নামহীনা
তা আজ নয় নয় করেও পঁচিশ বছর হয়ে গেল।
পঁচিশটা বছর – এমনিতে তেমন কিছু মনে হয় না বটে, কিন্তু যখন একটা জীবনের প্রেক্ষিতে ভাবি, এই ধরা যাক আমার নিজেরই অর্ধ-শতাব্দী পার করে-দেওয়া জীবনের প্রেক্ষিতে – কেমন গা শিরশির করে! ভাবি এতটা, এতটাই পিছনে ফেলে রেখে এলাম দিনগুলো, কিন্তু কই পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছি না তো?
সে না হয় হল। পায়ের ছাপ দেখা নাই বা গেল। কিন্তু তাতে তো হেঁটে আসাটা মিথ্যে হয়ে যায় না। জীবন জুড়ে কুড়োনো কথামালার সবটুকুই তো মলিন হয়ে পরিত্যাজ্য হয়ে যায় না!
অনেক বিজ্ঞ মানুষই বলেছেন, মানুষের স্মৃতি ব্যাপারটা ভয়ানক জটিল ব্যাপার। কোনটা মনে থাকবে আর কোনটা থাকবে না, তার নাকি কোনোনির্দিষ্ট প্যাটার্ন নেই। থিয়োরি নেই। যেমন আমায় একটা ওষুধ গত ছয় বছর ধরে রোজ সন্ধ্যেবেলায় খেতে হয়, কিন্তু আশ্চর্য সেটার নাম ও খাওয়ার কথা কিছুতেই মনে রাখতে পারি না! তাই ওষুধের নাম দিয়ে মোবাইলে রিপিটিং অ্যালার্ম দিতে শুরু করেছি আজ বছর তিন হলো। অথচ ক্লাস ওয়ানে দু’দিক-খোলা-যায় এমন একটা পেনসিল বক্স ছিল আমার, অফিসের কাজে বম্বে গিয়ে সেখান থেকে বাবা এনে দিয়েছিলেন – সেটার রঙ, চেহারা, এমনকি ঢাকনি খোলার ‘খুট’ শব্দটা অবধি সব স্পষ্ট মনে আছে। আর সেটা যে অচিন্ত্য নামে আমার একটা দুষ্টু ক্লাসমেট ভেঙ্গে ফেলেছিল ছ’মাসের মধ্যে, আর তাতে আমি কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম, সব একেবারে সেদিনের ঘটনার মতো মনে আছে আজও।
সে মান্ধাতার কালের তুলনায় পঁচিশ বছর আর কী! ঘটনাটা এমন সামান্য যে ভুলে গেলেই হয়, ভুলেই গেছি তো! কিন্তু কী করব, জীবন মাঝে মাঝেই আচমকা এমন সব উঁচুনীচু হাজির করে যে ওই অ্যালার্ম-দেওয়া ওষুধের মতো ওটা আপনাআপনি মনে পড়ে যায়। ভোলা আর হয় না।
পঁচিশ বচ্ছর আগে।
সে এক রোদ-ঝলসানো নিষ্ঠুর সময়; সে আমার প্রতিদিন সর্বত্র হেরে বাড়ি ফেরবার সময়, ফলাফলশূন্য শুধু প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাবার সময়; নিম্নবিত্ত বাঙালি বাড়ির এমএ পাশ ছেলে কাঁহাতক ‘মা ফলেষু’ করে ঢাকুরিয়া লেকের বেঞ্চিতে শুয়ে দুপুরের পর দুপুর কাটাতে পারে! তা আমার দোষটা কী ছিল?
আমি একটি প্রাইভেট ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে ঢুকে অতি অল্পদিনের মধ্যেই বেশ হেক্কড়মার্কা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পদ পেয়ে গিয়েছিলাম। পদটির দায়িত্বভার নির্বাহের পক্ষে যোগ্য আমি অবশ্যই ছিলাম, কিন্তু বাকি কিচ্ছু আমার ছিল না। না অভিজ্ঞতা, না পরিণতি; ওই ধরনের পদে রসেবশে রাজ করতে আসল যে সব সার্ভাইভাল স্কিল লাগে তা আমার তখনও সম্পূর্ণ অজানা ছিল। তাই কলকাতা শহরজোড়া বিপুল হোর্ডিং-প্রচারের ভুয়ো বিলে সই করতে আমি অস্বীকার করেছিলাম – বুঝতেই পারিনি ওটা হলো কর্পোরেটের কালো টাকা সাদা করবার একটা উপায়। আমি ভাবছিলাম, আমি তো সংস্থার টাকা বাঁচালাম, তাহলে আমায় কেন বরখাস্তের শাস্তি হিসেবে মালিকের ধামাধরা বুড়োঘুঘু ডিন বলবেন – ‘সাবমিট ইওর পেপার্স ভট্টাচারিয়া!’
বরং আমার অপরাধ অনেক স্পষ্ট বুঝিয়ে বলেছিল চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশানালের তেরো তলায় নিশি ইন্টারন্যাশানাল নামে আগরবাতি কোম্পানীর মালিক – আমি ম্যানেজারের পদে অ্যাপ্লাই করেছিলাম পার্ক স্ট্রিট মেট্রোর বাইরের দেওয়ালে সাঁটা বিজ্ঞাপন দেখে। ইন্টারভিউতে সেই মালিক আমায় বললেন – ‘আপ হামারে কোম্পানিকে লিয়ে কুছ জাদাহি কোয়ালিফায়েড হ্যায়, নোকরিকে লিয়ে দুসরা কোই জাগা ঢুঁন্ডিয়ে না! মিল জায়েগা আপকো জরুর!’
জানি তো… সবাই তাই বলতেন সেই সময়ে… মিল তো জায়েগা, লেকিন কব্? কাকে দেখাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ এমএ দু’টোতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার সার্টিফিকেট? বিকেল পাঁচটায় ডালহৌসিতে দাঁড়িয়ে চারদিকের অফিসগুলো থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে-আসা জনস্রোত দেখে ভাবতাম, ‘আর কী কী দরকার? আমার দখলে ঠিক কী কী জিনিস নেই যার অভাবে এই বিশাল মহানগরীতে এত এত অফিসের একটাতেও আমার কোনো জায়গা হয় না? নাকি, হাওড়া ব্রিজের উপর থেকে ওই গঙ্গায়… বা লেক গার্ডেন্সের রেললাইনের ধারে বস্তিগুলো পেরিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে রেললাইনে আজই…’
ওই… ওই যে উপরের লাইন দু’টো লিখতে লিখতেই আমার কানে পাশে কে যেন বলে গেল… কী করে ভুলি তাকে!
এটা স্বীকার করতেই হবে যে বড়োরা সবাই খুব আশা দিতেন, ওঁদের ভাষায় উৎসাহ দিতেন। হাল ছাড়তে মানা করতেন। সোজা বাংলায়, উচ্চ উচ্চ জ্ঞান দিতেন। কিন্তু কেউই ওই… আজকের জগতে টিকে থাকবার সার্ভাইভাল টুলবক্স বা স্কিলসেটের সন্ধান দিতেন না। দিতে পারতেন না হয়তো। কারণ পরে বুঝেছি ওগুলোর বেশির ভাগই জনসমক্ষে বলা চলে না, বললে স্ট্রাগলের বিশুদ্ধতা বিনষ্ট হয় ও সার্ভাইভালের গরিমায় টোল পড়ে। সেই ডারউইনের কাল থেকেই সার্ভাইভাল তো যোগ্যতমদেরই প্রাপ্য, আর যোগ্যতমরা সোজা পথেই বিজয়ী হয় বলে কথিত আছে, তারা বাইপাস বা শর্টকাটের অন্যায় ধরে কভু এগোয় না। তাই সেই সময়টা প্রতিষ্ঠিত সুশীলদের বাণী থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সময়… দিনের আলোয় নিজের মুখ জনারণ্যে বা বিজনে লুকিয়ে রাখবার সময়… আমি তাই পালাতাম… মানুষের সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতাম।
তারপর… নগরীর বুকে রাতের অন্ধকারের অবগুন্ঠন নেমে এলে সারাটা দিন যেন কত দায়িত্বশীল প্রকান্ড কাজটাজ সব করেছি, মানে আমার প্রোফাইলের ছেলের যেমন চাকরি করা উচিত তেমন আরকী – এমন ত্রস্ত ভঙ্গিতে শিয়ালদার ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে সাড়ে আটটায় ছাড়বে যে গেদে লোক্যাল, খুঁজে খুঁজে তার একটি অন্ধকার কামরায় উঠে মুখ লুকিয়ে বাড়ি ফেরবার সময়… অবসাদে চোখ বুজে আসত, তাও নিশ্চিন্ত হতাম এই ভেবে যে, যাক কোনোরকমে আরেকটা দিন পার করে দেওয়া তো গেল!
এমন একদিন মাঝেরহাট স্টেশন, মে মাস। মনে আছে, কারণ ঘটনাটির কয়েকদিন আগেই রবিঠাকুর আমায় চোখের জলে আবার পড়িয়ে গেছেন – “আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে!” কিন্তু আর যে দহনজ্বালা সইতে পারি না ঠাকুর!
সেদিন বেলা এগারোটাতেই গনগনে দুপুর-রোদ… জ্বালা আমার ত্বক ভেদ করে মর্মে ঢুকতে শুরু করেছে… নতুন কথা নয়, প্রতিদিনই এমনটাই হয়…
মাঝেরহাট স্টেশনে নেমে বাস ধরে আমি যেতাম সেই ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এ। সেখানে বিসি রয় মেমোরিয়াল লাইব্রেরিতে আমার একটি রিডিং কার্ড ছিল। ভারী ঠান্ডা কোলাহলহীন স্নিগ্ধ স্থান বটে। লেখাপড়া সেই সময়ে কতটা হতো মনে নেই, তবে মনটা বেশ শান্ত হয়ে আরাম পেত। তাই সপ্তাহে দিন তিনেক ওখানেই যেতাম। সেদিনও চলেছি সেই রুটিনে। ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীদের সঙ্গে রেললাইন টপকে মাঝেরহাট ফ্লাইওভারের (অধুনা কুখ্যাত, ওটিই ভেঙ্গে পড়েছিল কিনা!) নীচ দিয়ে ডায়মন্ডহার্বার রোড পেরিয়ে মিন্টএর উল্টোদিকে পেট্রোলপাম্পএর সামনে বাসস্টপ থেকে বাস ধরতাম। গোটা পথটাই আমি ঘোরের মধ্যে চলাফেরা করতাম, নিজেকে নিজের এক্কেবারে ভেতরে কেন্নোর মতো গুটিয়ে রাখা শিখে ফেলেছিলাম সেই সময়। আমার কানে সব শব্দ আসত, চোখে সব দেখতাম – কিন্তু মস্তিষ্কে যেন কিছুই ছাপ ফেলত না! ওই অ্যাক্সন-ডেনড্রেন-নিউরন না আরো কী কী সব যেন শিখেছিলাম ক্লাস টেনে জীবনবিজ্ঞানে, সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা বেশ শিখে ফেলেছি তখন।
প্ল্যাটফর্মের ঢালু বেয়ে রেললাইনে নেমেছি কি নামিনি, একটা শোরগোল আমার সেই স্বআরোপিত উদাসীন বর্ম ভেদ করে ধাক্কা মারল! তাকিয়ে দেখি একটি অল্পবয়েসি (আমার বয়েসিই হবে) মেয়ে রেললাইন পেরোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পাথরের উপর পড়ে গেছে, আর ওর পাশ দিয়ে একজন দু’জন চারজন করে যাত্রীর দল দ্রুত চলে যাচ্ছে নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে… কয়েক সেকেন্ডের একটা দৃশ্য, বা হয়তো তার চেয়েও কম…
আমার একটু আগেই ও রেললাইন পেরোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল, আমি এগিয়ে গিয়েছি ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে। তিন পা এগোতেই রেললাইনের পাথরের উপরে পড়ে-যাওয়া সেই মেয়েটি – কেমন হাতড়ে হাতড়ে উঠে বসতে চেষ্টা করছে। পাশে পড়ে আছে একটা লাঠি। আমি সেটা তুলে ওর দিকে তাকাতেই দেখি – মেয়েটির বসন্তের দাগ-পড়া মুখে কেমন আলগোছে সর্বক্ষণ ফুটে থাকা একচিলতে হাসি… ও ততক্ষণে কুড়িয়ে পেয়ে গেছে ওর কালো চশমাটা। মুখময় সেই অমোঘ হাসিটা নিয়ে চশমা দিয়ে ঢেকে ফেলেছে ওর দৃষ্টিহীন চোখ দু’খানি! হাতের লাঠিটা, যেটা ঠুকে ঠুকে ও নিজের দুনিয়া বুঝে নেয়, সেটা ছিটকে গেছিল, আমি লাঠিটা কুড়িয়ে ওর হাতে দিয়ে ওকে ধরে তুলতে যেতেই… যেন ওর পৃথিবীতে শুধু ওটাই আছে এমন ওই হাসিতে ঝিকমিক করে হেসে সে মেয়ে নির্বিকার বলল, “দেখেছেন, কী বোকার মত পড়ে গেলাম, কাজের সময় এর’ম পড়ে গেলে চলে?”
পারমাণবিক বন্ধনমুক্ত মহামৃত্যুর সেই ‘নভঃস্পৃশ্যং দীপ্তমনেকবর্ণং ব্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম’ কী আমি জানি না; আমি জানি না দ্যুলোকভেদী মহামন্দ্র দুন্দুভিনিনাদ কেমন শোনায়! কিন্তু সেই মধ্য মে-র গনগনে দুপুরে সেই অতিমানবীর কন্ঠস্বর – ‘কাজের সময় এর’ম পড়ে গেলে চলে’ যেন আমার ভুবন জুড়ে বাজতে থাকল। আর সেই মেয়ে অবলীলায় লাঠি ঠুকে ঠুকে লাইন পেরিয়ে উল্টোদিকের একটা চায়ের দোকান থেকে জলের জগ চেয়ে নিয়ে পাথরে ছড়ে-যাওয়া হাতের তালুর রক্ত ধুয়ে নিতে থাকল, যেন কিছুই হয়নি! আমি এক আকাশ প্রেমে স্থানু – স্তব্ধ হয়ে ওকে দেখছি আর দেখছি – ওর মুখে তখনও সেই অহেতুক ঝিলমিলে হাসি!
আজ পঁচিশ বছর পরেও, যখন ‘কাজের সময়’ ‘পড়ে যাই,’ ব্যথা লাগে। অপমান হয়। ধড়ফড় করে উঠে মন ছটফটিয়ে বলে এত চাপ… এই কি জীবন! …পরক্ষণেই কানের পাশে সেই অন্ধ মেয়েটি তার ‘চোখের আলো’ জ্বালিয়ে মুখের সেই হাসি ঝলমলিয়ে বলে ওঠে – “কাজের সময় পড়ে গেলে চলে?”
না রে বোন, পড়ে আমি যাব না।
কিছুতেই না।
তুই থাকতে আমি চোখ-কান-হাত-পা নিয়ে পড়ে যাই কী করে বল?
——
ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আন্তর্জাল