একটি প্রাসঙ্গিক ফুটবল ম্যাচ

একটি প্রাসঙ্গিক ফুটবল ম্যাচ

ফুটবলের জাদুকরী

সময়টা গত শতাব্দীর আশির দশক, তখন ফুটবলের খেপ সার্কিটে, দমদম অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির কর্মী আবাসনের ফুটবল টিম, ‘আঠারো নম্বর মলরোড এস্টেট ক্লাব’-এর প্রবল দাপট। অনেক স্থানীয় টুর্নামেন্ট বিজয়ী খ্যাতনামা এই ক্লাব, জ’পাড়ার বিখ্যাত (মতভেদে কুখ্যাত)। ডন কালুদা আয়োজিত এবং জ’পাড়ার 44C বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত ফুটবল টুর্নামেন্ট, ‘ভূতনাথ মেমোরিয়াল’ শিল্ডেও ছিল বাঁধা চ্যাম্পিয়ন। বলা বাহুল্য, ‘আঠারো নম্বর মলরোড এস্টেট ফুটবল ক্লাব’ কালুদার, ‘শিবশক্তি’ ক্লাবের হয়েই ওই প্রতিযোগিতায়, ম্যাচ পিছু টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে খেলতে যেত, ফুটবলের পরিভাষায় যাকে বলে খেপ খেলা। নামে শিবশক্তি ক্লাব হলেও, ক্লাবটি বাবা শিবের থেকে দাদা কালুর  শক্তির ওপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। আর জ’পাড়ার জনশ্রুতি অনুসারে, ওখানে কস্মিনকালেও, ‘ভূতনাথ’ বলে কোনও ব্যক্তি বাস করতেন না, সুতরাং তার নামে মেমোরিয়াল শিল্ড হওয়ার প্রশ্নই নেই। ওটা শিব ভক্ত কালুদার মস্তিষ্কপ্রসূত নাম। দাদা কেন তার আরাধ্য দেবতার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটিয়ে টুর্নামেন্টের নাম ভূতনাথ মেমোরিয়াল শিল্ড দিতে গেলেন, সেটা জানতে চাওয়ার মতন ব্যক্তি ওই তল্লাটে না থাকায় সেই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। সে থাক, কিছু জিনিস রহস্যাবৃত থাকাই ভালো।

তা যাই হোক, কালুদার এলাকা, কালুদার টুর্নামেন্ট, জনগণের টাকা মানে সেই কালুদারই টাকা, কালুদার ক্লাব, এতেও রেহাই নেই, তার ওপর আঠারো নম্বরের সব তারকা ফুটবলারের মহা সমারোহ। দুই স্ট্রাইকার তারক এবং টিঙ্কু, দুই স্টপার ব্যাক  গোরা এবং শঙ্কর, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার মেনদা এবং সর্বোপরি মহাতারকা গোলরক্ষক এবং অধিনায়ক কাশিদা বা কাশীনাথ দাসের সুযোগ্য নেতৃত্ব। সুতরাং, কালুদার হাতেই ট্রফি উঠবে, দাদা ট্রফি নিয়ে বিশ্ব বিজয়ীর হাসি দেবেন, স্থানীয় স্টুডিওর ফটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশ বাল্ব ঝলসে উঠবে, সেই ছবি শিবশক্তি ক্লাবের দেওয়ালে জ্বলজ্বল করবে, রাতে মাংস ভাত পিকনিক হবে, জ’পাড়ার আপামর জনসাধারণ সেখানে পাত পাড়বেন; সুধী দর্শক থুড়ি পাঠক, এইটুকু জানাই আপনার অধিকার, কালুদার অন্দরমহলে ঢোকার অনুমতি আমার আপনার নেই, অতএব সেখানে রঙিন পানীয়র ফোয়ারা ছুটবে কি না সে কৌতূহল দমন করাই ভালো।

এ সবই স্বাভাবিক, অতি স্বাভাবিক। কিন্তু মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ঘটনাও তো জীবনে ঘটে, পচা শামুকে পা কাটে। সেবার কালুদার দলের বিখ্যাত গোলরক্ষক কাশিদা, প্রথম ম্যাচ শুরুর মিনিট তিনেকের মাথায় আক্ষরিক অর্থেই একটি বগলি খেলেন অর্থাৎ বগলের তলা দিয়ে গোল খেয়ে বসলেন। বিপক্ষ দলটিও বোধহয় ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে আনন্দ করতে ভুলে গিয়েছিল; কিন্তু যেটা শুরু করেছিল সেটা বল পেলেই মাঠের বাইরে উড়িয়ে দেওয়া এবং সবাই মিলে নীচে নেমে এসে ডিফেন্সে পায়ের জঙ্গল তৈরি করা। সেই আঠারো নম্বর ফুটবল ক্লাবের তৎকালীন সদস্য হওয়ার সুবাদে আমার অভিজ্ঞতা বলে, আঠারো নম্বরের পোড় খাওয়া খেপুড়েরা এ হেন ধ্বংসাত্মক ফুটবল খেলা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে যথেষ্ট অস্বস্তি বোধ করত, কারণ যেকোনো প্রতিযোগিতার প্রথম ম্যাচই বেশ কঠিন ম্যাচ, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় অভিজ্ঞ ফুটবলারদেরও ব্যয় হয়ে যায়। আর হাতে সময় যখন খুবই কম। এই ধরনের ওয়ান ডে ফুটবল টুর্নামেন্টে দুই অর্ধে দশ মিনিট করে খেলা হত, মধ্যে দু’মিনিটের বিরতি। সুতরাং একবার পিছিয়ে পড়লে, খুব কম সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচ বার করাটা বেশ কঠিন ছিল। জ’পাড়ার দর্শকরা, আঠারো নম্বর মলরোড এস্টেটের ফুটবল দলকে জিততে দেখতেই অভ্যস্ত, সেই প্রত্যাশার বিপুল ভারও অস্বীকার করা যায় না।

আঠারো নম্বর ফুটবল ক্লাব, নিজেরা গঠনমূলক ফুটবল খেলত এবং চাইত প্রতিপক্ষও ঠিকঠাক ফুটবল খেলবে, নিজেদের ডিফেন্সে সারা ক্ষণ জটলা না করে আক্রমণে উঠবে এবং ওরা তারপর জাল গুটিয়ে মাছ পাড়ে তুলে ফেলবে। খেপ ফুটবলের বেশিরভাগ মাঠই সুবিধের হত না, সেটায় ওরা অভ্যস্ত হলেও পছন্দ করত ভালো মাঠ, যেখানে জমিতে বল রেখে আক্রমণে ওঠা যায়। জ’পাড়ার মাঠ ছিল জঘন্য, ওই মাঠে প্রথমে গোল খেলে বিপদ আছে।

সেদিন লাগাতার আক্রমণ করেও তারক, টিঙ্কুরা গোল শোধ করতে পারছিল না।

তবে কী হবে? প্রথম খেলাতেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়নের বিদায়? তাও আবার এলাকার ডনের দল! তবে ট্রফি নিয়ে কালুদার পোজ দেওয়ার কী হবে? রোসো খানিক, দেখো কী হয়। হাফটাইমের পরে কালুদাকে মাঠের ধারে চেয়ার দেওয়া হল, দাদা বসলেন, ভক্তকুল একটু দূরত্ব রেখে পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। দাদার পরনে লুঙ্গি, টেরিলিনের শার্ট, সেই শার্টে একটা বোতাম কোনওরকমে লাগানো আছে কী নেই। (দুষ্টু লোকে বলত, কালুদার প্রধান ব্যবসা ছিল বাংলাদেশী কাপড় জামা স্মাগলিং, তবে তিনি ওসব নিজের সোনার বরণ অঙ্গে ধারণ করতেন না। সেখানে শুধু টেরিফিক, ‘টেরিলিন’)। তা কালুদা আসন গ্রহণ করে একটা আড়মোড়া ভাঙলেন, চারিপাশে একবার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকালেন, তারপর হাঁক পাড়লেন, “গোল চাই।”  সকলেই ব্যাপারটা বুঝল, গোল অবশ্যই চাই, গোল না হলে মহাগোল হবে, আর সেই গোলমাল কে সামলাবে! আমি যেন দেখলাম পরম পূজনীয় কালুদা হাঁকটা পেড়ে পরনের জামাটা একটু অন্যমনস্কভাবেই বোধহয় তুলে ধরলেন, সেটিকে স্বস্থানে নামাতেও কিছু বেশি সময় নিয়ে ফেললেন, আর ওইটুকু সময়েই আমি দেখলাম, অনেকেই দেখলেন এবং তার থেকেও বড় কথা, রেফারি দেখলেন সম্মাননীয় দাদার কোমরে শোভা পাচ্ছে সেই যন্ত্রশ্রেষ্ঠ, যা শুধু দাদাদের অঙ্গ শোভার নিমিত্তেই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে, যার পোশাকি নাম ছ’ঘড়া। বিপক্ষ দল কিন্তু লড়ে গেল, গোল শোধ করতে আঠারো নম্বরের তারকাখচিত দলের তখন কালঘাম ছুটে গেছে, আসলে কালুদার মতন ডনের হয়ে পেশাদারি শর্তে খেলার (না খেলতে চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না)। একটা মানসিক চাপ তো থাকেই, সেখানে জেতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা নেই। যতই তোমরা গত তিনবারের চ্যাম্পিয়ন হও না কেন, চতুর্থবারে প্রথম খেলায় হেরে যাওয়ার অধিকার তোমাদের থাকতে পারে না।

যাই হোক গোল আর শোধ হয় না, নির্ধারিত সময়ের খেলা উত্তীর্ণ হওয়ার পরও রেফারি খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তার তো ধড়ে একটাই মাথা, যে পাড়ায় দাদার অনুমতি ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না, সেখানে রেফারি কী করবেন? নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার আরও মিনিট দুয়েক বাদে আঠারো নম্বর গোলটা শোধ করে দিল, রেফারি কালুদার দিকে করুণ নয়নে তাকালেন, কালুদা ওপর নীচে মাথা নেড়ে খেলা শেষ করার অনুমতি দিলেন। অতিরিক্ত সময়ে বিপক্ষ আর দাঁড়াতে পারেনি। তিন গোল খেয়ে যায়। বেচারারা আর কী করে, এসে কালুদার কাছেই রেফারি বেশি খেলিয়েছে বলে অনুযোগ করছিল। দাদা তখন দার্শনিক। উপদেশ দিলেন, “কী আর করবি, হার-জিত কী আর তোর আমার হাতে পাগলা, সব আগে থেকে ঠিক করা আছে। এদের সঙ্গে পারিস কখনও, প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন হয়। আর একবার খেললে পাঁচ ছয় গোল খেয়ে যাবি।” বলেই শিবনেত্র হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন। কাকে কে জানে, নিজেকেই হয়তো। উনি নিজেই ওই এলাকার হর্তা কর্তা বিধাতা তো বটেই। আমিও মনে মনে ভাবছিলাম, হার-জিত সত্যিই তো আগে থেকে ঠিক করাই আছে, নিজের শিল্ড নিজে রাখবে, কার কী বলার আছে!  

আজও আশেপাশে তাকালে সেই ফুটবল ম্যাচের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই।

হয়তো বা কিছু অন্য রূপে; সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজেদের সংগঠিত শিরোপা নিজেরাই শিরোধার্য করে নিচ্ছেন। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *