প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

হিমাংশু রাই (রায়) (১৮৯২-১৯৪০)*

কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে হিমাংশু রাই শান্তিনিকেতনে কিছুদিন পড়াশুনো করেছিলেন। পরে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পাশ করে লণ্ডনে যান ব্যারিষ্টার হতে। সেখানে ওঁর পরিচয় হয় এক প্রতিভাবান নাট্যকার নিরঞ্জন পালের সঙ্গে। নিরঞ্জন ওঁকে ওঁর কয়েকটি নাটকে অভিনয় করতে বলেন। সেই সময়ে নিরঞ্জন পাল গৌতম বুদ্ধের উপর একটি চিত্রনাট্য লিখছিলেন এডুইন আর্নোল্ডের 'লাইট অফ এশিয়া' পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে। হিমাংশু রাইয়ের সেটি পড়ে ভালো লাগে। রাই কথাবার্তা বলে লোকদের প্রভাবান্বিত কারতে পারতেন। জার্মানীর এমেলকা কোম্পানীকে তিনি রাজি করালেন সেটিকে প্রযোজনা করতে। ১৯২৫ সালে হিমাংশু রাই আর এমেলকার যৌথ-উদ্যোগে লাইট অফ এশিয়া চিত্রায়িত হল। ছবির পরিচালক এমেলকার ফ্রান্জ ওস্টেন (Franz Osten), অন্যতম ক্যামেরাম্যান ছিলেন জোসেফ ওয়ারশাং** (Joseph Wirsching)। গৌতম বুদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হিমাংশু রাই, নবাগতা সীতা দেবী সেজেছিলেন গোপা।

যদিও ভারতবর্ষে ছবিটি তেমন সাড়া জাগাতে পারে নি, ইউরোপে লাইট অফ এশিয়া খুবই জনপ্রিয় হয় । তাতে উত্সাহিত হয়ে হিমাংশু রাই জার্মানীর আরেকটি কোম্পানী ইউ এফ এ-র সহযোগিতায় তাজমহলের কাহিনী নিয়ে (খানিকটা কল্পিত) ১৯২৮ সালে তৈরি করলেন শিরাজ ছবিটি। শিরাজ শুধু বিদেশে নয়, ভারতবর্ষেও সমাদৃত হল। রাইয়ের তৃতীয় ছবি হল পুরনো যুগের রাজারানীদের গল্প নিয়ে থ্রো অফ ডাইস (১৯২৯)। এই ছবির জন্য শুধু জার্মানী থেকে নয় ইংল্যাণ্ডের এক প্রযোজক ব্রুস উলফ-এর কাছ থেকেও তিনি টাকা জোগাড় করলেন। থ্রো অফ ডাইস ছবিটি (অল্প কিছু অংশ ভিডিও-তে দেখতে এইখানে ক্লিক করুন)।

থ্রো অফ ডাইস তৈরি করার সময়ে হিমাংশু রাইয়ের পরিচয় হয় ইংল্যাণ্ড-শিক্ষিতা এক আর্কিটেক্ট, দেবিকা রাণীর সঙ্গে। ছবিটি শেষ হবার আগেই হিমাংশু রাই অপরূপ সুন্দরী দেবিকারানীকে বিয়ে করেন।

ইতিমধ্যে সবাক চিত্র যুগ এসেছে। ছবি করার টেকনিক্যাল বিষয়গুলি আরও কঠিন হয়েছে। অন্য কোনো ছবিতে হাত দেবার আগে হিমাংশু রাই সস্ত্রীক জার্মানীর ইউ.এফ. এ স্টুডিওর বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে ছবি তোলার প্রযুক্তিগত কৌশলগুলি ভালো করে শেখা শুরু করলেন। দেবিকা রানী সে-যুগের নামকরা শিক্ষকদের কাছে অভিনয় করাও শিখে নিলেন। এবার ছবি করার পালা।

হিমাংশু রাইয়ের প্রথম সবাক ছবি কর্ম (১৯৩৩) তোলা হল ইংরেজিতে। মামুলী গল্প। কিন্তু তাও ছবিটি ইংল্যাণ্ডে প্রশংসিত হল দেবিকা রানীর মনোহারিত্ব আর হিমাংশু রাইয়ের পূর্ব-পরিচিতির জোরে। লণ্ডনের ষ্টার পত্রিকায় এক মুগ্ধ সমালোচক দেবিকা রানী সম্পর্কে লিখলেন, এর থেকে ভালো কণ্ঠস্বর বা কথা বলার ধরণ আর কোথাও শুনতে পাবে না, এতো সুন্দর মুখও আর কোথাও দেখতে পাবে না। ("You will never hear a lovelier voice or diction, or see a lovelier face.")।

দেশে ফিরে হিমাংশু রাই আর দেবিকা রানী স্থাপন করলেন তাঁদের স্বপ্ন বোম্বে টকিজ। উদ্দেশ্য সত্যিকারের ভালো হিন্দী ছবি তৈরী করা। টাকা জোগাড় করার ক্ষমতা রাইয়ের ছিল। তাই দিয়ে জার্মানী ও ইংল্যাণ্ড থেকে দামী দামী যন্ত্রপাতি এবং কলাকুশলীদের নিয়ে এলেন। আর্কিটেক্ট স্ত্রী দেবিকা রানীর সাহায্য কাজে লাগলো। তৈরী হল পাশ্চাত্য কায়দায় একটি বিরাট স্টুডিও। একে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে দেশে কলাকুশলী তৈরী করতে হবে। তাই কলাকুশলীদের জন্য ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হল। শিক্ষার উপর হিমাংশু রাই খুব জোর দিতেন। বোম্বে টকিজে চাকরি পেতে হলে সাধারণ শিক্ষা থাকা ছিল একটি প্রয়োজনীয় যোগ্যতা। নিয়মানুবর্তিতার বিষয়ে রাই ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। সাধারণ কলাকুশলীদের কথা বাদ দেওয়া যাক, কর্তব্যে নায়ক-নায়িকার গাফিলতিকেও তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। ভালো গল্প ছাড়া ভালো ছবি হয় না - রাই সেটা বিশ্বাস করতেন। সে-যুগের বহু প্রতিভাবান লেখককে (যেমন মুন্সী প্রেমচাঁদ, ইসমত্ চুগতাই, অমিয় চক্রবর্তী, প্রমুখ) তিনি বোম্বে টকিজে চাকরি দিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তী কালের বিখ্যাত নায়ক, প্রযোজক ও কলাকুশলীদের (যেমন, অশোক কুমার, শশধর মুখার্জি, প্রমুখ) অনেকেরই হাতে খড়ি এই বোম্বে টকিজেই।

দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৯৪০ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে হিমাংশু রাই মারা যান। এই স্বল্প সময়ে তিনি জওয়ানি কি হাওয়া (১৯৩৫), অছ্যুত্ কন্যা (১৯৩৬), জীবন নয়া (১৯৩৬), ইজ্জত্ (১৯৩৭), আজাদ (১৯৪০) ইত্যাদি ছবি করেছিলেন। প্রথম দিকের সবগুলি ছবিতেই পরিচালক ছিলেন ফ্রান্জ ওস্টেন, নায়িকা থাকতেন দেবিকা রানী। পরে অন্যান্য নায়িকাও (যেমন, অধুনাপ্রয়াত লীলা চিটনিজ) বোম্বে টকিজের ছবিতে কাজ করেছেন।

বাংলার নিউ থিয়েটার্স বা পুনার প্রভাত স্টুডিওর মত হিমাংশু রাই-দেবিকা রানী স্থাপিত বোম্বে টকিজ ভারতের ছবির ইতিহাসে চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

_____________
* বাংলা চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে হিমাংশু রাইয়ের কথা বলা একদিক থেকে অসংগত। বাংলা ছবি তিনি কোনদিন করেন নি। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন বাঙালী এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর দান অবিস্মরণীয়। সেই কারণেই এখানে ওঁর কথাও যোগ করা হল।

** ওস্টেন ভারতবর্ষে বেশ কিছুদিন রাইয়ের কোম্পানীতে ছিলেন। জোসেফ ভারতবর্ষেই আজীবন কাটান। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তোলা তাঁর শেষ ছবি হল কমল আমরোহী পরিচালিত মীনাকুমারী অভিনীত পাকিজা।


Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।