লেখক পরিচিতি : পাঁচকড়ি দে ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন
। বাবা কেদারনাথ দে । ভবানীপুরে একটি স্কুলে পড়াশুনা করেন
; তবে প্রথাগত শিক্ষা খুব বেশী হয়েছিল বলে জানা যায় না ।
ইংরাজিতে
এড্গার অ্যালেন পো (Edger Allan Poe ) (১৮০৯ - ১৮৪৯ ) রচিত
The Murders in the Rue Morgue (১৮৪১) বইটিকেই প্রথম ডিটেক্টিভ
কাহিনী বলে ধরা হয় । শোনা যায় প্রুসিয়ার ( বর্তমানে জার্মানী
) লেখক E. T. A. Hoffmann-এর একটি গল্পের দ্বারা তিনি প্রভাবিত
হন । তবে অনেকে উইল্কি কলিন্সকে (Wilkie Collins) (১৮২৪
- ১৮৮৯ ) ডিটেক্টিভ উপন্যাসের জনক বলে মনে করেন । বিখ্যাত
লেখক চার্লস ডিকেন্স রচিত Bleak House-ও (১৮৫৩) একটি প্রাচীন
গোয়েন্দা কাহিনী । যাই হোক, বাংলায় ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী
না হলেও ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে দারোগা গিরিশচন্দ্র বসু রচিত ‘সেকালের
দারোগার কাহিনী’ অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে
লিখিত গল্প । এর পর উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্য্যায়
(১৮৫৫ - ১৯১৭ ), যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘দারোগার দপ্তর’
লিখে । এই সঙ্গে হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের নামও উল্লেখযোগ্য
। এর পর স্বল্প কালের জন্য আবির্ভাব ‘তপস্বিনী’ খ্যাত নগেন্দ্রনাথ
গুপ্তর । রহস্য কাহিনীর ইতিহাস ‘অবসর’
ও বাংলা
মিস্ট্রি ওয়েবসাইটে আছে রয়েছে, এ নিয়ে বেশী লেখা নিষ্প্রয়োজন
। পরে কিছু গোয়েন্দা কাহিনী রচিত হলেও বিখ্যাত হন তিনজন
লেখক পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩ - ১৯৪৫ ) , দীনেন্দ্রকুমার রায় (
১৮৭৩ - ১৯৪৩ ) এবং সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য । এদের সবার
মধ্যে যার জনপ্রিয়তা তখনকার দিনে প্রায় শরৎচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথকেও
ছুঁতে চলেছিল তিনি হলেন পাঁচকড়ি দে । তার একটি বইয়ের দোকান
ছিল , বাণী প্রেস নামে একটি ছাপাখানারও মালিক ছিলেন তিনি
। তার বই এত বিক্রি হয়েছিল যে তিনি কলকাতার তিন জায়গায় তিনটি
প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরী করেন । তার লেখা বই বিভিন্ন ভাষায়
অনুবাদিত হয়েছিল । তার কয়েকটি বই-এর নাম – ‘মায়াবী’ , ‘মায়াবিনী’
, ‘নীল বসনা সুন্দরী’ , ‘হত্যাকারী কে ?’ , ‘জীবন্মৃত রহস্য’
ইত্যাদি । রবীন্দ্রনাথ যে বছর নোবেল পুরষ্কার পান (১৯১৩)
, সে বছরই পাঁচকড়ি দে তার ‘জীবন্মৃত রহস্য’ পুস্তকটি ‘শ্রদ্ধাস্পদ
কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় করকমলেষু’ লিখে
কবিগুরুকে উৎসর্গ করেন । ‘হত্যাকারী কে ?’ সম্বন্ধে বঙ্গদর্শন
পত্রিকার মন্তব্য : ‘হত্যাকারী কে ? পাঁচকড়ি দে প্রণীত একখানি
ডিটেক্টিভ গল্প এবং সে হিসাবে ইহাতে বিবৃত ঘটনার সমাবেশ
এবং অনুসন্ধানের প্রণালীতে কারিকুরীর পরিচয় পাওয়া যায় ।
অক্ষয়বাবু যে একজন সুদক্ষ ডিটেক্টিভ ইহা গ্রন্থকার দেখাইতে
সমর্থ হইয়াছেন । ভাষাও প্রশংসার্হ ।’ ১৯১০ খৃষ্টাব্দের ভাদ্র
মাসের একটি সংখ্যায় বসুমতীর সমালোচনা : ‘গল্পটি বেশ হইয়াছে
, গল্পটি আদ্যোপান্ত পাঠ করিবার পর সত্য সত্যই জিজ্ঞাসা
করিতে ইচ্ছা করে হত্যাকারী কে ? ইহাতে লেখকের বাহাদুরী প্রকাশ
পাইয়াছে । যে পাঠকগণ ডিটেক্টিভ গল্প পাঠ করিতে বিশেষ উৎসুক
, এই পুস্তকখানি তাঁহাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগিবে ।’ সাহিত্যিক
ধীরেন্দ্রনাথ পালের পুত্র যতীন্দ্রনাথ পালের আকস্মিক মৃত্যুতে
দীনেন্দ্রনাথ অত্যন্ত শোকগ্রস্ত হন । যতীন্দ্রনাথ ছিলেন
পাঁচকড়ির বিশেষ বন্ধু । তার নামানুসারেই জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ
দাঁ লেনে পাঁচকড়ির বইয়ের দোকানের নাম ছিল ‘পাল ব্রাদার্স’
। বন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি আর কোন লেখা লেখেন নি । ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের
২০শে নভেম্বর তার মৃত্যু হয় ।
দীপক
সেনগুপ্ত
(
লেখক পরিচিতি প্রস্তুত করবার জন্য অন্যান্য সূত্র ছাড়াও
শ্রীযুক্ত বারিদবরণ ঘোষের রচনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে )
প্রথমার্ধ
উপক্রমণিকা
আমার কথা
দুইজনেই নীরবে বসিয়া
আছি , কাহারও মুখে কথা নাই । তখন রাত অনেক , সুতরাং ধরণীদেবীও
আমাদের মত একান্ত নীরব । সেই একান্ত নীরবতার মধ্যে কেবল আমাদের
নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ প্রতিক্ষণে স্পষ্টীকৃত হইতেছিল ।
কিয়ৎক্ষণ পরে আমি পকেট হইতে ঘড়ীটা বাহির করিয়া দেখিলাম , "ইঃ
! রাত একটা !"
আমার মুখে রাত একটা শুনিয়া যোগেশবাবু আমার মুখের দিকে একবার
তীব্র দৃষ্টিপাত করিলেন । অনন্তর উঠিয়া একান্ত চিন্তিতের ন্যায়
অবনতমস্তকে গৃহমধ্যে পদচারণা করিতে লাগিলেন । এইরূপ আরও কিছুক্ষণ
কাটিল , হঠাৎ পার্শ্ববর্তী শয্যার উপরে বসিয়া , আমার হাত ধরিয়া
যোগেশচন্দ্র ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিলেন , -
"আপনার সদয় ব্যবহারে আমি চির ঋণী রহিলাম । আপনার ন্যায়
উদার হৃদয় আমি আর কাহাকেও দেখি নাই । আপনি ইতিপূর্ব্বে অনেক
কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন ; কিন্তু আমি তাহার যথাযথ উত্তর
দিতে পারি নাই ; আমার এখনকার অবস্থার কথা একবার ভাবিয়া দেখিলে
আপনি অবশ্যই বুঝিতে পারিবেন , সেজন্য আমি দোষী নহি । আপনি
আমার সম্বন্ধে যে সকল বিষয় জানিবার জন্য একান্ত উৎসূক হইয়াছেন
, আমি তাহা আজ অকপটে আপনার নিকট প্রকাশ করিব ; নতুবা আমার
হৃদয়ের এই দুর্ব্বহ ভার কিছুতেই কমিবে না । ঘটনাটা যেরূপ জটিল
রহস্যপূর্ণ , শেষ পর্য্যন্ত শুনিতে আপনার অত্যন্ত আগ্রহ হইবেই
। আপনি যদি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে পারেন , তাহা হইলে
আমি এখনই আরম্ভ করিতে পারি। ঘটনাটার মধ্যে আর কোন নীতি বা
হিতোপদেশ না থাক , অক্ষয়বাবু যে একজন নিপুণ ডিটেক্টিভ সে
পরিচয় যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় । কেহ যদি কখনও কোন বিপদে
পড়েন , তিনি যেন অক্ষয়বাবুরই সাহায্য প্রার্থনা করেন । আমার
বিশ্বাস , ন্যায়পথে থাকিয়া নিরপেক্ষভাবে যথাসময়ে ঠিক কার্য্যোদ্ধার
করিবার ক্ষমতা তাঁহার বেশ আছে ।"
আমি মুখে যোগেশবাবুকে কিছুই বলিলাম না । মুখ চোখের ভাবে মস্তকান্দোলনে
বুজ্খাইয়া দিলাম , তাঁহার কাহিনী আমি তখনই শুনিতে প্রস্তুত
, এবং সেজন্য আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে । আরও একটু ভাল হইয়া বসিলাম
।
যোগেশচন্দ্র তখন বলিতে আরম্ভ করিলেন ।
প্রথম
পরিচ্ছেদ
যোগেশচন্দ্রের কথা
কি মনে করিয়া যে আমি তখন অক্ষয়বাবুকে আমার কাজে নিয়োজিত করিয়াছিলাম
, সেকথা এখন ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না । কতক বা ভয়ে , কতক বা
রাগে এবং কতক বা অনুতাপে , তখন আমি কতকটা পাগলের মতই হইয়া গিয়াছিলাম
। যদি আপনি কখনও কাহাকে ভালবাসিয়া থাকেন - প্রকৃত ভালবাসা যাহাকে
বলে , যদি আপনি সেইরূপ ভালবাসায় কাহাকে ভালবাসিয়া থাকেন , তাহা
হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন , কি মর্ম্মান্তিক ক্লেশ আমি ভোগ করিতেছি
। কি আশ্চর্য্য , আমি এখনও সেই নিদারূণ যন্ত্রণা সহ্য করিয়া
বাঁচিয়া আছি ।
আমি বাল্যকাল হইতেই লীলাকে ভালবাসিয়া আসিতেছি । লীলা আমাকে সর্ব্বন্তঃকরণে
ভালবাসিত ; সে ভালবাসার তুলনা হয় না । মরিয়াও কি লীলাকে ভুলিতে
পারিব ? শৈশবকাল হইতেই শুনিতাম লীলার সহিত আমার বিবাহ হইবে ।
তখন হৃদয়ের কোন প্রবৃত্তি সজাগ হয় নাই , তথাপি সেকথায় কেমন একটি
অজানিত আনন্দ-প্রবাহে সমগ্র হৃদয় উল্লসিত হইয়া উঠিত । তাহার
পর বড় হইয়াও সেই ধারা অটুট ছিল । আমাদিগের আর্থিক অবস্থা তেমন
সচ্ছল ছিল না বলিয়া আমার সহিত লীলর বিবাহে লীলার পিতার কিছু
অনিচ্ছা থাকিলেও লীলার মাতার আর তাহার ভ্রাতা নরেন্দ্রনাথের
একান্ত আগ্রহ ছিল । নরেন্দ্রনাথ আমার সহাধ্যায়ী বন্ধু । এমনকি
, তাঁহাদিগের আগ্রহে লীলার পিতাকেও সম্মত হইতে হইয়াছিল । সুতরাং
লীলা যে একদিন আমারই হইবে , এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার সমভাবে অক্ষুণ্ণ
ছিল ।
এমন সময়ে ডাক্তারের পরামর্শে আমার পীড়িতা মাতাকে লইয়া আমাকে
বৈদ্যনাথে যাইতে হয় । পীড়ার উপশম হওয়া দূরে থাক্ , বরং উত্তোরত্তর
বৃদ্ধি পাইতে লাগিল । মা বাঁচিলেন না । মা ভিন্ন সংসারে আমার
আর কেহ ছিল না । মাতার সহিত সংসারের সমুদয় বন্ধন আমার শিথিল
হইয়া গেল - সমগ্র জগৎ শূন্যময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । একমাত্র
লীলা - সে শূন্যতার মধ্যে - দীনতার মধ্যে - আমার সমগ্র হৃদয়ে
অভিনব আশার সঞ্চার করিতে লাগিল ।
বৎসরেক
পরে দেশে ফিরিয়া শুনিলাম লীলা নাই - লীলা আমার নাই - তাহার বিবাহ
হইয়া গিয়াছে - সে তখন অপরের । তাহার চিন্তাও তখন আমার পক্ষে
পাপ । এই মর্ম্মভেদী কথা শুনিবার পূর্ব্বে আমার মৃত্যু শ্রেয়ঃ
ছিল ।
লীলার
পিতা এ বিবাহ জোর করিয়া দিয়াছেন , পত্নী পুত্রের মতামত তাঁহার
কাছে আদৌ গ্রাহ্য হয় নাই ।
যাহার সহিত লীলার বিবাহ হইয়াছে , তাহার নাম শশিভূষণ । সে আমার
অপরিচিত নহে । তাহার সহিত আমার আগে খুব বন্ধুত্ব ছিল ।
মাথার উপরে শাসন না থাকায় , নির্দ্দয়প্রকৃতি পিতৃহীন শশিভূষণের
চরিত্র যৌবন-সমাগমে যখন একান্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল , আমি তখন
হইতে আর তাহার সহিত মিশিতাম না ; হঠাৎ কখনও যদি কোনদিন পথে তাহার
সহিত দেখা-সাক্ষাৎ ঘটিত , পরস্পর কুশল প্রশ্নাদি ছাড়া বন্ধুত্বসূচক
কোন বাক্যালাপ ছিল না ।
শশিভূষণের বাৎসরিক হাজার-বারশত
টাকার একটা আয় ছিল ; তাহাতেই এবং প্রতিমাসে কিছু কিছু দেনা করিয়া
তাহার সংসার , বাবুয়ানা , বেশ্যা এবং মদ বেশ চলিত । সেই ঘোরতর
মদ্যপ বেশ্যানুরক্ত শশিভূষণ এখন লীলার স্বামী ।
ক্রমে লোকমুখে বিশেষতঃ লীলার ভাই নরেন্দ্রের মুখে শুনিলাম ,
লীলার স্বামী লীলার প্রতি পশুবৎ ব্যবহার করিয়া থাকে ; এমন কি
, যেদিন বেশী নেশা করে , সেদিন প্রহার পর্য্যন্ত । নরেন্দ্রনাথের
সহিত দেখা হইলে সে প্রতিবারেই বন্ধুভাবে এই সকল কথা আমার কাছে
উত্থাপন করিয়া যথেষ্ট অনুতাপ করিত , এবং পিতৃনিন্দানামক মহাপাপে
লিপ্ত হইত ।
অনুতাপদগ্ধ
লীলার পিতা এখন ইহলোক হইতে অপহৃত হইয়াছেন , সুতরাং তাঁহার অমোঘ
একজ্ঞায়িতার পরিণাম তাঁহাকে দেখিতে হয় নাই ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এইরূপে
আর একটা বৎসর অতিবাহিত হইল । লীলার স্বামী শশিভূষণের বাটী লীলার
পিতৃগৃহ হইতে অধিক দূরে নহে , এক ঘণ্টায় যাওয়া-আসা যায় ; তথাপি
শশিভূষণ লীলাকে এপর্য্যন্ত একবারও পিতৃগৃহে আসিতে দেয় নাই ।
নরেন্দ্রের কাছে শুনিলাম লীলারও সেজন্য বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল
না । পিতার মৃত্যুকালে লীলা একবার মাত্র পিতৃগৃহে আসিবার জন্য
তাহার স্বামীর নিকট অত্যন্ত জেদ্ করিয়াছিল ; কিন্তু দানবচেতার
নিকটে তাহা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছিল । সেই অবধি লীলা আর পিতৃগৃহে
আসিবার নাম মুখে আনিত না ।
এ বৎসর পূজার সময়ে লীলা একবার পিতৃগৃহে আসিয়াছিল । শারদীয়োৎসবোপলক্ষে
নহে , লীলার মার বড় ব্যারাম , তাই সে আসিয়াছিল । মাতার আদেশে
একবার নরেন্দ্রনাথ শশিভূষণকে অনেক বুঝাইয়া হাতে-পায়ে ধরিয়া ,
কাঁদিয়া-কাটিয়া ভগিনীকে নিজের বাড়ীতে আনিয়াছিল ।
আমি নরেন্দ্রের
রুগ্না মাতাকে দেখিবার জন্য যেমন প্রত্যহ তাহাদের বাড়ীতে যাইতাম
, সেদিনও তেমনি গিয়াছিলাম । সেখানে আমার আবাল্য অবারিত দ্বার
। যখন ইচ্ছা হইত , তখনই যাইতাম ; কোন নির্দ্দিষ্ট সময়সাপেক্ষ
ছিল না । সেদিন যখন যাই , তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল
।
সন্ধ্যার পর শুক্লাষ্টমীর কি সুন্দর চন্দ্রোদয় হইয়াছে । জ্যোৎস্না-প্লাবনে
নক্ষত্রোজ্জ্বল নির্ম্মেঘ আকাশ কর্প্পূরকুন্দধবল । অদূরবর্ত্তী
প্রবাহমানা তটিনীর সুন্দর কলগীতি অস্পষ্ট শ্রুত হইতেছিল । সম্মুখস্থ
পথ দিয়া কোন যাত্রাদলের বালক "দাসী বলে গুণমণি মনে কি পড়েছে
তোমার" , গায়িয়া গায়িয়া আপন মনে ফিরিতেছিল । গায়ক বালকের
হৃদয়ে কত হর্ষ ! কি উদ্দাম আনন্দ-উচ্ছ্বাস ! তুষানলদগ্ধ জীবন্মৃত
আমি - আমি কি বুঝিব ? হৃদয়ে যে নরকাগ্নির স্থাপনা করিয়াছি ,
তাহা আজীবন ভোগ করিতে হইবে । যেদিকে দৃষ্টিপাত করি , সকলই যেন
হাস্যপ্রফুল্ল - উৎফুল্ল চন্দ্র ; উৎফুল্ল নক্ষত্রমালা ; উৎফুল্ল
সমীরণ ; উৎফুল্ল আম্রশাখাসীন পাপিয়ার ঝঙ্কৃত মধুর কণ্ঠ ; উৎফুল্ল
আলোকাম্বরা শোভনা প্রকৃতির চারুমুখ । কেবল আমি - শান্তিশূন্য
- আশা শূন্য - কর্ত্তব্যচ্যুত - উদ্দেশ্যহীন কোন্ দূরদৃষ্ট
পথের একমাত্র নিঃসঙ্গ যাত্রী ।
বাটীর
সম্মুখ-দ্বারেই নরেন্দ্রের সহিত আমার দেখা হইল । তখন সে ডাক্তারের
বাড়ী যাইতেছে ; সুতরাং তাহার সহিত বিশেষ কোন কথা হইল না ।
আমি বাটীর
মধ্যে যাইয়া যে ঘরে নরেন্দ্রের মাতা ছিলেন , সেই ঘরের প্রবেশ-দ্বারে
দাঁড়াইলাম । দেখিলাম , রোগশয্যায় নরেন্দ্রের মাতা পড়িয়া আছেন
। পার্শ্বে বসিয়া একজন কঙ্কালসর্ব্বস্ব স্ত্রীলোক তাঁহার মস্তকে
ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া দিতেছে । প্রদীপের আলো আসিয়া সেই উপবিষ্টা
স্ত্রীলোকের অধিলুলিতচিবুক , প্রকটগণ্ডাস্থি অরক্তাধর ম্রিয়মাণ
মুখের একপার্শ্বে পড়িয়াছে । প্রথমে চিনিতে পারিলাম না । তাহার
পর বুঝিলাম - এ সেই লীলা । আজ দুই বৎসরের পরে লীলাকে এই দেখিলাম
। যাহা দেখিলাম , তাহা না দেখিলেই ভাল ছিল ।
লীলার
সেই শরন্মেঘমুক্তচন্দোপম স্মিত মুখমণ্ডল রৌদ্রক্লিষ্ট স্থলপদ্মের
ন্যায় একান্ত বিবর্ণ এবং একান্ত বিষণ্ণ । সেই লাবণ্যোজ্জ্বল
দেহলতা নিদাঘসন্তপ্তকুসুমবৎ শ্রীহীন । সেই ফুল্লেন্দীবরতুল্য
স্নেহ-প্রফুল্ল আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু কালিমাঙ্কিত ! বিষাদ-বিদীর্ণ
হৃদয়ে লীলাকে দেখিতে লাগিলাম - ক্ষণেকে আমার আপাদমস্তক স্বেদাক্ত
হইল । কি আশ্চর্য্য , দুই বৎসরে মানুষের এমন ভয়ানক পরিবর্ত্তনও
হয় !
মনে মনে
ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিলাম , হে করুণাময় ! হে অনাথের নাথ
! দীনের অবলম্বন , নিরাশ্রয়ের আশ্রয় ! যাহার আশা আমি ত্যাগ করিয়াছি
- যাহার চিন্তাতেও আমার আর অধিকার নাই ; কেন প্রভু ! আবার তাহাকে
এ মূর্ত্তিতে আমার সামনে ধরিলে ? প্রভো ! আমার হৃদয় অসহ্য বেদনাভারে
ভাঙিয়া-চুরিয়া যাক্ , অবিশ্রান্ত তুষানলে পুড়িয়া খাক্ হইয়া
যাক্ , ক্ষতি নাই ; লীলাকে সুখী কর - তাহার অন্ধকার মুখ হাসিমাখা
করিয়া দাও । আমি আর কিছুই চাহি না ।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আমাকে দেখিতে পাইয়া লীলা
মাথায় কাপড় দিল । এবং তাড়াতাড়ি উঠিয়া , জড়সড় হইয়া লজ্জানম্রমুখে
যেমন ঘরের বাহির হইতে যাইবে , তাহার ললাটের একপার্শ্বে কবাটের
আঘাত লাগিল । লীলা সরিয়া দাঁড়াইল ।
আমি কতকটা অপ্রকৃতিস্থভাবে তাহাকে বলিলাম , " লীলা ,
বসো । তুমি কি আমাকে চিনিতে পার নাই ?"
আমার বিশ্বাস -
লীলাকে চিনিতে প্রথমে আমার মনে যেমন একটা গোলমাল উপস্থিত হইয়াছিল
, সেইরূপ তাহারও কিছু একটা ঘটিয়া থাকিবে । এ-লীলা , সে-লীলার
মত নয় বলিয়া আমার মনে এইরূপ ধারণা হইয়াছিল । যাক , এমন সময়ে
পার্শ্ববর্তী গৃহমধ্যস্থ কোন দুগ্ধপোষ্য শিশুর করুণ ক্রন্দন
শ্রুত হইল । লীলা মৃদুনিক্ষিপ্ত শ্বাসে "আসছি",
বলিয়া ঘরের বাহির হইয়া গেল ।
আমি চিন্তিত মনে রুগ্নার শয্যার পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলাম ।
রুগ্না নিদ্রিতা । অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়াছিলেন , সুতরাং আমি
পূর্ব্বে তাহা বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , "এখন
কেমন আছেন ?"
তাহাতেই তাঁহার
নিদ্রাভঙ্গ হইল । আমাকে দেখিয়াই বসিতে বলিলেন । আমি তাঁহার
শয্যার একপার্শ্বে বসিলাম । তাহার পর তিনি বলিতে লাগিলেন "বড়
ভাল নয় বাবা , এ যাত্রা যে রক্ষা পাইব , এমন মনে হয় না । নরেন
রহিল - লীলা রহিল , উহাদের তুমি দেখিয়ো । আমি জানি , তুমি
উহাদের ছোট ভাই ভাই-বোনের মত দেখ ; এখন উহাদের আর কেহ রহিল
না ; তুমি দেখিয়ো । তুমিই উহাদের বড় ভাই ।"
আমি বলিলাম , "
সেজন্য আমাকে বিশেষ কিছু বলিতে হইবে না । নরেন্দ্র ও লীলা
যে আমাকে বড় দাদার ন্যায় ভক্তি করে , তাহা কি আমি জানি না
? আমি আজীবন তাহাদের মঙ্গল-চেষ্টা করিব । ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি
এখন শীঘ্র আরোগ্য লাভ করিলে সকল দিক রক্ষা হয় ।"
নরেন্দ্রের
মাতা বলিলেন, " না বাবা , আর বাঁচিতে ইচ্ছা নাই । নরেনের
জন্য ভাবি না , সে বেটাছেলে , লেখাপড়া শিখিয়াছে , বড় ঘরে তাহার
বিবাহও দিয়াছি - সে যেমন করিয়া হউক , আজ না হয় , দুদিন পরেও
মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে । কেবল লীলার জন্য - লীলার স্বামী
মাতাল - বদ্রাগী লোক - আমার সোনার লীলার যে দশা করিয়াছে দেখিলে
চোখে জল আসে । লীলার জন্য আমার মরণেও সুখ হইবে না । লীলা এখন
এখানে আছে , অনেক করিয়া তবে তাহাকে এবার আনিয়াছি ।"আমি
বলিলাম , " হ্যাঁ , এইমাত্র আমি তাহাকে দেখিয়াছি - আমি
প্রথমে লীলাকে চিনিতে পারি নাই ।
"
দীর্ঘনিশ্বাস
ফেলিয়া জননী বলিলেন , "লীলা এখন সেই রকমই হইয়াছে ।"
তাঁহার চক্ষে দুই বিন্দু অশ্রু সঞ্চিত হইল । তাহার পর বলিলেন
, "লীলার একটি ছেলে হইয়াছে , দেখ নাই ?"
আমি শুষ্ক
হাস্যের সহিত বলিলাম , " না ।"
চতুর্থ
পরিচ্ছেদ
পাশের ঘরে লীলা ছিল ,
লীলার মা তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন , " লীলা , প্রবোধচাঁদকে
একবার এ ঘরে নিয়ে আয় - তোর যোগেশ দাদা এসেছে - দেখ্বে ।"
বলা বাহুল্য শিশুর
ক্রন্দনে এবং লীলার ব্যস্ততায় তাহা আমি পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম
। অনতিবিলম্বে শিশুপুত্র ক্রোড়ে লীলা আমাদিগের ঘরে প্রবেশ
করিল - দেখিলাম , সেই সেদিনের খেলাঘরের বালুকাকে অন্ন , কচুপাতাকে
ঘণ্টে , ইঁটের ক্ষুদ্র টুকরাগুলিকে মৎস্যে এবং পরমান্নে পরিণত
করিবার অসীমক্ষমতাধারিণী পাচিকা , হাস্যচপলা ছোট লীলা আজ মাতৃপদাধিষ্ঠাত্রী
।
লীলা গৃহতলে বসিল । শৈশবে দুইজনে একসঙ্গে খেলা করিয়াছি , ছুটাছুটি
করিয়াছি , ঝগড়া করিয়াছি ; ভাবের পর একসঙ্গে বসিয়া কত গল্প
করিয়াছি । বুঝিতে পারিলাম না , কেমন করিয়া কোন্ দিন সহসা
সে শৈশবস্বর্গচ্যুত হইলাম । শুধু স্মৃতিমাত্র রহিয়া গেল ।
যাহা হউক
, যদিও এখন সে-লীলা নাই , তথাপি লীলা আমাদের পাড়ার মেয়ে , তাহাকে
আমি এতটুকু হইতে দেখিয়া আসিয়াছি , আমাকে দেখিয়া তাহার লজ্জা
করিবার কোন আবশ্যকতা ছিল না । সে মাথায় একটু কাপড় দিয়া বসিল
। আমি সস্নেহে তাহার শিশুপুত্রকে বুকে করিলাম ।
সুন্দর
টুকটুকে ছেলেটি - মুখ, চোখ, ও কপালের গড়ন ঠিক লীলার মত । বুঝিলাম
, লীলাকে প্রবোধ দিতেই এই প্রবোধচাঁদের জন্ম , এবং লীলা হইতেই
তাহার এইরূপ নামকরণ ।
তাহার পর লীলার মাতা
লীলার অদৃষ্টকে শতবার ধিক্কার দিয়া এবং লীলার স্বামীর প্রতি
অনেক দুর্ব্বচন প্রয়োগ করিয়া নিন্দাবাদ করিতে লাগিলেন । তাহাতে
লীলার মলিন মুখ আরও অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল । স্বামীনিন্দা হিন্দুরমণীমাত্রেরই
নিকট অপ্রীতিকর । তা লীলা শিক্ষিতা এবং সদ্কুলোদ্ভবা । লীলার
স্বামীভক্তি অচলা হউক , লীলার চরিত্রহীন স্বামী দেবতুল্য হউক
, লীলা সুখী হউক , আমি তাহাতেই সুখী ।
পাঁচকড়ি
দে
( ক্রমশঃ
)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)