অনন্য তরুণ

অনন্য তরুণ

একটা সময় মানুষ, সিনেমাকে বলত “বই।”

শিক্ষার প্রলেপ, আর মানুষের সংস্কৃতিতে, পাশ্চাত্য ভাবনার প্রভাবে, বিদ্বজ্জনেরা এখন সিনেমাকে ডাকে ফিল্ম বলে। মাঝে মাঝে শাখানদীর মত, এই সিনেমায় মিশে যায় ডকুমেন্টারি বা হালফ্যাশানের ওয়েবসিরিজ বা নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় হওয়া টেলিফিল্ম বা টিভি সিরিয়ালের ধাঁচ। কিন্তু দিনের শেষে দর্শক, সিনেমাকে বই কেন বলে? তার কারণ বোধ করি একটাই – দর্শক আসলে শ্রোতা, সে গল্প শুনতে চায়। সিনেমায় ক্যামেরার কারসাজি, আলো আর রঙের খেলা, গৎ ছেড়ে বেরিয়ে আসা চরিত্রদের কায়দাকানুন, দর্শককে চমকে দেয়। তাকে ভাবায়, তাক লাগায়, মুগ্ধ করে।

বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটহীন রাজা সত্যজিতের ভূতের রাজা, জলফড়িংয়ের নাচ, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মগজাস্ত্র, দূরবী্ ট্রেন, কাশফুল – দর্শকের দেখার চোখকে আরো বেশি প্রশস্ত করে। মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটক সেই দর্শককেই আবার “আকালের সন্ধানে “বা “মেঘে ঢাকা তারার ” মধ্য দিয়ে সমাজের জীর্ণ,দীন,কঠিন বাস্তবকে চিনতে শেখান। সিনেমার যে রংচঙে পর্দা তা একটানে খুলে নিয়ে বঞ্চনাকে মন্থন করতে শেখায়। শেখায় বেদনার জারণ। তবু দর্শক বুভুক্ষুর মত একটাই জিনিস খোঁজে – গল্প। প্রযুক্তির যুক্তি, বা চিত্রনাট্যের সাজসজ্জার প্রশংসা করেও, সে সন্ধান করে একটাই জিনিসের, গল্পের ।

আর সেই গল্প বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের কোটালপুত্র তরুণ মজুমদার।

রূপকথার প্রতি গল্পে, কোটালপুত্রের উল্লেখ থাকত। রাজার ছেলে ঘোড়া হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়ত অজানার সন্ধানে, বা রাজকন্যের খোঁজে। আর তার পাশ দিয়ে নিশ্চুপে,ঘোড়া ছুটিয়ে চলত কোটালপুত্র। গল্পের শেষে যার কথা কেউ বিশেষ মনে রাখত না।

কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র, মনে রাখবে এই গল্পকারকে, যিনি সত্যজিত, মৃণাল, ঋত্বিকের পাশাপাশি থেকেও সমান্তরাল ও স্বতন্ত্র।

পরিচালক তরুণ মজুমদারের একটাই উদ্দেশ্য ছিল – নির্মল আনন্দ দান, এবং দর্শকের মানবিক উত্তরণ, আর নিটোল গল্প পরিবেশন। ঠিক যেমন গ্রীষ্মের দুপুরে তৃষ্ণা নিবারণে দইয়ের ঘোল, বর্ষার প্রথম টুপ করে ঝরে পড়া জল, বসন্তের প্রথম কচিপাতা।

তরুণ মজুমদার এক ঋজু মেরুদণ্ডের মানুষ। একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন। জীবনের শেষ দিন অবধি,তা পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। যদিও তাঁর পরিচালিত ছায়াছবিতে সেই রাজনৈতিক চিন্তাধারার উচ্চকিত প্রতিফলন ঘটেনি, তবুও সিনেমার পাত্র পাত্রীর চরিত্রে স্পষ্ট ফুটে ওঠে মূল্যবোধের ছাপ।

তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা মহান নয়। তাদের মহত্বের চোখে দেখতে হবে তার এমন দাবীও তাঁর ছিল না। তারা আশেপাশের মানুষ। তারা ব্যর্থ বা আপাত সফল মানুষ।

তারা ভুলো, তারা বোকা, তারা সরল, তারা সোনালি ডানার ঈগল নয়, তারা গ্রামবাংলার দোয়েল, শ্যামা, ফিঙে, মুথাঘাস। তারা ধানসিঁড়ি। তারা ভয় পায়, তারা দুঃস্বপ্ন দেখে, পালিয়ে যায়, দাম্পত্যর প্রথম স্বাদ পেয়ে লজ্জায় রাঙা হয়। তাঁর সৃষ্ট দুষ্টু লোকেরাও ভুল স্বীকার করে, খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই, পরিবার,পরিজন আত্মীয় স্বজনের কাছে ফিরে আসে। তাঁর ছবিতে প্রেম, যৌনতা, পরিবার এতটাই সুস্থ, যে তারা সিনেমায় আলাদা হবার দাবী জানায় না, গল্পেই মিলেমিশে যায়।

‘কাঁচের স্বর্গ,’ ‘সংসার সীমান্তে,’ ‘ফুলেশ্বরী,’ ‘বালিকা বধূ,’ ‘দাদার র্কীতি,’ ‘কুহেলি,’ ‘আলো,’ ‘চাঁদের বাড়ি’ সব ছবিতেই ক্যামেরা চলে গল্প বলার মুন্সিয়ানার ছাপ রেখে।

তাঁর ছায়াছবি বাঙালিকে উপহার দেয়, অনুপকুমার, শমিত ভঞ্জ, সন্ধ্য্য রায়, মৌসুমী চ্যাটার্জি, অয়ন ব্যনার্জি, মহুয়া রায় চৌধুরী, তাপস পাল, দেবশ্রী রায়ের মত অভিনেতাদের যাঁদের মানুষ মনের গভীরে জায়গা দেন।

কুনাল মিত্র, ভাস্বর চ্যাটার্জি, সৌমিলি বিশ্বাস, বা ঋতা দত্ত চক্রবর্তী( আলো) বা ঋষি কৌশিকের ( চাঁদের বাড়ি) মত যে সব অভিনেতারা একটা দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন অখ্যাত, অথবা ছায়ার আড়ালে, তাঁদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটে তাঁর হাত ধরেই।

তরুণ মজুমদারের কোন প্রোপ্যাগান্ডা ছিল না। তাঁর নির্মিত ছবি কোন বিশেষ একটা ভাবধারা নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রভাবিত করবে এমন কোন পাকাপাকি উদ্দেশ্যও ছিল না। তাঁর ছবি ছিল কাঁচামিঠে, যা মুখে হাসি ও চোখে জল একসঙ্গে নিয়ে আসত।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত,( ‘আলোর পিপাসা,’ ‘অমরগীতি’) বা লোকগানের (” ফুলেশ্বরী”, “পলাতক”) পাশাপাশি, চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানকে তাঁর মত এত নিপুণ ভাবে অন্য কোন পরিচালক সুব্যবহার করে উঠতে পেরেছেন বলে জানা যায় না।

মানুষের আনন্দ, ব্যথা, মিলনের উচ্ছ্বাস বা একাকিত্বের বেদনা রবীন্দ্রগানের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন এই পরিচালক। এবং সে গানকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন আরেক গুণী মানুষ – হেমন্ত মুখোপ্যাধায়, যাঁর প্রতিভা আলাদা করে পরিচয়ের দাবী রাখে না।

“দূরে কোথাও “(‘নিমন্ত্রণ’), “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে।”(‘কুহেলি’), “চরণ ধরিতে,” “এই করেছ ভালো,” “বঁধূ কোন আলো লাগল চোখে”(‘দাদার কীর্তি’), “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন “(আলো) তরুণ মজুমদারের ছবিতে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলির মধ্যে অন্যতম।

দুটি ঘন্টা ব্যয় করে, তাঁর ছবি দেখার পর, দর্শকের মন ভিজে যায় আবেগে। ভরে যায় অমলিন আনন্দে, যা এই প্রচারবিমুখ মানুষটির পাথেয় ছিল। তাঁর র্কীতি আগামী প্রজন্মের পরিচালক ও দর্শকের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়, যে, অনায়াসে সহজ সরল কাহিনীর বিন্যাস করতে পারেন যিনি তিনি হলেন আমাদের চিরতরুণ – “তরুণ মজুমদার।”

পরিচালকের ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতাস্বীকার: অন্তর্জাল। 

লেখিকা শীর্ষা গঙ্গোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতায়, চৌদ্দই মার্চ ১৯৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। লেখিকা প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও যাদবপুর থেকে স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতা। লেখিকা ফেসবুকে, বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ের ওপর গল্প, উপন্যাস, মুক্তগদ্য রচনা করে থাকেন। ফেসবুকে ‘সিঁদুর কৌটো’ এবং ‘একটি "নির্মেদ প্রেমের গল্প,’ নামক দুটি বড়গল্প লিখে পাঠকের ভালবাসা পেয়েছেন। লেখিকা পরবর্তীকালে এ ভাবেই মানুষকে ভালো লেখা উপহার দিতে সচেষ্ট থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *