প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হত্যাকারী কে-    

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আমি অক্ষয়বাবুর নূতন বাগান হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম , কে একটা লোক অনতিদূরস্থ একটা গাছের পার্শ্বে , তথাকার সীমাবদ্ধ ছায়ান্ধকার মধ্যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে। আমি সেদিকে আর দৃষ্টিপাত না করিয়া সেই তরুচ্ছায়াঘন সন্ধ্যাধূসর জনমানবশূন্য গ্রাম্যপথের বিপুল নিস্তব্ধতা নিজের পদশব্দে কম্পিত করিতে করিতে গৃহাভিমুখে চলিলাম।

কিছুদূরে আসিয়া আমি একবার পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম , সেই লোকটাই , অনেক তফাতে আসিতেছে। একবার একটু মনে সন্দেহ হইল ; তাহার পর মনে করিলাম , হয়ত তাহারও এই গন্তব্য পথ। তাহার পর যখন আমি আমার বাড়ীর সম্মুখবর্ত্তী হইলাম , তখনও সেই লোকটাকে দেখিতে পাইলাম ; কিন্তু এবারে তাহাকে আমার পশ্চাতে দেখিলাম না। সে কখন কোথা দিয়া আসিয়া আমাদের বাড়ী ছাড়াইয়া আরও তিন-চারিখানা বাড়ীর পরে একটা গলিপথের ধারে দাঁড়াইয়া আছে ; এবং আমার দিকে বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতেছে। তখন বুঝিলাম , সে আমারই অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে। অবশ্যই লোকটার একটা কোন উদ্দেশ্য আছে। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে যতদূর পারা যায় দেখিলাম - আকৃতি এবং বেশভূষায় তাহাকে ভদ্রলোক বলিয়া বোধ হয় না। ভদ্র বা ইতর যেই হোক - লোকটা কে? লোকটার উদ্দেশ্য কি?

সন্দেহে মনটা কিছু চঞ্চল হইয়া উঠিল। মনে করিলাম , তখন নিজের বাড়ীতে না যাইয়া , আরও খানিকটা এদিক-ওদিক করিয়া লোকটাকে তফাৎ করিয়া দিই। অনেকরকম দুর্ভাবনায় মনটা তখন অত্যন্ত পীড়িত ছিল ; সুতরাং মনের ইচ্ছা মনেই রহিয়া গেল। আমি দ্রুতপদে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিলাম , এবং পরক্ষণেই এ ক্ষুদ্র ঘটনা আমার মন হইতে একেবারে অপসৃত হইয়া গেল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

পরদিন বেলা ঠিক তিনটা বাজিবার মুখে অক্ষয়কুমারবাবু আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেদিন দেখিলাম , তিনি অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত এবং তাঁহার মুখ সহাস্য। দেখিয়া বোধ হইল , আজ যেন তিনি রাশি রাশি প্রয়োজনীয় সংবাদে কূলে কূলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছেন। আমাকে সজোরে টানিয়া একটি চেয়ারে বসাইয়া বলিলেন , " বসুন মহাশয় , বসুন , ব্যস্ত হইবেন না।" তাঁহার এইরূপ আগ্রহ ও অভ্যর্থনায় বোধ হইল , যেন সেটি আমার বাড়ী নহে , আমিই তাঁহার সহিত দেখা করিতে তাঁহার বাড়ীতেই সমুপস্থিত হইয়াছি।

সে যাহাই হউক , আমি উত্তেজিতকণ্ঠে বলিলাম , " এবার বোধ হয় আপনি এ কেস্টার একটা কিছু কিনারা করিতে পারিয়াছেন।"

তিনি বলিলেন , " হ্যাঁ , সাহস করে বলতে পারি , এখন কেস্টাকে ঠিক আমার মুঠোর ভিতরে আনিতে পারিয়াছি। বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার ! আমার মত বিচক্ষণ ডিটেক্টিভের হাতে যত কেস্ আসিয়াছে , একটি ছাড়া এমন অত্যাশ্চর্য্য কোনটিই নহে। যে বয়স আমার , তাতে "বিচক্ষণ" , বিশেষণটার আমার কিছু অধিকারও থাকতে পারে , কি বলেন? ( হাস্য ) কাল মোক্ষদার সহিত আপনার কথাবার্ত্তায় কেস্টা একেবারে পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। আর কোন গোল নাই। বলিতে কি মোক্ষদা মেয়েটি ভারী ফিচেল - ভারী চালাক , এমন সে ভাণ করিতে পারে , ঠিক হুবাহুব। যদি তাকে কোন থিয়েটারে দেওয়া যায় , সে শীঘ্রই একটি বেশ নামজাদা , এক্ট্রেস্ হতে পারে।"

আমি শ্রুতিমাত্র বিস্মিত হইয়া বলিলাম , " কেন , কাল আপনি বল্ছিলেন যে -"

বাধা দিয়া অক্ষয়বাবু বলিলেন , " কি আপদ ! কল্যকার কথা আজ কেন? ব্যস্ত হইবেন না - আমি যা বলি , তা মন দিয়ে শুনুন। আপনার নব্য বয়স , রক্ত গরম - সুতরাং ধৈর্য্যটি অত্যন্ত কম। কাল যদি আপনাকে সমুদয় প্রকৃত কথা ভাঙিয়া বলিতাম , তাহা হইলে আপনি হয়ত আমার সকল শ্রম পণ্ড করিয়া ফেলিতেন। মোক্ষদা মেয়েটি ভারী চালাক - যতদূর হইতে হয়।" এই বলিয়া তিনি সুখ্যাতিবাদের আবেগে নিজের হস্তে হস্ত নিষ্পীড়ন করিতে লাগিলেন।

আমি ধৈর্য্যচ্যুত হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম , " মোক্ষদা হইতে কি আপনি এ খুন-রহস্যের কোন সূত্র বাহির করিতে পারিয়াছেন?"

অক্ষয়কুমারবাবু বলিলেন , " দেখুন যোগেশবাবু , আপনার কথাটাই ঠিক। এই হ্ত্যাকাণ্ডে শশিভূষণের কিছুমাত্র দোষ নাই। আরও একটা কথা - কি জানেন , হত্যাকারী শশিভূষণকে খুন করিতে গিয়া ভ্রমক্রমে লীলাকে খুন করিয়াছে।"

আমার মস্তিষ্কের ভিতর দিয়া বিদ্যুতের একটা সুতীব্র শিখা সবেগে সঞ্চালিত হইয়া গেল ; আমি অত্যন্ত চমকিত হইয়া উঠিলাম।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

অক্ষয়কুমারবাবু বলিতে লাগিলেন , " স্থির হন , ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। শশিভূষণের কোন দোষ থাক বা না থাক , সে এখন আর এ জগতে নাই , সে কাল রাত্রে হাজত ঘরেই আত্মহত্যা করিয়াছে। বোধ হয় , আপনি জানেন , শশিভূষণের শয়ন-গৃহটি দক্ষিণ দিকের সরু গলিটার ধারেই। একটি অনতি উচ্চ প্রাচীর এবং কয়েকটি বড় বড় ফলের গাছ ব্যবধান মাত্র। শশিভূষণের শয়ন-গৃহে দুইটি শয্যা ছিল। একটিতে লীলা তাহার শিশু-পুত্রকে লইয়া শয়ন করিত , অপরটিতে শশিভূষণ একাকী শয়ন করিত। যে রাত্রে লীলা খুন হয় , সে রাত্রে মোক্ষদার বাড়ীতে শশিভূষণ যায় নাই - সেইজন্য মোক্ষদা রাত্রে চুপি চুপি শশিভূষণের বাড়ীতে আসিয়াছিল। সেদিন শশিভূষণ অত্যন্ত বেশী মদ খাইয়াছিল ; সেই ঝোঁকে শয়ন-গৃহে গিয়া লীলাকে অত্যন্ত প্রহারও করিয়াছিল। সে রাত্রে তাহাদের ঐ গলির দিকের একটি জানালা খোলা থাকায় সেই গলিতে দাঁড়াইয়াও ঘরের সেইসব ব্যাপার দেখিবারও বেশ সুযোগ ছিল। যাক্ , তাহার পর শশিভূষণ একটি বিছানায় শুইয়া , মদের ঝোঁকে খানিকটা এপাশ-ওপাশ করিয়া নিদ্রিত হইল। এবং লীলাও তাহার খানিকটা পরে ঘুমাইয়া পড়িল। তাহার একঘন্টা পরেই হত্যাকারী সেই গলিপথ দিয়া প্রাচীর , বৃক্ষ এবং উন্মুক্ত গবাক্ষের সাহায্যে সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া লীলাকে হত্যা করে। পরে পুনর্ব্বার উন্মুক্ত বাতায়ন পথ দিয়া নামিয়া যায়। তখন লীলার স্বামী মদের ও নিদ্রার ঝোঁকে একেবারে সংজ্ঞাশূন্য। যোগেশবাবু , আমার কথা আপনার বড় আশ্চর্য্য বলিয়া বোধ হইতেছে , বোধহয় ; কিন্তু ইহার একটি বর্ণও মিথ্যা নহে - আমি এ সম্বন্ধে অনেক প্রমাণ পাইয়াছি। আপনার এই কেস্ হাতে লইয়া প্রথমে আমি শশিভূষণের পারিবারিক বৃত্তান্তগুলি জানিতে চেষ্টা করি। তা সে চেষ্টা যে একেবারে বৃথা গেছে , তাহা নহে। তাহাতেই জানিতে পারি যে , শশিভূষণের দুইটি বিছানা ছিল। একটি বড় - সে বিছানায় লীলা তাহার ছোট ছেলেটিকে লইয়া শয়ন করিত। আর যেটি ছোট , সেইটিতে শশিভূষণ নিজে শয়ন করিত। তাহাদের এক বিছানায় না শয়ন করিবার কারণ , শশিভূষণ অনেক রাত্রে মদ খাইয়া আসিত , যতক্ষণ না ঘুম আসিত , ততক্ষণ পড়িয়া পড়িয়া সে ছট্ফট্ করিত। সেরূপ অবস্থায় আরও দুইটি প্রাণীর সহিত একত্রে শয়ন করা সে নিজেই অসুবিধাজনক বোধ করিয়া এইরূপ ব্যবস্থা করিয়াছিল। বিশেষতঃ নিত্য মধ্যরাত্রে পার্শ্ববর্ত্তী শিশুপুত্রের তীব্রতম উচ্চ ক্রন্দনে বারত্রয় তাহার সুনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিবারও যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। সেদিন প্রাতঃকালে সকলেই লীলার মৃতদেহ তাহার স্বামীর বিছানায় থাকিতে দেখিয়াছিল। সেই সূত্র অবলম্বনে আমি দুইটি অনুমান করিতে পারিয়াছি। প্রথম অনুমান - সেদিন রাত্রে শশিভূষণ বেশী মদ খাইয়াছিল , তেমন খেয়াল না করিয়া ঝোঁকের মাথায় ভ্রমক্রমে তার স্ত্রীর বিছানায় শুইয়াছিল , এবং অনতিবিলম্বে সেইখানেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। লীলা স্বামীকে নিদ্রিত দেখিয়া এবং তদবস্থ স্বামীর নিদ্রাভঙ্গ করা অনুচিত মনে করিয়া , নিজের ছেলেটিকে লইয়া অপর বিছানায় শয়ন করিয়াছিল। দ্বিতীয় অনুমান - এমন সময় কেহ গবাক্ষদ্বার দিয়া সেই অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল। সম্ভব , সে এই দম্পতীর এই অপূর্ব্ব শয়ন-ব্যবস্থা পূর্ব্ব হইতেই জানিত ; সুতরাং অন্ধকারে কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া স্বামীর পরিবর্ত্তে স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছে। এই দুইটি অনুমানের যথেষ্ট প্রমাণও আমি সংগ্রহ করিয়াছি। তখন তাহাদের শয়ন-গৃহে যে অপর কেহ গোপনে উপস্থিত হইয়াছিল , তাহার প্রমাণ - সেই গলিটার পাশে প্রাচীরের উপরে আমি দুই-তিনটি অস্পষ্ট পদচিহ্ণ এবং নীচে গলির ধারে অনেকগুলি সেই পদচিহ্ণ সুস্পষ্ট দেখিয়াছি। সেখানে অনেক গাছপালা এবং পাশেই আবার শশিভূষণের দ্বিতল অট্টালিকা ; সুতরাং সেই গলির ভাগ্যে রৌদ্রস্পর্শ্ব সুখ বহুকাল ঘটে নাই। সেইজন্য সেখানকার মাটি এত স্যাঁতসেঁতে যে , অনতিশুষ্ক কর্দ্দম বলিলে অত্যুক্তি হয় না। তাহাতে সেই কাহারও পায়ের দাগগুলি সেখানে বেশ সুগভীর এবং সুস্পষ্ট অঙ্কিত হইয়াছিল। পরে অনেক কাজে লাগিবে স্থির করিয়া আমি সেইসকল পদচিহ্ণের মধ্যে যেগুলি অধিকতর গভীর এবং নিঁখুত , সেইগুলির উপরে গাছের কতকগুলা শুষ্কা পাতা কুড়াইয়া আগুন ধরাইয়া দিই , সেই পদচিহ্ণগুলি বেশ শুষ্ক হইয়া আসিতে আমি ময়দা দিয়া একটি ছাপ তুলিয়া লই। সেই মাপেরই অতি অস্পষ্ট পদচিহ্ণ শশিভূষণের শয়ন-গৃহের গবাক্ষের বাহিরে আলিসার উপরেও দুই-একটা দেখিয়াছি। আমার কথায় আপনার একটি সন্দেহ হইতে পারে যে , হত্যাকারী সেই অনতি উচ্চ প্রাচীর হইতে একেবারে কি করিয়া সেই অত্যুচ্চ দ্বিতলে উঠিল , কিন্তু সে সন্দেহ আমি রাখি নাই। হত্যাকারী সেইখানকার একটা জামগাছ অবলম্বন করিয়া উঠিয়াছিল। সেই জামগাছের গুঁড়ির কিছু উপরে কতকগুলি খুব ছোট নধর শাখা অঙ্কুরিত হইয়াছিল। তা নামিবার সময়ে হউক বা উঠিবার সময়েই হউক হত্যাকারীর পা লাগিয়া , সেগুলার কতক ভাঙিয়া মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল , কতক গাছেই ঝুলিতেছিল। এইসকল প্রমাণে এই হত্যাকাণ্ডের ভিতরে যে আর একজন কাহারও অস্তিত্ব আছে - সে সম্বন্ধে আমি একেবারে নিঃসন্দেহ এবং আপনার মতের সহিত একমত হইতে পারিয়াছি। শশিভূষণ সম্পূর্ন নির্দ্দোষ। আমি যাহা বলিলাম , আপনি কি তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন?"

এইরূপ জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি আমার উত্তরের জন্য ক্ষণমাত্র অপেক্ষা না করিয়া তন্ময়চিত্তে বলিতে লাগিলেন , " মোক্ষদা মেয়েটা ভারী চালাক - যতদূর হতে হয় - ওঃ ! বেটী কি বুদ্ধিমতী , সাবাস্ মেয়ে যা হক !"

আমি তাহার সেই তন্ময়তার মধ্যে একটু অবসর পাইয়া বলিলাম , " ওঃ হরি ! আপনি তাহা হইলে এখন সেই মোক্ষদাকে দোষী ঠিক -"

বাধা দিয়া আমার মুখের দিকে ক্ষণমাত্রস্থায়ী একটা বিরক্তিব্যঞ্জক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সহাস্যমুখে বলিলেন , " মোক্ষদা? তাও কি সম্ভব ! একি কাজের কথা? আপনি অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছেন দেখিতেছি - আপনি আমার নিযোক্তা - আপনার কাছে কথাটা আর অধিকক্ষণ গোপন রাখা ঠিক হয় না। অন্য আর প্রমাণ দেখাইবার কোন আবশ্যকতা নাই - আমি একেবারে হত্যাকারীকে আপনার প্রত্যক্ষ করিয়া দিতেছি।"

বলিতে বলিতে অক্ষয়কুমারবাবু উঠিলেন। ক্ষিপ্রহস্তে পথের দিক্কার একটি জানালা সশব্দে খুলিয়া ফেলিলেন। এবং জানালার সম্মুখভাগে ঝুঁকিয়া কাহাকে লক্ষ্য করিয়া বংশীধ্বনি করিলেন।

নবম পরিচ্ছেদ

নিদারুণ উৎকণ্ঠায় আমার আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল , এবং দৃষ্টি সম্মুখে সর্ষপ-কুসুম নামক বিবিধ-বর্ণ-বিচিত্র ক্ষুদ্র গোলকগুলি নৃত্য করিয়া উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল।

ক্ষণপরে দুইটি লোক সেই ঘরে প্রবেশ করিল। একজনকে দেখিবামাত্র পুলিস-কর্ম্মচারী বলিয়া চিনিতে পারিলাম। আর তাহার পাশের লোকটি সে-ই - গত রাত্রে যে বালিগঞ্জের পথ হইতে আমার বাড়ী পর্য্যন্ত আমার অনুসরণে আসিয়াছিল।

সেই লোকটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া অক্ষয়কুমারবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন , " আপনি কি এই লোকটিকে চিনিতে পারেন?"

আমি বলিলাম , " হ্যাঁ , যখন আমি আপনার বাগান হইতে ফিরিতেছিলাম , তখন এই লোকটি আমার বাড়ী পর্য্যন্ত অনুসরণ করিয়া আসিয়াছিল ; কিন্তু তাহার পূর্ব্বে ইহাকে আর কখনও দেখি নাই।"

অক্ষয়কুমারবাবু বলিলেন , " না দেখিবারই কথা। আমারই আদেশে এই লোক আপনার অনুসরণ করিয়াছিল।" এই বলিয়া তিনি বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া নবাগতদ্বয়কে বলিলেন , " তোমাদের ওয়ারেন্ট বাহির কর , ইঁহারই নাম যোগেশবাবু - ইনিই লীলার হত্যাকারী।"

কথাটা শুনিয়া বজ্রাহতের ন্যায় আমি সবেগে লাফাইয়া উঠিয়া দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গেলাম। এবং তেমন মধ্যাহ্ণ-রৌদ্রোজ্জ্বল দিবালোকেও উন্মীলিত চক্ষে চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। এই বিশ্বজগতের সমুদয় শব্দ-কোলাহল আমার কর্ণমূলে যুগপৎ স্তম্ভিত হইয়া গেল গাঢ়তর গাঢ়তর গাঢ়তর অন্ধকারে চারিদিক ব্যাপিয়া ফেলিল। কতক্ষণ পরে জানি না - প্রকৃতিস্থ হইয়া দেখিলাম , অয়ষ্কঙ্কণে আমার হস্তদ্বয় শোভিত এবং সন্নিবদ্ধ হইয়াছে। অক্ষয়বাবু বলিতেছেন , যোগেশবাবু , আপনার জন্য আমি দুঃখিত হইলাম। কি করিব? কর্ত্তব্য আমাদিগের সর্ব্বাগ্রে। আপনি জানিয়া-শুনিয়াও এইমাত্র মোক্ষদার স্কন্ধে নিজের অপরাধটা চাপাইতেছিলেন? তাহাতে আপনাকে বড় ভাল লোক বলিয়া বোধ হয় না। সে যাহা হউক , যেদিন আপনি আমার সহিত প্রথম দেখা করেন , সেইদিন আপনার মুখে হত্যাবৃত্তান্ত শুনিবার সময়েই আমি কোন সূত্রে আসল ঘটনাটা ঠিক বুঝিতে পারিয়াছিলাম। সেইজন্যই আপনার দেয় পুরষ্কারের হাজার টাকা একটি দস্তুরমত লেখাপড়া করিয়া কোন ভদ্রলোকের মধ্যস্থতায় জমা রাখিতে বলি। আপনিও তাহা রাখিয়াছেন। আর আপনিও জানেন , শুধু হাত কখন কাহারও মুখে ওঠে না। সে যাহাই হউক , ইহাতেই আপনার হৃদয়ের একটা মহৎ উদারতার পরিচয় পাওয়া যায় , শশিভূষণ আপনার ঘোরতর শত্রু হইলেও সে যে নিরপরাধ , তাহা আপনি অন্তরে জানিতেন। আপনার অপরাধে যে তাহাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে , এই ভাবিয়া আপনার যথেষ্ট অনুতাপ হইতেই এই হাজার টাকা পুরস্কারের সৃষ্টি। এখন দুই-চারিটি প্রমাণ দেখাইয়া দিলে , আপনি যে একটা অর্ব্বাচীনের হাতে কেস্টা দেন নাই , সে সম্বন্ধে আপনার আর কোন সন্দেহ থাকিবে না। যেদিন লীলা খুন হয় , সেইদিন রাত দশটার সময়ে বাগানে আপনার সঙ্গে শশিভূষণের খুব একটা রাগারাগি হয়। এবং তাহাকে খুন করিবেন বলিয়া আপনি উচ্চকণ্ঠে শাসাইয়াছিলেন। অবশ্যই আপনার সেই উচ্চকণ্ঠের শাসনগুলি সেই সময়ে শশিভূষণ ছাড়া আরও দুই-একজনের শ্রুতিগোচর হইয়াছিল। ইহার কিছুক্ষণ পরে শশিভূষণ তাহার ছুরি চুরির কথা জানিতে পারে। শশিভূষণকে না বলিয়া সেই ছুরিখানি আপনি লইয়াছিলেন। আপনার এই 'না-বলিয়া-ছুরি-গ্রহণ' সম্বন্ধে আমি দুই-একটা প্রমাণও সংগ্রহ করিয়াছি। সেদিন শশিভূষণের তীক্ষ্ণতর কটূক্তিতে আপনার রক্ত নিরতিশয় উষ্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। আপনি বাড়ীতে ফিরিয়াও নিজেকে কিছুতেই সামলাইতে পারেন নাই ; আপনি শশিভূষণকে হত্যা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়া পুনরায় তাহার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন। এবং আপনার মাথায় হঠাৎ কি একটা প্ল্যান্ উদ্ভব হওয়ায় , আসিয়াই বৈঠকখানা ঘর হইতে ছুরিখানা 'না-বলিয়া-হস্তগত-করা নামক পাপে' লিপ্ত হইয়া আসেন। তখন একজন পরিচারিকা আপনাকে দেখিয়াছিল। আপনি ভদ্রলোক , সে ছোটলোক সুতরাং তখন সে আপনার উপর এরূপ একটা গর্হিত সন্দেহ করিতে পারে নাই। এদিকে যখন এইরূপ দুই-একটি ক্ষুদ্র ঘটনা আরম্ভ ও সমাপ্ত হইয়া গেল , তখনও শশিভূষণ সেই বৈঠকখানার ছাদে মদ খাইতেছিল। উদ্যানে আপনাদের সেই বাগ্বিতণ্ডার পরে আপনি যখন চলিয়া গেলেন - কোন দুর্জ্ঞেয় কারণে শশিভূষণের মনে একটা বড় অস্বাচ্ছন্দ্য উপস্থিত হয়। এবং সেই অস্বাচ্ছন্দ্য দূর করিবার জন্য সে আবার বৈঠকখানার ছাদে উঠিয়া মদ্যপান আরম্ভ করিয়া দেয়। মদেই লোকটা মাথা খাইয়া দিয়াছিল। যতটা পারি , বসিয়া বসিয়া খাইল। তাহার পর বাকীটা বোতলের মুখে ছিপি আঁটিয়া যখন ঘরের আলমারীতে রাখিতে যায় - তখন দেখে আলমারী খোলা রহিয়াছে এবং ছুরিখানি সেখানে নাই। দেখিয়া প্রথমে একটু চিন্তিত হইল। তাহার পর দুই-একবার এদিক-ওদিক খুঁজিয়া না পাইয়া বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেল। এবং লীলাকে ছুরির সহসা অদৃশ্য হবার কথা বলিল। সেই সময়ে তাহার শয়ন-গৃহের পার্শ্বস্থ গলিপথে মোক্ষদা কোন লোককে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিল। মোক্ষদাকে আমি সেই লোকটার নাম জিজ্ঞাসা করায় সে বলে তাঁহাকে সে চেনে না , পূর্ব্বে কখনও দেখে নাই। তখন আমি একটা কৌশল করিয়া আপনাকে তাহার সম্মুখে নিয়ে যাই ; আপনি তাহার মুখে তখন যে সকল কথা শুনিয়াছিলেন , তাহা ভাষণমাত্র , আমিই তাহাকে এইরূপ একটা অভিনয় দেখাইতে শিখাইয়া দিয়াছিলাম। যাহা হউক , মোক্ষদা আপনাকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারে। তখন রহস্যটা অনেক পরিষ্কার হইয়া আসিল। তাহা হইলেও কেবল মোক্ষদার কথায় আমি বিশ্বাস করি নাই - সেটা ডিটেক্টিভদিগের স্বধর্ম্মও নহে। আর যাহা হউক , সেই প্রাচীরের পার্শ্ববর্ত্তী পদচিহ্ণগুলি মিলাইয়া দেখিবার একটা সুযোগ সেই সঙ্গে ঠিক করিয়া লই। সেইজন্য আপনাকে আমার বাগানবাড়ীতে গিয়া হল্ঘরে যাইতে সবেমাত্র-বিলাতীমাটি-দেওয়া সোপানে নগ্নপদে অতি সন্তর্পণে উঠিতে হয়। তাহাতে সেই সদ্যোমার্জ্জিত বিলাতীমাটিতে আপনার পায়ের যে সব দাগ পড়ে , আমি সেইগুলির সহিত ময়দার ছাপে তোলা সেই গলি পথের দাগগুলি মিলাইয়া বুঝিতে পারি - সকলই এক পায়ের চিহ্ণ এবং সেই পা মহাশয়েরই।" এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন , এবং নিজের হস্তাবমর্ষণ করিতে করিতে অতি উৎসাহের সহিত বলিতে লাগিলেন , " মোক্ষদা বেটী ভারি চালাক - ভারী বুদ্ধিমতী - সাবাস্ মেয়ে যা হোক - যতদূর ফিচেল হতে হয়। কি জানেন , যোগেশবাবু , তাহা হইলেও , আমি , মোক্ষদার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে পারি নাই। আপনাদের সহিত সাক্ষাৎকালে সে যদি আমার কথা আপনাকে বলিয়া দিয়া থাকে , যে আমি আপনাকে ফাঁদে ফেলিবার চেষ্টা করিতেছি ; অথবা আপনি কৌশলে তাহার মুখ হইতে কোন কথা বাহির করিয়া লইয়া আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া থাকেন , এই আশঙ্কা করিয়া আমি এই লোককে তখন আপনার বাড়ী পর্য্যন্ত আপনার অনুসরণ করিয়া দেখিতে বলিয়াছিলাম। আপনি বাড়ীতে যান , কি আর কোথায় যান - কি করেন , আপনার মুখের ভাব কি রকম , এইসব লক্ষ্য করিতে বলিয়া দিয়াছিলাম। যখন আপনি বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন , এই লোক তখন আপনার বাড়ীর সম্মুখে দুইঘণ্টা অপেক্ষা করিয়া যখন আপনাকে বাহিরে আসিতে দেখিল না - তখন নিশ্চিত মনে ফিরিয়া আসিয়া আমাকে সংবাদ দিল। তাহার পর আপনার নামে আজ ওয়ারেণ্ট বাহির করিয়া আমার কর্ত্তব্য নিষ্পন্ন করিলাম। বলিতে কি , অনেক খুনের কেস্ আমার হতে আসিয়াছে , তার মধ্যে একটা ছাড়া এমন অদ্ভুত কোনটাই নয়। যাহা হউক , এখন বুঝিলেন , শশিভূষণ নিরপরাধ এবং হত্যাকারী কে?"

দশম পরিচ্ছেদ

আর কি বলিব? আর কি বলিবার আছে? হে সর্ব্বজ্ঞ , সর্ব্ব-শক্তিমান ! এ দুর্ভাগ্যের হৃদয়ের কথা তুমি সব জান , প্রভো। যাহাকে আমি প্রাণের অধিক ভালবাসিতাম , তাহাকে একজন নৃশংসের হাতে এইরূপ উৎপীড়িত এবং অত্যাচারিত হইতে দেখিয়া আমার হৃদয়ে কি বিষের দাহন আরম্ভ হইয়াছিল , তুমি সব জান , প্রভো ! সেদিন যদি আমার সেই ভুল না হইত , যদি আমি ঠিক শশিভূষণকে হত্যা করিতে পারিতাম , তাহা হইলে বোধহয় , সুখে মরিতে পারিতাম। লীলাকে একজন নররাক্ষসের কবল হইতে উদ্ধার করিয়া মনে করিতে পারিতাম , আমার মৃত্যুতে একটা কাজ হইল। হায় ! মানুষ যা মনে করে , তাহার কিছুই হয় না। সেই সর্ব্বশক্তিমানের অঙ্গুলি হেলনে সমগ্র বিশ্ব সমভাবে শাসিত হইতেছে , সেখানে মানুষ মানুষের কি বিচার করিবে? তাঁহার এমনই রচনা কৌশল - পাপী নিজের হাতেই স্বীকৃত পাপের দণ্ডবিধান করিয়া থাকে।

দুগ্ধপোষ্য অপরিস্ফুটবাক্ শিশু ব্যাঘ্র-কবলিত হইয়া যেমন সে প্রথমে নিজের বিপদ বুঝিতে পারে না , বরং যতক্ষণ ব্যাঘ্র কর্ত্তৃক কোনরূপে পীড়িত না হয় , ততক্ষণ তাহার উল্লম্ফন , বীষণোজ্জ্বল চক্ষু , এবং দীর্ঘ লাঙ্গুলান্দোলনে বরং সেই শিশুর বিকলদন্ত মুখে , নধর অধরপুট দিয়া , কল্লোলিত শুভ্রহাস্যস্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে। হায় ! স্বপ্নাবিষ্ট আমারও তেমনি দুঃখদারিদ্র্য ভীষণ , শোকতাপপূর্ণ , বিপদসঙ্কুল কঠিন সংসারের বক্ষঃশায়িত হইয়া কোন্ অজ্ঞাতমোহে অবিশ্রাম হাস্যতরঙ্গে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে থাকি। তাহার পর যখন কোন অপ্রতিহত দুর্দ্দান্ত আঘাতে স্বপ্ন ভাঙিয়া যায় , তখন নিরবলম্বন এবং আশা-ভরসা-শূন্য হইয়া , হৃদয় শতধা বিদীর্ণ করিয়া উচ্চকণ্ঠে কাঁদিয়া উঠি।

( সমাপ্ত )।

পাঁচকড়ি দে

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

সেকালের জনপ্রিয় লেখক ও তাঁদের লেখা

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ