আটশো
থেকে হাজার বছর মতো পেছিয়ে গেলে, অর্থাৎ প্রথম সহস্রাব্দের
শেষে, যা আমরা চিত্রকলা বলতে বুঝি আজকাল, তার খুব
একটা বেশী চল ছিলো না। স্থাপত্য নিয়েই তখন বেশী হৈচৈ,
কিছু কিছু দুর্গ যে তৈরি হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু গির্জে
গড়াটাই ফ্যাশান। রোম যদিও অনেককাল গত, তবু তার প্রভাব
যায়নি, স্থাপত্যে তো নয়ই,-- খিলেন, মোটা মোটা থাম,
ভারী ভারী ছাদ আর পুরু পুরু দেওয়াল। এদিকে এ তো আপনার
খাজুরাহো কী কোনারক নয়, এ হোলো সায়েবী গির্জা অতএব
তার অলঙ্করণ তো দেবদূত, সাধুসন্ত, বা স্বয়ং যীশুর
মূর্তি, এসব মিলিয়ে কোনো ধর্মমূলক কাহিনী হতেই হবে।
তাই স্থাপত্যের সঙ্গে মানিয়ে খোদাই করা মূর্তিগুলোও
কাঁড়া কাঁড়া, গোঁফদাড়ি নিয়ে, আলখাল্লা পরে ভারী মহিমাময়।
তার ওপর পাদ্রীরা কোনো সন্তকেই চটাতে চাইতেন না, তাই
অকথিত নিয়ম ছিল যে সব সন্তদের আঁকতে হবে এবং মাপে
ছোট বড়ো করা চলবে না। ছবি-আঁকিয়েরা আর কী করেন,--
একেবারে চ্যাপটা সব মূর্তি এঁকে, মুখে চোখে ভীষণ পবিত্র
ভাবের মুখোস পরিয়ে আর মাথার পেছনে কাঁসার থালা এঁটে
(হেইডা অগো ঝ্যুতি, বোঝলান না), একে ওর ঘাড়ে চড়িয়ে
ভীড় করে দাঁড় করিয়ে দিতেন। ছবি তখন বেশীর ভাগই আঁকা
হয় দেয়ালে, ফ্রেস্কো, কিন্তু এত বড় জায়গা থাকতেও তখন
শিল্পীর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, কী করে সবাইকে ছবিতে আঁটা
যাবে। এই অধ্যয়াটিকে সায়েবরা বলেন রোমানেস্ক।
১৩শ শতাব্দী
বরাবর স্থপতিরা এই খিলেন, আর্চ, এবং সেই সংক্রান্ত
রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজে পেলেন, অঙ্কটা কষে নিতে শিখলেন
এবং দেখলেন যে খিলেনের পিঠে খিলেন চড়ানো যায়, ঠিকমতো
কায়দা জানলে থাম বা দেয়াল খুব পুরু করতে হয়না ইত্যাদি
ইত্যাদি। গির্জা আরো ছুঁচলো, আরো উঁচু হয়ে আকাশ ছুঁতে
শুরু করলো, পুরু পুরু দেয়ালের জায়গায় লাগলো বাহারী
জানলা -- স্থূলের জয়গায় লঘু, গহীনতার জায়গায় আলো।
লোকেরা এর নাম দিলো গথিক। মজার কথা এই যে তখন গথিক
কথাটা ব্যবহার করা হোতো "বর্বরোচিত", এই
অর্থে। কেন, তা একটু পরে বলছি। তো এর সঙ্গে তাল রাখতে
ভাস্করদের বলা হোলো যে মূর্তিগুলোকে ওরকম হাঁড়িমুখ
করে রেখোনা, একটু ভাবের খেলা দেখাও, বসনে-ভূষণে লাগাও
সূক্ষ্ম কাজ, আনো একটা বহতা ভাব, ফ্লো। ছবিওয়ালাদের
কাছেও সেই একই দাবী, কিন্তু তাঁদের আরো কিছু সময় দিতে
হোলো। ওঁরা ওই চ্যাপ্টা ব্যাপারটা কিছুতেই আর কব্জা
করে উঠতে পারছিলেন না, ভাস্করদের এ অসুবিধে ছিলো না।
১৪শ শতাব্দীতে একদিন জোত্তো (Giotto di Bondone) --
তিনি আবার ফ্লোরেন্সেরই সন্তান-- কী করে ছবিতে গভীরতা
আনতে হয়, দ্বিরৈখিক পটে ত্রিরৈখিক বস্তু সমাবেশ করতে
হয়, সেটা আবিষ্কার করে ফেললেন। চিত্রশিল্পীরা মুক্তি
পেলেন চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা সব মূর্তি নিয়ে তাদের ডাকটিকিটের
মতো সেঁটে ছবি বানানোর থেকে, সুযোগ পেলেন পট ছেড়ে
ছবি দেখাবার এবং ছবি মারফতে গল্প বলার। এই পার্থক্যটা
এতোই চমৎকারক যে "আগে" এবং "পরে"
মার্কা দুটো ছবি দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না, যদিও
দুটোর কোনোটাই ফ্লোরেন্সে নেই।

The
Entombment of Christ--1250-1300 যীশুকে শেষবারের
মতো আলিঙ্গন মা মেরীর, দুঃখে দিশাহারা সন্ত জন। ওপরে
দেবদূতেরা, নীচে ভক্তেরা, সবাই কাতর। লক্ষ্যণীয় যে
শিল্পী সবার প্রতিকৃতিতেই এই দুঃখের ভাব ফোটাতে সবিশেষ
চেষ্টিত, কিন্তু আসল ঘটনা-- কোথায় হচ্ছে, কী হচ্ছে,
পরিপ্রেক্ষিত-- সেদিকে নজর নেই। এ যেন ঘটনার লিখিত
বিবরণমাত্র, ঘটনার প্রতিচ্ছবি নয়।

Giotto
di Bondone-- The Mourning of Christ, 1305. Fresco;
PaduaP|। ওই একই বিষয় নিয়ে আঁকা ছবিতে জোত্তো আসল
ঘটনাটারই ছবি এঁকেছেন-- বিবরণ নয়। যার যেখানে থাকার
কথা, সে সেখানে আছে, পরিপ্রেক্ষিত আছে, ভাবপ্রকাশ
আরো মর্মস্পর্শী।
আর জন্ম হোলো
ইটালিয়ান চিত্রকলার রেনেসাঁর। রেনেসাঁ শব্দের অর্থ
পুনর্জন্ম। যদিও আসল রেনেসাঁ কথাটার ব্যবহার এসেছে
অনেক পরে (১৯শ শতাব্দীতে) কিন্তু এই ঘটনার জোয়ারটিকে
তখনই পুনর্জন্ম বলা হোতো। কিসের পুনর্জন্ম? না পুরাকালের,
যাকে বলবেন ক্ল্যাসিক টাইম্স্। ইটালী, বিশেষ করে ফ্লোরেন্সের
সংস্কৃতিমনারা মনে করতেন গ্রীক-রোমক সভ্যতা, যা তাঁদের
মতে সত্য, শিব ও সুন্দর, তার মৃত্যু হয়েছিল বর্বর
গথদের হাতে। তাঁরা ভেবেছিলেন যে সাতশো বছর পরে সেই
সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নবজন্ম নিয়ে ফিরে আসছে
পূর্ণ সমারোহে। মধ্যের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগটি হোলো
মধ্যযুগ, মিড্ল এজেস। আর সেই মধ্যযুগের সংস্কৃতি হোলো
ওই বর্বর ভিজিগথদের সংস্কৃতি, গথিক, -- বার্বারিক।
এই শেষ কথাটার অবশ্য কোনো ভিত্তিই নেই, তবে তা নিয়ে
তর্ক করার জন্য কাকেই বা আর পাচ্ছি হাতের কাছে।
যাই হোক, এই
তো কলির সন্ধ্যে। ওই যে নতুন করে পুরাতনকে দেখার দ্বার
খুলে গেলো, সেই পথ ধরে অনেক অসাধারণ শিল্পী এলেন--
স্থাপত্যে, ভাস্কর্যে, চিত্রকলায়। নানা রকম পরীক্ষা
নিরীক্ষা চলতে লাগলো। স্থপতি ব্রুনেলেশ্কি আবিষ্কার
করলেন পরিপ্রেক্ষিত, পার্স্পেক্টিভের গণিত, লিখে রাখলেন
একটা ছোট চটি বইতে। এর ফলে ছবিতে পশ্চাৎপটের খেলাও
দেখানো গেল। ১৫শ শতাব্দী এসে গেল, পিয়েরো দেল্লা ফ্রান্সেস্কা
আবিষ্কার করলেন আলোছায়ার খেলা, তাতে ঘনত্ব, স্পেস,
দেখানো যায়, প্রকাশ করা যায় অনুভূতি। এতোদিন আঁকা
হতো হয় দেয়ালে (ফ্রেস্কো) নয় কাঠের তক্তায়, টেম্পেরা,
অর্থাৎ ডিমের কুসুমে গোলা রঙ দিয়ে। তার জায়গায় এলো
তেল রঙ, টেম্পেরার মতো অতো চটপট শুকিয়ে যায় না, আর
এলো ক্যানভাস। রেনেসাঁর তরী পাল তুলে দিয়েছে।
ভ্রমণের ধান
ভানতে এসে এতো শিবের গীত কেন? কেন, না এতোক্ষণ যা
লিখলাম, তার বেশীর ভাগেরই শুরু ফ্লোরেন্সে। এবং স্বচক্ষে
তাই দেখে চক্ষু সার্থক করার জন্যই আমার আসা। আরো বড়ো
কথা হচ্ছে যে ফ্লোরেন্সে একটা শিল্পের যাদুঘর আছে
যেটির নাম উফ্ফিৎসি গ্যালারী, যেটিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম
গ্যালারীগুলির অন্যতম বলা হয়, অন্তত এই রেনেসাঁ ও
তৎসংক্রান্ত বিষয়ে। রেনেসাঁর স্থপতি ভাসারি অর্নো
নদীর পাড়ে এই ইউ-আকৃতির প্রাসাদটি তৈরী করেন, প্রথমত
মেদিচি পরিবারের ব্যবসা-সংক্রান্ত খাজাঞ্চিখানা আর
টুসকানি শাসনবিভাগ হিসেবে (অফিস তাই উফ্ফিৎসি), আস্তে
আস্তে সেখানে মেদিচি পরিবারের মহার্ঘ শিল্প সঙ্কলন
রাখা শুরু হয়। ১৬-শ শতাব্দীতেই সীমিত ভাবে আর ১৭৬৫
সালে গ্যালারীটি পুরোপুরি সাধারণ দর্শকদের জন্য খুলে
দেওয়া হয়। ১৩-শ থেকে ১৮-শ শতাব্দীর শিল্পকলার প্রদর্শনী,
তার মধ্যে ১৫শ আর ১৬শ শতাব্দীর ছবিই বেশী। আমি যা
দেখে বেজায় মজা পেলাম, সেটি হোলো এই যে এই গ্যালারীতে
ছবিগুলো (এবং ভাস্কর্যও) শতাব্দীর পর শতাব্দী ভাগ
করে ক্রমান্বয়ে এতো সুন্দর করে সাজানো আছে যে গ্যালারির
এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি হেঁটে গেলে মনে
হবে যেন আপনি, ওই ওপরে যেমনটি লিখেছি, সেই ইতিহাসের
পথে সশরীরে হেঁটে এলেন।

উফ্ফিৎসি
গ্যালারি -- ইউ-আকার, মধ্যের আঙিনা, দুপাশে লম্বা
করিডোর ও সংলগ্ন ছবিঘর।

উফ্ফিৎসি
গ্যালারির দোতলার প্ল্যান -- কোথায় কোন শতাব্দীর শিল্পকলা
রাখা আছে তা দেখানো হয়েছে। লাল তীরচিহ্ন বরাবর হেঁটে
যেতে হয়, তাতে শতাব্দী পরম্পরায় শিল্পের বিবর্তন দেখা
যায়। একতলায় কিছু ছবিঘর আছে কিন্তু আপিস-কাছারীই বেশী।

উফ্ফিৎসি
গ্যালারির প্রশস্ত, আলোকোজ্জ্বল লম্বা করিডোর। ভাস্কর্য
সাজানো আছে, ছাদ ভর্তি ফ্রেস্কো, ডানদিকের দেওয়ালের
টঙে তখনকার ক্ষমতাশালী রাজা-গজা ও পাদ্রীদের প্রতিকৃতি।
ডানদিকে মাঝামাঝি দরজাগুলো ছবিঘরের প্রবেশপথ।
**********************

Sandro
Botticelli-- The Birth of Venus, 1485. Tempera on
Canvas, Uffizi.
এইখানে ক্লিক করলে ছবিটিকে একটু বড়ো করে দেখতে
পাবেন।
উফ্ফিৎসি গ্যালারির
অমূল্য সব ছবির, মাস্টারপিসের, তালিকা দিয়ে ভারাক্রান্ত
করতে চাই না, তবে একটি ছবির কথা একটু খুলে বলি। সেটি
হোলো সান্দ্রো বত্তিচেল্লির "দি বার্থ অফ ভেনাস
"। শুধু চিত্ররূপ হিসেব করে দেখলে এটির থেকে
বহুগুণ উৎকৃষ্ট অনেক ছবি রেনেসাঁতে আঁকা হয়েছে, এমনকি
উফ্ফিৎসিতেই তার বহু নমুনা আছে, কিন্তু রেনেসাঁর ছবি,
যে ভাবরূপকে চিত্রকল্পে বাঁধতে রেনেসাঁর সাধনা তার
বীজমন্ত্র হিসেবে,-- স্পিরিট অফ রেনেসাঁ-- এই ছবিটিকে
গুণীরা রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি বলে সম্মান দেন। পূর্ণযৌবনা
(তাঁর জন্মবৃত্তান্ত, সে আর এক ঘটনা, আপনার মতো সুকুমারমতি
লোকেদের না জানাই ভালো) "কুন্দশভ্র নগ্নকান্তি
সুরেন্দ্রবন্দিতা" ভেনাস সাগর থেকে উঠে ঝিনুকের
নৌকায় সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে পাড়ি দিয়ে সৈকতে পৌঁচেছেন,
তীরে নামতে প্রস্তুত। আমাদের ঊর্বশীও এমনই ভাবে সাগর
থেকে উঠে এসেছিলেন, যদিও তাঁর জন্য সাগর মন্থন করতে
হয়েছিল-- " আদিম বসন্তপ্রাতে উঠেছিলে মন্থি সাগরে
"। বামে দেখা যাছে জেফির ও অরা, দুই পবন দেবতাকে,
তাঁরা সুবাতাস দিয়ে ভেনাসের সমুদ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন
করেছেন। ডাইনে ঋতুর দেবী হোরা এক পুষ্পখচিত আঙরাখা
নিয়ে ভেনাসকে অভ্যর্থনা করছেন। ভেনাস নগ্ন কিন্তু
ব্রীড়াবৃতা। পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, স্বর্ণকেন্দ্রিক গোলাপফুল।
ক্যানভাসের ওপর টেম্পেরা দিয়ে আঁকা ছবির মাপ উচ্চতায়
প্রায় ছ ফিট, প্রস্থে দশ। অ্যাফ্রোদিতি বা ভেনাস গ্রীক-রোমক
পুরাণের দেবী, বত্তিচেল্লির ছবিটি কোনো একটি কবিতার
ওপর ভিত্তি করে আঁকা, এইরকম প্রচলিত। লোরেঞ্জো মেদিচির
ফরমায়েসে ছবিটি তৈরি করা হয়।
এবার ছবিটি নিয়ে
কিছু আলোচনা করা যাক। গ্রীক-রোমক (ইটালীয় রেনেসাঁর
মানুষেরা যে সভ্যতাকে সবার ওপরে স্থান দিতেন) পুরাণ
থেকে বিষয় নিয়ে এতো বড়ো ক্যানভাসের ছবি এই প্রথম;
এর আগে যা ছবি আঁকা হোতো, বড়ো ছবি তো নিশ্চয়ই, তার
সিংহভাগই খ্রীষ্টধর্মীয় বিষয় জড়িয়ে। তার বিপ্রতীপে
এই ছবিটি হোলো ক্ল্যাসিক সভ্যতার এক বৃহৎ স্বীকৃতি।
রেনেসাঁর লোকেরা বিশ্বাস করতেন যে সৌন্দর্যই সত্য
ও সত্যই ঐশ্বরিক-- বিউটি ইজ ট্রুথ এণ্ড ট্রুথ ডিভাইন,
নিওপ্লেটোনিজম-- তাই পুরাণের সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের
অভ্যুত্থান যেন সত্য ও অপার্থিব সৌন্দর্যের পুনরাগমন।
এইটা ছিল রেনেসাঁর শিল্পীদের মন্ত্র, এইটা প্রথম সুচারুরূপে
ফুটিয়ে তুলতে পারলেন বলে বত্তিচেল্লি আর তাঁর এই ছবির
এতো নাম। লোরেঞ্জো মেদিচি স্বয়ং এই ছবির মূল সূত্রটির
সূত্রপাত করেছিলেন, এই মতো কথিত আছে।
গ্রীকদের অ্যাফ্রোদিতি
ছিলেন সৌন্দর্যের ও প্রেমের দেবী, রোমানদের কালে তাঁর
নাম হোলো ভেনাস, আর তাঁর কার্যভার, পোর্টফোলিও বলতে
পারেন, বিস্তৃত করা হোলো সৃষ্টিশীলতার সব প্রেরণা
ও শক্তিতে। দেবীর এই দৈবী ভাবের প্রকাশ করতে বত্তিচেল্লি
অনেক প্রতীকের ব্যবহার করেছেন। পূর্ব দিক থেকে সূর্যের
আলো এসে তাঁকে করেছে উজ্জ্বল শুভ্রা। তাঁর শরীরের
চতুর্দিকে এক সূক্ষ্ম কালো রেখা টেনে মূর্তিটিকে দেওয়া
হয়েছে স্বাতন্র্ত্য ও গরিমা। সোনা হোলো সুন্দর ও দেবরঞ্জক,
তাই গোলাপফুলের কেন্দ্রে, ডানদিকের গাছের পাতায় আর
ফুলে এবং পবনদেব জেফিরের ডানায় সোনালী রঙ। হোরার হাত,
লাল আচ্ছাদন আর দুই পবনদেবের অবস্থান যেন একটি খিলান
তৈরী করেছে, তার কেন্দ্রে স্থাপিতা ভেনাস রয়েছেন ছবির
অন্য কুশীলবদের থেকে দূরে। ওঁদের ধর্মীয় ছবিতে এই
জায়গাটিতে রাখা হোতো মেরী মাতা, ম্যাডোনাকে। সেখানে
ভেনাসকে দাঁড় করিয়ে বত্তিচেল্লি ক্লাসিক ও খ্রিশ্চান
ঈশ্বরচিন্তার মধ্যে যেন এক সেতু রচনা করলেন। ছবিতে
গতির দ্যোতনা প্রচুর ও প্রকট-- বাতাসে, জলের ঢেউতে,
কেশরাজির বিন্যাসে, পুষ্পবৃষ্টিতে। এইটা লক্ষ্যণীয়
যে বত্তিচেল্লি ব্যবহার করেছেন বহমান, সঞ্চরণশীল রেখা
যা ছবিতে এনেছে তরল ও সহজ এক সৌষ্ঠব আর একটু রহস্যের
ছোঁয়া। একটু খেয়াল করলে ভেনাসের চেহারাতেই এটি দেখা
যেতে পারে, মরাল গ্রীবা, বাঁ হাতটি লম্বা, নিজে দীর্ঘদেহী।
প্রসঙ্গত, এই ভেনাসের মডেল ছিলেন সিমোনেত্তা ভেস্পুচি,
সারা ফ্লোরেন্সে সবচেয়ে সুন্দরী বলে তাঁর খ্যাতি ছিল।
বত্তিচেল্লি এই পরস্ত্রীেক ভালোবেসেছিলেন মনে হয়,
সারাজীবন অকৃতদার রয়ে গেলেন, মৃত্যুর পর তাঁরই ইচ্ছামতো
তাঁকে কবর দেওয়া হোলো সিমোনেত্তার পায়ের কাছে।
বত্তিচেল্লি
অনুসৃত এই তারল্যের শৈলী কিন্তু গথিক, এবং রেখার এইমতো
প্রয়োগে রেনেসাঁ শিল্পীদের একটু আপত্তি ছিলো। খেয়াল
করলে ছবিটিতে কিছু অসঙ্গতি দেখা যায়, বিশেষত পরিপ্রেক্ষিত,
পার্স্পেক্টিভের ব্যবহারে। যেমন, সমুদ্রের সব ঢেউয়ের
একই মাপ, ভেনাসের বেশ কিছুটা পেছনে থেকেও জেফির একই
মাপের, অরার দুটি পাও এক মাপের। অরার পাটি যেভাবে
জেফিরকে জড়িয়ে আছে সেভাবে পা রাখা অসম্ভব; এমনিতর।
কেন কে জানে; আমি কোথাও ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না।
আশ্চর্যের কথা যে তাঁর জীবদ্দশাতেই বত্তিচেল্লিকে
খ্যাতির এই শীর্ষ থেকে নেমে আসতে হোলো। অথবা আশ্চর্যের
কিছু নেই, বত্তিচেল্লির দেখানো পথে তারপর মঞ্চে যাঁরা
এলেন, যথা দা ভিঞ্চি বা মাইকেলেঞ্জেলো, তাঁদের প্রতিভার
দীপ্তি সর্বগ্রাসী। এইরকমভাবে বত্তিচেল্লি একদিন হারিয়ে
গেলেন, তাঁর আঁকা ছবি অবহেলিত হয়ে পড়ে রইলো প্রাসাদের
আনাচে কানাচে। ১৯-শ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডের একদল শিল্পী
(প্রি-রাফায়েলাইট বলে খ্যাত) বত্তিচেল্লিকে পুনরাবিষ্কার
করেন। এই বার্থ অফ ভেনাস নিয়ে একটা আশ্চর্য জিনিষ
দেখলাম উফ্ফিৎসিতে -- সেটা হোলো ছবিটির রেজিন দিয়ে
তৈরী একটা বাস-রিলিফ যার ওপর আঙুল বুলিয়ে অন্ধেরাও
বত্তিচেল্লির সৃষ্টি কিছুটা উপভোগ করতে পারেন।

Botticelli--
Birth of Venus in bas-relief, Uffizi -- অন্ধরাও
যাতে বত্তিচেল্লির মহৎ শিল্পকীর্তির স্পর্শ পেতে পারেন।
(চলবে)
ডিসেম্বর
৭, ২০১১