শেষের সে দিন ভালোবাসার
এ জীবন বড় সুন্দর কিন্তু ক্ষণস্থায়ী, একদিন না একদিন প্রদীপ নিভে যাবে জেনেও পথচলা। এককালের সুস্থ, সতেজ দেহ বয়সের ভারে ন্যুব্জ, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত – জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে এগুলোই চরম এবং একমাত্র সত্য। আমেরিকায় গ্যাসের দামের পর যদি কিছু অসম্ভব ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে থাকে তবে তা হল চিকিৎসা পরিষেবা। সমস্ত ব্যাপারটাই বিভিন্ন চিকিৎসা সংক্রান্ত বিমা কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের প্রিমিয়ামের হারও অত্যন্ত বেশি। ভারতীয় মা বাবারা তাঁদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে স্বনির্ভর করে তোলেন, তাদের মধ্যে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ এই আমেরিকায় এসে পাকাপাকি ভাবে থেকে যায় জীবিকার সন্ধানে। পরবর্তীকালে এমন একটা সময় আসে যখন অভিভাবকরা বৃদ্ধ ও অথর্ব হয়ে পড়েন, তাঁদের নিয়মিত দেখভাল অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, অভিবাসী ভারতীয় সন্তানেরা মানসিক টানাপোড়েনের শিকার হয়ে পড়ে।
শুধু অভিবাসী কেন খোদ আমেরিকানদেরও বিরাট সমস্যা জরাগ্রস্ত অভিভাবকদের ভার বহন করা। সকলেই যন্ত্রের মতো ছুটছে, স্বামী স্ত্রী উভয়ের কর্ম সংস্থানের ফলেই সংসারের বিপুল ব্যয়ভার সামলে ওঠা সম্ভব। তখন কে দেখবে এই সমস্ত অসহায় মানুষদের, যাঁরা মৃত্যুপথযাত্রী, চিকিৎসায় যাঁদের কোনো সুরাহা হবে না, শুধু প্রয়োজন একটু সেবা যত্নের। এঁদের কথা ভেবেই গড়ে উঠেছে ‘হসপিস(hospice.)’ ল্যাটিন শব্দ hospis, যার ইংরেজিতে অর্থ host and guest, অর্থাৎ আতিথেয়তা অথবা অতিথি সৎকারতাই এই শব্দের ভাবার্থ। প্রথম হসপিসের সন্ধান পাওয়া গেছে ১০৬৫ সালে মাল্টাততে, যেখানে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় মানুষদের সেবা করা হত। আমেরিকাতে স্বেচ্ছাসেবকরা একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন এই হসপিস গড়ে তোলার পেছনে। নিজের গৃহে একাকী মারা যাচ্ছেন, সমাজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, অথবা হাসপাতালেই দীর্ঘকাল মৃতপ্রায় এ ধরণের মানুষের কথা ভেবেই তাঁরা কাজকর্ম শুরু করেন। এরপর ২০১০ সালে আনুমানিক ১০ লক্ষেরও বেশি আমেরিকান এই সেবার অন্তর্ভুক্ত হন। এ সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে গেলেও বিমা কোম্পানির মাধ্যমেই যেতে হবে, তারা অবশ্য এরপর সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় বয়স্কদের জন্য সরকার বেশ কিছু বিমা কোম্পানির প্রচলন করেছেন যেগুলোতে প্রায় নিখরচায় চিকিৎসা সম্ভব কিন্তু হসপিসের অন্তর্গত হতে হলে অন্ততঃপক্ষে দুজন ডাক্তারের সুপারিশ প্রয়োজন। এই হসপিস আবার অনেক ধরণের হয়, যাঁরা বড় জোর মাস ছয়েক বাঁচবেন বলে অনুমান করা হয় তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো রকম চিকিৎসা করা হয় না, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয় শেষ পরিণতির জন্য। পুরোহিত ওঁদের বাড়ি গিয়ে ধর্ম কথা শোনান, সব রকম শারীরিক যন্ত্রণা থেকে ওঁদের মুক্তি দেওয়া হয়, এর জন্য মরফিন ব্যবহার করতেও কোনো বাধা নেই। আর এক ধরণের হসপিস রয়েছে যেখানে মানুষ নিজের বাড়িতে থেকেই এই পরিষেবার অন্তর্গত হতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের এমন কোনো অসুস্থতা থাকতে হবে যা তাঁদের হসপিসে থাকার যোগ্য হিসাবে প্রমাণিত করবে। সম্প্রতি অভিবাসী ভারতীয়রা অনেকেই আগ্রহী হয়েছেন তাঁদের বাবা মা কে বৃদ্ধ বয়সে এদেশে নিয়ে আসতে। এক্ষেত্রে প্রথমেই যে বিশাল বাধা উপস্থিত হয় সেটা হল মা বাবাকে শিকড় উপড়ে ফেলে বিদেশে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করাতে রাজি করানো। বাঙালি ও দক্ষিণ ভারতীয় বেশ কিছু ছেলে মেয়ে তাদের একা হয়ে যাওয়া মা অথবা বাবাকে গ্রিন কার্ড করিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো শহরে নিয়ে আসতে পেরেছে। একটি পরিবারের কর্তার মা মোটামুটি শারীরিকভাবে সক্ষম, উনি দিব্যি রয়েছেন নাতি নাতনি নিয়ে। সঙ্গে রয়েছে বাগান পরিচর্যা আর স্থানীয় লাইব্রেরিতে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। একজনের বাবা হাঁটতে পারেন না, তাঁকে একটি বাস এসে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, বয়স্কদের জন্য নানারকম অনুষ্ঠান হয় বিভিন্ন সংস্থায়, সেখানে তিনি হুইল চেয়ারে বসেই অন্যান্যদের সঙ্গে আলাপ করেন, চেয়ারে বসেই “chair yoga” করেন, কখনও ওঁদের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থাও থাকে। সপ্তাহের দুটি দিন ওই বৃদ্ধ ওই বাসটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। এমনই একটি বাঙালি পরিবারের গৃহিণী শ্রীমতী দত্তের বৃদ্ধা মা এদেশে আসার পরপরই ধরা পড়ে ওঁর পারকিনসন্স অসুখটি। প্রথম ছমাস লেগে গেছে ওঁর এদেশের সঙ্গে ধাতস্থ হতে। তারপর ওঁর এই রোগটির কারণেই উনি হসপিসের সদস্যপদ লাভ করলেন। যেহেতু ওঁর শুধু সেবার প্রয়োজন সেজন্য তিনি বাড়িতেই রইলেন হসপিসের ছাতার তলায়। এই একটি মানুষ যাঁর জীবন প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু তাঁকে কি ভাবে আনন্দে ও নিরাপদে রাখা যায় সে জন্য “in house hospice” টির কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীরা সর্বদা নিবেদিতপ্রাণ। প্রথমদিন ওঁদের বাড়ি পুরোহিতের ফোন আসে এবং জানতে চায় ওঁর দাহ কার্য নিয়ে বাড়ির সকলে কোনো সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে কিনা এবং তারা কোন ধর্মাবলম্বী। এ হেন প্রশ্নে পরিবারের সকলেই প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, পরে জানতে পারে যে এটি হসপিসের একটি রুটিন মাফিক কাজ, আগাম সব কিছু স্থির করে রাখা। এদেশে দাহ কার্য অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার। হসপিস থেকেই একটি লম্বা লিস্ট দেওয়া হয় যাতে বিভিন্ন সংস্থার নাম ও তাদের দাহ কার্যের আনুমানিক খরচ, পরিষেবা ইত্যাদি দেওয়া আছে। কেউ মারা গেলেও চট করে দাহ কার্য সম্পন্ন করা যায় না, রোগীর মৃত্যুর পর তাকে হিমঘরে রাখা হয় যতদিন না ওই শ্মশান গুলির কোনো একটায় জায়গা পাওয়া যায়, সেটাও ব্যয়বহুল ব্যাপার। এই সমস্ত কিছু ওরা হসপিসে ভর্তি হওয়ার প্রথম দু তিন দিনের মধ্যেই আলোচনা করে ফেলে।
সেবার জন্য এই দত্ত পরিবারের বৃদ্ধার মতো আরো অনেকেই হসপিসের অন্তর্ভূক্ত। ভর্তি হওয়ার পরেই একজন সমাজ কর্মী ও একজন নার্স বাড়িতে এসে রোগী কে ভালোভাবে পরীক্ষা করেন এবং সমাজকর্মীটি দেখে নেন রোগীটি নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন কিনা। বাড়ির কোনো সদস্যের দ্বারা অবহেলিত বা নির্যাতিত হচ্ছেন কিনা। এরপর রোগীর শারীরিক অক্ষমতার ধাপ অনুযায়ী বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান করা হয়। একেবারেই অথর্ব যাঁরা তাঁদের জন্য বাড়িতে স্বাস্থ্য সাহায্যকারী সংস্থা থেকে একজন এসে সপ্তাহে দু দিন রোগীকে চান করিয়ে যান। এই কাজটি ওঁরা যে কি যত্ন নিয়ে করেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। এ সব ক্ষেত্রে ভাষা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, সব সময় বাংলা বা হিন্দিতে দোভাষীও পাওয়া সম্ভব হয় না, তখন এই সমস্ত সহায়তাকারীরা আকারে ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করেন ও রোগীর বক্তব্য বুঝে নেন। এঁরা রোগীকে চান করিয়ে, চুল শুকিয়ে, যত্ন করে লোশন মাখিয়ে, বিছানার চাদর পাল্টে, রোগীর ঘরের জঞ্জাল ফেলে দিয়ে তবেই বিদায় নেন। একটি দক্ষিণী পরিবারের গৃহিণী শ্রীরাধার শাশুড়ি মায়ের পায়ের একটা ছোট্ট অপারেশন ওঁকে শয্যাশায়ী করে ফেলেছিল। তাঁকে সপ্তাহে দুদিন দেখে যেত দীর্ঘদেহী আফ্রিকান আমেরিকান এক নার্স। কী এক মায়ার বাঁধনে মেয়েটি ওই পরিবারকে বেঁধে ফেলেছিল সেটা ওঁর বৌমা শ্রীরাধার মুখেই শোনা। নার্সটি প্রায় ছ ফুট লম্বা, পেটানো চেহারা, একদম সেরেনা উইলিয়ামসএর মতো, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল কর্ন রো স্টাইলে বাঁধা, বড় বড় চোখ দীর্ঘ আঁখি পল্লবে ঢাকা, (কৃত্রিম নয়), আর গাত্রবর্ণ? হ্যাঁ, কৃষ্ণা সেই মেয়ে, আফ্রিকান। মুখটা মাস্কে ঢাকা, কিন্তু একবার দেখার জন্য শ্রীরাধা খুব আকুল হয়ে পড়েছিল। সে কোন দেশে জন্মেছে জানতে চাওয়ায় বলল,”আমি ইংল্যান্ডে জন্মেছি, এই এক বছর হলো এদেশে এসেছি।”
পরের সপ্তাহে ও ওর রুটিন ভিজিটে এল, এমনভাবে কথা বলল শ্রীরাধার শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে যেন উনি একটা শিশু। গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “তুমি এখনও এত সুন্দর? রিংকল্ নেই? কী মাখো বলো তো?” শাশুড়ি মায়ের এক গাল হাসি। “কই? এই দ্যাখো না চামড়া সব ঝুলে গেছে!” “ইউ আর স্টিল বিউটিফুল!” উনি বলেন, “থ্যাংক ইউ!” কাজ সেরে মেয়েটি দরজা খুলে বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, বৃদ্ধার দিকে চেয়ে বলে, “ক্যান আই গিভ ইউ এ হাগ?” ওর উষ্ণ আলিঙ্গন কী যেন একটা বার্তা দিল, অনেক না বলা কথা বলে ও সেদিন চলে গেল। প্রতিবার এসে ও শাশুড়ি মায়ের পাশের চেয়ারে বসে ওঁর সঙ্গে গল্প শুরু করে আর গায়ে হাত বোলায়। বৃদ্ধা তো মহা খুশী, কিন্তু শ্রীরাধা ভাবে, আরে এ যেতে চায়না কেন! মতলবটা কী! আসলে নির্ভেজাল ভালোবাসা থেকে মানুষের বিশ্বাস উড়ে গেছে কিনা! মনের কথাটা বুঝি ও পড়ে ফেলল, মেয়েটি বলল, “I feel peace in my heart when I come here!” আসলে গত মাসে আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, ইংল্যান্ডেই। আমি যেতেও পারিনি কোভিডের জন্য। উনি একদম সুস্থ ছিলেন, তোমার মায়েরই বয়সি। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে গেলেন, আর উঠলেন না। কিছু করতে পারলাম না। তাই আমি যখন তোমার শাশুড়িকে দেখি, আমি যেন আমার মাকে খুঁজে পাই, মন ভরে যায়।” শ্রীরাধা যখন এই ঘটনাটা বলছিল তখন ওর গলাটা ধরে এসেছিল। রোগীর সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের যে ব্যক্তি সব সময় রোগীর দেখভাল করেন তাঁর মানসিক সুস্থতার দিকেও এই সংস্থা খেয়াল রাখে। বলা হয় যিনি অসুস্থ তার থেকেও বেশি ঝড় বয়ে যায় যিনি তাঁর সেবা করেন মানে care giver র ওপর দিয়ে। সেজন্য এই হসপিস থেকে প্রতি তিনমাস অন্তর রোগীকে পাঁচ রাতের জন্য অন্য একটি নার্সিং হোম বা হোমে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ওই পরিবারের পরিচর্যাকারী ব্যক্তিটিও একটু নিঃশ্বাস নিতে পারেন। সেই নার্সিংহোমে রোগীর পছন্দ মতো খাবার বানিয়ে দেওয়া হয়, বাড়িতে যাঁরা এসে স্নান করিয়ে দিতেন তাঁরা ওখানেও রোগীকে স্নান করিয়ে দিয়ে আসেন। প্রতিদিন ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে যান এবং প্রয়োজনে বাড়ির লোকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে নেন। রোগীর ঘরে টিভি, ঘরের লাগোয়া বাথরুম, সোফা, টেবিল সব মজুত। অনেক সময়ই দেখা গেছে ভারতীয় বৃদ্ধ বৃদ্ধারা ভাষার অসুবিধার জন্য সেখানে যেতে নিমরাজি হলেও ফিরে আসার পর বলেন ওঁরা কত যত্নে ছিলেন। সেবা এই সমস্ত কর্মচারীদের পেশা আর সেই কাজটি এঁরা অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে করে চলেন। কখনো কোনো কাজে গাফিলতি নেই, যদি রোগীর বাড়ির থেকে কোনো নালিশ শোনা যায় তবে ওই কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়।
এই হসপিস কিন্তু কোনো রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না, অর্থাৎ নতুন কোনো অসুখ হলে যদি রোগীকে হাসপাতালে যেতে হয় তখন তাকে হসপিস থেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়। হাসপাতালের খরচ ও অনেকাংশেই বিমা কোম্পানি বহন করে। রোগী যে সমস্ত ওষুধ চলাকালীন হসপিসে ভর্তি হন তার সমস্তটাই নিখরচায় রোগীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। যে সমস্ত রোগী চলাফেরা করতে পারেন তাঁরা তো মাঝেসাঝে একটু বাগানে গিয়ে বসতে পারেন অথবা ওই বিশেষ বাসটিতে চেপে কোনো অনুষ্ঠানেও টুক করে ঘুরে আসতে পারেন, কিন্তু যাঁরা শয্যাশায়ী তাঁদের মন কীভাবে ভালো রাখা যাবে? এঁদের অনেকের মনেই অবসাদ বাসা বাঁধতে থাকে, নিজেদের অবাঞ্ছিত এবং বোঝা বলে মনে করতে থাকেন তাঁরা। এঁদের সঙ্গে সমাজকর্মীরা এসে নিয়মিত কথা বলেন, পরিবারের লোকজনদের প্রশ্ন করেন ওঁরা খাওয়া কমিয়েছেন কিনা, কখনও নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন কিনা, একা একা কেঁদেছেন কিনা ইত্যাদি। এই সমস্ত মানুষদের কিছুটা আনন্দ দেবার জন্য হসপিস ব্যবস্থা করেছে মিউজিক থেরাপির।
নির্ভেজাল বাঙালি পরিবারের মিত্র মাসিমা হসপিস থেকে আসা কর্মচারীদের সঙ্গে যেমন সহজ ইংরেজিতে গল্প করেন, আবার সেই সঙ্গে উনি তাঁদের বাংলায়, “তুমি কেমন আছো, আমি ভালো আছি” শিখিয়ে দিয়েছেন। কাজ শেষ ক’রে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁরা বিড়বিড় করেন, “ঠুমি, কেমন আছো!” রোগীর কী অসম্ভব যত্ন নেয় এঁরা তা বলে বোঝানো যাবে না! মিসেস মিত্র ওঁর ভাইয়ের লক ডাউনে অসময়ে বিনা চিকিৎসায় চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। উনি এদেশে আসার পর ওঁদের ভাই বোনের বাঁধনটা যেন অনেক মজবুত হয়ে গেছিল, একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলেন, ফোনেই প্রতিদিন কথা হত দুজনের। হসপিসের নির্দেশ অনুযায়ী দুটি খুব মিষ্টি মেয়ে চলে এলেন ওঁর মিউজিক থেরাপি করতে। ব্যাপারটা কী? ব্লুটুথ স্পিকারে তাঁরা বৃদ্ধাকে ওঁর পছন্দের গান শোনাবেন এক ঘন্টা ধরে, সেই সঙ্গে ওরা গিটার, ঝুমঝুমি ইত্যাদিও বাজাবে। গান শুনতে শুনতে যদি বৃদ্ধার কান্না পায়, কাঁদবেন, মেয়েদুটি ওঁর সঙ্গে গল্পও করবেন। এই যে ব্যাপারটা মানে বৃদ্ধাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া, এটাই ওঁকে আবেগে ভাসিয়ে দেয়। মেয়ে দুটি একজন সিনিয়র আর একজন কাজ শিখছে। সিনিয়র মেয়েটি আবার প্রায় ছমাস হায়দ্রাবাদে গেছিল এক আশ্রমের অতিথি হয়ে। সেখান থেকে সে শিখে এসেছে, “ওম গণ গণপতায়ে নমো নমঃ,” হিন্দি চটুল গানও কিছু জানে। প্রথমে মিসেস মিত্রর সঙ্গে ওঁর শারীরিক কষ্ট নিয়ে মিনিট পনেরো ওরা কথা বললো, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজিতে উনি নিজেই উত্তর দিলেন। মন খারাপের কারণ বেরিয়ে এল ভাইয়ের মৃত্যু এবং দেশে ফিরতে না পারা। মেয়েদুটি বললেন, “ডোন্ট ওয়ারি, এখুনি তোমার দেশ কে তোমার কাছে আনছি। কার গান ভালো লাগে?” উত্তর এল, “কিশোর কুমার!” প্রথম গানটা আঁধির সেই বিখ্যাত “তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই, শিকওয়া, তো নেহি ….” নিস্তব্ধ চারিপাশ, দুটি নিবেদিত প্রাণ মেয়ে যেন পুজো করছে এই ভাবে নিশ্চল বসে এই গানটি পোর্টেবল স্পিকারে শোনাচ্ছে, বৃদ্ধার চোখ বন্ধ, এক সময় উনি কাঁদতে থাকেন। ইতিমধ্যে মেয়েদুটি গানের কথার মানে ট্রান্সলেট করে বুঝে নিয়েছে, দুজনের মুখেই মন খারাপের ছায়া। গান শেষ হতে বললেন, “তোমরা তো পুনর্জন্মে বিশ্বাস করো, দেখো ওখানে ঠিক ভাইবোনের আবার দেখা হবে। ততদিন আমরা আছি তোমার মন ভালো করতে।” এদেশে স্কুলে ‘grief’ করার জন্য ছুটি দেওয়া হয়, কান্না খুব জরুরি, শোক পালন আবশ্যিক। আমাদের দেশের রুদালির কথা মনে পড়ে যায়, অনেক সময় বুক ফেটে কান্না বার করা ভীষণ জরুরি। যাবার আগে মেয়েদুটি বৃদ্ধার গায়ে, পায়ে হাত বুলিয়ে বলল, “It’s OK to cry, you will feel better!” যাওয়ার আগে মেয়েদুটি বৃদ্ধাকে বলে যেতে ভুলল না, “You are so beautiful!” উনি আন্তরিক ভাবে বললেন, “Thank you!” এভাবেই বিকেলটা আলোয় ভরে দিয়ে যায় ওরা। বৃদ্ধার মুখে চোখে শীতল জলে অবগাহন সেরে ওঠার তৃপ্তি। বিভিন্ন পরিবারের কিছু অসহায় মানুষের মুখে নিরন্তর হাসি ফুটিয়ে চলেছে হসপিস নামক সেবা প্রতিষ্ঠানটি।
1 Comment