উৎসবকালে ক্রন্দনরতা জননী, তবুও মনে আশা

উৎসবকালে ক্রন্দনরতা জননী, তবুও মনে আশা

এক ‘উৎসব’ সংখ্যা দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন ‘অবসর’ পত্রিকার পথচলা। এবার আমরা হাজির দ্বিতীয় বর্ষের উৎসব সংখ্যা নিয়ে। বিগত এক বছরে আমরা কতটা পাল্টালাম?
নাঃ! দুর্ভাগ্যজনকভাবে যতটা আশা করেছিলাম ততটা সুখের মুখ মানবজাতি এখনো দেখতে পাচ্ছে না। উৎসবের আলো এখনো পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত হয়নি। তবে বাংলা সাহিত্যের সেই অমোঘ বাক্যটির মতই আমরা আশাবাদী – ‘আলো ক্রমে আসিতেছে।’
শরৎ ঋতুর আগমনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে উৎসবের পূর্বাভাস। প্রকৃতির নয়নভোলানো রূপ প্রত্যক্ষ করার আশায় থাকি আমরা। ‘বরষণ-শেষে’ মেঘেরা তো ছাড়া পায়নি। বর্ষাকালে কাজে ফাঁকি মেরে তারা এখন আকাশ মেঘলা রাখাতেই ব্যস্ত। আর্থ-সামাজিক ভাবে পৃথিবীর মানুষ এখনো পুরো উৎসবের আমেজে মেতে উঠতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে একটি প্রাচীন ব্যঙ্গ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়।

আমরা জানি বসন্ত এবং বর্ষার পরেই শরৎ রবিঠাকুরের প্রিয় ঋতু। শরতের উৎসবমুখরতাকে তাঁর নান্দনিক ভাষায় সম্বর্ধনা দিয়ে তিনি লিখেছেন –

“পারে না বহিতে নদী জলধার,
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর–
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কাননসভাতে!
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
শরৎকালের প্রভাতে।”

তাঁর এক অনুজ কবি ছিলেন যিনি সম্ভবত বাংলার প্রথম ইঞ্জিনিয়ার সাহিত্যিক।  শ্রী যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তাঁর বক্তব্য ছিল একদম পরিষ্কার – এই কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ বাস্তববোধের চেয়ে ভাবালুতার আশ্রয় বেশি নিয়েছেন। বাংলার গ্রামজীবন সম্পর্কে রবিঠাকুরের কিছু ধারণা থাকলেও কবিতাতে তার কোন প্রভাব নেই। বস্তুতঃ ‘দুঃখবাদী, বাস্তববাদী’ কবি যতীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত কবিতা – ‘ঘুমের ঘোরে’ তে সেই বিখ্যাত পংক্তি – “চেরাপুঞ্জির থেকে একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি সাহারার বুকে?’’র মাধ্যমে রবিঠাকুরের ভাববিলাসের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন।  রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত কবিতার ব্যঙ্গাত্মক রূপ ও ঝলসে উঠেছে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে –

“পারে না বহিতে লোক জ্বরভার,
পেটে পেটে পিলে ধরে নাকো আর –
দিবসে শেয়াল গাহিছে খেয়াল
বিজন পল্লীসভাতে!
একপাশে তুমি কাঁদিছ জননী,
শরৎকালের প্রভাতে।”

আজকের ভারতবর্ষ বা গোটা পৃথিবীর দিকে তাকালেও যেন যতীন্দ্রনাথের কবিতাটি আমাদের চোখের সামনে একটি আয়না ধরিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, উৎসব হোক, কিন্তু উৎসব ছাড়াও আমাদের দায়িত্ব আছে পৃথিবীর বঞ্চিত জনসংখ্যার প্রতি। আশা করা যাক, এই উৎসবের আনন্দের পরশরাগে রঞ্জিত হয়ে আমরা আবার সানন্দে আমাদের কর্তব্যে শামিল হতে পারব। উৎসবের রঙ আমাদের মর্মে, সকল কর্মে এসে লাগবেই।

কিছুদিন আগেই আমরা হারালাম আমাদের দুই প্রাণের মানুষকে – সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ ও আবৃত্তিকার গৌরী ঘোষকে। তাঁদের উদ্দেশে রইল আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য – উপস্থাপনায় যথাক্রমে ঈশানী রায়চৌধুরী ও সমর্পিতা ঘটক। আমাদের এক প্রিয় সাহিত্যিক বিমল কর পা দিলেন শতবর্ষে। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাহিত্যিক শেখর বসু। তাঁর কলমে ধরা পড়েছে সেই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা। এবার ‘পুরনো’ অবসর বিভাগেও আমরা রেখেছি শেখর বসুর একটি লেখা – শারদীয়া সংখ্যাতে তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখার স্মৃতিচারণ।

প্রাচীন ভারতের ইস্পাত নিয়ে ইস্পাতের মতই একটি ঝকঝকে লেখা উপহার দিয়েছেন বিমল বসাক। নারী ও সমাজকে নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন শমীতা দাশ দাশগুপ্ত – “যা দেখতে পাই না, তা হই কী করে?”  –  

অনুরূপ ভাবেই শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগে তথাগত ভট্টাচার্যপ্রশ্ন –রবীন্দ্র নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীত- সবই কি সুপ্রযুক্ত?” একই বিভাগে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের প্রারম্ভিক সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেছেন সোমেন দে।

এবারের ইতিহাস বিভাগ অলংকৃত করেছে দুটি লেখা। মেহেরগড়- লুপ্ত সভ্যতার সন্ধান করেছেন পল্লব চট্টোপাধ্যায়। সুন্দরবনের জটার দেউলের অজানা কাহিনি – দীপক সেনগুপ্তর কলমে। সঙ্গে দর্শন সংক্রান্ত একটি লেখা – অভিষেক দত্তর কলমে। 

আসন্ন দুর্গাপুজোর কথা ভেবে রইল দুটি লেখা – ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানালেন শ্যামলী আচার্য। সাহিত্যে ও লোকাচারে অকালবোধন নিয়ে লিখেছেন সূর্য সেনগুপ্ত।

ক্রিকেটে চৌকস খেলোয়াড় বা অলরাউন্ডারদের ভূমিকা আরও বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে। এই নিয়ে কলরব রায়ের প্রতিবেদন।

ব্যক্তিগত গদ্য ও রম্যরচনা বিভাগে রয়েছে যথাক্রমে পায়েল চট্টোপাধ্যায় ও রাম হালদারের দুটি লেখা। অনিন্দিতা বসুর কলমে ভ্রমণ বিভাগে রইল ফুল আর ভালোবাসার জায়গাতে বেড়ানোর গল্প।

আনন্দে কাটুক পুজো। সাবধানের মার নেই, এ কথার সত্যতা যেন আমরা আরো বেশি করে টের পাচ্ছি। তাই সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি আমাদের পত্রিকার তরফ থেকে – পুজোর সাজে ও ‘মাস্ক’ কিন্তু আবশ্যক। পুজোর ভিড়ে মানসিক নৈকট্য থাকলেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন। সর্বশেষ আহ্বান, আসুন, আমরা সকলে মিলে ‘হাত ধুয়ে’ করোনা বিধি মেনে চলি। 

জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, অন্যদেশ, পরবাস ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। সম্প্রতি নিজের একটি ব্লগ চালু করেছেন – www.bhaskarbose.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *