বইমেলার বারোমাস্যা
সে সময় চাঁদমামার জন্য অপেক্ষা ছিল।
ছিল মিঠে রোদে, আমকাঁঠালের
ছায়ায় বসে গল্পের বই
পড়তে পড়তে কল্পনায় ভেসে
যাওয়া। স্কুলে বিশাল লাইব্রেরি রুমে বড় বড়
কাচের আলমারি ভর্তি বই দেখে বিস্ময়ে
তাকিয়ে থাকা ছিল। লাইব্রেরি
ক্লাস কেন সপ্তাহে ছয়দিন
নয়, এই নিয়ে মনে
মনে ক্ষোভ ছিল। একদিন বাবা
অফিস থেকে ফিরে বললেন,
আমাদের মফস্বল শহরের কলেজ স্ট্রিটে নাকি
বইমেলা হচ্ছে। সামনের রবিবার আমাদের নিয়ে যাবেন।
বইমেলা!
সেটা কী? আমি তো
শুধু বারোদোলের মেলা জানি। সেখানে
হাঁড়িকুড়ি–পুতুল–খেলনা–তেলেভাজার দোকান! বই নিয়ে আবার
মেলা হয় নাকি? বাবা
হাসলেন, “গেলেই দেখতে পাবি।” উৎকণ্ঠা,
উত্তেজনায় ফুটছি আমি। মনে মনে
সেই স্বপ্নের মেলাটির ছবি আঁকছি।
“বুঝলে
রিক্সাকাকু, সে একেবারে বইয়ের
সমুদ্দুর! যেদিকে তাকাও, সেদিকেই বই!”
রিক্সাকাকুকে
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাল্পনিক বইমেলার গল্প শোনাচ্ছি। কল্পনার
পাখি বাধাহীন উড়ান দিয়েছে, “জানো
তো, বারোদোলের মেলায় যেমন হাঁকে, ‘যা
নেবেন দু‘টাকা,দু‘টাকা‘, এখানেও হাঁকবে, ‘যে কোনো বই
দু‘টাকা, দু‘টাকা‘।
উফ্ কী আনন্দ! আমি
অনেক বই কিনব।“
রিক্সাকাকু
বিস্মিত। আমি গর্বিত। কত
জানি আমি, বাব্বা! বইমেলা
বলে কথা!
রবিবার
নিজের ইচ্ছায় সাবান ঘষে ভালো জামা
পরে দুইবোন বাবার সাইকেলে চেপে পৌঁছলাম বইমেলায়।
কিন্তু এ কী! কোনো
চিৎকার নেই তো? ‘সব
বই দু‘টাকা, যা
নেবেন দু‘টাকা‘ হাঁক
তো শোনা যাচ্ছে না!
তাছাড়া এ তো প্যান্ডেলের
মধ্যে ঘেরা জায়গা! খোলা
আকাশ কই? এ আবার
মেলা নাকি?মুখটা ব্যাজার হল। কিন্তু ভেতরে
যে কী বিস্ময় অপেক্ষা
করে আছে, তা তো
তখনও জানি না! আজও
মনে পড়ে, মেলায় ঢুকে
আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। এত্ত বই একজায়গায়!
এত্ত বই! এও কি সম্ভব?
বাবা
হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে
চললেন মেলার ভেতরে। আমি মনে মনে
সব বই কিনে ফেলেছি
ততক্ষণে। বাবা খুব নীচু স্বরে
বললেন, “দুজনেই একটা একটা করে
বই পছন্দ করো। তিরিশ টাকার
ভেতর। কেমন?” এই বলে একটা
স্টলে আমাকে আর বোনকে ঢুকিয়ে
দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
আমি
একের পর এক নানা
বই তুলে নিচ্ছি হাতে।
সবগুলোই যে কিনে নিতে
ইচ্ছে করছে! পড়ছি মন দিয়ে।
কী কী পড়েছিলাম মনে
নেই আজ, শুধু মনে
আছে লীলা মজুমদার সম্পাদিত
কিশোর সমগ্র বইটি কিনেছিলাম। এখনো
আমার কাছে আছে সে
বই। বোন কিনেছিল ঠাকুর্দার
ঝুলি। ঠাকুরমার ঝুলি নয় কিন্তু।
ব্রাউন পেপারে মুড়ে দেওয়া বইটা
বুকে চেপে মেলায় ঘুরেছিলাম।
মোটা মোটা বইগুলো দেখে
খুব ইচ্ছে হয়েছিল একটা অন্তত আমার
হোক। থাকতে না পেরে শেষে
বলেই ফেললাম, “ঐ মোটা বইগুলোর
কত দাম বাবা?”
বাবা
মাথায় হাত রেখে বললেন,
“পড়াশোনা করো, চাকরি পাও,
তাহলে কিনতে পারবে।“
কতক্ষণ
ঘুরেছিলাম ঠিক মনে নেই।
হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা, তাও
রাতে ঘুম আসছে না।
চোখ বুজলেই যে দেখছি রাশি
রাশি বই! ঠাকুমার পাশে
শুয়ে জেগেই আছি। শুনলাম পাশের
ঘরে বাবা মাকে বলছেন,
“মেয়েটা যেন অন্য
জগতে চলে গিয়েছিল। আমার
সাধ্য কোথায় ওর
সাধ পূরণ করি?”
বাবার
গলায় কেমন একটা যেন
অসহায়তার বেদনা ছুঁয়ে গেল আমায়। ছোট্ট আমি মনে মনে
ঠিক করে নিলাম, আর কখনো বইমেলায়
যাব না।
দূর,
তাই কি হয়! আমি
বইমেলায় না গেলেও এবার
বইমেলা চলে এল আমার
কাছে। আমি যেখানে পড়ি, সেই কৃষ্ণনগর
গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলের নিজস্ব ভবনের কয়েকটা ঘরে বইমেলা বসল।
কেবল বিদ্যালয়ের মেয়েরাই
তাতে অংশ নিতে পারবে। ঘটনাটা বোধহয়
প্রথম বইমেলা দেখার দুবছর পরের। তিনটে ঘরে লম্বা লম্বা
টেবিলে বই রাখা। এইখানে
ভারী মজার একটা ব্যাপার ঘটে গেল। আমি
ছিলাম স্কুলের বইমেলার ভলান্টিয়ার। দীর্ঘ সময় ধরে একটা ঘরে
লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব ছিল আমার। খুব
সুবিধেই হল তাতে। বইকাকুদের
থেকে চেয়ে দু‘তিনটে
বই বেশ অনেকক্ষণ ধরে
পড়েছিলাম। তার মধ্যে একটা
ছিল ‘রাশিয়ার উপকথা’। বইটাতে লালরঙে আঁকা সুন্দর সব
ছবি ছিল, বেশ মনে
আছে। বই পড়তে পড়তে
বরফঢাকা স্তেপের বাসিন্দা ইভান কখন যেন
আমার খুব বন্ধু হয়ে
গেল।
আমি
সেবার কোনো বই কিনতে
পারিনি কিন্তু আমার বন্ধু মহুয়া
কিনেছিল। অবন ঠাকুরের ‘বুড়ো
আংলা’। আমায় পড়তেও দিয়েছিল।
একনিঃশ্বাসে পড়া শেষ। একদিন
বাদে বইটা ওকে ফেরৎ
দিতে গেলাম। মহুয়া তো অবাক! খুব
সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছিল, আমি
নাকি বইটা পড়িইনি! ওকে
বোঝাতে পারিনি আমার বই পড়ার
খিদে, নাওয়া–খাওয়া ভুলে বইয়ের পাতায়
চোখ সেঁটে বসে থাকার অভ্যাস।
বুড়ো আংলার তিন ডবল মোটা
বই আমি একদিনে পড়তে
পারি। অনেক পরে মহুয়াকে
সেটা কাজে করে দেখিয়েছিলাম।
অবাক হয়েছিল, সন্দেহ নেই।
এই করে করে বড়
হওয়া। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেল
কত জল, কত ফুল
ঝরে গেল, কত স্বপ্ন
ভেঙে গেল, তারপর এক
দিন হাতে হাত তুলে
নিয়ে সে প্রথম নিয়ে
এল কলকাতা বইমেলায়। সেটা দুহাজার সাল, নতুন শতাব্দী।
আমি থরথর করে কেঁপে
উঠলাম উত্তেজনায়। কত বছর পর
আমি বইমেলায়,কত বছর পর!
আমার শহর কল্যাণীতে
তখনো বইমেলা শুরু হয়নি, কলকাতাতেই
বইমেলা হয় প্রতি বছর।
সঙ্গী মানুষটি মেলায় মাটিতে বসে ছবি আঁকে,কার্ড আঁকে। অনেকেই কিনে নেন। সে–ই আমায় চিনিয়ে
দিল আনন্দ,
দে‘জ, প্রান্তিক, বিশ্বভারতী
আরো কত বিখ্যাত
প্রকাশনা। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে
কেবল বই দেখছি, দেখেই যাচ্ছি। কেনার ক্ষমতা নেই। মাত্র পঞ্চাশটি
টাকা আছে সঙ্গে। এত
দূরের পথ ফিরব, ওটুকুই
তো আমার সম্বল, খরচ করলে বাড়ি
যাব কী করে! খানিক
পর ছেলেটি এসে হাতে গুঁজে
দিল নিজের সস্তার মানিব্যাগ। আশ্চর্য চোখে চেয়ে বলল, “চারদিনের ছবি বিক্রির টাকা
আছে। সবটা তোর। যা
খুশি কিনে নে।“
আমার
গলা তখন প্রায় বন্ধ।
রাশি রাশি কান্না ফেনার
মতো উঠে আসছে। ঢোঁক
গিলে কোনোমতে বললাম, “তোর কী থাকবে
তবে?”
কী এক অসম্ভব মায়াজড়ানো স্বরে
বলেছিল, “কেন, তুই!”
একমুহূর্তে
বিরাট আকাশটা নেমে এল নিচে, আমার
হাতের নাগালে।
কিনেছিলাম
রাজসিংহ, মধুসূদন রচনাবলী, বিদ্যাসাগর সমগ্র,
শেক্সপিয়র সমগ্র, সুকুমার সমগ্র, পদ্মানদীর মাঝি…কী আশ্চর্য সবগুলোই
ছিল কোনো না কোনোভাবে
আমার সিলেবাসের অঙ্গ। অর্থাৎ পড়াশোনার কাজেও লাগবে তারা। নিজেকে খুব বড়লোক মনে
হচ্ছিল। তার মুখেও হাসি।
হাত ধরে নিয়ে গেল
ফুডকোর্টে। আবার আমার অবাক
হবার পালা! নাম না জানা
সব খাদ্যের সমাহার।
থালা জুড়ে ছোট ছোট
সাদা পুঁটলি। সঙ্গে ঘন লাল সস।
মুখে দিতেই মনে হল আহা,
কী স্বাদ! এমন উচ্চবর্গীয় খাদ্য না হলে
বইমেলায় মানায়? শুনলাম, এর নাম ‘মোমো’।
হবেও বা, কোনোদিন তো খাইনি এসব!
খাওয়া
শেষ, দুজনে আবার ফিরেছি মেলায়।
মাটিতে ছড়িয়ে বসে আবার সে
আঁকতে শুরু করেছে। আমি স্টলগুলো
ঘুরে ঘুরে দেখছি। আনন্দ পাবলিশার্সে এসে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের
‘কাছের মানুষ‘ বইটি হাতে
নিয়ে পড়ছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল কিনতে। কিন্তু আর যে পয়সা নেই!
কাঁধে হাত রেখে ছেলেটি মলিন মুখে বলল, “আজ পারলাম না দিতে, একদিন ঠিক দেব।”
কথা রেখেছিল সে।
মেলা
থেকে এবার বাড়ির পথ
ধরেছি। স্বপ্নের ফেরিওলা ফেরার পথে এবার এক
আশ্চর্য স্বপ্ন দেখাল, “তোমার বই একদিন এই
বইমেলায় থাকবে, দেখো।”
শিহরিত
আমি, এ যে অসম্ভব
এক স্বপ্ন! যাকে লালন করার
মতো সাহস, সামর্থ্য, শক্তি – কিছুই
আমার নেই!
জীবন
বড় বিস্ময়ের, কত অপ্রত্যাশিত পাওয়া
ছড়িয়ে থাকে পথের বাঁকে
বাঁকে! যেদিন
কল্যাণী বইমেলায় ‘রা প্রকাশন‘ থেকে
আমার গল্পের বই ‘সাপলুডো‘ প্রকাশ
পেল, কেঁদেছিলাম আবারও। কালো অক্ষরের সমাহার
চিরকাল আমায় কত ভাবেই
না আলো দিয়েছে। বইমেলায়
দাঁড়িয়ে নিজের বইতে সই করছিলাম,
যেন স্বপ্নের মত সবকিছু। কারা
যেন হাততালি দিয়ে উঠল, কারা
ফিসফিস করে বলল, “অভিনন্দন।”
আমি হেঁটে বেড়াই বইমেলা জুড়ে। ছেলেটি এখনো হাতে হাত
রেখে স্বপ্ন দেখায়।
* অবসর পত্রিকা গ্ৰুপের ইভেন্ট থেকে নির্বাচিত লেখা