সৌজন্যের প্রতিমূর্তি,....আর ভালোবাসার শেষ কথা......
“কি যে বলেন স্যার!” নাঃ…. একেনবাবুর সংলাপ নয়, এই অধমের মুখনিঃসৃত বচন, চূড়ান্ত হতভম্ব অবস্থায়! স্থান ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। প্রকাশিত হয়েছে ‘একেনবাবু সমগ্র’ প্রথম খণ্ড, প্রকাশক দ্য কাফে টেবল। তখনও আলাপ হয়নি প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার মানিকজোড়ের সঙ্গে। হলের মধ্যে ছোট্ট এক স্টল। জাস্ট কৌতূহলবশে ঢুকেছিলাম। চোখ আটকে গেল বইটির দিকে। মাথার মধ্যে কি রকম একটা পোকা নড়ে উঠলো। ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম নব্বইয়ের দশকে। স্কুলজীবনের শেষ প্রান্তে তখন আমি, কলেজের দিকে এগোচ্ছি। পাক্ষিক আনন্দমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘ম্যানহাটানে মুনস্টোন।’ তখনও বঙ্গসন্তানের কাছে বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্র মানে ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটী। তখনও আবির্ভাব হয়নি গার্গী, দীপকাকু, মিতিনমাসির। এর বাইরে যে সমস্ত গোয়েন্দা চরিত্র এসেছিলেন বিভিন্ন সময়ে, তাঁরা কেউ দীর্ঘস্থায়ী হননি। পড়তে শুরু করে মনে হল এ তো পুরো অন্য রকম। এ রকম আনস্মার্ট গোয়েন্দা!! এ তো পুরো ছকের বাইরে। মুশকিলটা হল এই যে পুরো শেষ না করে ছাড়া গেল না। উপন্যাসের পটভূমি নিউইয়র্ক শহর আর সংলগ্ন এলাকা। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে ভারতীয় তথা বাঙালিদের আমেরিকা নামক দেশটার সঙ্গে পরিচয় ছিল সীমিত। তিন কিলোমিটার দূরে কোনো বন্ধুর পিসতুতো মেসোমশাই আমেরিকায় থাকেন মানে সেই বন্ধুর প্রতি একটা চোরা ঈর্ষাজনিত সম্ভ্রম ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দাক্ষিণাত্য কুলতিলক প্রধানমন্ত্রীর পাঞ্জাবতনয় অর্থমন্ত্রী সবে নিয়ে আসছেন মুক্ত অর্থনীতির ধারণা। ফোন বলতে তখনও কালো রঙের ডায়াল ঘোরানো ফোন (সবার বাড়িতে তাও থাকতো না)। যদি কারুর বাড়িতে লাল ফোন থাকে, তারা স্পেশাল। আর ক্বচিৎ কদাচিৎ যদি কারুর বাড়িতে বোতাম টেপা ফোনের সেট থাকে তা হলে তারা ভিআইপি – এই ছিল প্রচলিত সরলীকরণ (এই ফোন নিয়ে ফনফনানির রহস্য পরে উন্মোচিত হবে, আপাতত রহস্যই থাক)। ইন্টারনেট বলে কোনো বস্তু খায় না গায়ে মাখে, ভারতবাসী তা জানত না। ‘ব্রেন ড্রেন’ বলে একটি কথা সমাজে ঘুরে বেড়াতো, যার দ্বারা বোঝাতো মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের দেশ ছেড়ে পাশ্চাত্যে গিয়ে সেটল হওয়া, এ দেশে তাদের মেধার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্ম বা গবেষণার সুযোগের অভাবে। আর…আইটি সেক্টর নামক দিগন্তটির সাথেও ভারতবাসীর পরিচয় সেভাবে হয়নি। ‘অনসাইট’ শব্দটি তখন বাংলা অভিধানে ঢুকে পড়েনি। আজকের মত প্রায় প্রত্যেকে পরিবারের কারুর না কারুর স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূত্রে আমেরিকা বা ইউরোপে কাটিয়ে আসা জলভাত ছিল না মোটেই।
আরে…..কি থেকে কোন দিকে চলে যাচ্ছে… হচ্ছিল ‘ম্যানহাটানে মুনস্টোন’ নিয়ে কথা, সেখান থেকে এসব কোন দিকে চলে যাচ্ছে?? আরেকটু ধৈর্য ধরতে হবে প্রিয় পাঠক!
সেই নব্বইয়ের দশকের ‘ম্যানহাটানে মুনস্টোন’ আর ‘ম্যানহাটানে ম্যানহান্ট’… তার পরেই কাট এই সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশক… একেনবাবুর দেখা মিলল মাসিক ‘সুখী গৃহকোণ’-এর পাতায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে তখনও জানিই না কে এই লেখক… সুজনবাবু…। আবার দৃশ্যান্তরে যেতে হচ্ছে… সেই বইমেলা ২০১৭… প্রথম খণ্ড তো হাতে এসে গেল… বইয়ের পিছনে ছবি সুপুরুষ এক ভদ্রলোকের, একমাথা রুপোলি ব্যাকব্রাশ করা চুল। আর… যাদবপুর থেকে মাস্টার্স করা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার! ব্যাস! ‘দুনিয়ার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার’ এক হও। বইয়ের পাতা থেকে একবার চোখ তুলেছি, হটাৎ একটু দূরে চোখ পড়ল… পুরো শক খাওয়ার ফিলিং!! দাঁড়িয়ে আছেন ওই একমাথা ব্যাকব্রাশ রুপোলি চুলের ভদ্রলোক! লেখক এত কাছে!!! বেশ ফাঁকায়! আশে পাশে স্তাবকের ভিড় নেই, নেই কোনো আর্টিফিশিয়াল গাম্ভীর্য। সাহস করে এগিয়ে গেলাম। পরিচয় দিলাম নিজের, আর বললাম আনন্দমেলায় প্রথম ‘ম্যানহাটানে মুনস্টোন’ পড়ার অভিজ্ঞতার কথা। তার পরে? পরের এক ঘন্টা দুজনের কেউই আর ঘড়ির দিকে তাকাইনি। এ কথা সে কথা হতে আমার দিকে প্রশ্ন ধেয়ে এল, “তোমার কি লেখালেখির অভ্যেস আছে?” তার উত্তরে যা বলেছিলাম, সেই দিয়েই এই লেখার শুরু।
লেখকের প্রতি পাঠকের মুগ্ধতা থাকেই। আর যে লেখককে পাঠক প্রথম পেয়েছিল কৈশোরে, আর আবার ফিরে পেল প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় এসে, সেই লেখককে চোখের সামনে দেখলে সেই পাঠকের অবস্থা তো একেবারে আলুথালু হবেই।
একেনবাবুর কাহিনি এই পাঠকের কাছে শুধু মাত্র একজন তথাকথিত আনস্মার্ট কিন্তু তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন গোয়েন্দার কাহিনি নয়, আমেরিকার অনাবাসী ভারতীয়দের সমাজজীবনের এক প্রতিচ্ছবিও। আগেই বলেছি, নব্বইয়ের দশকে এই প্রতিচ্ছবি বঙ্গসন্তানদের কাছে অনেকটাই দূরের ছিল, যা এই সহস্রাব্দে অনেক কাছে চলে এল। আর একেনবাবুও এগোলেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সেই বইমেলার এক ঘন্টাতেই ‘স্যার’ হয়ে গেলেন ‘সুজনকাকু।’ চমকের আরও বাকি ছিল। সেদিনই কাকু জানালেন ‘অবসর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের কথা। সত্যি কথা বলতে কি, এই ‘না লেখক’ এর ‘লেখক হওয়ার হাতে খড়ি অবসরের পেজেই, সুজনকাকুর উৎসাহে। সুজনকাকুর সঙ্গে পরিচয় যত এগোল, তত মানুষটার সম্বন্ধে জানতে শুরু করলাম। নাঃ… ওনার নিজের কাছ থেকে নয়, নিজের পরিচয় ফলাও করে দেওয়ার মানুষ উনি ছিলেন না। অথচ… ওনার ‘পার্সোনা’র দশভাগের একভাগও যদি কারুর থাকে, তাহলে তিনি নিজেকে জগতের সম্রাট ভাবলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। একেনবাবুর মত সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র সফল সৃষ্টি যদি ওনার হাত দিয়ে নাও তৈরি হত, তা হলেও কি সেই ‘পার্সোনা’য় বিশেষ কমতি আসত? না বোধ হয়। সুজনকাকু এবং তাঁর সহধর্মিণী শমীতা কাকিমার পরিব্যাপ্তি যে অনেক বিশাল। কি রকম? হ্যাঁ, এই বার সেই ধান ভানতে ‘ফোনের’ গীত গাইবার সময় হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিঙের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক প্রয়াত অমিতাভ ভট্টাচার্যের প্রিয় ছাত্র সুজনকাকুর মার্কিন মুলুকে গমন তাঁর শিক্ষকের প্রেরণাতেই। পি এইচ ডি শেষ বেল ল্যাবস-এ তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মোবাইল টেকনোলজির ক্ষেত্রে তিনি যে অসামান্য সাক্ষর রেখেছিলেন, তা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে যখন নব্বইয়ের দশকে তিনি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বিশেষ পরামর্শদাতা হিসাবে এদেশে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে যান, ভারতে মোবাইল টেকনোলজির প্রারম্ভকালে। সঙ্গী ছিলেন আরেক কৃতী প্রবাসী বাঙালি প্রযুক্তিবিদ, প্রয়াত সুমিত রায়, কিংবদন্তী অভিনেতা প্রয়াত বিকাশ রায়ের পুত্র। এই দুই বঙ্গসন্তানকে এক অর্থে ভারতবর্ষে মোবাইল টেকনোলজি প্রসারের ভগীরথ বলাই যায়। গবেষণা ক্ষেত্রে সুজনকাকুর যে অবদান, তাতে ‘একেনবাবু’র আবির্ভাব না হলেও ওনার গরিমা এতটুকু কম হত না। আসলে সুজনকাকু প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেই প্রজন্মের, যাঁরা প্রকৃত অর্থেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। এর সঙ্গে এসেছে সামাজিক অবদান, যৌথভাবে সুজনকাকু আর শমীতা কাকিমার। এত কিছু সৃষ্টির পরেও কিন্তু তাঁরা রয়ে গেছেন আপাদমস্তক বাঙালি।
লেখক সুজনকাকুকে নিয়ে লিখতে গেলে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে সেই লেখা ‘বায়াসড’ হবে, হবেই। যেটা না বললেই নয়, নতুন লেখকদের প্রতি কাকুর ভালোবাসা ছিল দেখার মত। উৎসাহ দিয়েছেন অকৃপণ ভাবে, সবাইকেই। কখনও কারুর সম্পর্কে কোনো বিন্দুমাত্র নেগেটিভ বক্তব্য ওনার থেকে আসেনি।
এই সৌজন্যের প্রতিমূর্তি মানুষটির সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল অতিমারীর আগে, ২০২০র কলকাতা বইমেলায়। সাথে ছিলেন ওনার দাদা, অধ্যাপক সুমন দাশগুপ্ত, যাঁর সঙ্গে পূর্ব পরিচয় আমার বাবার সূত্রে। সুজনকাকুর কাছে বিশাল বড় ধাক্কা ছিল অল্পদিনের ব্যবধানে সুমন জেঠু এবং সুমিত জেঠু (রায়) – দুজনেরই চলে যাওয়া। এই দুজনের কথা বার বার উঠে এসেছে ওনার বিভিন্ন লেখায় ও কথায়। বস্তুত, ‘অবসর’ পত্রিকা শুরুই হয়েছিল সুজনকাকু আর সুমিত জেঠুর হাত ধরে। সেই উত্তরাধিকার তাঁরা দিয়ে গেছেন সুযোগ্য উত্তরসূরিদের হাতে।
ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ডিটেকটিভ উপন্যাস আরও অনেকে লিখবেন, মোবাইল টেকনোলজির আরও প্রসার হবে, প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্র নিয়েও কাজ করবেন আরও গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদ, সামাজিক ক্ষেত্রেও আরও অনেকে অবদান রাখবেন, কিন্তু এই সমস্ত ক্ষেত্রেই সমান কৃতিত্বের সাক্ষর কোনও একজন ব্যক্তির দ্বারা রাখা সম্ভব হবে কি? ভবিষ্যৎই দেবে এর উত্তর।
পাঁচ দশকের বেশি অনাবাসী হয়েই সুজনকাকু ভুলতে পারেননি সেই সাউথ এন্ড পার্কের পাড়াকে। কোথায় যেন নিয়তি নির্দিষ্ট করে রেখেছিল তাঁর জন্য নিজের জন্মভূমির মাটিতেই থেকে যাওয়ার।
আক্ষেপ থেকে যাবে সারাজীবন – এইবারে আপনি এলেন এ দেশে, কিন্তু দেখা হল না। আর দুঃখ এটাই কাকু – আমাদের মাঝে কি আরও কিছুদিন থাকা যেত না? আজকের মধ্যমেধাযুক্ত হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণার দুনিয়ায় আপনি যে ছিলেন এক ধ্রুবতারা।
ভাল থাকবেন কাকু, যেখানেই থাকুন।
1 Comment