বদরীনাথ
১ ২
৩

আমরা মে,
জুলাই-অগাষ্ট আর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বদরীনাথ
গেছি। জুলাই-অগাষ্ট মাস ছাড়া নীলকণ্ঠ পাহাড়
যেন মনে হয় সমগ্র বদরীনাথধাম রক্ষা করছে নারায়ণ
পর্বতের মোটামুটি পিছন দিক থেকে। ভোর বেলা সূর্যোদয়ের
সময়কার অপূর্ব দৃশ্য না দেখলে বদরীনাথ দর্শন
বৃথা জানবেন। নভেম্বর মাসের এক ভোরে নীলকণ্ঠের
প্রায় ১ মিনিট অন্তরে তোলা চারটি ছবি দিলাম
(চিত্র-৮, ৯, ১০ ও ১১)।




সিংহ-দ্বার
দিয়ে ঢুকলে সামনেই মন্দিরে প্রবেশ করার কথা
বলেছি, এই মন্দিরের অবস্থান বেশ বড় এক চত্বরের
মাঝে। প্রধান মন্দির ছাড়াও এই চতুষ্কোণ চত্বরে
আরও কয়েকটা মন্দির রয়েছে। দক্ষিণ দিকে আছে লক্ষ্মীর
মন্দির এবং তার পাশেই বদরীনাথের ভোগ বিতরণ করার
ব্যবস্থা ও রন্ধনশালা। উত্তর দিকে বদরীনাথধামের
রক্ষক ঘণ্টাকর্ণের ছোট মন্দির। এ ছাড়া আরও বেশ
কিছু ছোট ছোট মন্দির আছে এর মধ্যে।
সিংহ-দ্বার দিয়ে বেরিয়েই উত্তর দিকে মন্দিরের
পাশে গোটা কয়েক সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দির সম্পর্কীয়
এক মিউজিয়াম দেখতে যেতে পারেন। এখানে মন্দিরের
কিছু
পুরাণ ভাঙ্গা অংশ রাখা আছে। উল্লেখযোগ্য বিশেষ
কিছু না থাকলেও কৈলাস পর্বতের বিশেষ একটি ছবি
আছে, যা এক খুবই দুর্লভ মুহূর্তের প্রমাণ-চিত্র।
এই ছবিতে কৈলাস পর্বতের সঙ্গে মহাদেবের মুখের
সাদৃশ্য বুঝতে কোনও কল্পনার প্রয়োজন হয় না।
সংযোগ বশত আমার এক সহকর্মীর কাছ থেকে এমনই এক
ছবি পেয়েছিলাম। আপনাদেরও সেই ছবি দেখতে অনুরোধ
করছি (চিত্র-১২)।
অলকনন্দার
পশ্চিম পারে, অর্থাৎ যেদিকে মন্দির আছে, সেখান
থেকে প্রায় ৫০০মি. দক্ষিণে নীলকণ্ঠ (৬৫৯৬মি.)
পর্বতের পাদদেশ থেকে উদ্ভূত ঋষি-গঙ্গার ধারা
অলকনন্দায় এসে মিশেছে। বদরীনাথ মন্দিরের সামনে
দিয়ে অলকনন্দার পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে ‘বামনি’
গ্রামের দিকে পথ চলে যাচ্ছে। এই পথে অল্প কিছুটা
এগোলে পশ্চিম দিকে উঠে যাচ্ছে এক গলি পথ নারায়ণ-পর্বতের
(৫৯৬৫মি.) গা দিয়ে এবং ঋষি-গঙ্গাকে বাঁ দিকে
রেখে। এই পথে প্রায় ৫০০মি. উঠে ডান দিকে এক
শাখা-পথ পাবেন, যা চলে গিয়েছে মন্দিরের পিছনে
সন্ন্যাসীদের সমাধি ক্ষেত্রে (চিত্র-১)। এখান
থেকে সমগ্র বদরীনাথ-ক্ষেত্রের বিহঙ্গম দৃশ্য
অপূর্ব (চিত্র-১৩, ১৪ ও ১৫)।



আপনি অলকনন্দার
অর্ধচন্দ্রাকার গতি-পথ দেখতে পাবেন। নিচে থেকে
এই গতি-পথ দেখা সম্ভব নয়। যদি আপনার সময় ও মন
করে, শাখা-পথ থেকে ফিরে গিয়ে নারায়ণ-পর্বতের
পিছন দিকে এবং নীলকণ্ঠ পর্বতের প্রায় পাদদেশে
পোঁছে যাবার আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। এক বার
নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আমরা বেশ কয়েক জন
মহিলা ও পুরুষ এই পথে হেঁটে ভীষণ আনন্দ ও রোমাঞ্চ
উপভোগ করেছিলাম। ওই সময় সাধারণত এই অঞ্চলে নীলকণ্ঠ
পর্বতে ছাড়া আর কোথাও বরফ দেখা যায় না। কিন্তু
ওই পথ থেকে নর-পর্বতের (৫৮৩১মি.) শীর্ষে হিমবাহের
মতো বরফ দেখেছিলাম (চিত্র-১৬)।

এই পথে
প্রায় ৩কিমি. হাঁটলে পথের ধারে “চরণ-পাদুকা”
দেখতে পাবেন। পাথরের গায়ে মোট তিনটে প্রায় দুই
সেমি. উঁচু অংশ আছে একটু বড় আকারের জুতোর সোল-এর
মতো। এক সংস্থার নোটিস-বোর্ডে লেখা আছে যে তিব্বতের
থোলিং মঠ থেকে বদরীবাথ আসার পথে ভগবান এই পাদুকা
রেখে গেছেন। ভগবানের নাম অনুল্লেখিত তবে ধারনা
যে ইনি নিশ্চয় বিষ্ণু (চিত্র-১৭ ও ১৮)। থোলিং
মঠ থেকে কেন বিষ্ণু আসবেন? তাহলে কি বিষ্ণু
এক্ষেত্রে বুদ্ধ?


বামনি গ্রামের দিকে আপনি যেতে পারেন। অক্টোবর
মাসে এখানে গম, বাঁধা-কপি, ফুল-কপি, কড়াই-শুঁটি
ইত্যাদির চাষ দেখতে পাবেন। এখানেই পাবেন রাস্তার
বাঁ দিকে কিছুটা উঁচুতে এক ঘেরা জায়গা। ঘেরার
মধ্যে অবশ্য সুন্দর কিছু দেখবার নেই, কিন্তু
এক বোর্ডে লেখা আছে যাতে শিব-পার্বতীর কাছ থেকে
বদরীনাথ কেমন করে এই জায়গায় বিশালাপুরির অধিকার
লাভ করেন (চিত্র-১৯)। কিছু আগে কেদারেশ্বর মন্দিরের
কথা বলেছিলাম। বিশালাপুরির অধিকার ছেড়ে দিয়ে
শিব এখানেই এসে বাস করতে থাকেন। এখনও এই অঞ্চল
কেদারখণ্ড নামে পরিচিত। পার্বতীর কি হলো তা
অবশ্য অনুল্লেখিত থেকে গেছে।

আরও এগিয়ে গেলে ঝোলা পুলের উপর দিয়ে নদীর পূর্ব
পারে বদরীনাথ বাস-টার্মিনাসের পিছন দিকে চলে
আসতে পারবেন (চিত্র-২০)।

বদরীনাথ ছাড়িয়ে উত্তর দিকে ২কিমি.-র কিছু বেশি
দূরে ভারত সীমান্তের শেষ জনবসতি, গ্রাম ‘মাণা।’
এই গ্রামের সম্বন্ধে এর আগেই কিছু বলেছি। এই
গ্রামে ঢোকার মুখ পর্যন্ত গাড়িতে আসা যায়। কয়েকটি
বাসও এ পর্যন্ত এসে থাকে। গ্রাম প্রায় ১ কিমি.
দৈর্ঘ্যে এবং অলকনন্দার ধার বরাবর। এখন এখানকার
অধিবাসীদের অবস্থা বেশ ভালই। অনেক বাড়িই পাকা
তবে বেশির ভাগ বাড়ির ছাদ স্লেট পাথরের আর ঢালু,
বরফের ভার বাঁচানোর জন্যে। রাস্তা সরু হলেও
সিমেন্টে গাঁথা পাথরের। শীত কালে এঁরা প্রত্যেকেই
নিচে নেমে যান, সামর্থ্য অনুযায়ী একেবারে শ্রীনগর
পর্যন্ত। কিছু শস্য ও বিশেষ করে আলু উৎপাদন
(চিত্র- ২১, ২২ ও ২৩) ছাড়া উলের পোশাক বুনে
বিক্রি করা এঁদের প্রধান জীবিকা।



গ্রামের
পূর্ব দিকে অল্প দূরে এবং পরস্পর থেকে বেশ দূরে
দুই গুহা, মহাভারতের সৃষ্টিকারী ব্যাসদেবের
আর তাঁর ‘স্টেনোগ্রাফার,’ যিনি ওই গুহায় বসেই
মহাভারতের ‘ডিক্টেশন’ নেন, গণেশের নামে। আমার
মনে হয়েছে তাঁদের মধ্যে নিশ্চয় অধুনা লুপ্ত
বিশেষ কোনও রকমের ‘কমিউনিকেশন শর্টক্টের’ ব্যবস্থা
ছিল। যাই হোক, এখন গুহা দুটির নামানুসারে তাঁদের
মূর্তি স্থাপিত এবং আমার মনে হয়েছে কৃত্রিমতা
দোষে দুষ্ট। ব্যাস গুহার উপরে পাললিক শিলায়
পরস্পর সমান্তরাল স্তর-রেখা আছে। সেই স্তর গুলির
সঙ্গে বই-এর পাতার মিল লক্ষ করেন ভক্তগন।

এই গ্রামের উত্তর প্রান্তে সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর
গর্জনরত এক ঝর্ণা আছে (চিত্র-২৪), সরস্বতী নদী
পূর্ব দিকের পাহাড়ের শিরা বরাবর লাফিয়ে লাফিয়ে
নেমে নিচে অলকনন্দার কোলে শুয়ে পড়ছে। সঙ্গমের
নাম কেশব-প্রয়াগ। ঝর্ণার কিন্তু কোনও নাম নেই,
নাম আছে ঝর্ণার দুই পাশের পাহাড় যোগাযোগের পাথরের
নামে, ‘ভীম-পুল।‘ বলা হয় মহাপ্রস্থানের পথে
পঞ্চ-পাণ্ডবগণ সহজেই এই ঝর্ণা পার করে গেলেন
কিন্তু দ্রৌপদী পারছেন না। তাই ভীম এই পাথর
দিয়ে এই সেতু রচনা করেন স্ত্রীর জন্যে (চিত্র-২৫)।
আমরা অবশ্য সেই মহাভারতীয় পুলের উপর দিয়ে যাতায়াত
করতে পারি না, অল্প নিচের এক কালভার্ট ব্যবহার
করতে হয়। এখান থেকে চারিদিকের দৃশ্য দেখবার
মতো।

পায়ে চলা পাথুরে পথ উত্তর দিকে এগিয়ে গেছে।
১৯৮৮ সালের মে মাসে আমি সস্ত্রীক আমাদের ৫ বছরের
কন্যা আর ৭ বছরের পুত্রকে নিয়ে এখান থেকে আরও
প্রায় ৬কিমি. হেঁটে বিখ্যাত এক ঝর্ণা, ‘বসুধারা’
দেখে এসেছিলাম। পথে দুটি গ্লেসিয়ার পার হতে
হয়েছিল। পূর্ব দিকের এক পাহাড়ের উপর থেকে প্রায়
৫০মি. নিচে জল এক গ্লেসিয়ারের উপর আছড়ে পড়ছে।
স্বাভাবিক নিয়মেই জল পড়ার জায়গায় চাপের আধিক্যের
কারণে গ্লেসিয়ারের বরফ গলে গিয়ে ঘড়ার মুখের
মতো এক গর্তের সৃষ্টি করেছে। সেই ‘ঘড়া’-র মধ্যে
জল পড়ার কারণে সাধারণ ঝর্ণার মতো শব্দ না হয়ে
হচ্ছে ঘড়ায় জল পড়ার মতো শব্দ, শুনতে তা আমাদের
অপার্থিব লেগেছিল। বসুধারার জল গ্লেসিয়ারের
নিচ দিয়ে অলকনন্দায় মিশছে। অলকনন্দার অপর পার
ধরে আরও প্রায় ২০কিমি. এগোলে শতোপন্থ হিমবাহ
ও পরে স্বর্গারোহীণি (৬২৫৪মি.)পর্বতে পৌঁছান
যায়। সে পথ খুবই বন্ধুর আর সাধারণ যাত্রীর জন্য
নয়।
ড.
শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী
(চলবে)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)