জনৈক টিনের সিপাই এবং অমৃতকাল

জনৈক টিনের সিপাই এবং অমৃতকাল

‘The police was granted the license to enter, arrest and seize any person, scenery, costumes, and or articles whose use or intended use in the performance as prohibited under the terms of the Dramatic Performances Act 1876, had been reasonably established. By this Act, no public performance was to take place in any local area without the sanction of a license.’

(Dramatic Performance Act -1876)

উল্লেখ্য, ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ শাসকের তরফে আর্ল অফ নর্থব্রুক বঙ্গীয় নাট্যমঞ্চকে দলন করার জন্য যে ‘Dramatic Performance Act’ প্রয়োগ করেছিলেন, ১৯৪৭ সালের পরেও তা বাতিল করা হয়নি। উপরন্তু, স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার ব্রিটিশ আইনটির বিভিন্ন ধারা কঠোরতর করে মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। ব্রিটিশ রাজদ্রোহ আইনের মতো ব্রিটিশ নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনও এদেশে পরম গৌরবে টিকে আছে। জন্ম থেকেই এদেশের অমৃতকাল। ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’।

১৯৭০ ছিলো বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসী তাণ্ডবের অন্ধতম অধ্যায়। বিভিন্ন পতাকা হাতে কিছু সুযোগসন্ধানীর হননপিপাসু রাজনৈতিক হঠকারিতা শিখর ছুঁয়েছিল তখন।। অন্যদিকে তাকে দমনের নামে, যাবতীয় শুভবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দালালদের মারণযজ্ঞ। সবার উপরে ‘শুদ্ধতাবাদী’ শিল্পী সাহিত্যিকদের নান্দনিক পলায়নবৃত্তি। সে বড়ো সুখের সময় ছিলো না। আনন্দ তো দূরের কথা। বামপন্থী কর্মীদের মধ্যে চূড়ান্ত রাজনৈতিক সংশয় ও মতাদর্শের সংকট, পারস্পরিক গৃহযুদ্ধ এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বঙ্গীয় সমাজকে প্রায় চূর্ণবিচূর্ণ করছিলো তখন। সামগ্রিক মাৎস্যন্যায় গ্রাস করেছিলো বঙ্গীয় সংস্কৃতি জগৎকে। উৎপল দত্তও কোনও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি মিনার্ভা ছাড়লেন। ‘পিপলস থিয়েটার’ ভেঙ্গে পড়লো। বাংলার যাবতীয় সাংস্কৃতিক সন্ধান ও সংগ্রাম তখন হালভাঙা, পালছেঁড়া নৌকোর মতো দিশেহারা।

মিনার্ভা ছাড়ার পর, টিকে থাকার যুদ্ধে উৎপল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বিবেক নাট্যসমাজ’। প্রয়াসটি সফল হয়নি। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে নতুন নাট্যদল ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ (পি-এল-টি) রেজিস্ট্রি হয়েছিলো। অবশ্য দলটি তার আগে থেকেই নাট্য প্রযোজনা শুরু করে দেয়। ১৯৭১ সালের ১২ই অগস্ট পিপলস লিটল থিয়েটারের নাটক ‘টিনের তলোয়ার’ প্রথম অভিনীত হয়েছিলো কলকাতার রবীন্দ্রসদনে।

‘পি-এল-টি’র স্রষ্টা উৎপল দত্ত তখন বিয়াল্লিশ। তাঁর রাজনৈতিক ও সৃজনশীল জীবন তখন এক কথায় বিভ্রান্ত, দিশেহারা। তাঁর ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, শৈল্পিক জীবন বিপর্যস্ত। নিবেদিত ‘এজিটপ্রপ’ শিল্পী উৎপল দত্ত তখন প্রায় জনবিচ্ছিন্ন। তাঁর জন্য লিটল থিয়েটার গ্রুপ ও মিনার্ভা পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে।

পিএলটি তখনও সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে বিশ শতকের সাত দশকে দুঃস্বপ্নের রাত শিল্পীর স্বাধীনতা গুঁড়িয়ে দেবার জন্য শক্তি সঞ্চয় শুরু করছে। লাগামছাড়া শ্বেত সন্ত্রাস ও প্রতিবাদীদের রক্তস্রোতে ক্লান্ত আর পাঁচটা সংবেদনশীল মানুষের মতো উৎপলের সামনে একটা নতুন পথ খোঁজা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিলো না। বিষণ্ণ এবং একাকী। থাকার মধ্যে ছিলো তাঁর দোর্দণ্ড ব্যক্তিগত ক্যারিশমা। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের প্রধান চরিত্র কাপ্তেন বেণীমাধবের একটা সংলাপে উৎপলের সেই সময়ের মনোভাব নির্ভুল ফুটে উঠেছিলো।

‘…আসলে আমি বড় একা। কেউ কখনো পাশে নেই। দেবতার মতন একা। অভিশাপের মতন, অবজ্ঞার মতন আমি একা।’

উনিশ শতকের ‘নবজাগরণ’ পর্বে আমাদের শিল্পজীবন, বিশেষত নাট্যশিল্প, কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিলো মুৎসুদ্দি শ্রেণির দালালদের কুটিল বাণিজ্য অভিসন্ধির অন্ধকারে। তার উপরে ব্রিটিশ শাসকের নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল প্রযুক্ত হওয়ায় শিল্পমাধ্যমের সব চেয়ে প্রত্যক্ষ শাখা, নাট্যশিল্প চর্চায় বিষম দুর্যোগ ভারতীয় থিয়েটারকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। এই সংকটকালের প্রেক্ষাপটে ‘থিয়েটারওয়ালা’দের লড়ে যাবার গল্প নিয়ে লেখা হয়েছিলো ‘টিনের তলোয়ার’। বহু পরে ঐতিহাসিক সুমিত সরকার বলেছিলেন, অনেক ইতিহাসবিদের থেকে উৎপল ইতিহাসটা ভালো বুঝতেন। ঐ সময়ের লিখিত ইতিহাসেও (‘টিনের তলোয়ারে’র মতো) সমাজের বিচিত্র স্তরবিন্যাস এতো যথার্থভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। মেথর মথুরের তীব্র শ্লেষ ও শ্রেণীঘৃণাজাত সংলাপ যেন উনিশ শতকের ‘নবজাগরণে’র প্রকৃত স্বরূপকে উন্মুক্ত করে দেয়। ‘….এতো নেকাপড়া করে টিনের তলোয়ার বেঁধে ছেলেমানুষি করো কেন?… যা আছো তাই সাজো না। … কই যুবরাজ ছেড়ে আমায় নিয়ে লাটক ফাঁদতে পারবে? হেঃ, চাটুজ্জে বামুনের জাত যাবে তাতে।’

সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,

‘টিনের তলোয়ার’ আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের সর্বোচ্চ শিখর’।

তিনি আরও বলেছিলেন,’ উৎপলের কয়েকটি থিয়েটার দেখা আমার কাছে ‘Phenomenal experience’. ‘সর্বোচ্চ শিখর’ বলতে সত্যজিৎ ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তার রূপরেখা তিনি স্পষ্ট করেছিলেন অন্য একটি সাক্ষাৎকারে।

তাঁর মতে  ‘টিনের তলোয়ার’  বাংলায় একটি প্রথম শ্রেণীর থিয়েটার। তার পূর্বসূরি ছিলো অসীম প্রতিভাশালী শিশির ভাদুড়ির ব্যক্তিকেন্দ্রিক থিয়েটার এবং বিজন ভট্টাচার্যের আইপিটিএ-কেন্দ্রিক সংগ্রামী  থিয়েটারের ভিত্তি। 

বামপন্থী শিল্প চর্চা প্রসঙ্গে সাধারণ জনমনে কয়েকটি ধারণা আছে। যেমন, তার মধ্যে ‘প্রচারধর্মী’ টেমপ্লেট থাকতেই হবে। পথে নেমে ‘বিপ্লব’ করার প্রতি আহ্বান থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। শেষ পর্যন্ত সরলরৈখিক ভাবে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন বিষয়ক সোচ্চার বার্তাও থাকবে। এক কথায় যে ভাবে কোনও ‘ধর্মীয়’ নীতিকথার স্বভাবজ সারমন বিচ্ছুরিত হয়, সে ভাবেই ‘বামপন্থী’ শিল্প রূপায়ণের প্রত্যক্ষ অবলম্বন হয়ে উঠবে প্রচারধর্মিতা। বিড়ম্বনাটি অন্য জায়গায়। প্রচলিত অর্থে ‘বামপন্থী’ শিল্প আদর্শ বলতে বোঝায় দ্বান্দ্বিক শিল্পচেতনা থেকে উঠে আসা সৃজনধর্মী নির্মাণ প্রয়াসগুলি। দ্বান্দ্বিকদর্শন মানুষের ইতিহাসকে সামগ্রিকভাবে বিচার করে। ঘটমান বর্তমানের স্বল্পকালীন বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে এই দর্শনে কোনও অবস্থান নেওয়া হয় না। এই দর্শনে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের যাবতীয় শৈল্পিক নির্ণয়ের সূত্র থাকে ইতিহাসের দৃঢ় ভিত্তিতে। উৎপল এই নীতিটি অনুসরণ করে চলতেন। অধ্যাপক সুমিত সরকার বলেছিলেন উৎপল দত্ত উনিশ শতকের বঙ্গীয় নাট্যশালা ও সামাজিক বস্তুস্থিতির ইতিহাস বিশদে জানতেন। সত্যি কথা বলতে সেকালের নথিবদ্ধ যে ইতিহাস আমরা পেয়ে থাকি সেখানে সমাজের সংখ্যাগুরু মানুষের প্রকৃত বস্তুস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায় না। সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে আড়াল করে যুগটিকে ‘নব জাগরণ-কাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আকুলতা বেশ স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। ‘’টিনের তলোয়ার’ নাটকের ভূমিকায় উৎপল লিখেছিলেন,

‘বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীতে প্রণাম করি সেই আশ্চর্য মানুষগুলিকে যাঁহারা কুষ্ঠগ্রস্ত সমাজের সমাজের কোনও নিয়ম মানেন নাই, সমাজও যাঁহাদের দিয়াছিল অপমান ও লাঞ্ছনা। যাঁহারা মুৎসুদ্দিদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীর মুখোশ টানিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন নাই। যাঁহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয়বেদনাকে দিয়াছিলেন বিদ্রোহমূর্তি। … যাঁহাদের উল্লসিত প্রতিভায় সৃষ্টি হইল বাঙ্গালির নাট্যশালা, জাতির দর্পণ, বিদ্রোহের মুখপাত্র।’

উৎপল দত্তের স্বভাবসিদ্ধ নাট্য নির্মাণের ধারায় ‘টিনের তলোয়ার’ ছিলো এক ব্যতিক্রমী সন্ধান। তিনি সচরাচর স্বল্প সময়ের প্রস্তুতি থেকে নাটক প্রযোজনা করতেন। এমন কি মাত্র দশদিনের মহলার পর মঞ্চে নতুন নাটক নামিয়ে দিতে পারতেন। সে হেন উৎপল ‘টিনের তলোয়ার’ মঞ্চে আনার আগে সুদীর্ঘ ন’মাস মহলা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিলো আবহমান স্বপ্রকাশ মেধার ইশারাগুলি। নাটকটির প্রথম মঞ্চায়নের পর একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের নাট্য আলোচনায় লেখা হয়েছিলো উৎপল, জর্জ বার্নাড শ-য়ের নাটক ‘পিগম্যালিয়ন’ থেকে ভাব আত্মসাৎ করেছেন। কিছুদিন পরে নাটকের অন্য একটি মঞ্চায়নের সময় উৎপল লক্ষ করেন দর্শকদের মধ্যে সেই নাট্য সমালোচক বসে আছেন। তিনি নাটক থামিয়ে মঞ্চের সামনে এসে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘হ্যাঁ, অমুকবাবু আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি পিগম্যালিয়ন থেকে টুকেছি।’ মনে পড়ে যাবে সবজিওয়ালি শংকরীকে অভিনেত্রী ময়নায় রূপান্তরিত করার পর কাপ্তেন বেণীমাধবের সদর্প ঘোষণা, ‘আমি স্রষ্টা। আমি তাল তাল মাটি দিয়ে জীবন্ত প্রতিমা গড়ি। আমি একদিক থেকে ব্রহ্মার সমান।’ বিভিন্ন নাট্যবেত্তারা ‘বেণীমাধব’ চরিত্রের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন শেকসপিয়রের কিং লিয়ার, জাঁ আনুই-এর ‘আন্তিগোনে’র ক্রেয়নকে। দীক্ষিত দর্শকদের মনে পড়ে যাবে ‘হুতোম পেঁচার নকশা’, গিরিশচন্দ্র-বিনোদিনী, মাইকেলের ‘বুড় শালিখের ঘাড়ে রোঁ’, দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’। সর্বোপরি মনে পড়ে যাবে ‘ছোটলোকের কবি’ বের্টোলট ব্রেখটকেও।

‘টিনের তলোয়ার’ শুধুমাত্র একটা নাটকই নয়। উৎপল দত্তের এই সৃষ্টিটি সর্ব অর্থে বঙ্গীয় রঙ্গালয়ের বস্তুনিষ্ঠ আদি ইতিহাস ধরে রেখেছে। বিষয় বৈচিত্র্য, আঙ্গিক, নির্মাণকৌশল ও প্রস্তুতির সমারোহে বহু নাট্যপণ্ডিত ও নাট্যপ্রেমী দর্শকদের কাছে ‘টিনের তলোয়ার’ বাংলা নাটকের সর্বকালের সেরা প্রযোজনা। শ্রেষ্ঠতম ও মহত্তম।

সেটা ছিলো বাহাত্তর সালের এক বসন্তসন্ধ্যা। আমাদের গ্রামে বেঙ্গল ক্লাবে পিএলটির নাটক হবে। নতুন দলের নতুন নাটক। এক ‘নতুন’ উৎপল দত্ত। আমার স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা ঠিক দশ দিন পরে। বাবার উপর দায়িত্ব উৎপল দত্তের সম্বর্ধনা পত্র রচনা ও সেটি মঞ্চে পাঠ করা। বাবা যাবেন। আমি তখন পনেরো। যেতে চাইলাম। বাবা-মা আপত্তি করলেন না। সেকালে স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার মাত্র দশদিন আগে ‘থিয়েটার’ দেখতে যাবার আবদার এককথায় হেরেটিক্যাল বায়না। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম। সেকালের মধ্যবিত্ত বাবা-মায়েদের বিচারে এও বোধ হয় একটা বিপ্লব। সাক্ষী ছিলাম এক নতুন অভিজ্ঞতার। আমার আজীবন নাটক-পাগলামির ভিত্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেই দিন।
বাবার প্রতিষ্ঠার দৌলতে বসেছিলাম একেবারে প্রথম সারিতে। শুরু হতে তখনও আধ ঘন্টা খানেক বাকি। আমি অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে গেছি। ধীরাজদাকে ধরে বললাম, আমাকে একবার উৎপল দত্তের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ধীরাজদা, অর্থাৎ ধীরাজ জানা। আমার দেখা চূড়ান্ত নাটক খ্যাপা একটা মানুষ। জামশেদপুরের লোকের কাছে তাঁর পরিচয় দেওয়া নিরর্থক। উৎপল দত্তের ‘বাড়ির লোক’। টাটা-কলকাতা মান্থলি রেল টিকিট কাটা থাকতো তাঁর। সারা রাত টাটা কারখানায় ডিউটি সেরে ভোর ছটা পাঁচে স্টিল এক্সপ্রেস ধরে সোজা ‘কল্লোল’, উৎপল দত্তের বাড়ি। সেখানেই খাওয়াদাওয়া করে, পিএলটি’র মহলা দেখে, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আবার স্টিল ধরে ফেরা। স্টেশনেই সাইকেল থাকতো। ট্রেন থেকে নেমে সোজা টাটা কারখানার বার্মামাইন্স গেট দিয়ে আবার ডিউটি দিতে ঢুকে যাওয়া। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।

যাঁরা ‘টিনের তলোয়ার’ দেখেছেন, তাঁদের মনে থাকতে পারে। ‘থ্যাটার’ শুরু হবার আগের এক-আধ ঘন্টা কাপ্তেন বেণীমাধব ‘পাগল’ হয়ে যেতেন। এরকম একটা সময়ে ‘গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’র মালিক, তাঁর অন্নদাতা, মুৎসুদ্দি বীরকৃষ্ণ দাঁ কথা বলতে গেলে বেণীমাধব তাঁকে গাল দিয়ে তাড়িয়ে দেন। উৎপল দত্তের নিজের সম্বন্ধেও এরকম শোনা যেতো। নাটক শুরুর ঠিক আগে সই চাইতে গেলে যদি আমারও সেই অবস্থা হয়। ধীরাজদা রীতিমতো চিন্তিত। আমি বলি, আরে তাড়িয়ে দিলে দেবেন না হয়। মারবেন না তো। ধীরাজদা বলেন, তারও ঠিক নেই। তুই আমার পিছনে আয়। খাতা নিয়ে রেডি থাকবি। ইশারা করলে চলে আসবি। স্টেজের বাঁদিকের দরজাটা একটু খালি থাকে। সেখান দিয়েই ধীরাজদার পিছু পিছু ঢুকে যাই। দূর থেকে দেখি একটা চেয়ারে উৎপল দত্ত মেক-আপ নিয়ে বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে শোভা সেন কিছু কথা বলছেন। হঠাৎ ধীরাজদা সামনে পৌঁছে গিয়ে, ‘উৎপলদা, চা খেয়েছেন?’ উৎপল বলেন, একটু হলে হতো। ধীরাজদা রীতিমতো চেঁচামেচি করে, ‘আরে আমি না থাকলে তোরা উৎপলদাকে চা’ও এনে দিস না’, ইত্যাদি শুরু করে দিলেন। চা এলো মাটির ভাঁড়ে। চোখ বুজে চুমুক দিয়ে উৎপল বললেন, বাহ। ধীরাজদা অপাঙ্গে আমাকে ইশারা করলেন। আমি খাতাসহ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, ধীরাজদা স্বভাবসিদ্ধভাবে, ‘বুঝলেন উৎপলদা, এই ছেলেটা একেবারে নাটক-পাগল। আপনাকে দেখতে এসেছে।‘ উৎপল দত্ত চোখ খুলে বললেন, তাই? ধীরাজদা রীতিমতো আমাকে ধমকে, অ্যাই শিবাজি, খাতা আর পেনটা দে না। আমি প্রায় চোখ বুজে পেনটা খুলে, খাতাটা এগিয়ে দিই। তখনকার সব চেয়ে চলতি পেন। চিনে উইন সাং। উৎপল দত্ত কিছু বলেন না। চায়ের ভাঁড়টি নামিয়ে রেখে আমার খাতায় তারিখসহ নাম সই করে দেন। কলমের কালি একটু শুকিয়ে গিয়েছিলো। সইটি দেখলে বোঝা যায়।

সম্বর্ধনা পর্ব চুকে যাবার পর সামান্য বিরতি। ঘন্টা পড়ে, কিন্তু পর্দা সরে না। গাঢ় নীল পর্দা আর ফুটলাইটের সামনে ‘বাংলার গ্যারিক’ কাপ্তেন বেণীমাধব ও মেথর মথুরের প্রবেশ। বিখ্যাত সংলাপ, ‘আপনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য পড়েছেন? উত্তর আসে, ‘আমরা কলকেতার তলায় থাকি’। কথাবার্তার মধ্যে মঞ্চের ডান দিক দিয়ে ময়না অর্থাৎ ছন্দা চট্টোপাধ্যায় প্রবেশ করলেন। ডি শার্প স্কেলে খোলা গলায় ‘ছেড়ে কলকেতা হবো পগার পার…’ পর্দা ধীরে ধীরে সরে গেলো। সঙ্গে বেহালা, কর্নেট, বাঁশি, ঢোলের বৃন্দবাদ্য, সাবেক বাংলা থিয়েটারের আবহসঙ্গীত। সুরেশ দত্তের মঞ্চ, তাপস সেনের আলো, প্রশান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গীত। অভিনয়ে তিনি নিজে ছাড়া শোভা সেন, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিত বসু, সমীর মজুমদার, ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, আরও কতো জন।
সত্যজিতের ভাষায়, শুরু হলো আমারও ‘Phenomenal experience’…

যাঁদের স্মৃতিতে বেঙ্গল ক্লাবের পুরোনো স্টেজ মনে আছে, তাঁরা জানেন। স্টেজের একেবারে গায়ের উপর থেকে চেয়ার পাতা থাকতো। আমার আসন থেকে হাত বাড়ানো দূরত্বে, মঞ্চের এক কোণে উৎপল দত্ত কাপ্তেন বেণীমাধব সেজে একটি চেয়ারে বসে আছেন। মহলা চালানোর অভিনয় করছেন। তাঁর চোখমুখের ভঙ্গি, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, চলাফেরার রাজকীয়তা, আমার পনেরো বছরের চোখকে মুগ্ধ করেছিলো। 

এখানে নাটকের একটি ছবি রয়েছে। ‘গ্রেট বেঙ্গল থিয়েটারে’র মহলার সময় পাড়ার লোকেদের ছোঁড়া ইঁট-পাটকেল বাঁচতে নটদের হাতে থিয়েটারি ঢাল। ‘সমাজপতি’ বামুন নদেরচাঁদের হুংকার আর বেণীমাধবের সংলাপ চলাকালীন নেওয়া হয়েছিলো। আরেকটি ছবিতে রয়েছে তাঁর সেই স্বাক্ষর। আমার খাতায়।

এ দেশের স্বাধীনতা লাভের পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হতে আবার মনে পড়ে গেলো এই ‘স্বাধীনতা’ যাঁরা এনে দিয়েছিলেন, তেমন অনেক অনেক লোকের মধ্যে ছিলেন কাপ্তেন বেণীমাধবের মতো মানুষেরাও। আজ উত্তরাধিকারীরা দেখছে, তাঁদের প্রাপ্য ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় বীরকৃষ্ণ দাঁর মতো মুৎসুদ্দির দল। ইতিহাসের প্রত্যাশা ছিলো আমরা সেইসব দুর্বৃত্তদের অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করবো। আমরা পারিনি। আজ আমরা তাদের রুখতে টিনের তলোয়ার ধরতেও ভুলে গেছি ।

অন্যদিকে ‘টিনের তলোয়ার’ ইতিহাসের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এলো।

শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *