প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পোনুর চিঠি - ফ্লোরেন্সে পোনু () () ()

দাদা:

অনেক তো হোলো আর কেন? আমার মাথায় ধূসর পদার্থের একটু খামতি আছে, আর একটু গতরখেকো বলে সারা জীবন "কম্মের ঢেঁকি", "বুদ্ধির ঢেঁকি"-- এইসব নামে ডেকে এলেন। তারপর এ বছর ফলন ভালো হয়ে যখন বাড়তি ধান ভানার দরকার পড়লো, তখন চাঁদা তুলে স্বর্গে পাঠালেন। আমিও মশাই বুনো ওলের মাপসই বাঘা তেঁতুল, নাহলে এতকাল আপনাদের চরিয়ে খেলাম কী করে। এইবার শুনুন গীত -- সে গীত শিবেরও হতে পারে, বাঁদরেরও হতে পারে। কেঁচো খুঁড়তে যেতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিলো আপনাকে?

স্বর্গ অর্থে ফ্লোরেন্স, রোম, প্যারিস এবং পোড়ার মুখে যাতে এসবের স্বাদ আরো ভালো লাগে তাই মুখ পোড়াবার জন্য বেলগ্রেড ও রুমানিয়া। গতবার আপনাদের মতো ওপরচালাক কয়েকজনের ভাঁওতায় ভুলে কুণ্ডু ইস্পেশালের টিকিট কেটে দেশভ্রমণে গিয়েছিলাম। এবং ছড়িদারের কাছা ধরে ধরে ঘুরেছিলাম। সে দিন নেই রাত নেই, কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে যাতায়াত, যা দেখতে চাই তা না দেখে ছড়িদারের মর্জিমাফিক চলা -- এ যে একেবারেই পোষায়নি, সে সম্বন্ধে আপনি ভালোই জানেন, আপনিই সম্পাদনা করে আমার লেখা সেসব কেচ্ছার কথা ছেপেছেন। এবারে দুটি পণ করে বেরিয়েছিলাম -- এক কুণ্ডু ইস্পেশাল আর নয়। যদি ছড়িদার ধরতেই হয় তবে এমন ধরবো যে সকালে প্রাতঃকৃত্য করার সময় দেবে এবং যাকে চটপট বিদেয় করা যাবে। আর দ্বিতীয়, আমি কী দেখবো আর কী দেখবো না, সে আগে থেকেই ঠিক করে যাবো। আমি আর ওই কবন্ধ মূর্তি বা ভাঙা খিলেনের ধারে কাছে নেই; তারাও এতোদিন আমার দর্শনে না এসে ভালোই আছে আর তাদের অদর্শনে আমারও এমন কিছু অনিদ্রারোগ হচ্ছে না। আপনাদের আশীর্বাদে দুটো না হোক, দেড়খানা সংকল্প রক্ষে হয়েছে। আপনাদের বৌমা লেজুড় হয়ে ঘ্যান ঘ্যান না করলে আরো সিকিখানা মেরে দিতে পারতাম। কিন্তু কী করি, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করতে হবে তো।

প্রথম ছড়িদার আমার শ্বশুরবাড়ীর লোক। তিনি "পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি" বীজমন্ত্র নিয়েছেন। মার্কিনদেশের পুরুষ ড্রাইভারের মতন, ম্যাপ বা জিপিএসতে বিশ্বাস নেই, কম্পাসটি মাথার মধ্যেই, একেবারে মরো মরো হলে পথিককে শুধান, ভাষার ব্যবধানটা কোনো ব্যবধানই নয়, তারপর আবার চলেন নিজের খুশীতে। মনের প্রসারতা, গুল্ফের পেশী আর পেটের খিদে বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা গিয়ে পৌঁছোই গন্তব্যে এটা ঠিক। তার জাজ্বল্য প্রমাণ যে বাড়ী ফিরে নিজের স্টাডিতে বসে এই লেখা লিখছি। তবে ছড়িদার বাক্চতুর, বাসুকী অজগর-সম লাইনের ভেতর থেকে বার করে কী করে চট করে টিকিট পাইয়ে দেন, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। থ্যাঙ্কফুল ফর স্মল ফেভারস, বুঝলেন না।

তা সেই ছড়িদারের ওপর ভরসা করে ইটালী। যাবো ফ্লোরেন্সে, কিন্তু আপ্ত বাক্য, অল রোড্স্ লিড তু রোম, অতএব রোমে উড়ে এসে একটা গাড়ী ভাড়া করে ফ্লোরেন্সে। ফ্লোরেন্স ইটালীর মাঝামাঝি, অর্নো নদীকে ঘিরে, টুস্কানি অঞ্চলের রাজধানী। টুস্কানি অঞ্চলের খাদ্য আর পেয়, দুইয়েরই নামডাক আছে। ফ্লোরেন্সের খ্যাতি মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির ধারক হিসেবে, ইটালীয় রেনেসাঁর জন্ম এই আঁতুড়ে, লালন ও পূর্ণযৌবন প্রাপ্তিও--"হাই রেনেসাঁ'-- এখানেই। সেই গৌরবের চিহ্নে ফ্লোরেন্স আকীর্ণ, তারই নেশায় পর্যটন, টুরিজম, আজকের ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে বড়ো অর্থাগমের পথ। বস্ত্র ব্যবসায়, বিশেষত পশমবস্ত্র আর ইটালীয় ফ্যাশন-- এ দুটিতেও ফ্লোরেন্সের নাম বিশ্বজোড়া। টালি-সাজানো খেত-খামারের মধ্যে দিয়ে পথ, গাছ দুরকমের। একটি বন্ধ ছাতার মতো, সেটি পপলার; আরেকটি খোলা ছাতা, তার নামটি জানা গেলো না।

শহর হিসেবে ফ্লোরেন্সের প্রতিষ্ঠা প্রাক্খ্রিস্ট কালে। তারপর ইতিহাসের "পতন-অভ্যুদয়বন্ধুরপন্থা" বেয়ে নামতে নামতে উঠতে উঠতে ফ্লোরেন্স একদিন খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে েগল। সেই যাত্রাপথে 'ব্ল্যাক ডেথ' প্লেগের সাক্ষাৎ মিলেছে, রাজা-রাজড়ার যুদ্ধ তো নিত্য সাথী, আভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির উৎপাতও লেগে আছে-- কিন্তু এর মধ্যেই নিশ্বাস নেবার সময় যেই পাওয়া গেছে, ফ্লোরেন্সবাসীরা তখনই তাকে ভালো ভালো কাজে লাগিয়েছেন। অনেক অনেক খ্যাতনামাদের মধ্যে যোগ দিয়েছেন দান্তে বা পেত্রার্কের মতো কবি, জোত্তোর মতো চিত্রশিল্পী, ডোনাতেল্লোর মতো ভাস্কর, ব্রুনেল্লেশ্কির মতো স্থপতি। আর এছাড়া যেটি হয়েছে, সেটি হোলো ফ্লোরেন্স চালু করছে নিজেদের স্বর্ণমুদ্রা, যার নাম ফ্লোরিন, এবং সেটি ক্রমে ক্রমে সারা ইয়োরোপের সেকালের "ইউরো" হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফ্লোরেন্স তখন ইয়োরোপের কুবের, ব্যাঙ্কার। এই করতে করতে ১৫-শ শতাব্দী যখন এসে গেলো, তখন ফ্লোরেন্সে ধনকুবের বণিক গোষ্ঠীর গোষ্ঠী শাসন, অলিগার্কি, যদিও গণতন্ত্রের নলচে আড়াল দিয়ে। কিছুদিনের মধ্যে আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়তে আরম্ভ করলেন মেদিচি পরিবার, ইয়োরোপের ধনকুবের বলে তখন তাঁদের খ্যাতি আর ক্ষমতা, দুইই ভারী জোরদার। এই মেদিচিরা প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর সংস্কৃতিমনা ছিলেন, যে যার পছন্দমতো বিষয়ে। তাঁদের আনুকূল্যে ইটালীয় রেনেসাঁর জন্ম হোলো এই ফ্লোরেন্সেই। ১৫শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ক্ষমতার মঞ্চে এলেন এক বিশাল স্বপ্ন আর চিন্তাভাবনার পুরুষ, এই পরিবারেরই লোরেন্জো মেদিচি। তিনি ফ্লোরেন্সের প্রতিপত্তি বাড়ালেন আর তাঁর আনুকূল্য প্রসারিত হোলো চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সাহিত্য আর দর্শন-- সব ক্ষেত্রেই। ফ্লোরেন্সে চাঁদের হাট বসালেন তিনি। শুধু চিত্রকলার কথা ভাবলেই ভের্রচ্চিও, বত্তিচেল্লি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, ঘিরল্যান্দিওর কথা মনে আসবে। লোরেঞ্জো এই পুনর্জন্ম (রেনেসাঁ) শুধু ফ্লোরেন্সেই আটকে রাখলেন না, তাকে ইটালী জুড়ে ছড়িয়ে দিতে সাহায্যও করলেন।

১৫-শ শতাব্দীর শেষদিকে লোরেঞ্জোর মৃতুর পর আবার অরাজকতা, হানাহানি বাইরে ও ভেতরে। তার মধ্যে মেদিচিরা কেউ কেউ কিছু কিছু করলেন, কেউ চেষ্টা করলেন, কেউ বা কিছুই করলেন না, কিন্তু যে আলো লোরেঞ্জো জ্বালিয়ে গেলেন তার শিখা রইলো অনির্বাণ। তবে শেষ মেদিচি, আন্না মারিয়া লুইসা, যা দিয়ে গেলেন সে দানের তুলনা হয় না। তিনি মেদিচি পরিবারের সংগৃহীত সব শিল্পকীর্তি টুস্কান প্রদেশকে দান করে গেলেন এক শর্তে-- এসব যেন টুস্কান ছেড়ে না যায় কখনো। আর সেই দাক্ষিণ্যের অংশমাত্রের স্বাদ পেতেই আমার ফ্লোরেন্সে আসা। এবার তাহলে সেই কথা হোক।

প্রথম দর্শনীয়টা মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড হতেই হবে। অনেকের মতে মাইকেল. . . কী সর্বনাশ, একী করেছেন মশায়, য়্যাঁ? কোথাকার অজ্ঞাতকুলশীল কার এই "মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড দর্শনে" লেখা ছেপে দিয়েছেন? এই যে এইখানে ক্লিক করে দেখুন তাহলেই দেখতে পাবেন। আমি তখনই জানি এইরকম কিছু একটা গোলমাল হবে। আরে মশায়, অ্যাকেডেমিয়াতে ডেভিড দেখতে গেছি, দেখি এক অতি সন্দেহজনক চেহারার লোক, তিনদিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কানে গোছা গোছা চুল, হাবার মতো হাঁ করে ডেভিডের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনে কী বিড়বিড় করছে আর একটা আধ ইঞ্চি পেন্সিল চুষে চুষে একটা জীর্ণ খাতায় কী লিখছে, মুছছে, আবার লিখছে। চেহারা দেখে বাঙালী মনে হোলো, কাছে গিয়ে দুয়েকবার গলা খাঁকারি দিলাম, তা কানের মাথা বোধহয় খেয়ে বসে আছে। সায়েবরা আবার কটমট করে তাকাতে লাগলো তাই চলে এলাম। ও মা সে যে এই সর্বনাশ হচ্ছে তা আমি কী করে জানবো? আর আমি এতো ভেবে চিন্তে ডেভিডকে নিয়ে কতো মজার মজার কথা ভেবে রাখলাম। বেশ তাই হোক, এই আমার বল নিয়ে আমি বাড়ি চললাম, মরুন এখন বাতাবী লেবু লাথিয়ে!

(চলবে)

ডিসেম্বর ৭, ২০১১

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।