পূজা করে।

“চাঁদা না দিলে দুর্গার মূর্তি ফেলা হত রাতের অন্ধকারে। গৃহস্থ বাধ্য হত পুজো করতে। তাতে চাঁদা বাবদ যে খরচ হবার, তার চেয়ে বেশিই হত। সাধারণতঃ কৃপণরাই এই চপল অত্যাচারের বলি হতেন। বিদ্বেষবশতঃ কখনও কখনও নিরীহ গরিবদেরও এই বিপদে ফেলা হত। 

“তবে প্রতিবাদ তখনও হত। ১৮২০ সালে বেলঘরিয়ার জনৈক ব্যক্তির বাড়ির সামনে দুর্গা ফেলা হয়। তো তিনি সেটা দেখে রেগে টং।  তারপর বাড়িতে ফেলে দিয়ে যাওয়া দোমাটিয়া দুর্গাপ্রতিমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। তার ফল স্বরূপ নিশ্চয়ই সে যুগে নানা কটূক্তির শিকার তিনি হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা মনের মধ্যে বসে থাকা ধর্মভয়। ‘ঠাকুর দেবতার নামে চাইছে, দিয়ে দিই বাবা,’এই ভেবে এই যুগেও কত মানুষ কপালে আর থুতনিতে টাকা ছুঁইয়ে চাঁদাওয়ালাদের হাতে দিয়ে দেয়। বাহ্যিক ভয়ের সঙ্গে থাকে অন্তরের ধর্মভয়। সেটা অতিক্রম করতে পারা কম কথা নয়।

“তবে চাঁদার অত্যাচার নিয়ে সরব হতেন তখনও কিছু মানুষ। বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠি লিখতেন চাঁদার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য। ১৮৭১ সালে ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত এরকমই একটি চিঠি থেকে পড়ছি শোন,

কোন কোন ব্যক্তি মাসে মাসে দর মাহের কর্ম করিয়া অতি কষ্টে সংসার নির্বাহ করে। তাহাদের নিকট ১০ টাকা বারইয়ারির চাঁদার নিমিত্ত দাওয়া করা হয়। ইহাতে যদ্যাপি বলিবামাত্র গৃহস্থরা যে কোন প্রকারে হউক প্রদান করে, তাহা হইলেই ত ডেকরাদিগের নিকট নিস্তার, নতুবা তাহাকে সর্বস্বান্ত করিয়া সমুদয় দ্রব্যাদি কাড়িয়া লইয়া যায়, এবং তাহাতে যদ্যাপি সেই গৃহস্থেরা দ্বিরুক্তি করে তাহা হইলে জন্মের মত তাহাকে একঘরে করিয়া রাখে। 

“সত্যিই ধর্মের নামে টাকা তোলা, আর সেটা দিতে না পারলে একঘরে। ধর্ম কী আসলে? সেটাই তো ধর্ম যা মানুষকে ধারণ করে। আহত করে না, বিচ্ছিন্ন করে না!” 

“কিন্তু জেঠু, চাঁদা কেউ না দিলে পুজোটা হবে কীকরে? আগেকার দিনে কেউ কেউ তো ভালোবেসে দিত, নাকি?” ট্যাবলার প্রশ্নে পয়েন্ট আছে। 

“হ্যাঁ এটাও সত্যি, সব সময়ে জোর জুলুম নয়, পাড়ার ছেলেরা কৃপণ কোনো অভিভাবক স্থানীয় প্রৌঢ়ের কাছে গিয়ে বাক কুশলতায় চাঁদা বের করে আনত। সকলে মিলে আনন্দ করত সেই উৎসবে। এমনকি যিনি টাকা দিতে বাধ্য হলেন, তিনিও ভেতর ভেতর স্নেহের হাসি হাসতেন। 

  “কলকাতার পুরোনো পাড়ায় এই চাঁদা তোলা নিয়ে কয়েকটা মজার গল্প মুখে মুখে প্ৰচলিত। একবার এক বারোয়ারি পুজোর পাণ্ডারা চাঁদা তুলতে গিয়েছিলেন এক বেনের দোকানে। বেনে বাবুটির একচোখ কানা এবং ভদ্রলোক ডাহা কৃপণ। একটি পয়সাও চাঁদা দিতে নারাজ। কস্মিনকালেও এক কানাকড়ি বাজে খরচা করতেন না। চাঁদা চাওয়া পার্টি পুজোর জন্য খরচের বহর শোনাচ্ছে, ইনিও সবই বাড়তি খরচ বলে বাতিল করে দিচ্ছেন। হঠাৎ চাঁদার দলের পাণ্ডাদের একজনের নজরে পড়ল যে একচোখে কানা হয়েও বেনেবাবুর দু’চোখেই কাঁচ লাগানো চশমা। সুতরাং এই বাড়তি কাঁচ ব্যবহার তাঁর বাড়তি খরচের মধ্যেই পড়ছে। তর্কে যুক্তি না মেনে পারলেন না বেনেবাবু। শেষ পর্যন্ত অতি কষ্টে দু’সিকি চাঁদা দিয়েছিলেন তিনি!

“চাঁদা আদায়কারীদের আরেক ফন্দির কবলে পড়েছিলেন সিঙ্গিবাবু নামে এক ভদ্রলোক। চাঁদা আদায়কারীরা তাঁকে বলেছিল, ‘মশাই! মা ভগবতী সিঙ্গির ওপরে চড়ে কৈলাশ থেকে আসছিলেন, কিন্তু পথে সিঙ্গির পা ভেঙ্গেছে। তাই স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে আমরা অন্য কোন সিঙ্গির সন্ধানে বেরিয়ে আপনাকে পেয়েছি।” অতএব! না, সিঙ্গিবাবুকে মা ভগবতীর বাহন হতে হয়নি, তবে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে রেহাই পেতে হয়েছিল।

   “এখন যেমন গাড়ি থামিয়ে চাঁদা নেওয়া হয়, তখনও হত। চাঁদার জোর-জুলুম আর উৎপাত বন্ধ করতে সে যুগেও আয়োজন ছিল। তৎকালীন ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকা থেকে জানা যায় যে, একবার বেহালা অঞ্চলের বারোয়ারি পূজার চাঁদা আদায়ের জুলুমের ফলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন; এমনকি ডুলি-পাল্কির মেয়ে সওয়ারি পর্যন্ত সেই অত্যাচার থেকে রেহাই পেতেন না। অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে তৎকালীন চব্বিশ পরগণার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেটন সাহেব নিজে একবার গৃহবধূ সেজে পাল্কিতে চেপে ওই পথে চললেন। যথারীতি মস্তানরা চাঁদার জন্য পাল্কি আটকাল। কথা কাটাকাটি হচ্ছে বেহারাদের সঙ্গে চাঁদা পার্টির। এমন সময়ে পেটন সাহেব পাল্কির ঘেরাটোপ সরিয়ে নেমে এসে ঝপ করে কয়েকজনকে পাকড়াও করেন। এঁদের দীর্ঘ মেয়াদী কারাদণ্ড হয়েছিল। এটা ছিল ১৮৪০ সালের ঘটনা!”

 তাহলে? 

না না, এতক্ষণ ধরে এত কথার পরেও চাঁদা থেকে বাঁচা গেল না। দিতেই হল কড়কড়ে পাঁচশো, দরদস্তুর করে। সেদিনের বারোয়ারি পুজো আজ সার্বজনীন। “বলো দুর্গা মা মায়ি কি…” শুনতে শুনতে আর ঝোড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে পাঁচশো টাকার শোক ভোলার চেষ্টা করতে করতে এটাই ভাবলাম, অন্তত চাঁদা তুলে পুজো শুরু হয়েছিল বলেই মা দুগ্গা ধনীর প্রাসাদ থেকে সাধারণের মা হয়ে উঠলেন। সত্যিই তো দুর্গাপুজোর খরচ তুলতে স্পন্সরশিপ , প্রশাসনিক আনুকূল্য এসব তো একেবারেই হালের। সে জন্য পাড়ার ঘরোয়া পরিবেশে পুজোর জায়গায় হচ্ছে থিম পুজো। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত শহর, শহরতলী, গাঁ গঞ্জে পাড়া ছিল প্রায় বর্ধিত পরিবারের মত। বারোয়ারি পুজো ছিল সবার সারা বছরের অপেক্ষার অদ্ভুত আবেগ। আর সেটা সম্ভব করে তুলতে চাঁদা তুলতে হত। জোর জুলুম নিশ্চয়ই হত, এবং সেটার বলি হত সাধারণ মানুষ। কিন্তু সম্পন্ন গৃহস্থরা খুশি হয়েও দিতেন। ঢাকের বোলে, উৎসবের আলোয় বেজে উঠত আনন্দের আগমনী।

তথ্যসূত্র

১- বাংলার দুর্গোৎসব, নির্মল কর

২- বঙ্গে শারদোৎসব ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা, শিবশংকর ঘোষ

 
হৈমন্তী ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষিকা। মূলত নিবিড় পাঠক। তুলি নিয়ে রঙের বাহারে প্রকৃতির ছবি আঁকা এবং কলমে ভাবনাকে রূপ দেওয়াই প্যাশন। ছাত্রাবস্থায় লেখালিখির সূচনা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও সংকলনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *