আলোর সাগর

আলোর সাগর

জীবনের এত বড় সফরে কিছু কিছু মুহূর্ত আলোর ঝরনার মতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সেই আলো বুকে ধরে বয়স এগোতে থাকে। সঙ্গে জন্ম নেয় এক প্রবল বোধ। বিশ্বাস করতে শুরু করি, হয়তো সত্যিই আলোর দেশ আছে। যেখানে শ্বেত শুভ্র আলো চরাচর জুড়ে থাকে। রাত নামে না কখনো।

গিরিরাজ

প্রায় ছয় বছর আগে এমন এক ঝরনা নয় আলোর সাগরে মন ডুবেছিল। আজও ভাবলে মনে হয় আমি সদ্যস্নাত এক মানুষ। এখন আমার চোখে পরপার আর এপারের কোন বিভেদ নেই।

২০১৬ সালে মোট চৌদ্দজন আমরা চলেছি হিমালয়ের চারধামের তীর্থ যাত্রায়। আমিই একমাত্র সদস্য যার বয়স চল্লিশ পেরোয়নি। বেশিরভাগ সহযাত্রীর বয়স সত্তর বা তার বেশি। এরমধ্যে উজ্জ্বলতম যিনি, তিনি হলেন ক্রান্তদর্শী গুরুজি মহারাজ। বিহঙ্গম যোগী। আর একজন দুঃখিনী মা। কিছু বছর আগে একটি পথ দুর্ঘটনায় তিনি স্বামী ও ডাক্তার সন্তানকে হারিয়েছেন। শীর্ণকায়া স্বল্পবাক এক মহিলা। আমি গুরুজির আদেশে তাঁকে ‘দীপ্তি মা’ বলে ডাকি। দীপ্তি মায়ের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই পরমেশ্বর ওঁর চোখের তারায় দীপ্তি জাগিয়ে রাখেন বারো মাস। ওঁর আশেপাশে থাকলে আমি খুব শান্তি পেতাম।

ছোটো চারধাম যাত্রায় একে একে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, শ্রী কেদারনাথ দর্শন করে আমরা পৌঁছেছি বদ্রীনাথে। সন্ধ্যার খানিক আগে পৌঁছে বিস্তর দৌড়োদৌড়ি করে সবার থাকবার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল। থাকবার ব্যবস্থা চলনসই। আশ্রমের একতলা ও দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলো থাকবার ঘর। সরকারি আবাসনের মতো ঘরের সামনে টানা বারান্দা। ঘরের লাল মেঝে এখানে ওখানে ফেটে গিয়েছে। আর সেই সব অংশ থেকে আলপনার মতো সরু সরু দাগ ফুটে উঠেছে। সাদা দেওয়ালের কোনায় ঝুল জমেছে। এক কথায় অতীব সাধারণ থাকবার ব্যবস্থা। তবে আশ্রমের প্রতিটা ঘরের দরজা খুলে দিলেই অলকানন্দার ওপারে বদ্রী মন্দিরের খানিকটা দৃশ্যমান হয়। শুধুমাত্র এই একটি কারণেই আশ্রমটিকে বড় ভালো লেগে গেল। মে মাসের শেষাশেষি। ঠাণ্ডা অসহনীয় নয়। তাই ঘরের আলো নিভিয়ে রেখে দরজা খুলে রেখেই মন্দির ঘিরে থাকা প্রাণের চঞ্চলতা দুই চোখ ভরে দেখা যায়। প্রবল শীতে কষ্ট পেতে হয় না। ঘর বাটোয়ারার পর ভেবেছিলাম সবাই ক্লান্ত হয়ে এই সন্ধ্যায় আশ্রমের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করবে না। খানিক পরেই আমার ভুল ভাঙল। পথের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়েছেন যাত্রীরা ঠিকই কিন্তু এত কাছে এসে ভগবান বিষ্ণুর সন্দর্শনের জন্য সবাই উতলা। ভক্তের ভক্তি দমিয়ে রাখার ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বরের নেই। ঠিক হল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সবাই যাবেন মন্দির দর্শনে। দল বেঁধে। আমার ইচ্ছে অবশ্য অন্য রকম। আমি গুরুজির থেকে অনুমতি চাই। অনুরোধ করি, “একবার একা একা চারদিক হেঁটে আসতে চাই। যাব?” উনি বলেন, “যাও, কিন্তু রাত আটটার মধ্যে ফিরে এসো!” ওঁকে প্রণাম করে ‘জয় বদ্রী’ বলে পথে পা রাখলাম।

এ আমার বহুদিনের চেনা পথ। এই গলি সেই গলি ধরে ঘুরে বেড়াই। দোকানগুলোর সামনে সারা ভারতের পর্যটক ও তীর্থলোভীদের দরদাম করা দেখি। পুরোনো দিন, পুরোনো সাথিদের কথা মনে পড়ে। প্রথমবার যেখানে রাত কাটিয়েছিলাম, সেই ফেলে আসা ধৌলি গঙ্গা আর অলকানন্দার বিষ্ণু প্রয়াগ দেখার ভীষণ সাধ হয়। আমার প্রথম দেখা বদ্রীনাথ আর একশ’ কুড়ি বছর আগে শ্রী জলধর সেনের লেখা ‘হিমালয়’ বইয়ে উল্লিখিত বৈকুণ্ঠ কতটা বদলেছে জানতে বড় লোভ হয়। সেকালের বদরিকা আশ্রম প্রতিদিন শহরে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে একশ বছর পর ভবিষ্যতের ভক্তরা শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্মে কি একই ভাবে সমর্পিত থাকবেন? অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

এই ভাবে একা একা ঘুরতে আমার বেশ লাগে। কেউ আমায় চেনে না। আমার উপস্থিতির কোন মূল্য নেই। হাজার মানুষের ভিড়েও আমি অদৃশ্য। যারা আমার বেঁধে রাখতে চায় তারাও কেউ এখানে নেই। এমনভাবে শরীর নিয়েও অশরীরী হওয়ার যে আনন্দ তা বোঝাই কেমন করে? মন্দিরের চুড়ো ছাড়িয়ে আমার দৃষ্টি চলে যায় নর আর নারায়ণ পর্বতের দিকে। আঁধার জমা সেই পাহাড়ের মাথা আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। মনের ক্যামেরায় এই বিস্তৃত হিমালয়ের ছবি ধরা আছে। আর্কাইভ করে রেখেছি যে! সময় এলে স্মৃতির কুলুঙ্গি থেকে শুধু বের করে আনলেই হল। দেহের স্থূল চোখের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রিয় তো অপার। সে বিশাল। সময়ের ভগ্নাংশে সম্পূর্ণ সৃষ্টিকে হেলায় সামনে এনে হাজির করতে পারে। মনে মনে প্রার্থনা করি, ‘আমার সেই অনুভুতি এনে দাও হে বদ্রী বিশাল!’

কীভাবে যে সময় হু হু করে কেটেছে জানি না। ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। রাত পৌনে আটটা। সর্বনাশ!! ছুটতে ছুটতে ফিরে আসি আশ্রমে। আমরা ছাড়া অন্য বোর্ডার বিশেষ কেউ ছিল না। দূর থেকে সব ঘরই অন্ধকার দেখে স্বস্তি পাই। তবে একটু ভুল বলা হল। দীপ্তি মা’র ঘরে আলো জ্বলছে। একটু অবাক হই। উনি কি তবে একাই ফিরে এলেন? শরীর সুস্থ তো?  সন্তর্পনে ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখি মা চুপ করে শুয়ে আছেন। মন কু’ডাক দেয়। শরীর খারাপ হল নাকি? আলতো করে জিজ্ঞাসা করি, “মা তুমি মন্দির দর্শনে যাওনি?”

আমি এসেছি বুঝে দীপ্তি মা উঠে বসেন। মুখে স্মিত হাসির রেখা। আমাকে অভয় দিয়ে শাড়ি ঠিক করতে করতে বলেন, “শরীর ঠিক আছে। আসলে ওরা বলল, আমি তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারব না। সবার দেরি হবে। তাই থেকে গেলাম।”

আশ্চর্য! ব্রজেশ্বর কাকু ও তাঁর স্ত্রীকে বারবার বলেছিলাম দীপ্তি মাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কী করে এমন কথা বলতে পারলেন ওঁরা!

মা তো! আমার শরীরী ভাষার ছোট্ট পরিবর্তন ওঁর চোখে ধরা পড়ে। আমাকে আশ্বস্ত করবার জন্য বলেন, “সম্রাট, ভগবানের ওপর সবার সমান অধিকার। ওরা নিজেরাই হাঁটতে চলতে পারেন না ঠিক মতো। কী করে আমার দায়িত্ব নেবেন? খামোখা ওদের ভুল বুঝো না। আমি এখান থেকেই মন্দিরের চুড়ো দেখেছি। চার দেওয়ালের মধ্যে রাখা বিগ্রহে আমার প্রণাম পৌঁছে দিয়েছি। ভক্তি মার্গের কথা তুমি শোননি, এমনটি তো নয়। তাহলে?”

দীপ্তি মায়ের কথা শুনে লজ্জা পাই। ক্ষমাশীল না হলে তীর্থযাত্রা অর্থহীন হয়ে পড়ে। মানুষ পাথর কেটে বিগ্রহ তৈরি করে। বিমূর্ত ঈশ্বরের পার্থিব রূপকে এরপর নিজের প্রেম আর ভক্তির রসে সিঞ্চিত করে প্রাণ দান করতে হয়। সেই পাথরের মূর্তির বরাভয়ে হাজার বছর ধরে মানুষ সব পার্থিব সুখের নিশ্চয়তা খুঁজে পায়। ধীরে ধীরে পাপী হয়ে ওঠে পুণ্যবান। লোভী, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করে ফকির হয়। কামার্ত, শরীরের স্থূল উপস্থিতি বুঝতে পেরে সূক্ষ্ম দেহে বিবর্তিত হতে চায়। নিরাকারের সাধনা শুরু হয় আকারের সামনে আসন পেতে।

“কী ভাবছো?”

নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, “না, সেরকম কিছু না। আমি বলি কী…”

“তোমার সঙ্গে যেতে বলবে?”

“হ্যাঁ…কিন্তু না বলবে না!”

মা বলেন,  “ঠিক আছে। যাব তোমার সঙ্গে। তবে তুমি তো জানোই যে আমার দুই পায়ে স্টিলের রড বসানো। খুব ধীরে চলতে হয়। এই ঠান্ডায় আমার সঙ্গে এতটা সময় ধরে পথ চলতে হলে কষ্ট হবে তোমার!”

মায়ের স্নেহ একই বলে। পুণ্য পড়ে থাক। বাৎসল্য রসে ভেজা মনকে বশে আনবার তাগিদটুকু নেই দীপ্তি মা’র। কিছু মুহূর্তের জন্য দুজনেই চুপ করে যাই। ঘরের ভিতর তখন নিশ্ছিদ্র মৌনতা। অন্তরে প্রশ্ন জাগে? এই চুপ থাকা কি সত্যিই মৌনতা? ওই নাতিদূরের নীলকন্ঠ শৃঙ্গের বরফচুড়োও কি মৌন? বরফ ধ্বসের সময় সেই মৌনতা যায় কোথায়? সহনশীল হতে পারা মানেই যে মৌনতা নয়। সসীম জগতে যে প্রাণ আনন্দে বা দুঃখে, প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে, সৃষ্টি বা ধ্বংসে অংশগ্রহণ করে, সে মৌন থাকতে পারে না। মৃত্যুই একমাত্র চিরস্থায়ী মৌনতা। কিন্তু মৃত্যু যে ধ্বংস নয়। এ হল মিলিয়ে যাওয়ার, নিজেকে হারিয়ে ফেলার শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজাল।

শান্ত, গম্ভীর!

এই যে আমি নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় এতদিন ধরে চুপ করে একা হেঁটে চলেছি, আমাকে ঘিরে থাকা চতুর্দিক সেও তো মৌন নয়। হিমালয়ের পথে চোখে পড়েছে ক্রেস্টেড বুলবুলির সতর্ক ঘাড় ঘোরানো, লাল-কালো স্কারলেট মিনিভেটের ইতস্তত ওড়াওড়ি। রাস্তার এক পাশের পাথরের দেওয়াল ধরে ইয়েলো অরেঞ্জ টিপ প্রজাপতি দলের উড়নচণ্ডী খ্যাপামো। হিমালয় সেও তো কত ব্যস্ত।

নিজের শহরে দেখেছি অন্য ধরনের মৌনতা নিয়ে ভুল ভাবনা। শহরের মানুষ মস্ত বড় ফ্লাই-ওভার থেকে উড়ান ভরতে চায়। সেই উড়ান স্বাচ্ছন্দ্যের অভিমুখে। সুখের সব উপকরণ কুক্ষিগত করবার জন্যে। তাই এই সব পাহাড়ের নির্জন গ্রামে অথবা তীর্থস্থানে ওরা শুধু দেখে অলস জীবন, সময়ের সঙ্গে তাল না মিলিয়ে চলা মানুষের সংসার। পাহাড়ি জীবন এদের কাছে মৌনতা হিসেবে ধরা দেয়। ভিতরে ডুব দেওয়ার ইচ্ছে বা সামর্থ থাকলে বুঝতে পারত এখানেও পাওয়া এবং না পাওয়ার সংঘাত একই ভাবে সশব্দে হাজির থাকে সকাল থেকে পরের ভোর পর্যন্ত। নগরের ব্যস্ততায়, শব্দের হট্টগোলে এরা পাহাড়ি গ্রামগুলোর আপাত চুপ থাকাকে মৌনতা বলে ভুল করে। আচ্ছা, আমাদের দুই প্রাণের এই সাময়িক শব্দ বিরতি কি আদৌ মৌনতা? বোধহয় নয়। অনুচ্চারিত আলাপচারিতা চলছে আমার আর দীপ্তি মা’র মধ্যে।

“যাও। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও!”

ভাবনার গোপন স্তর থেকে বেরিয়ে এসে বলি, “না, তা হয় না। হতে পারে না। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমি আর আপনি দুজনে মিলে আজ বদ্রীনাথের দর্শন করব। আমার ক্লান্তি নেই। হিমালয় আমায় অফুরান শক্তি দেয়। সেই সঞ্চয়ের ওপর ভরসা করেই তো শহরে আমার দিন কাটে!”

হতে পারে আমার বলবার ধরনে ছিল জেদ। ভালোবাসার জেদ। জড়িয়ে ধরবার আকুলতা। মা আমার চোখের দিকে চোখ রেখে শান্ত স্বরে বলেন, “বেশ। তবে তাই হোক। বুড়িকে নিয়ে সময় নষ্ট যখন করবেই…”

কথা শেষ করতে না দিয়ে বলি, “এমন ভাবে সময় নষ্ট যেন সারাটা জীবন করতে পারি!”

দীপ্তি মায়ের মুখে এবার চওড়া হাসি ফুটে ওঠে। ওঁর মনের শেষ সন্দেহ দূর হয়। আমি শুধুমাত্র কর্তব্যবোধ থেকে অথবা করুণা দেখিয়ে ওঁকে সঙ্গে নিয়ে চলতে রাজি হয়েছি এমনটি যে নয় এবার উনি বেশ বুঝতে পেরেছেন।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমরা হাঁটা লাগাই বদ্রীনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। অতি ধীরে পার করি বিশাল তোরণ দ্বার। সামনের বিস্তীর্ণ সমতল প্রান্তর তখন ভরে রয়েছে দূরপাল্লার বাস, আধুনিক মডেলের দামি গাড়িতে। কত আতিশয্য, কত বিলাস। এখান থেকে চোখে পড়ছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এটিএম। উজ্জ্বল গ্লোসাইন বোর্ড মনে করিয়ে দিচ্ছে অর্থ আগে পরে ধর্মাচরণ। ভুল নেই অবশ্য। লঙ্গরখানা, কুঠিয়া এসব একবিংশ শতাব্দীতে অতীত। এখন পর্যটন শিল্পে সবার মন মজেছে। তীর্থযাত্রা সেকেলে ব্যাপার। বিনে পয়সার খাবার, কোনক্রমে জুটে যাওয়া রাতের আশ্রয় ভিখিরিদের জন্য। তাতে ট্যুরিস্টদের মান যায়। ঈশ্বরের কৃপা প্রত্যাশীদের লম্বা লাইনে অর্থের শাসন স্পষ্ট। যার যত আর্থিক জোর সে তত সহজে পৌঁছতে পারে গর্ভগৃহে। অথচ প্রান্তিক ভারতবর্ষের দেহাতি মানুষগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে শুধুমাত্র একটি বার বদ্রীনাথের দর্শন অভিলাষে। দুই হাতে পূজার উপাচার সাজিয়ে তাদের অপেক্ষা চলতে থাকে। চলতেই থাকে। তবুও এরা শ্রান্ত হয় না। বিরামহীন প্রান্তিক ভক্তর দল ভক্তির শক্তিতে নিজেকে উজ্জীবিত করে অবলীলায়। এই হল ভারতবর্ষ। যার বুকে ধর্ম ভাব প্রবল। ওটুকু কেড়ে নিলে অখণ্ড দেশের মানচিত্র খণ্ডিত হবে। ধর্মব্যবসায়ীরা এইসব সরলমতি মানুষগুলোকে দোহন করে বড়লোকের দলে নাম লিখিয়েছে। মাঝখান থেকে দোষ পড়ে সেই মহান সৃষ্টিকর্তার।

“সম্রাট, এর আগে কতবার এই মন্দিরে এসেছ তুমি?”

এবার আমার অস্বস্তি শুরু হয়। কী বলি? তবে সত্যের অপলাপ করা সম্ভব নয়। বিনীত স্বরে বলি, “মা, বদ্রীনাথে এসেছি বেশ ক’বার। সবই বিভিন্ন রুটে ট্রেকিং করবার জন্য। তবে একবারও মন্দিরের ভিতরে ঢুকিনি!”

দীপ্তি মা অবাক হয়ে জানতে চায়, “কেন? মন্দিরে যাওনি কেন? ভগবানে বিশ্বাস নেই বুঝি!”

“যাকে জানি, যাকে বুঝি, যাকে দেখতে পাই তাকে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে আটকে রাখিনি দীপ্তি মা। আয়নার সামনে দাঁড়ালে যখন নিজেকে দেখি, তখনই ঈশ্বর দর্শন হয়ে যায়। আমি-আপনি জগতের সব আমরা একই শুদ্ধ আত্মার বিভিন্ন প্রকাশ, সে আমায় মহান হিমালয় শিখিয়েছে। মূর্তি দেখে কী হবে মা? যিনি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, তাকে অবরুদ্ধ দেখতে মন চায় না। ওই মূর্তি কথা বলে না। নড়েও না চড়েও না। তার বদলে সতপন্থের হিমবাহ, চন্দ্রকুন্ড, সূর্যকুন্ড, সরস্বতী নদী, মা অলকানন্দা ভগবান বিষ্ণুর নামগান ছড়িয়ে দিয়ে চলেছে সেই আদি থেকে। যখন হিমালয় সৃষ্টি হয়নি তখনো এই মায়ার পৃথিবী স্বয়ং ঈশ্বরের নামগান করত। আজও সে করছে। শীত এলে মানুষের তৈরি মন্দিরে বছরের ছয় মাস মানুষ নিজেই থাকতে পারে না। অসহায় যে প্রাণী সে কি করে অত বড় ঈশ্বর ধারণাকে ধারণ করতে শেখাবে আমায়? আমি মূর্খ। জানি না কী ভুল বললাম। তবে যা বললাম উপলব্ধি থেকে বললাম।”

দীপ্তি মা উত্তর দেন না। শুধু ডান হাত বাড়িয়ে দেন। আমি আমার বাঁ হাতের মুঠোয় তা ধরে নিই। আমরা এতক্ষণে লোহার ব্রিজ পার করে মন্দিরের সিঁড়ির সামনে পৌঁছেছি। এখন ভিড় সামান্য পাতলা হয়ে এসেছে। মন্দিরের দরজা বন্ধ হতে আর বেশি দেরি নেই। আমি বলি, “চলুন, এক এক করে সিঁড়ির ধাপ শেষ করি। আমার হাতে চাপ দিয়ে উঠতে থাকুন!”

দীপ্তি মা বলেন, “একবার তুমি একবার আপনি বল। তুমি আমায় আপনি না বলে তুমি কেন বলো না?”

“আপনকে যে আপনি বলতে হয়, মা।”

দীপ্তি মা হেসে বলেন, “তোমার সঙ্গে কথায় জিততে পারব না। আমার ইচ্ছেটুকু বললাম। এবার তুমি ঠিক করো।”

“আচ্ছা মা – তুমিই বলব’! আর ভুল হবে না!”

আমরা অলকানন্দার মতোই আনন্দে উচ্ছল হতে হতে এক-দুই-তিন গুনতে গুনতে মন্দির চত্বরে এসে দাঁড়াই। এলোমেলো দৃষ্টিতে চারদিকের মাপজোক বুঝে নিচ্ছি। কীভাবে বিগ্রহ দর্শন হবে জানি না। ঠিক এমন সময় এক পান্ডা এসে বললেন, “চলো মেরে সাথ। পূজা তো দোগে না?”

আমি কিছু বলবার আগেই দীপ্তি মা বলেন, “নেহি। সৃফ বাতাও বাহার সে ক্যায়সে দর্শন হো সকতা হ্যায়?”

পান্ডা বেচারার সঙ্গে আমিও খুব অবাক হয়েছি। সে ইতস্তত ভাব দেখিয়ে বলে, “আইয়ে মা’জী!”

আমরা ওর পিছু পিছু একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। এই প্রথমবার চোখে পড়ল করুণাময় বদ্রীনাথের প্রস্তর রূপ। কী সুন্দর! কোন শিল্পীর ছেনি হাতুড়ির ঘায়ে ঈশ্বর কল্পনা রূপ পেয়েছে আমায় বলবে কে? অজান্তেই দুই হাত এক হয়। করজোড়ে প্রণাম করি। প্রণাম করবার সময় আঙুল ছোঁয় কপালের মধ্যবিন্দুতে। ত্রিনেত্র জাগরিত করবার পদ্ধতি তো কবেই বলা হয়েছে সনাতন ধর্মের পাঠশালায়। আজ যেন তা স্পষ্ট অনুভব করলাম। মনে পড়ল আদি শঙ্করাচার্য অলকানন্দার গভীরে ডুব দিয়ে এই মূর্তি উদ্ধার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেকালের বদরিকা আশ্রমে। মনে পড়ল স্বামী তোটকাচার্যের কথা। এঁরা করুণাময় ঈশ্বরের পার্থিব দূত হয়ে আপন দায়িত্ব পালন করে ফিরে গিয়েছেন সেই বৈকুণ্ঠলোকে। কত ইতিহাসের সাক্ষী এই মন্দির, মন্দিরের সামনে বয়ে চলা অলকাপুরির কোল থেকে জন্ম নেওয়া নদী অলকানন্দা। সেই সময়ও কি কোন সাদা শাড়ির অবগুণ্ঠনে এক সব হারানো মা দাঁড়িয়েছিল মন্দিরের দ্বার প্রান্তে? সে কী চেয়েছিল? সে কী চাইতে পারে? সময়ের পথ ধরে দীপ্তি মা কি এখন কিছু চাইছে? প্রত্যাশার কোন অনুরোধ সে এখন বিষ্ণুরূপী এই বিগ্রহের কাছে রাখছে? ওঁর মুখের দিকে তাকানোর কৌতূহল হল। তেরছা নজরে মায়ের মুখ দেখি। নাহ্। সেই দৃপ্ত মুখমণ্ডলে এক আলোর আভাস। ওই দৃষ্টি প্রত্যাশার নয়। অনুরোধ উপরোধের নয়। এমনকি অনুযোগেরও নয়। সাবলীল সেই তাকিয়ে থাকা কত সহজ অথচ পরম মাধুর্যে ভরা। সময় থমকে গিয়েছে। চারদিকের মানুষজনের ভিড় ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমিও যেন ওর সঙ্গে চেতন থেকে অবচেতনে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছি। দুঃখ নেই, আনন্দ নেই, শোক নেই, প্রেম নেই, ভক্তি নেই, ঘৃণা নেই। সবকিছু অস্বীকার করবার ক্ষমতা জন্মাচ্ছ। নিজেকে বড় হালকা বোধ করছি। চোখের সামনে আলোর বিস্তার। আলোর সমুদ্র। সেই সমুদ্রে চঞ্চল ঢেউ নেই। সব শান্ত, সমাহিত। পৃথিবী, সৌরলোক, আকাশগঙ্গা সবই অপসৃয়মান। নিজেকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না। আমিও যে আলোর ঢেউয়ে এক বিন্দুমাত্র।

ধ্যান গম্ভীর

কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না। হতে পারে মুহূর্তের ভগ্নাংশ। নাও হতে পারে। সময়ের হিসেব রাখার ইচ্ছে বা চেতনা কোনটাই ছিল না সেদিন।

মনে হল আমাকে কেউ যেন ডাকছে। অনেকবার ডাকছে। অচেতন থেকে চেতনে ফিরে এলে দেখি একটি কিশোর ছেলে হাতে লাড্ডু আর ফুল নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে।

“মন্দির বন্ধ হোগা। ইহাসে যানা পড়েগা। কাল সুবাহ আ জাইয়ে ফির।”

দীপ্তি মা’ও চোখ মেলে তাকিয়েছে। আমরা দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসি। মা শাড়ির আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোন ধরে যা কিছু তরল শরীরে জমেছিল সে সব মুছে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলে, “দো হামকো!”

হাত বাড়িয়ে ফুল আর প্রসাদ নিয়ে আমায় বলে, “ফেরা যাক তবে?”

আমি শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাই। মন্দির চত্বর প্রদক্ষিণ করতে করতে মাকে জিজ্ঞাসা করি, “এত কাছে এসেও ভিতরে গেলে না?”

“নাহ্। ভিতরে যিনি আছেন তাঁকে তো ভিতরেই দেখতে পেলাম। কলকাতায় ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়াব। তোমার মতো।”

আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আবেগ তরল হলে মাটির বাঁধ হেলায় ভেঙে ফেলে সব ভাসিয়ে দেয়। মনে পড়ল সেই আলোর সমুদ্দুরের কথা। এমন এক সমুদ্র যার তীরে দাঁড়ালে মানবিক প্রকাশকে তুচ্ছ করতে হয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলাম। এমন ভাবনায় সাময়িকভাবে সামলে তো নিয়েছি কিন্তু আবার রোজের জীবনে ফিরে গেলে মনে থাকবে তো আলোর সমুদ্রের কথা?

সেই রাতে ফিরে এসে দেখি সবাই তখনো পৌঁছয়নি। আমরা দু’জন দুই ঘরে চলে গেলাম। ফিরতি পথে খুব হালকা কথাবার্তা হয়েছে। বুঝতে পারছি আমাদের মন এখনো দ্রবীভূত হয়ে রয়েছে সেই পরমানন্দে।

বদ্রীনাথ থেকে ফিরে আসছি হরিদ্বার। প্রায় তিনশ কুড়ি কিলোমিটারের যাত্রা। বয়স্ক মানুষদেরই শুধু নয় তরতাজা তরুণ পর্যটকদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং। অতএব ঠিক করাই ছিল এক রাত শ্রীনগরের হোটেলে কাটিয়ে হরিদ্বার পৌঁছনো যাবে। কিন্তু অদৃষ্ট দেখতে পারে কে? বদ্রী মন্দির থেকে বেরিয়ে কিছু কিলোমিটার যাওয়ার পর আমাদের তিনটে গাড়ির মধ্যে একটি  বিগড়োল। গিয়ার লক হয়ে গিয়েছে। আমাদের তখন একটিই লক্ষ্য যে করেই হোক অন্তত যোশীমঠে পৌঁছতে হবে। এদিকে আকাশের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। কালো রঙের আস্তরণ আকাশ জুড়ে। দুটো গাড়িতে তৃতীয় গাড়ির চারজনকে কোনক্রমে বসিয়ে রওনা করে দেওয়া হল। অন্তত যোশীমঠ থেকে মেকানিক খুঁজে নিয়ে আসা যাবে গাড়িসহ আমাদের চারজনকে উদ্ধার করবার জন্য। এছাড়া যোশীমঠে রাতের আস্তানার ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের জন্য এর থেকে তোফা বন্দোবস্ত আর হয় না। আমিও হাঁফ ছেড়ে হালকা হতে পারতাম যদি না দীপ্তি মা আমাদের বাকি তিনজনের সঙ্গে থেকে না যেত। আমার সঙ্গে থাকা বাকি দুই সহযাত্রীর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। তাদের শরীর-মনের কোথাও ক্লান্তির ছিটেফোঁটা লেগে নেই। তাই তাদের থেকে যাওয়া যৌক্তিক ও স্বাভাবিক। কিন্তু দীপ্তি মা? সেদিন বুঝেছিলাম জেদ আর দৃঢ়তার তফাৎটা ঠিক কোথায়। শান্ত স্বরক্ষেপণ ও অবিচলতার গূঢ় অভিঘাতে সেদিন আমরা সবাই ওঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে মেনে নিয়েছিলাম। দুটি গাড়ি দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাওয়ার পর দীপ্তি মা’র কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ।

“মা, এমন কেন করলে? তোমার ওষুধ নেওয়ার, খাবার খাওয়ার সিডিউল সব তো ওলট-পালট হয়ে গেল। আমরা কখন পৌঁছতে পারব জানা নেই। বৃষ্টি নামতে পারে যে কোন মুহুর্তে। এখানে আড়াল কোথায়? এত ঠান্ডায় তুমি ভিজে গেলে শরীর খারাপ হবে। কী দরকার ছিল? চলে গেলেই হয়ত ভালো হত!”

দীপ্তি মায়ের উত্তর আমাকে থমকে যেতে বাধ্য করে। কী বলব? কীই বা বলা চলে। মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “এর কারণ যে তুমি নিজেই।”

“মানে?”

“শরীর দুটো আলাদা হলেও আত্মা যে এক তার অনুভব তোমার হাত ধরেই হয়েছে। কিসের সিডিউল? কে ঠিক করেছে? ডাক্তার? ডাক্তারদের ক্ষমতা আমার দেখা আছে। বিপজ্জনক পথ আর তার মাঝে চলন্ত গাড়ি, দুটোকেই আর ভয় পাই না। বরঞ্চ ওই প্রগাঢ় অনুভূতি আমার শেষ কষ্টটুকু মুছিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ফিরে গেলে আনন্দে কাটবে বাকি জীবন।”

এটুকু বলে আমার চোখের দিকে চোখ রেখে বলে, “তুমি থাকবে খোলা আকাশের নিচে আর আমি রাত কাটাব চার দেয়ালের সুরক্ষায়? এ যে হওয়ার নয়। মৃত্যুভয় আমার কেটেছিল কিছু বছর আগে। তবে কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। সেই রাতের পর সমস্ত রকম দ্বন্দ্বের বাইরে চলে এসেছি।”

বুঝতে পারি বাধ্য জীবন থেকে বোধের জীবনে দীপ্তি মা’র উত্তরণ ঘটেছে। জীবনকে সে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করেছে। মানব শরীরে এমন সময় অদ্ভুত অনুরণন হয়। পাহাড়িয়া বাঁশির সুরের মতো সে মূর্ছনা ছড়িয়ে দেয় উপত্যকা থেকে উপত্যকায়। সেই অমোঘ বাঁশির সপ্তসুর প্রতিধ্বনিত হয় মানস জগতের কোনায় কোনায়। শুদ্ধ আমি’তে যে প্রবেশ করেছে তাঁর কাছে জাগতিক ব্যস্ততা, পরিকল্পনার স্খলন কোন দাগ কাটে না। আমার ভালোলাগা ঠিক এখানেই। দীপ্তি মা প্রকৃত সুখ খুঁজে পেয়েছে যখন ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ঈশ্বর নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে তাঁর সঙ্গে ছিলাম। এমন অপার্থিব নির্বাণ প্রাপ্তির প্রথম ধাপ পার করে দীপ্তি মা তার নিজের আলোয় উদ্ভাসিত মানুষ। এই দীপ্তি ভরা পূর্ণিমার থেকেও বেশি উজ্জ্বল, বেশি প্রশান্ত। ইচ্ছে করছিল ওঁর চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করি। কিন্তু নিজেকে সামলে নিই। এতে দীপ্তি মা’য়ের শান্ত মন অশান্ত হতে পারে।

আরাম ভরা চোখে মা’কে বলি, “তুমিই ঠিক। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই পড়ে রইলাম। কর্মফলের জন্য কেউ হয় বোষ্টম কেউ হয় সৎনাশী মানে ভেক ধরা সন্ন্যাসী। যেমন আমি। সত্যের অন্বেষণ করবার মতো যোগ্যতা এখনো আমার হয়নি। তুমি সার্থক। তোমার জীবন সার্থক।”

দীপ্তি মা শুধু চোখ দুটো ছোটো করে আমার দিকে তাকালো। স্নেহের বকুনিতে মন খুশি করে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। ড্রাইভার বেচারা তখন ফোনে ব্যস্ত।

সে রাতে কী হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার পরিসর এটি নয়। তবুও নিশ্চিন্ত করবার জন্য বলি অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে ফিরে কলকাতায় এসেছিলাম সবাই।

শহরের চেনা বাসায় ঢুকে পড়লে মানুষ নিশ্চিন্ত হয়। এই নিশ্চয়তা কেড়ে নেয় অনেক কিছু। তৈরি করে আরো ঘোর অনিশ্চয়তা। তবে

ফেরার পর বেশ কিছু মাস কেটে গেলেও বুঝেছি আলোর পরশের নির্যাসটুকু মনের ভিতরে আতরের সুগন্ধের মতো রয়ে গিয়েছে।

দীপ্তি মা’র বাঁধনে সাময়িক ভাবে নিজেকে বেঁধে ফেললেও সম্পর্কের মায়া থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলাম নিজেকে। ওঁর সঙ্গে আর কোনদিন দেখা করিনি। খোঁজও নিইনি। জানি না দীপ্তি মা এখন কোথায়। বদ্রীনাথে দেখা সেই আলোর সমুদ্র শিখিয়েছিল জগৎ এক ও অভিন্ন। সম্পর্কের নাম, তার প্রতি অনুরক্ত হয় পড়া সবটাই খেলা। পার্থিব খেলা। আমি সেই খেলায় ব্যস্ত হয়ে জীবনের মূল স্বত্বাকে উপেক্ষা করতে পারি না। দীপ্তি মা যদি এই শরীর নিয়ে বেঁচেও থাকে আমি জানি একই অনুভূতি ওর মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর কাজ বয়ে চলা। কে ডুবল কে ভাসল সেসব ভাবা নদীর কাজ নয়। জীবনও তাই। উৎস থেকে বয়ে চলেছি। মোহনায় মিশে যাওয়ার পর আমি আর আমিই থাকব না। আলোর সমুদ্র আমার এক মাত্র গন্তব্য। জানি একদিন এই প্রিয় শহর, প্রিয় মানুষদের না জানিয়ে আলোর সাগরের খোঁজ পেয়ে চলে যাব চুপিচুপি। আর কোনদিন ফিরে আসতে চাই না। পরম ব্রহ্মাণ্ডে সূক্ষ্মদেহের উপস্থিতিই শাশ্বত। স্থূল দেহের সীমাবদ্ধতা না জেনেই ভাবি এই প্রকৃত ‘আমি।’ আর এমন ভ্রম আমাকে নিরন্তর মূল লক্ষ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একীভূত হওয়ার বাসনা তীব্র না হলে যে বারবার ফিরে আসতে হবে। পেতে হবে প্রেম-অপ্রেম, সুখের অসুখের মতো তীব্র যন্ত্রণা। আলোর সাগরে অবগাহনের ইচ্ছে শক্তিশালী হয়েছিল যে মাহেন্দ্রক্ষণে তাকে যেন মুহূর্তের জন্যেও হারিয়ে না ফেলি। এত বড় সম্পদ রাখবার জন্য উপযুক্ত আধার হয়ে ওঠা প্রয়োজন। দীপ্তি মা হয়ত পেরেছে। আমি পারব কী না শুধু সময় বলতে পারে। আমি শুধু শেষ শ্বাস পর্যন্ত কৃপাপ্রার্থী হয়ে সৃষ্টিকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখব আর পরমানন্দে ডুবে যাব।

———-

ছবিঃ সম্রাট মৌলিক 

সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে চির বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদী ব্যবস্থা ও ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের লক্ষ্যে কাজ করছেন। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া এই পাঁচটি দেশে এখনো পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার সাইকেলে একাকী ভ্রমণ করেছেন। দুই চাকা ছাড়াও প্রায় দু'দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম, অজানা পাহাড় ও জঙ্গলে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'দাগ'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *