জন দ্য ব্যাপটিস্ট ও জর্ডন

জন দ্য ব্যাপটিস্ট ও জর্ডন

জন দ্য ব্যাপটিস্ট – কাল্পনিক ছবি

লোকটা যে ধর্মযাজক তাতে সন্দেহ নেই। গায়ে উটের লোমের ঢিলেঢালা পোশাক। কোমরবন্ধনীও উটের চামড়ায় তৈরি। দাড়ি গোঁফে ভরা মুখ। রুক্ষ পরিধানের সঙ্গে মানানসই হেডব্যান্ড গাছের পাতা আর অন্যান্য জিনিস দিয়ে তৈরি।

ধর্মযাজকের তরুণ সঙ্গীটি ওঁরই সমবয়েসি হবে। শ্মশ্রু-গুম্ফে ভরা মুখ। ঘাড় অবধি লম্বা চুল। জর্ডন নদীর কোমর জলে জোর হাতে দাঁড়িয়ে আছে নবযুবক। মুখের স্মিত হাসিতে প্রশান্তির ছাপ। মাথায় নদীর পবিত্র জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন ধর্মযাজক। মৃদু সুরে বাজছে মন্ত্র উচ্চারণের গম্ভীর স্বর। বাইবেলে আছে, প্রাচীন শহর জেরিকোর পাশ দিয়ে খরস্রোতা জর্ডন নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত বেথানি গ্রামে যীশুখ্রিস্টকে ব্যাপ্টাইজ (baptize) করেছিলেন জন দ্য ব্যাপটিস্ট (জন ১:২৮)। এই বর্ণনায় সেই ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

একটা বিশেষ কাজের জন্য মরুভূমিতে তাঁবুর মধ্যে বসবাস করতে পছন্দ করতেন জন। ঈশ্বরের নির্দেশ, ব্যাপ্টিজম প্রচার করে অনুতপ্ত মানুষকে পাপমুক্ত করতে হবে। ইহুদিদের ভাবী ত্রাণকর্তা (messiah) ধরাধামে অচিরেই আবির্ভূত হবেন। লক্ষহীন, দিকভ্রষ্ট মানুষকে এই আশ্বাস দেবার দায়িত্বও জন-এর ওপর। তাঁর বিচরণস্থল জেরুজালেমের পূর্ব প্রান্ত, জর্ডন নদীর আশেপাশের বিস্তীর্ণ অনুর্বর এলাকা। কিন্তু নদীর উপত্যকায় বন্য পশুদের আনাগোনা। অবশ্য জন-এর তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। যে কাজের আদেশ পেয়েছেন, সে কাজে বিশ্রাম নেওয়া চলে না।

জন-এর ধর্মপ্রচার মানুষকে এমনই মুগ্ধ করেছিল যে তাঁর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। দেশের রাজা তখন হেরড অ্যান্টিপাস। রাজাকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বসলেন জন, কারণ হেরড অবৈধ ভাবে বিয়ে করেছিলেন তাঁর ভ্রাতৃবধু হেরোডিয়াসকে (তখনকার দিনে এই ধরনের বিবাহবন্ধন ইহুদিরা অনুমোদন করত না)। যদিও প্রথম প্রথম হেরড অ্যান্টিপাস জন-এর ধর্ম প্রচারকে ভালো চোখেই দেখেছিলেন, কিন্তু ওঁর স্পষ্টবাদিতা রাজ পরিবারের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। গ্রেপ্তার হলেন জন দ্য ব্যাপটিস্ট। হেরোডিয়াসের কন্যার প্ররোচনায় রাজা হুকুম দিলেন কারারুদ্ধ জন-এর শিরশ্ছেদ করা হোক।

জন-এর মৃত্যু যীশুকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল। সংসারত্যাগ করে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে উনি বুঝেছিলেন নিজের জীবনের উদ্দেশ্যও সহজ হবে না। ক্ষমতাবানদের চ্যালেঞ্জ করে সত্যপ্রচারের পরিণাম যে মৃত্যু, এই কঠিন সত্যের সম্মুখীন হলেন সেদিন। সেই মহাত্যাগের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে হবে এখন থেকেই।

*****

উপরের  ঘটনাটা ঘটেছিল প্রায় দু’হাজার বছর আগে। ২০২৩ সালে জর্ডন-এ গিয়ে দেখলাম যেখানে ব্যাপ্টিজম হয়েছিল, সেই জায়গাটার এমন একটা আকর্ষণ আছে যে চেষ্টা করলে দৃশ্যটা কল্পচক্ষে দেখা যায়। এককালে ছোট্ট একটা ঝর্না জর্ডন নদীতে এসে মিশেছিল এখানেই। নদী এখন গতিপথ পাল্টে দূরে সরে গেছে, কিন্তু ঝর্না তেমনই আছে। তির তির করে বয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে। 

ছবির সামনের দিকে যে চারটে স্তম্ভ রয়েছে, তারই মধ্যেকার নীচু জায়গায় যীশুখ্রিস্টকে ব্যাপ্টাইজ করেছিলেন জন দ্য ব্যাপটিস্ট। আদিম ঝর্নার জল এখনও এই জায়গাটাতেই জমা হয়। জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও আছে। এক সময় জর্ডন নদী এরই বাঁ পাশ ধরে বইত, কিন্তু এখন পথ পরিবর্তন করেছে। সামনের ছাউনির নীচে পৃথিবীর প্রথম গির্জার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। পিছনের ছাউনির নীচে এবং আশেপাশে আরও চারটির।

পাথুরে জমি, গভীর উপত্যকা এবং খাড়া পাহাড় দিয়ে ঘেরা জায়গাটা এখন জর্ডন রাষ্ট্রের অন্তর্গত। ইসরায়েল ও জর্ডনের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর, ১৯৯০ এর দশকে, প্রত্নতত্ত্বের কাজ শুরু হয়েছিল এখানে। তবে বেথানির সঠিক অবস্থান নিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছিল ২০১৫ সালে, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, এবং ভূতাত্ত্বিক সূত্রগুলো একত্র করে অনুসন্ধান চালানোর পর। স্থানটি অবশেষে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এটি এখন খ্রিস্টানদের অন্যতম প্রিয় তীর্থস্থল। আশেপাশে বেশ কয়েকটি নতুন গির্জা এবং মঠও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

খনন করে এখানে পুরাকালের কয়েকটি গির্জা এবং মঠের সন্ধান পাওয়া গেছে। খ্রিস্টের জন্মের পর কয়েক শতাব্দী ধরে নির্মিত হয়েছিল এগুলো। আর খ্রিস্টানদের আচার-অনুষ্ঠান সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন করার কাজে বানানো হয়েছিল কতোগুলো ব্যাপ্টিজমাল পুল। এখন আর সেগুলো নেই। ভূমিকম্প আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বহুকাল আগেই অদৃশ্য হয়েছে।

পোপ ফ্রান্সিস জর্ডন-এর রাজপরিবারের সঙ্গে ব্যাপটিজম-এর জায়গাটি পরিদর্শন করছেন।

জর্ডন নদী ব্যাপ্টিজম সাইট থেকে কিছুটা দূরে বইছে। অনায়াসে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। গিয়ে দেখলাম ইসরায়েল এর দিকে নদীতীরে একটা ব্যাপ্টিজম অনুষ্ঠান চলছে। জনা পঞ্চাশ মানুষ পাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত। সকলেরই গায়ে সাদা জোব্বা। কয়েকজন লাল রঙের কোট পরেছে। তাঁরাই বোধহয় ধর্মযাজক। তিন-চারজন লোক কোমর জলে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে নদীর পুণ্যজলে ডুব দিচ্ছে। স্পষ্টত এদেরই ব্যাপ্টিজম-এর মাধ্যমে শুদ্ধ করা হবে। দু’হাজার বছর কেটে গেলেও সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।

জর্ডন মন-ভাল-করা জায়গা। ঝকঝকে সুন্দর দেশ। প্রায় আশিভাগই মরুভূমি। রাজধানী আম্মান। ২০২১ সালের আদমশুমারিতে বলে শহরের জনসংখ্যা মাত্র চল্লিশ লক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মতো ইতিহাস জর্ডনের কোনায় কোনায় গাঁথা। ভ্রমণের সময় সেই ইতিহাস আবিষ্কার করার মধ্যে একটা বিমল আনন্দ আছে।

জর্ডন একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। রাজা এখানে সামরিক বাহিনীর সেনাপ্রধান (কমান্ডার-ইন-চিফ)। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের দায়িত্ব রাজার। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিচালকদের নিয়োগও তিনিই করেন।

আমাদের ভ্রমণ গাইড জানালেন জর্ডনে রাজার

দু’হাজার বছর আগে জর্ডন নদী এবং ঝর্নার সঙ্গমস্থলে যিশুর ব্যাপ্টিজম হয়েছিল। সেই প্রাচীন ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ গাইড আমাদের সেই তথ্য জানাচ্ছেন। বিভিন্ন রঙিন মোজাইকের টুকরো একত্রিত করে প্যানেল দুটো তৈরি। মোজাইক শিল্প জর্ডনের বিশেষত্ব। এই জনপ্রিয় শিল্পের ঐতিহ্য জর্ডন-এ মুসলমান রাজ্য বিস্তারের পর থেকে অব্যাহত আছে।

বিরুদ্ধাচরণ করলে রাজদণ্ড অনিবার্য। রাজার বিরুদ্ধে কথা বলাও আইনবিরুদ্ধ। নিজের দেশের সম্বন্ধে সব প্রশ্নর উত্তর দিতে উনি প্রস্তুত, কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্ন হলে উত্তর দেওয়া মুশকিল হবে। রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করলে চাকরি যাওয়াও অসম্ভব নয়। 

ভাবছিলাম রাজতন্ত্র তো পুরাকাল থেকেই আছে। কিন্তু হিতৈষী, কল্যাণময়, পরার্থপর (benevolent) রাজা কি সত্যিই হওয়া যায়? অপরিমিত ক্ষমতা দুর্নীতিকে আশ্রয় দেয় না কি? কিছু কিছু মানুষ জন্মসূত্রে অন্যদের থেকে বেশি সুযোগসুবিধে পাবে, তা কি ন্যায্য?

গণতন্ত্রের পথ অগোছালো। অগ্রগতিও ধীর। কিন্তু মন্ত্র নিগূঢ় – অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। ভুললে চলবে না, জনগণের অথবা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা সরাসরি তুলে দেওয়ার দায়িত্ব গণতন্ত্রের। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতার হাতিয়ারও গণতন্ত্র।

দুর্ভাগ্যবশত সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের দীপ্তি যেন আজ ক্ষীণ। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষকে এবার হয়তো এগিয়ে চলার নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নাহলে আজকের সাথে মধ্যযুগের তফাৎ থাকবে কি?

———-

ছবিঃ লেখক। জন দ্য ব্যাপটিস্ট-এর ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

কৌশিক সেনগুপ্ত একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু প্রশিক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে। প্যাশন হল পপুলার লেভেলে এ বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের SUNY-বাফেলো এবং লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন বহু নামি আন্তর্জাতিক জার্নালে। আর সহযোগিতা করেছেন সর্বদেশীয় এবং NASA বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন গাণিতিক কম্পিউটিং এবং সফটওয়্যার ডিজাইনে। অবশেষে IBM সংস্থায় যোগদান এবং অবসর গ্রহণের পর ফুল টাইম লেখার কাজে হাত। প্রথম বই, 'Are We Alone? Humankind's search for extraterrestrial civilizations।' মহাবিশ্বে আমরা একা কিনা, অর্থাৎ মানবসদৃশ আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কিনা, সে সব প্রাচীন প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রয়াসের কথা এই বইয়ের বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *