সংগীত
জুলাই ৩০, ২০১৬
গানের ভুবন, প্রাণের ভুবন
ঈশানী রায়চৌধুরী
গৌরচন্দ্রিকা
আমার খুব আফশোস। কত কিন্নরকণ্ঠ কিন্নরকন্ঠী মানুষজন দেখি, অথচ
আমি ... গান গাইতে গেলেই হাঁড়িচাঁচা লজ্জা পেয়ে যাবে ! অগত্যা
আমার শুধুই ওই যাকে বলে "চানঘরে গান।" তবে গাইতে অপারগ
বলে তো আর ভালোবাসতে অক্ষমতা নেই ! তাই মনের আনন্দে নির্লজ্জের
মতো গানকে ভালোবেসে এসেছি সেই কোন ভুলে-যাওয়া শিশুকাল থেকে। গান
আমার জন-অরণ্যে, বিজন ঘরের বাতায়নে, আমার চিলেকোঠার গোঁসাঘরে,
সুয্যি-ডোবা গোলাপী জলের ঝিলের পারে, অভিমানে আর আহ্লাদে, অনুরাগে
অথবা অসহায়তায়। গান সপাটে এসে আছড়ে পড়ে কখনো বুকের গভীরে, কখনো
বা টেরও পাই না কোন ক্ষতমুখ থেকে অঝোর রক্তপাত ... ব্যথা লাগে
না, কোনো বোধই তো নেই ব্যথার ... অথচ চোখের কূল ছাপিয়ে দু'টি গাল
ভেসে যায় জলে। আবার আনন্দও আছে। আনন্দের জন্যই আনন্দ, যন্ত্রণাতেও
আনন্দ। কোন অলৌকিক মন্ত্রবলে যে দু:খ আর সুখ এভাবে হাত ধরাধরি
করে চলে ... আজও বুঝলাম না !
আমার মনে হয় জীবন আর গান ... কেমন যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ,
সূচনা বা স্থায়ীতে রহস্যময়তার বাতাবরণ ... না জানি কী আছে এতে
!, অন্তে বা আভোগে নিশ্চয়তা ... মৃত্যু বা সমাপ্তি। আর মধ্যবর্তী
সময়টিকে দু'ভাগে ভাগ করি যদি ... প্রথমভাগে স্থায়ী, যেন নিজেকে
গুছিয়ে নেওয়া। নতুন আলোয় যৌবন এবং অন্তরা, তারপর তাকে এক পরিপূর্ণতা
দেওয়া…মধ্যবয়স এবং সঞ্চারী।
সুর এবং গান হলো রং আর তুলি ... ছবি এঁকে যায় নিস্তব্ধতার অনন্ত
ক্যানভাসে। এই সুরের মূর্ছনা নিখিল ব্রহ্মাণ্ডে সঞ্চারিত করে আত্মা,
মনকে করে সোনালি ডানার দুরন্ত পক্ষিরাজ ঘোড়া, কল্পনাকে নিয়ে যায়
দিগন্ত পেরিয়ে অনেক দূরে…আর জীবনকে নিয়ে যায় অমৃতকুম্ভের সন্ধানে।
গান মানে কি শুধুই সুরে গাঁথা কিছু বর্ণমালা ? আমার মনে হয়, না.
গান হল সুরে গাঁথা শব্দগুলির পরস্পরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নৈ:শব্দ্যের
মধুরিমা। আনন্দ , বিষাদ, অশ্রু, শোক,হাসি ... এই সব ক'টি অনুভবে
প্রাণসঞ্চারী বীজমন্ত্রটি হল সুর বা গান ... যা আমাকে নিয়ে যায়
অনায়াস মসৃণতায়…এক অন্য ভুবনে। তখন এই পৃথিবীর নির্মম বাস্তবকে
দেখি পরিচিত বৃত্তের পরিসীমার বাইরে দাঁড়িয়ে। নির্মেঘ আকাশ, বরফ
ঢাকা পাহাড় ... তাতে পিছলে যাচ্ছে রোদ্দুররেখা, অনেক নীচে নীলনয়না
সুন্দরীর চোখের তারার মতোই টলটলে নীল জলের সরোবর, অরণ্যের সবুজ
অন্ধকার ... নির্জনতা …আমি ... আর আমার প্রাণের ভুবন, আমার গানের
ভুবন।
স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি, ভুলে যাই …আমি সেভাবে গান গাইতেই পারি
না, হয়ত বেসুরে, বেতালে। আমি তখন নদীর স্রোতের মত গানের স্রোত
জড়িয়ে নিই আমার শরীরে, মনে। সেই আমার আবরণ এবং আভরণও বটে, গানের
সমেরা আমার কালো চুলের দীঘল বেণীটিকে সাজায় সোনা রুপোর ফুলে, গানের
বর্ণমালা যেন চন্দনলেখা ... সঙ্গীত আমায় তিলোত্তমা করে তোলে। আমার
আত্মা অবগাহন করে ভোরের শিশিরে, রাত্রির চন্দ্রমালোকে। চুপ করি
বসে থাকি ... স্থির, নিষ্কম্প, উন্মাদিনী।
ধুয়ে মুছে যায় সমস্ত কালিমা এবং ম্লানিমা, আমার চারিদিকে এক জ্যোতির্বলয়
... চিত্তশুদ্ধির। অনেক অনেক দু:খ আর যন্ত্রণা ছাপিয়ে এক অদ্ভুত
শান্তি আর স্থৈর্য আমায় আপ্লুত করে। অনুভব করি, আমি বেঁচে আছি
... এবং কী প্রবলভাবে বেঁচে আছি ! সেই মুহূর্তে আবার জীবনকে নতুন
করে খুব খুব ভালোবেসে ফেলি।
গান আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই
দ্রুত অনিবার্যতায়
এক ছায়া ছায়া হিমেল স্বর্গগঙ্গার দিকে
আমার পায়ের নীচে ধূসর মায়াবী কুয়াশা
আমি রুপোলি ডানায় ভর করে পরী হয়ে উড়ে যাই
মিশে যাই তারাদের ভীড়ে
আমার বুক ভ'রে শুধুই সুগন্ধি সুবাতাস
আমায় ঘিরে লুকোচুরি খেলে দিনান্তের মেঘ ও পাখিরা
আমি আলগোছে ছুঁয়ে থাকি আলো
আর সেই সাথে যত অনুভব
আমার বুকের মধ্যে থিরথির করে কাঁপে ছোট্ট একটা হলুদ-বসন্ত পাখি
আকাশের আয়নায় নিজেকে দেখি আমি
আর প্রতিদিন নতুন করে দাঁড়াই ঠিক এইভাবেই
নিজের সামনে ... নিজেকে খুঁজে নিতে।
আদিপ্রসঙ্গ
গানের ভুবনে পৌঁছবার হদিশ করতে গিয়ে এদিক ওদিক খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। দেখি, পুরোনো ঠিকানা হলো সামবেদ। আর ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত তো এখনো ধোঁয়া ধোঁয়া মায়াবী ওড়নায় মুখ লুকিয়ে, কত নতুন চমকই না লুকিয়ে আছে অন্তরালে ! সেই কবে থেকেই তো নাট্যশাস্ত্রের রূপকার ভরত , অভিনব গুপ্ত, মাতঙ্গ থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, ড: লালমণি মিশ্র, আচার্য বৃহস্পতি, ঠাকুর জয়দেব সিং, এবং ললিত কিশোর সিং ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের নিয়মকানুন, উৎস, সূত্রাবলী ইত্যাদি নানা বিষয়ের হাল হকিকত আমাদের জানিয়েছেন। আর সেও রীতিমত গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং নন্দনতত্ত্বভিত্তিক আলোচনা ! সেই সঙ্গে আছে নানা বাদ্যযন্ত্র, রাগ রাগিণী আর তাদের সৌন্দর্যের অকৃপণ বর্ণনা, যা আমাদের অনায়াসে হাত ধরে পৌঁছে দেয় এক অজানা অচেনা কল্পলোকে। ভাবলে কিন্তু খুব অবাক লাগে, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই যে এত সাহিত্যচর্চা চলছে ; নানা প্রাদেশিক ভাষায় ... প্রায় পর্বতপ্রমাণ বললেও হয়ত অত্যুক্তি হয় না, এতে কিন্তু গানবাজনাকেন্দ্রিক রচনা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তাহলে হয়ত আমাদের মতো পাঠক পাঠিকা, যারা এ নিয়ে আরও জানতে উৎসাহী, তাদের আকন্ঠ তৃষ্ণার কিঞ্চিৎ উপশম হত। তবে এটাও ঠিক, এই ধরনের লেখার বোধগম্যতার মান এমন হওয়া উচিত, যাতে সাধারণ বোধবুদ্ধির মানুষ লেখার সঙ্গে গানের উজানে ভেসে যেতে পারে অনায়াস আনন্দে।
একটা সময় তো এমনটাই ছিল, যে গানবাজনার চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল দুটি জায়গায় ... রাজারাজড়ার দরবারে আর মন্দিরে। শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন রাজা মহারাজা নবাব বাদশারা আর নয়তো নাচ গান দিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্টিবিধান। রাজসভায় ভালো গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়ে থাকলে রাজার ইজ্জত বাড়ত। অবশ্য রাজপরিবারের নারীরাও কেউ কেউ চৌষট্টি কলায় পারঙ্গমা হতেন, তবে বিয়ের পর তাঁরা কতটা তা নিয়ে চর্চা করতেন জানি না ! মুষ্টিমেয় কয়েকজন করতেন অবশ্যই, তবে অন্ত:পুরের অন্তরালেই বাকি জীবন কেটে যেত বেশিরভাগ পটিয়সীর। আর মন্দিরে দেবদেবীর সামনে তদ্গতপ্রাণ শিল্পী মানে তার পার্থিব কামনা বাসনা সব দেবক্ষেত্রে উৎসর্গীকৃত। দুটি জায়গার কোনটিতেই কিন্তু শিল্পীর নিজস্ব গুণগ্রাহী প্রায় থাকতই না। পারিষদেরা রাজাকে বাহবা দেন ... গুণগ্রাহিতার তারিফ করেন, আর ভক্তরা দেবদেবীমাহাত্ম্যে দরবিগলিত নয়নে বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হন। তাই হয়ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই গানবাজনার চর্চা নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কবিরা গান বাঁধতেন, সেই গান গাওয়াও হত, কিন্তু সেখানে সুর ছিল শুধু শব্দের মাধুর্যবাহী মাধ্যম মাত্র।
ইতিহাস প্রমাণ করে দেয় যে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের ঐতিহ্য বহু শতাব্দীর পুরোনো। এটি আসলে বিভিন্ন ধর্মাচরণ, লোকাচার আর সংস্কৃতির এক আশ্চর্য মিশেল আর এতে রয়েছে বিভিন্ন ধারার সুর ও তালের সঙ্গম।
একদিকে যেমন পুরোপুরি শাস্ত্রীয় ধারা, অন্যদিকে এটিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব বৈচিত্র্যেরও মেলবন্ধন ঘটেছে।
বাল্মীকি রামায়ণে সঙ্গীতচর্চার একটি বিশেষ জায়গা আছে। নারদ মুনি নিজে ছিলেন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ, রাবণও তাই। বীণাপাণি দেবী সরস্বতী বিদ্যা ও সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী। গন্ধর্ব সমাজের সব নারীপুরুষের সঙ্গীতের জগতে অবাধ আর সানন্দ বিচরণ। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে নাগরাজ অশ্বতর স্বর শিক্ষা করেছিলেন দেবী সরস্বতীর কাছে।
গুপ্ত যুগেও কালিদাস বিরচিত কাব্যগুলিতে বিভিন্ন ধরনের বীণার উল্লেখ পাওয়া যায় ... যেমন, পরিবাদিনী, বিপঞ্চি। এছাড়াও উল্লেখ পাওয়া যায় মৃদঙ্গ, বাঁশি, আর শঙ্খের। বিভিন্ন বৌদ্ধ আর জৈন পুঁথিপত্রেও সঙ্গীতের উল্লেখ আছে।
নারদের সঙ্গীত মকরন্দ সূত্রাবলী এ বিষয়ে প্রাচীনতম দলিল। এটিতে যে নিয়মরীতির উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে বর্তমান হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের নিয়কানুনের সাদৃশ্য পরিষ্কার। আর দ্বাদশ শতকে জয়দেবের " গীত গোবিন্দম " সম্ভবত অষ্টপদী সঙ্গীতের প্রথম প্রামাণ্য উদাহরণ।
এরপর ত্রয়োদশ শতকে শার্ঙ্গদেব রচনা করেন "সঙ্গীত রত্নাকর"। এতে তুরস্ক টোড়ির যে উল্লেখ আছে, তাতে মনে হয় এই সময় থেকেই ইসলামিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে।
এরপর ভারতবর্ষে শুরু হয় মুসলমান শাসন. প্রথমে সুলতানী আমল, তারপর মুঘল আধিপত্য। ফলে উত্তর ভারতে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির বিনিময় শুরু হয়ে যায়। নতুন শাসকরা অনেকেই গান বাজনার অনুরাগী ছিলেন, ফলে গুণীজনদের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এভাবেই হিন্দু আর মুসলমান সঙ্গীতধারার মেলবন্ধনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খেয়াল ও কাওয়ালী।
সুলতানী আমলে সবচেয়ে বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন আমির খসরু ( ১২৫৩-১৩২৫)। তাঁকেই কখনো কখনো মর্যাদা দেওয়া হয় আধুনিক হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের জনক হিসেবে। পারসী, তুর্কি, আরবী এমনকি ব্রজভাষাতেও তিনি গীত রচনা করেন। ইমন, জীলাফ, সরপদ রাগগুলি তাঁরই সৃষ্টি। কাওয়ালীরও স্রষ্টা আমির খসরু, যাতে পারসী সুর আর ধ্রুপদ আঙ্গিকের লয় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর আমলেই সেতার, তবলার ব্যবহার শুরু হয়।
আমির খসরুকে এক আধবার খেয়ালের জনক বলা হয়েছে বটে, কিন্তু তথ্যপ্রমাণ তা বলে না। বরং মহম্মদ শাহর দরবারে সঙ্গীতশিল্পী সদারঙ্গ সম্বন্ধে যা তথ্য মেলে, তাতে মনে হয় আধুনিক খেয়াল গায়কীর সঙ্গে তাঁর গায়নশৈলীর উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য আছে।
এছাড়া সাধারণ লোকভাষাতেও অনেক গান রচনা করা হয়। উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবে যে নামদু'টি সবার আগে আসে, তা হলো কবীর এবং নানক। এগুলি ভক্তিবাদের অন্তর্গত। এর সঙ্গে একযোগে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে বৈষ্ণব পদাবলী এবং পদকর্তা হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও মীরাবাঈ।
মুঘল শাসন যতই হিন্দু সাম্রাজ্যে জাঁকিয়ে বসে, ততই সঙ্গীতচর্চাও বিশেষভাবে নিজের জায়গা করে নেয়। মুঘল সম্রাট আকবরের আনুকূল্যে তাঁর দরবারের নবরত্নের অন্যতম ব্যক্তিত্ব তানসেন অনেক রাগ রাগিণী সৃষ্টি করেন। কথিত আছে, প্রতিভাবান তানসেন দীপক রাগে গাইলে আগুন জ্বলে উঠত আর মল্লারে আকাশে ঘনিয়ে আসত মেঘ।
গোয়ালিয়র রাজপ্রাসাদে রাজা মানসিংহ তোমর মার্গসঙ্গীতে সংস্কৃত থেকে হিন্দি ভাষার ব্যবহার প্রচলন করতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজেও অনেক সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। মূলত তাঁর আগ্রহে আর আনুকূল্যে রচিত হয় " মানকুতুহল" ... যেটিতে তৎকালীন সঙ্গীতধারাগুলির বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়। এই রাজদরবারেই ধ্রুপদ এক বিশেষ স্থান অর্জন করে এবং পরবর্তী সময়েও গোয়ালিয়র ঘরানার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এই ধ্রুপদ।
মুঘল শাসনের পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট করদ রাজ্যগুলিতে সঙ্গীতচর্চা অব্যাহত থাকে ... যেমন লখনৌ, পাতিয়ালা আর বেনারস। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ঘরানা। বহু সঙ্গীতজ্ঞ পরিবার এই সব রাজা ও নবাবদের আনুকূল্যে বিপুল জায়গাজমি লাভ করেন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে সঙ্গীতচর্চায় মন দেন। এর সঙ্গে ভক্তি আর সুফি ঐতিহ্যও চলতে থাকে সমান তালে।
এরপর আসে হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের নবজাগরণ। ১৮৫৭ সালের পর লখনৌ থেকে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় এলে লখনৌ ঘরানাতে মেশে বাংলার সঙ্গীতশৈলী। সৃষ্টি হল রাগপ্রধান গান।
এরপর গানবাজনার আকাশে উদিত হলেন দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ... বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকর এবং বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে . . এঁরা দুজনেই স্বাধীনভাবে নিজেদের মতো করে হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতকে ছড়িয়ে দিলেন আমজনতার মাঝখানে ... বিশেষ করে মারাঠি মধ্যবিত্ত সমাজে। শুরু হলো মার্গ সঙ্গীত সম্মেলন, সঙ্গীত শিক্ষার বিদ্যালয়, সাধারণ পাঠক্রমে এল সঙ্গীত চর্চা, সঙ্গীত শিক্ষানবিশদের জন্য নানা পাঠক্রম ও পরীক্ষার সুযোগ এবং ঠিকঠাক স্বরলিপির প্রচলন।
পালুসকর মাত্র বারো বছর বয়সে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি, কিন্তু অন্ধত্ব তাঁর সঙ্গীতচর্চার অন্তরায় হয়ে উঠল না ! তিনি লিখলেন বই, আর লাহোরে ১৯০১ সালে স্থাপন করলেন গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়। এই প্রথম ঘরানা পরিবারভিত্তিক কূপমণ্ডুকতা ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাইরে, দূরে।
ভাতখন্ডে নিয়মিত খবরাখবর রাখতেন নানা ঘরানার. হিন্দুস্তানি আর কর্ণাটকী ... দুইয়েরই। ১৯০৯ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি রচনা করলেন চারটি বৃহদাকার খণ্ডে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত পদ্ধতি। নিয়ে এলেন ঠাট, রাগ রাগিণী সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আর তত্ত্ব। তবে এত বিশাল কাজ তো, কিছু দ্বন্দ্ব আর সংশয়ের জায়গাও তাই যথারীতি রয়েই গিয়েছিল।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হল ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের সেই ধারা, যেটির প্রথম সূচনা দেখা যায় খ্রীষ্টপূর্ব ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে উত্তর ভারতে। যে কথাটি প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম, ওই যে সামবেদেই ( সাম অর্থাৎ সুর বা সঙ্গীত আর বেদ অর্থাৎ জ্ঞান ) সামবেদের গানগুলি সাধারণত বিভিন্ন দেবদেবীর সামনে বন্দনাগান হিসেবে গাওয়া হত।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মূলত তাই পূজা বা ধ্যান। এগুলি রাগাশ্রয়ী, তালাশ্রয়ী এবং প্রতিটি মানবদেহের কুন্ডলিনী জাগ্রত করার জন্য বিভিন্ন চক্র বা আবেগকে প্রভাবিত করে। এই শক্তিকেন্দ্রগুলি সক্রিয় করে যে নাদটি উৎসারিত হয়, তা হলো " ওম ", এবং এই "ওম "ই হল শব্দ এবং সঙ্গীতের বীজমন্ত্র।
যেকোনো শিল্পীর কাছে তার সৃষ্টি হল সাধনার ধন। কঠোর নিয়মরীতি, অনুশীলন আর নিবেদন ... এই তিনের সমাহারে উদ্ভূত। সুতরাং সফল সৃষ্টির আনন্দে মিশে থাকে সম্পূর্ণ আর সুখকর সমন্বয়সাধনের অপার তৃপ্তিও। শিল্পী তো আসলে তপস্বী , আর শিল্পের সাধনা তো ঈশ্বরেরই উপাসনা। কেউ সেই পূজা করেন বিদ্যাচর্চার মধ্যে দিয়ে, কেউ গান গেয়ে, কেউ বা তারযন্ত্রের ঝঙ্কারে আবার কেউ বা ক্যানভাসে রং ভরিয়ে।
নাট্যশাস্ত্রের নিরিখে আমাদের মনের মূল স্থায়ী ভাবগুলি হলো রতি, হাস্য, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, বিস্ময় আর জুগুপ্সা। আর এই স্থায়ী ভাব যখন বিভাব বা কোনো বাইরের উদ্দীপক দ্বারা উজ্জীবিত হয়, তখন তা এক আশ্চর্য মানসিক অনুভবের স্তরে নিয়ে যায় আমাদের সৃজনশীলতাকে। তখন শিল্পীর সৃষ্টি আর ভাব-অভিব্যক্তির প্রাণকেন্দ্রে থাকে রসানুভূতি। আর সেই যে নন্দনতত্ত্ব, তার মূলেই আছেই এই "রস", বা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে নবরস ... এগুলি হলো শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত এবং শান্ত।
ভারতীয় সঙ্গীত প্রধানত অনুশীলন এবং গুরু- নির্ভর। বিংশ শতক পর্যন্ত তো স্বরলিপিরও তেমন প্রচলন ছিল না। গুরু-শিষ্য পরম্পরার ওপর ভিত্তি করেই সঙ্গীত শিক্ষা চলত। হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের আর একটি খুব বিশিষ্ট দিক হল ঘরানা, অর্থাৎ সঙ্গীতের বিশেষ ও নিজস্ব রীতি আর স্বতন্ত্রতা। একটি ঘরানার সঙ্গে অন্য ঘরানার পার্থক্য সহজেই বুঝতেও পারা যায়।
ঘরানা প্রকৃত অর্থে সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট এবং নির্দিষ্ট চিন্তাধারা। প্রতিটি ঘরানা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর উপস্থাপনায় উজ্জ্বল।
রীতিবৈচিত্র্য
সঙ্গীতে সাতটি মূল বা প্রাথমিক স্বর হল সা, রে, গা, মা, পা, ধা এবং নি। এর প্রতিটিরই উৎস হিসেবে আছে কোনো না কোনো পশু বা পাখি। প্রতিটি স্বর আমাদের শরীরের সাতটি চক্রের কোনো না কোনটির সঙ্গে জড়িত। স্বর যেভাবে সপ্তকে ওঠে, সেভাবেই চক্রের হিসেবে তা শরীরের নীচ থেকে ওপরে ওঠে। কোমল স্বরগুলি প্রতিটি চক্রের বাম দিকের সঙ্গে জড়িত ... ইড়া ... অর্থাৎ আবেগ ও স্বজ্ঞা। শুদ্ধ আর তীব্র স্বর যুক্ত ডানদিকের সঙ্গে ... অর্থাৎ পিঙ্গলা। এভাবেই রাগ রাগিণীগুলিতে যেভাবে সুরের ও স্বরের বিন্যাস ঘটে, তাতে তারা কোনো না কোনো চক্রের ওপর সেইভাবেই প্রভাব ফেলে।
স্বর |
সংস্কৃত |
বিস্তৃতি |
অর্থ (পশু/পাখি ) |
চক্র |
দেবতা |
সা |
ষড়জ |
সাগর |
ময়ূর |
মূলাধার |
গণপতি |
রে |
ঋষভ |
অপরাজিত |
চাতক |
স্বাধিষ্ঠান |
অগ্নি |
গা |
গান্ধার |
গগন |
ছাগ |
মণিপুর |
রুদ্র |
মা |
মধ্যম |
মধ্যম |
কপোত |
অনাহত |
বিষ্ণু |
পা |
পঞ্চম |
পঞ্চম |
পিক |
বিশুদ্ধ |
নারদ |
ধা |
ধৈবত |
ধরিত্রী |
অশ্ব |
আজ্ঞা |
সদাশিব |
নি |
নিষাদম |
ব্যাধ |
হস্তী |
সহস্রার |
সূর্য |
(চলবে)
লেখক পরিচিতি - বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু
প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত ।
বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য অকাদেমি, ন্যাশনাল
বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি
নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালোবাসেন টুকরো
গদ্য, পদ্য লিখতে । নানা স্বাদের লেখা নিয়ে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে
ওঁর আরেকটি বই 'ম্যাজিক লণ্ঠন। এ বছর প্রকাশিত হচ্ছে আরও তিনটি
বই।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।