মধুসূদনের ছেলেবেলা ও বাল্যবন্ধুরা

মধুসূদনের ছেলেবেলা ও বাল্যবন্ধুরা

১)
সাগরদাঁড়ি, যশোহর।


“যশোরে সাগরদাঁড়ি, কপোতাক্ষ তীরে
জন্মভূমি। জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।”

দ্বিশতবর্ষে পদার্পণ করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি, ১৮২৪ – ২৯ জুন, ১৮৭৩), যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও প্রথম সার্থক নাট্যকার, বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা সনেট আর আধুনিক মহাকাব্যেরও জনক।

সাগরদাঁড়িতে মধুসূদনের পৈতৃক ভিটে- অধুনা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত

পূর্ব-বঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশে) যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে বাংলার মধুকবির জন্ম হয়। তাঁর জীবনের বাল্যকাল কাটে কপোতাক্ষ-তীরের সেই শ্যামলিমা-মাখা গ্রামে। বাবা রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতার সদর-দেওয়ানী আদালতে একজন নামকরা উকিল ছিলেন, কিন্তু মধুর জন্মের নয় বছর পর্যন্ত তিনি একাই কলকাতায় থাকতেন, বন্ধু রামকমল মুখুজ্জের বিশেষ অনুরোধে ১৮৩৩-এ পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।
মধুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের পাঠশালাতেই নিজের জেঠতুতো ভাইদের সঙ্গে আরম্ভ হয়, বাইরের কোন বাল্যবন্ধুদের কথা তেমন জানা যায় না। তারপর তাঁরা অদূরে শেখপুরা গ্রামের মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে ফারসি শিখতে যেতেন। গ্রাম্য গুরুমশায় বাংলা, গণিত আর সামান্য সংস্কৃত-ফার্সি জানতেন। মধু যতটুকু পেরেছেন তাঁর কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। তিনি যে রকম বিলাসিতার মধ্যে মানুষ হয়েছেন, লেখাপড়া তেমন মনোযোগ দিয়ে না করলেও কেউ কিছু বলত না। কিন্তু শ্রেষ্ঠতার অহংকার সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল- কেউ কোনকিছুতে তাঁর চেয়ে এগিয়ে যাবে এ তাঁর সহ্য হত না। হয়ত ভবিষ্যৎ জীবনের অমিতব্যয়িতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার বীজ সেই সময় থেকেই তাঁর মনে বোনা হয়ে গিয়েছিল- এর থেকে তিনি সারা জীবন মুক্তি পাননি। মা জাহ্নবী প্রথাগত শিক্ষালাভ না করলেও রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল থেকে অনর্গল পড়ে শোনাতেন ছোট্ট মধুকে, বুঝিবা মেঘনাদবধ আর ব্রজাঙ্গনার সূচনা তখনই হয়ে যায় তাঁর মনের গভীরে।
মধুসূদনের সাগরদাঁড়ির বাল্যসঙ্গীদের কথা বিশেষ জানা যায় না, শুধু কপোতাক্ষ-তীরের সেই ছায়ানীড় পরিবেশ সম্বন্ধে কবির জীবনীকার শ্রী নগেন্দ্রনাথ সোমের লেখা থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলেই তাঁর পরবর্তী জীবনকালের কল্পলোকে সে পরিবেশ কি গভীর ছায়াপাত করে থাকতে পারে।

 

মধুর জীবনীকারদের মধ্যে অনেকের ধারণা যে আট বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। কিন্তু জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু ও সুরেশচন্দ্র মৈত্রের মতে, মধুর ছোট দু’টি ভাই প্রসন্নকুমার আর মহেন্দ্রনারায়ণের যথাক্রমে ১৮২৭-এ মাত্র এক বছর ও ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচ বছর বয়সে অকালমৃত্যুর পরে, একমাত্র জীবিত বংশধর মধুসূদনকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ১৮৩৩-এ রাজনারায়ণ দত্ত পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে আসেন আর তাঁর খিদিরপুরের প্রাসাদোপম বাড়িতে এনে তোলেন। ১৮৩৩-এ মধুসূদন খুব সম্ভবতঃ লালবাজারের গ্র্যামার স্কুলে ভর্তি হন। সম্ভবতঃ বলছি এই কারণে যে ১৮৩৭-এ তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন, অথচ তার আগেই তিনি ইংরেজি, ফরাসি আর কিছুটা হিব্রুভাষা শিখে ফেলেছিলেন আর এই তিনটি ভাষা স্থানীয় স্কুলগুলির মধ্যে একমাত্র লালবাজারে অবস্থিত গ্র্যামার স্কুলেই শেখানো হত। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন তাই হিন্দু স্কুলে এসে অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি. এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্যপ্রীতি সঞ্চারিত করেছিলেন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশানুরাগের স্মৃতিও তাঁকে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করত। এছাড়া কলেজে তার সহপাঠী আর বন্ধুস্তরীয়দের মধ্যে ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার, ভোলানাথ চন্দ্র, বঙ্কুবিহারী দত্ত, গোবিন্দ দত্ত প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আঠারো বছর বয়সে পদার্পণ করার আগেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়, আর তারপর ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে খিদিরপুরের বাসা থেকে পালিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় নিয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এই ধর্মান্তরের কারণ কিন্তু হিন্দুধর্মের প্রতি অবজ্ঞা-বিদ্বেষ বা খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশেষ কোন ভক্তিবশতঃ নয়। নাস্তিক না হলেও তিনি ধর্ম সম্বন্ধে পরিপূর্ণ উদাসীন ছিলেন, প্রথামাফিক গির্জা বা উপাসনালয়েও যেতেন না। বস্তুতঃ তাঁর জীবনে ধর্মের কোন স্থানই ছিল না। তবে কেন খ্রিষ্টান হলেন? এর বীজ হয়ত প্রোথিত হয়েছিল তাঁর বাল্যকালেই, সেই সময়ের স্থানীয় পরিবেশ, বিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর বন্ধুবৃত্তের মধ্যে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে তার সন্ধান। হয়ত এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, বস্তুতঃ মধুসূদনের ঊনপঞ্চাশ বছর আয়ুকালের স্বল্পদীর্ঘ জীবন ছিল ভুলভ্রান্তি, প্রাচুর্য-বিলাসিতাময় অথচ চরম দুঃখকষ্ট-দারিদ্রের বৈপরীত্যে ভরপুর। শুনতে অবাক লাগলেও ‘Morning shows the day’ বা কবি William Wordsworth-এর অমর উক্তি ‘Child is the father of man’-এর সূত্র ধরে আমরা এটুকু বলতে পারি যে মধুর চরম বৈপরীত্যময় জীবনের ঘটনাগুলির বীজ প্রোথিত হয় তাঁর ছেলেবেলায়- বংশের, পারিবারিক-পারিপার্শ্বিক আর তাঁর প্রাথমিক জীবনের সঙ্গী-সাথী, স্কুল-কলেজ বা অধ্যাপকদের সান্নিধ্য থেকে।
খুব ছোটবেলায় সাগরদাঁড়ির অবস্থানকালের কালের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি প্রাচুর্য ও বিলাস-ব্যসনের মধ্যে বড় হলেও সেসব তাঁর কাছে এতটাই স্বাভাবিকভাবে এসেছে যে তা নিয়ে কোন অহংকার করার কথা কখনোই তাঁর মাথায় আসেনি। হ্যাঁ, বুদ্ধি বা পাঠে তাঁকে কেউ ছাড়িয়ে যাবে একথা মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল তাঁর কাছে। বিদ্যাবুদ্ধিকে ব্যবহারিক কাজে লাগিয়েই সাগরদাঁড়ির দত্তদের চার ভাইয়ের এসেছিল সাফল্য আর বিত্তের প্রাচুর্য, কিন্তু সাহিত্যরসে তাঁরা ছিলেন একেবারেই বঞ্চিত। জাহ্নবী দেবী যুগের নিরিখে মোটামুটি শিক্ষিতা ছিলেন, প্রাচীন কাব্য, পুরাণ থেকে গল্প শোনাতেন ছোট্ট মধুকে। তবে কাব্য-সাহিত্যের একটা জেনেটিক ধারা তাঁদের ঊর্ধ্বতন পুরুষদের মধ্যে কিছুটা ছিল। ঠাকুর্দা রামনিধি দত্তের ছোট ভাই মাণিকরাম তাঁর মুসলমান মনিবকে ফারসি ভাষায় রোজ একটি করে কবিতা রচনা করে শোনাতেন, যা শুনে নাকি তাঁর সুন্দরী মনিবকন্যা তাঁর প্রেমে পড়েন। কিন্তু মাণিকলাল প্রেম আর ধর্মত্যাগের দোটানায় পড়ে শেষে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন। এছাড়া মধুর তৃতীয় জেঠা দেবীপ্রসাদ দত্তও ঠিক কবি না হলেও মুখে মুখে মিল করে কবিতা রচনা করতে পারতেন। বাবা রাজনারায়ণ এ রসে বঞ্চিত হলেও কাব্য, সংগীত আর শিল্পকলার গুণগ্রাহী ছিলেন। হয়ত মধুর কবিত্বশক্তি আর সৌন্দর্যবোধ এভাবেই কিছুটা জন্মজাত। বরং পরবর্তীকালে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী মানকুমারী বসুর নামী কবি হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর মধুকাকার কিছুটা প্রেরণা থাকলেও থাকতে পারে।

২)
হিন্দু কলেজ, কলকাতা

তের বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৮৩৭-এ হিন্দু কলেজে ভর্তির সময় পর্যন্ত মধুর প্রতিভার উন্মেষ বা বিকাশ সম্বন্ধে তেমন কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হিন্দু কলেজে প্রবেশের আগেই তিনি ইংরেজি, ফারসি, ফরাসি ও হিব্রুভাষা কিছুটা শিখে ফেলেছিলেন। কথায় বাঙ্গাল টান, বংশ-কৌলীন্য ও পুরুষানুক্রমিক আভিজাত্যের অভাব, মফঃস্বলী উৎস- এসবই গোড়ার দিকে মধুর মধ্যে হীনমন্যতা জাগিয়ে তোলে। মধুর জীবনীকারদের মতে তাঁকে এসব খামতি ভেদ করে সগৌরবে টিকে থাকতে তিনি হাতিয়ার করলেন বহুদিনের কষ্টোপার্জিত ইংরেজি ভাষাজ্ঞান, বাবা রাজনারায়ণের অর্থের আতিশয্য, বন্ধুদের প্রতি বদান্যতা, মেধাবী আর কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, স্বাধীনচিত্ততা, গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে যাওয়া আর কথায় কথায় প্রচার করা ‘রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে টাকা গুনে খরচ করে না’। অবশ্য আমার মতে এগুলো তাঁর স্বভাবজাত গুণ, কারণ বাস্তবিক তাঁর নিজের কবিত্ব-শক্তি নিয়ে অহংকার থাকলেও বিত্তকে তিনি হেলাফেলার বস্তুই মনে করে এসেছেন চিরকাল। নয়ত চাকর-বাকর থেকে শুরু করে গরীব সহপাঠীদের প্রয়োজনে গোপনে অর্থসাহায্য করতেন না কখনও।

হিন্দু কলেজ, এখন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়

আগেই বলেছি যে মধুসূদন হিন্দু কলেজে এসে অধ্যাপক রিচার্ডসনের (১৮০১-৬৫) নজরে পড়েন, উভয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক ভাল-লাগার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই প্রাক্তন সৈনিক ক্যাপ্টেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনকে না জানলে কবি মধুসূদনকে বোঝা যাবে না। সেকালের বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে হেনরি ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর- এই তিন শিক্ষকের সঙ্গে সমোচ্চারিত হবে এই শিক্ষকের নাম। ইনি হিন্দু কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন ১৮৩৫-এ, ডিরোজিওর মৃত্যুর চার বছর পরে। মধু ডিরোজিওর লেখা ইংরেজি কাব্য পড়েছেন, হয়ত পড়েছেন তাঁর ছাত্র কাশীপ্রসাদ ঘোষের কবিতা যিনি সম্ভবতঃ প্রথম বাঙালি কবি যিনি ইংরাজিতে কবিতা লিখতেন। কিন্তু সত্যি বলতে মধুসূদনকে নিজের পড়ানোর কায়দা আর স্বরচিত সনেট, বিশেষতঃ এক অননুকরণীয় ব্যতিক্রমী কায়দায় শেক্সপীয়ার, বায়রন আর পোপের কবিতা পড়িয়ে সত্যিকারের প্রভাবিত করে তাঁর ইংরেজি কাব্যপ্রীতি জাগিয়ে তোলেন এই রিচার্ডসন। তাঁর আদর্শেই নিজেকে গড়ে তুলে বিলেতে যাওয়া আর ইংরেজিতে লিখে বিখ্যাত কবি হওয়ার বাসনা মধুর মাথায় বাসা বাঁধে। তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে প্রচার করতে থাকেন- ‘আমি একদিন বিখ্যাত কবি হব, তোমরা আমার জীবনী লিখো’। বন্ধু বঙ্কুবিহারী একটি চিঠিতে লেখেন- ‘I was a very dull boy at the commencement, but by diligence and exertion became one of the stars of the college of which Madhu was the Jupiter.’- সৌরমণ্ডলী মাঝে বৃহস্পতি ন্যায় বিরাজিত ছিলেন। মধু মেধাবী ছাত্র হলেও শোনা যায় গণিতে তাঁর তেমন দখল বা মনোযোগ ছিল না। ভূদেব, গৌরদাস ইত্যাদি বন্ধুরা একদিন তর্ক করেন যে সাহিত্য সহজ জিনিস। নিউটন চাইলে শেক্সপীয়ার হতে পারতেন কিন্তু তার উল্টোটা হওয়া সম্ভব ছিল না। সেই সময় গণিতের অধ্যাপক রীজ্‌ (Rees) একটি দুরূহ অঙ্ক ক্লাসে কষতে দেন যা কারো মাথায় ঢোকেনি। তখন মধু বোর্ডে গিয়ে অবলীলাক্রমে অঙ্কটি কষে দেখান ও পরে ভূদেবকে কটাক্ষ করে বলেন- ‘দেখলে, শেক্সপীয়ার চেষ্টা করলেই নিউটন হতে পারতেন! তবে আমার গণিত পড়া এখানেই শেষ।’
হিন্দু কলেজে পাঠকালে গৌরদাস বসাক ছিলেন মধুর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু আর তাঁদের এই সৌহার্দ্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল। তবে মধুর ছেলেবেলায় বাংলা সাহিত্যে মোটেই তেমন প্রীতি জন্মায়নি। অবশ্য তার কারণও ছিল। সেই সময় বাংলাভাষায় কাশীদাস, কৃত্তিবাস, বৈষ্ণব কাব্য, ভারতচন্দ্র, কবিকঙ্কন, রামপ্রসাদ আর সাম্প্রতিক ঈশ্বর গুপ্ত বাদে বাংলা কাব্য তেমন বিকাশলাভ করেনি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাদ্রি অধ্যাপক উইলিয়াম কেরি, রামরাম বসু বা মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের রচিত বাংলা গদ্য (বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম বা অক্ষয় দত্ত তখনও সাহিত্যের প্রাঙ্গণে অপরিচিত নাম) তখন নিতান্তই বালখিল্য পর্যায়ে। সুতরাং হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা বাংলা সাহিত্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে ভূদেব একবার কৌতুকছলে লিখেছিলেন ‘যে মধু তখন পৃথিবী বানান প্রথীবি লিখিত সে আর কয়েকবছরের মধ্যে মেঘনাদ বধের মত বাংলাভাষায় মহাকাব্য লিখে ফেলবে- তা সত্যিই আশ্চর্যজনক।‘
অবশ্য এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। সেকালে পণ্ডিত-বংশের ছেলে ভূদেব আর দু-একজন ছাড়া হিন্দু কলেজের প্রায় কেউই শুদ্ধ বানান আর ব্যাকরণে বাংলা লিখতে পারতেন না। তবু এক বর্ষার দিনে গৌরদাসের সঙ্গে তর্কচ্ছলে বাংলায় কাব্য লেখা কত সহজ তার একটা অনন্য উদাহরণ স্থাপন করলেন মধু। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অপটু হস্তে হলেও লিখে ফেললেন বাংলা ভাষার প্রথম acrostic। কবিতাটি অনেক ভুলভ্রান্তিতে ভরা, গৌর নয়, পংক্তিগুলির আদ্যক্ষর যোগ করলে হয় ‘গউরদাস বসাক’! যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’-এর কল্যাণে অনেকেই বিষয়টি অবগত, তবু মধুসূদনের প্রথম জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসুর বই থেকে কবিতাটি উদ্ধৃত করছি-

বর্ষাকাল
ভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর
থলিল নদনদী ধরণী উপর।
মণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।
মীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব,
রুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রভাব।
স্বাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়,
লয়ে করয়ে কোন মতে শান্ত নয়।“

এই গৌরদাস আর মধুর মধ্যে সারাজীবন ধরে অজস্র পত্রবিনিময় তাঁদের বন্ধুত্বের সাক্ষী, অবশ্য সহপাঠীদের মধ্যে রাজনারায়ণ বসুকেও প্রচুর চিঠিপত্র লিখে গেছেন অবশিষ্ট জীবনে। বস্তুতঃ ১৮৪১ সালের ২৯শে মার্চ তিনি ‘The Fortunate Rainy Day’ নামে একটি ইংরেজি কবিতা লেখেন, যাতে বাবু গৌরদাস বসাকের অনুরোধে লিখিত- এই স্বীকৃতি শিরোনামে রেখেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর রচিত বেশিরভাগ ইংরেজি কবিতাই গৌরদাসকে উৎসর্গীকৃত।
আগেই জানিয়েছি যে সেই সময় ক্যাপ্টেন রিচার্ডসনের পড়ানোর পদ্ধতি আর কাব্য, বিশেষতঃ শেক্সপীয়ার চর্চায় মধু-সমেত সব ছাত্র তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন। মধু এককাঠি এগিয়ে তাঁর উচ্চারণভঙ্গী, এমনকি রিচার্ডসনের বাঁকানো হাতের লেখা পর্যন্ত নকল করতেন। ১৮৪২ সালে মধুসূদন যখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন সাময়িকভাবে হিন্দু কলেজ ছেড়ে যান, সেই সময় কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেবের (James Kerr) সঙ্গে মধুর মনোমালিন্য হয়, সেই সূত্র ধরে মধু হিন্দু কলেজ ছেড়ে দেবার বাসনা প্রকাশ করেন। তিনি গৌরদাসকে একটি চিঠিতে লেখেন যে পরিবার, জন্মভূমি ত্যাগ করে ইংরেজির একজন বিখ্যাত কবি হবার বাসনায় তিনি ইংল্যান্ড পাড়ি দিতে চান। তবে সে সময় গোঁড়া হিন্দু সমাজের তরফ থেকে কালাপানি পার করা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু পিতামাতা দুজনে মিলে যখন একটি অশিক্ষিতা অপরিচিতা কন্যার সঙ্গে মধুর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর বিয়ে স্থির করে ফেললেন- মধুর মনে হল এসব কাটিয়ে বিলেত পালাতে গেলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া আর গতি নাই। না, তাঁর এই কাজে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক, সহপাঠীবৃন্দ, ডিরোজিও-শিষ্য ইয়ং বেঙ্গলের দল, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন, ডেভিড হেয়ার, ডাফ, রিচার্ডসনের প্রতি ভালবাসা……এমনকি হিন্দুধর্মের প্রতি অনাস্থা বা খ্রিস্টধর্মের প্রতি প্রেম- কোনটাই ছিল না। শুধু ছিল এক অনড় জেদ- তিনি এক স্বাধীন স্বপ্নের দেশে যাবেন, কবি হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাবেন, নিজের পছন্দমতো শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করতে পারবেন। কবি হতে গেলে প্রয়োজনে পিতামাতা সকলকে ছাড়তে হয়- আলেকজান্ডার পোপের এই উক্তি মনে করিয়ে দেন তিনি গৌরকে লেখা একটি চিঠিতে।
এই ছিল সংক্ষেপে মধু-কবির বাল্যকাল। বাঙালি খ্রিষ্টীয় সমাজের মাথা রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় সমস্ত বন্দোবস্ত হয়ে যায়। মধুসূদনকে খিদিরপুরের পৈতৃক বাসাবাড়ি থেকে গোপনে এনে লুকিয়ে রাখা হয় ফোর্ট উইলিয়ামে কড়া পাহারার মধ্যে। তারপর ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি ওল্ড মিশন চার্চে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন ও ‘মাইকেল’ নাম গ্রহণ করেন। শুরু হয় বাংলার ভাবী মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের এক অভিশপ্ত জীবনের পথে প্রথম পদক্ষেপ।

গ্রন্থ ও সহায়ক রচনা-পঞ্জী

১) যোগীন্দ্রনাথ বসু- মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনচরিত, ৪র্থ, ১৯০৭। সুখময় মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত (১৯৭৮)।
২) নগেন্দ্রনাথ সোম- মধুস্মৃতি, ২য়, ভাদ্র ১৩২৭। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স।
৩) সুরেশচন্দ্র মৈত্র- মাইকেল মধুসূদন দত্ত- জীবন ও সাহিত্য, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা (১৯৭০)।
৪) গোলাম মুরশিদ- আশার ছলনে ভুলি- আনন্দ (২০১৩)।
৫) ডাঃ মহফুজ পারভেজ- দ্বিশত জন্মবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (প্রবন্ধ), বার্তা২৪ ডট কম (২০২৪)।
৬) শিবনাথ শাস্ত্রী- রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (ইন্টারনেট)।
৭) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- সেই সময়, আনন্দ। ১ম সংস্করণ ১৩৯৮।
৮) সুবীর রায়চৌধুরী- হেনরি ডিরোজিও, তাঁর জীবন ও সময়, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ১৯৯৩।
৯) কোরক- দ্বিজন্মশতবর্ষে বিদ্যাসাগর সাহিত্য সংখ্যা শারদীয় ২০১৯। তাপস ভৌমিক সম্পাদিত।
১০) দিলীপকুমার গোস্বামী- মানভূমে মাইকেল মধুসূদন, পারিজাত প্রকাশনী ২০১৩।
১১) মধুসূদন রচনা ও পত্রাবলী। ইন্টারনেট।
১২) বিভিন্ন ওয়েব-সাইট ও পত্রপত্রিকা।

শিক্ষা- ইঞ্জিনিয়ারিং, কর্মসূত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের পেট্রোলিয়াম তৈলখনি অঞ্চলে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখি শুরু হয় ২০১১তে কম্প্যুটারে বাংলা ফন্টের আমদানির সূত্র ধরে, ‘অবসর’ সমেত বিভিন্ন নেট-পত্রিকা ও বম্বে ডাক, পশ্চিমঘাট ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায় গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। গত ২০২২ থেকে তিনটি ছোটগল্পের ও একটি প্রবন্ধের সঙ্কলন প্রকাশিত হয় এযাবৎ। দুটি নেট পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যুক্ত আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *