ইংরাজি উশ্চারণের সাতকাহন: জানুয়ারি (হানুয়ারি) মাসের লেখা

ইংরাজি উশ্চারণের সাতকাহন: জানুয়ারি (হানুয়ারি) মাসের লেখা

কিছুদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপে একটা চুটকি ভাইরাল হয়েছিল। মার্কিন কনসুলেট অফিসার এক ভারতীয় ভিসা প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করছেন তিনি কোথায় যেতে চান। ভিসা প্রার্থী উত্তরে বললেন, “স্যান জোস (San Jose)।”  তাতে অফিসার মৃদু হেসে তাঁকে শুধরে দিয়ে বললেন, “জায়গাটির নাম আসলে স্যান হোসে।” পরের প্রশ্ন, “কোন মাসে যেতে চান?” মার্কিনি ইংরাজিতে J অ্যালফাবেটের সঠিক উচ্চারণ সদ্য সদ্য শিখে-নেওয়া বুদ্ধিমান ভদ্রলোক চটজলদি উত্তর দিলেন, “হুন বা হুলাই!”

এরপর ভদ্রলোক ভিসা পেয়েছিলেন কিনা সঠিক ‘হানা হায় না’ অর্থাৎ জানা যায় না। তবে আমি মার্কিন দেশে আসার দীর্ঘদিন পরেও জানতাম না San Jose এর সঠিক উচ্চারণ কী। Jyoti Bose নামের উচ্চারণ যে ‘হোতি বোসে’ বা বাঘা যতীনের নাম যে ‘বাঘা হতীন’ হতে পারে তা আর সেই প্রাক গুগল যুগে ছাপোষা বাঙালির মাথায় আসবেই বা কী করে?

কিছুদিন আগে আদ্যন্ত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনো করা একটি বাঙালি মেয়ে কথাপ্রসঙ্গে বলছিল যে সে জার্সি সিটি থেকে নিউ ইয়র্ক শহরে যায় পাথ (path) নামক লাইট রেলে চেপে। সঙ্গে সঙ্গে তার মার্কিন দেশে জন্মানো পাঁচ বছরের পুত্র বলে উঠল, “Mom, পাথ is an incorrect pronunciation, please say প্যাথ।” খুবই প্যাথেটিক ব্যাপার। তবে প্যাথো-লজিকাল বলা যায় কারণ math কে তো আমরা চিরকাল ম্যাথই বলে এসেছি! মার্কিন দেশে থাকতে থাকতে আজকাল ক্ল্যাস (class) বা ম্যাস (mass) বলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। যেমন অভ্যাস হয়ে গেছে মাল্টি (multi) কে মাল্টাই আর শিডিউল (schedule) কে স্কেজুল বলাটাও। টম কে এখন ঠম আর পল কে ফল বলে ডাকি। তাও গন্ডগোল লেগেই থাকে। একবার আমার বউ এক রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে প্যানকেকে পেক্যান (এক প্রকার বাদাম) দিতে বলায় সার্ভার মিষ্টি হেসে বেকন দেওয়া প্যানকেক নিয়ে এল। গন্ডগোলটা তাকে বুঝিয়ে বলাতে সে চোখ কপালে তুলে বলল, “ও তুমি ফিখ্যান চাইছ? সরি, বুঝতে পারিনি!” অর্থাৎ মার্কিনি ইংরাজিতে বাংলা বর্ণমালায় বর্গের প্রথম বর্ণ সচরাচর দ্বিতীয় বর্ণ হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমন ক্যাট হবে খ্যাট। প্যারিস হবে ফ্যারিস, তবে F নয়, বাংলা ফ অর্থাৎ Ph।  টেলিভিশন হবে ঠেলিভিশন। যেমন সত্যজিৎ রায়ের গল্পে জটায়ু একবারে রাত্রে জানলায় ঠক ঠক শব্দে ভয় পেয়ে কে বলতে গিয়ে খে বলেছিলেন। মার্কিনি উচ্চারণে আমার নাম (তীর্থঙ্কর) এর উচ্চারণ হবে ঠিয়াঠাঙ্কা।

তবে ব্যাপারটা একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যায় যে ইংরাজি উচ্চারণের বিষয়টা বেশ গোলমেলে। To টু হলে go গো কেন হবে এ প্রশ্ন তো বাংলা চলচ্চিত্রেও উঠে এসেছে। Mac ম্যাক আর hine হাইন জুড়ে দিলেই উচ্চারণ হয়ে যাচ্ছে মেশিন। আমাদের ছোটবেলার আর একটি প্রচলিত চুটকি ছিল, শিক্ষক vague শব্দটিকে ভেগু উচ্চারণ করার পর ছাত্র ভুল ধরিয়ে দিয়েছে। তাতে শিক্ষক লজ্জা পেয়ে ব্যাপারটা স্লিপ অফ টাংগু বলে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করলে ছাত্র পুনরায় টাংগু শব্দের সঠিক উচ্চারণ উল্লেখ করে। শেষে শিক্ষক ধমক দিয়ে ওঠেন, “প্লিজ ডোন্ট আর্গ (argue)।” প্রথম গল্পের হুন বা হুলাই বা এই গল্পের আর্গ হল কথোপকথনের মাঝে ভুল শুধরে নেওয়ার প্রয়াসের ফসল। একে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে অ্যাকটিভ লার্নিং বলা হয়।

স্ট্যান্ডার্ড ভারতীয় অ্যাকসেন্ট বলেও কিছু হয় না। ভারতীয় উপমহাদেশের ইংরাজি উচ্চারণের বিশেষত্ব কী জিজ্ঞেস করলে অন্তত: চার রকমের উচ্চারণের কথা মাথায় আসে:

১) শুদ্ধ বাঙালি ইংরাজি যাতে zero কে জিরো, his, whose, these, those কে যথাক্রমে হিজ, হুজ, দিজ, দোজ বলা হয়। এই ইংরাজি অ্যাকসেন্টে যদি আপনি টাইমস স্কোয়্যারের আশেপাশে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাসের পথনির্দেশ চান, তাহলে মুখ নিচু করে ঠোঙায় বাদাম ভরতে থাকা বাংলাদেশি যুবক মুখ না তুলেই বিশুদ্ধ বাঙাল ভাষায় বলবেন, “আর দুইটা ব্লক পরে বাম দিকে ঘুইর‍্যা যাইবেন।”

২) পূর্ববঙ্গীয় ইংরাজি যাতে সবজিকে ভ্যাziট্যাবুল বলে। এই ইংরাজিতে স্নেক মানে জলখাবার আর স্ন্যাক মানে সাপ। তারাপদ রায় এক প্রবীণের গল্প লিখেছিলেন যিনি হাসপাতালের উল্টোদিকের দোকানের বেঞ্চে বসে চায়ে ডুবিয়ে পাঁউরুটি খেতে খেতে বলেছিলেন, “নাতিটারে সাপে কামড়াইসে – স্ন্যাক বাইটের কেস। সকাল থিকা বইসা বইসা ক্ষুধা লাগসে, তাই টি আর স্নেক খাইতাসি।”

৩) গুজরাতি ইংরাজি, যাতে হোল মানে প্রেক্ষাগৃহ আর হল মানে গর্ত। পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণের সাথে এর মিল আছে। যেমন, ম্যাড মানে প্রস্তুত বা তৈরি আর মেড মানে পাগল। একে অপরের জন্য উপযুক্ত যুগল হল ম্যাড ফর ইচ আদার। মেড ফর ইচ আদার বললে একে অপরের প্রেমে উন্মাদ বোঝাবে। আমাদের এক বন্ধু নিউ জার্সির এডিসন অঞ্চলে এক ভারতীয় দোকানে কিছু একটা কিনতে গিয়ে “রেপ কর দুঁ?” প্রশ্নে প্রথমে বিব্রত, আশ্চর্য ও অগ্নিশর্মা হয়ে পরক্ষণেই বোঝেন যে নিতান্তই নিরীহ গুজরাতি দোকানি কেনা বস্তুটি কাগজে র‍্যাপ করে অর্থাৎ মুড়ে দেবেন কিনা জিজ্ঞেস করছেন। কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার!

৪) দক্ষিণ ভারতীয় ইংরাজি, যাতে প্রেমিক প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে বলে, “আই লাউ ইউ।” অর্থাৎ প্রেমে গোলাপের মত লাউয়েরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে।

এ ছাড়াও আছে কনভেন্ট ইংরাজি যাকে ভারতে কুলীন ইংরাজি উচ্চারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই উচ্চারণ কিছুটা ব্রিটিশ ঘেঁষা হলেও অন্যান্য ভাষার প্রভাবমুক্ত বলে, একে অনেকে নিউট্রাল ইংরাজি উচ্চারণ বলেন। কিন্তু কনভেন্ট ইংরাজি নিয়েও অনেকে মার্কিন দেশে, বিশেষত দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে প্রথমদিকে সুবিধা করতে পারেন না। জর্জিয়া বা অ্যালাবামায় কম্পিউটার সায়েন্স ক্লাসে অধ্যাপক বলছেন file directory আর ভারতীয় ছাত্র শুনছে ফাউল ডিরেক্টরি – এ গল্প হামেশাই শোনা যায়।

তবে মার্কিন দেশে এসে যা শিখে সত্যিই সমৃদ্ধ হয়েছি, তা হল দূরপ্রাচ্যের ইংরাজি। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় চৈনিক ইংরাজির, যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংক্ষিপ্তকরণ। অর্থাৎ এক একটি বর্ণ হঠাৎ বেমালুম উড়িয়ে দেওয়া। আমার পি এইচ ডি অ্যাডভাইসর একবার একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে খুশি হয়ে বলেছিলেন, “ফু ইজ গু (food is good)।” গভীরভাবে ভেবে দেখলে অবিশ্যি ফু আর গুয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক শাশ্বত এবং অবিচ্ছেদ্য। টাকা মাটি মাটি টাকার মত। কোন চিনা বন্ধু যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে, “ডু ইউ ওয়াচ ফু নেওয়া?” বুঝবেন আপনি টিভিতে ফুড নেটওয়ার্ক চ্যানেল দ্যাখেন কিনা জিজ্ঞেস করছে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল TH এর উচ্চারণ দন্ত্য স। যেমন ধন্যবাদ জানাতে অধিকাংশ চিনা বলবেন, “স্যাঙ্ক ইউ।” চিন্তা করছি-র ইংরাজি আই অ্যাম সিংকিং। গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত হওয়ার বিষয়টা সিংকিং শব্দের প্রয়োগে সহজে বুঝিয়ে দেওয়াও যায়। আমার অধিকাংশ চৈনিক বন্ধুই আমাকে তিস্যাঙ্কা বলে ডাকে।

আবার চৈনিক ইংরাজিতে র এর জায়গায় মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে ল এসে পড়ে। কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে শুনতে পারেন, “ইউ আর লাইট” – অর্থাৎ তুমি সঠিক জ্ঞানের আলো বিতরণ করলে। একবার এক চিনা ছাত্রীর মুখে “মাই লিভার ইজ ফ্রোজেন” শুনে এক অধ্যাপক তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, পরে বোঝেন সে নিজের বাড়ির পাশে একটি নদী শীতকালে জমে যাবার কথা বোঝাতে চাইছে।

জাপানি ইংরাজিতে আবার উলটো। ল মাঝে মাঝেই হয়ে যায় র। সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রফেসর শঙ্কুর রক্তমৎস্য কাহিনীতে জাপানী বৈজ্ঞানিকদ্বয় হামাকুরা আর তানাকা কোন কিছুর তারিফ করতে হলেই “ওয়ানুদাফুরু! ওয়ানুদাফুরু!” বলে উঠছিলেন। ওয়ান্ডারফুলকে ওয়ানুদাফুরু বলার মধ্যে জাপানি ইংরাজি উচ্চারণের আরেকটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় – যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করার অপারগতা। যেমন পার্ফেক্ট শব্দটি জাপানিরা উচ্চারণ করবেন, “পারুফেকোতু।” কলকাতায় বেড়াতে আসা এক জাপানি গবেষক আমার মাস্টারমশাই অধ্যাপক রাহুল মুখার্জীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কলকাতায় ম্যাকাদুনারুদু আছে কিনা। রাহুলদা প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও পরে বারুগারু, ফুরেঞ্চফুরাই ইত্যাদি শব্দ শুনে বুঝেছিলেন ভদ্রলোক বার্গার আর ফ্রেঞ্চফ্রাই খাবেন বলে ম্যাকডোনাল্ডের দোকান খুঁজছেন। এর পরে ভদ্রলোক যখন “তাকুশি”র জন্য অনুরোধ করেন তখন তিনি যে ট্যাক্সি চাইছেন বুঝতে রাহুলদার কষ্ট হয়নি।

জাপানি ইংরাজির একটা পুরনো গল্প দিয়েই শেষ করি। আমাদের ছাত্রাবস্থায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে এসেছিলেন পৃথিবীবিখ্যাত জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ও গবেষক জেনিচি তাগুচি। তিনি জাপানি অটোমোবাইল শিল্পে তাঁর অবদান নিয়ে বক্তৃতা করাকালীন বারে বারে বাক্য শুরু করছিলেন, “When I was working with ছোতা মোতা company… ” বলে। তাতে শ্রোতারা খুবই আপ্লুত। একজন ফিসফিস করে বললেন, “ভাবা যায় না! কত বড় মানুষ, ভারতে বক্তৃতা দিতে এসে হিন্দি কথা ছোটা-মোটা শিখে নিয়েছেন! আর একটুও অহঙ্কার নেই – বিখ্যাত সব কোম্পানির পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন, কিন্তু তাদের ছোটা-মোটা কোম্পানি বলে উল্লেখ করছেন।

কিন্তু আর এক শ্রোতা বেয়াক্কেলের মত কৌতূহল নিবারণ করতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, “Sir, what is the name of this ছোটা-মোটা company you are referring to?”

তাগুচি বক্তৃতা থামিয়ে কটমট করে চাইলেন। তারপর কয়েক পা হেঁটে পাশে রাখা হোয়াইট বোর্ডের সামনে থেকে একটি স্কেচ পেন তুলে বড় বড় করে লিখলেন TOYOTA MOTOR COMPANY.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *