চেনা-অচেনা

চেনা-অচেনা

ট্রেনটা আস্তে আস্তে ব্রেক কষছে। কোলে দেড় বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে মেয়েটি উসখুস করছে। ট্রেন থামলেই তার বাড়ির লোক কেউ না কেউ এসে নামিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ আসছে না। গভীর নিশুতি রাত। মেয়েটি ব‍্যাগ গুছিয়ে রেডি। কাউকে দেখলেই এগিয়ে যাবে নামার জন‍্য। কিন্তু কেউ আসছে না।

মেয়েটির থেকেও বেশি ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে, লেডিস কম্পার্টমেন্টে কর্মরত অল্পবয়সী গার্ড ছেলেটি। মেয়েটির তুলনায় বয়সে সে অল্পই বড়, তবু গার্ডের ইউনিফর্মে বেশ কেতাদুরস্ত। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “চলুন, আপনাকে আমি সাহায্য করছি।”

মেয়েটি বলল, “আমি তো কাউকে এখনও দেখতে পাচ্ছি না!”

“তাতে কী হয়েছে? আমি সাহায্য করছি।”

“না না, কেউ না আসা পর্যন্ত আমি কী করে নামি?”

মিনিট পাঁচেক পর গার্ড মহাশয় আবার এগিয়ে এল। বলল, “চলুন চলুন, আপনার এখানে নামার কথা, নামবেন চলুন। এরপর ট্রেন ছেড়ে দেবে, তখন কী করবেন?”

“কেউ আসুক, নাহলে…”

“নামলেই দেখতে পাবেন, প্ল‍্যাটফর্মে নিশ্চয়ই আছেন ওনারা।”

মেয়েটি তখনও নামছে না দেখে সে এবার অতিশয় বিরক্ত হল। মেয়েটির ব‍্যাগটা তুলে রীতিমত ধমকে বলল, “চলুন, নামবেন চলুন।”

এবার মেয়েটিও রেগে গেল। দৃঢ়ভাবে বলল, আপনাকে বলেছি আমার বাড়ির লোক কাউকে না দেখলে আমি নামব না। বলেছি? আপনি কি আমাকে জোর করে নামাবেন?”

“কিন্তু আপনার তো এখানেই নামার কথা!”

“সেটা আমি বুঝব। নামব না এখানে। কাল সকালে শিয়ালদায় নামব। আপনি প্রোটেকশন না দিয়ে হ‍্যারাস করছেন?”

গার্ড ছেলেটি কেমন যেন চুপসে গেল।

মেয়েটির গন্তব্য শিয়ালদহ। ফিরছিল দার্জিলিং মেইলে তার মাসতুতো বোনের বিয়ে সেরে। সঙ্গে আরও অনেকে ছিল কিন্তু রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি। তাদের দলে তখন মেয়ে বলতে সে একাই ছিল। তার ভাই বা অন‍্য যারা ছিল, তারা টিটির সঙ্গে কথা বলে বার্থ পাবার চেষ্টা করছিল সেই নিউ জলপাইগুড়ি থেকেই। টিটি বলেছিলেন রায়গঞ্জে কয়েকজন নামার কথা, তখন ব‍্যবস্থা হয়ে যাবে। ততক্ষণ জেনারেলে যেতে হবে। মেয়েটিকে তাই লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠিয়ে দিয়ে তারা বলেছিল, “রায়গঞ্জে মনে হয় কয়েকজন নামবে। তখন আমরা কেউ এসে তোকে নিয়ে যাব।”

মেয়েটি জানলার ধারে যে সিটটা দখল করে বসেছিল বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, সেটাও যাত্রী সহায়ককে টাকা দিয়ে নিতে হয়েছিল। তাদের কথোপকথন গার্ড ছেলেটির কানে গিয়েছিল। সে তাই অপেক্ষা করছিল, মেয়েটি নেমে গেলেই সে ঐ সিটটার দখল নেবে। কিন্তু মেয়েটিকে নামানো গেল না। ট্রেন ছেড়ে দিল।

মালদায় অবশ্য রিজার্ভ বার্থ পাওয়া গেল আর তার ভাই এসে নামিয়ে নিয়ে গেল।

মেয়েটি জীবনে অনেকবার চাকরি ছেড়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে আপোশ করা কথাটা তার অভিধানে নেই। অনেকটা ‘রইল ঝোলা, চলল ভোলা’ টাইপের। মতের অমিল, কটু কথা, এসব তার সহ‍্য হত না।

একবার তার অফিসে সার্কুলার আসল, সব স্টাফকে পাঁচতলার ক‍্যান্টিনে গিয়ে খেতে হবে। আসলে প্রত‍্যেকেই নিজের জায়গায় বসে বা একটু সরে গিয়ে, ডিপার্টমেন্টেই লাঞ্চ সেরে নিত। সেটা বন্ধ করাই উদ্দেশ্য।

এদিকে পাঁচতলায় অসম্ভব গরম। এসির তো প্রশ্নই নেই। সব সময় রান্না হচ্ছে। একদম ফার্নেস। তার উপর গরমকাল, ভয়ঙ্কর অবস্থা! ছেলেরা মেনেই নিল। ঘাম মুছতে মুছতে কোনও মতে গলাধঃকরণ করে আসে। মেয়েরা পড়ল মহা সমস্যায়। এই গরমে কী করে লাঞ্চ করে? তারা ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে গিয়ে ধরে পড়ল। কিন্তু কোনও কাজ হল না। সবাই মুখ কালো করে খেতে যেতে লাগল আর হাঁসফাঁস করতে করতে ফিরল।

গেল না শুধু একজন। সে বলল, ‘আমি লাঞ্চই করব না। ঐ গরমে লাঞ্চ করে নামার পর কাজ করা যায় না। অতএব লাঞ্চ হরতাল।’ খবরটা রটে গেল।

কয়েকদিন পর ডাক পড়ল ঊর্ধ্বতনের ঘরে, “কী হল, আপনি নাকি লাঞ্চ করছেন না?”

মেয়েটি বলল, “অসুবিধা হচ্ছে না স‍্যার। ঐ গরমের থেকে নেমে এসে কাজ করা অসম্ভব, তাই…”

“তাই বলে না খেয়ে থাকবেন?”

“হ‍্যাঁ, তাতে তো আপনাদের অসুবিধা নেই!”

“তাই হয় নাকি? ওকে, ইউ ক‍্যান হ‍্যাভ ইয়োর ফুড ইন ইওর প্লেস।”

“স‍্যার, এই ‘ইউ’টা কি সিঙ্গুলার না প্লুরাল?” (এই কথাটা বলার সময় অবশ‍্যই স‍্যার আশুতোষকে সে মনে মনে প্রণাম করেছে।)

ভদ্রলোক এবার হেসে ফেললেন, “ঠিক আছে, আপনারা মেয়েরা নীচেই খাবেন।”

অফিস নিয়ে আর একটা অভিজ্ঞতা।

সেদিন ডক্টরস’ পার্টি ছিল। সবারই বেরোতে রাত হল। ছেলেমেয়ে সব কলিগরা এক সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। বাস আসছে আর যে যার মত বাসে উঠে পড়ছে। সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। তাকে নিয়ে আর চারজন মেয়ে বাকি। তার বাসও এসে গেল। বাকি তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন বলেই ফেলল, “দিদি তুমিও চলে যাবে?”

সে বলল, “কেন রে?”

আর একজন বলল, “ভয় করছে দিদি।”

সে বাসটাতে উঠতে গিয়েও উঠল না‌। ওদের চোখমুখের ভয়, উৎকণ্ঠা দেখে থেমে গেল। তারও বয়স তখন আঠাশ, তবু সেই সবার মধ্যে বড়। ওদের অভয় দিয়ে বলল, “ঠিক আছে তোরা আগে বাসে উঠে যা।”

সবাইকে বাস ধরিয়ে দিয়ে তবে সে নিজে বাসে উঠল।

জীবন নানা আবেগের কোলাজ। সাহসিকতাও তারই অন্তর্গত। শুনিয়ে গেলাম এমন একজনের দু’একটা গল্প যে আপনাদেরই একজন।

———-

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অন্তর্জাল ক্লিপ আর্ট। 

সুতপা বিশ্বাস ঘোষ মূলত ছোট গল্প লেখেন। কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখতে ভালবাসেন। অভিব‍্যক্তি নিউ জার্সি, শনিবারের আসর, সাহিত্য বিবর্তন, পাণ্ডুলিপি সহ বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত আকারে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *