ওপেনহাইমার, পারমাণবিক বোমা, ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ (দ্বিতীয় পর্ব)

ওপেনহাইমার, পারমাণবিক বোমা, ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ (দ্বিতীয় পর্ব)

সুজনদার (দাশগুপ্ত) স্মৃতির উদ্দেশে

শৃঙ্খলি (chain) বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ

অ্যাটমিক নম্বর ও আইসোটোপ

ম্যানহাটন প্রোজেক্ট প্রসঙ্গে নিউক্লীয় ফিশন (nuclear fission) বা কেন্দ্রকীয় বিভাজনের কথা আগে উল্লেখ করেছি। তবে ফিশনের কথা প্রসঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা আগে বলা দরকার: (১) পারমাণবিক সংখ্যা বা অ্যাটমিক নম্বর, এবং (২) আইসোটোপ।

পরমাণুর কেন্দ্রে (nucleus) থাকা প্রোটনের সংখ্যাকে বলে অ্যাটমিক নম্বর। নিউক্লিয়াসের অন্তর্বতী নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু প্রোটনের সংখ্যা বা অ্যাটমিক নম্বর একই থাকে। আইসোটোপ হল একটি মৌলের বৈকল্পিক (variant) রূপ বা আকার। সংজ্ঞা অনুসারে সব আইসোটোপেরই অ্যাটমিক নম্বর এক, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা। যেমন, কার্বন-এর (C) অ্যাটমিক নম্বর ৬। তার মানে, প্রত্যেক কার্বন অ্যাটমের মধ্যে ছ’টি প্রোটন আছে। কিন্তু এতে ৬, ৭, ও ৮-টা নিউট্রন থাকাও সম্ভব। আবার, ইউরেনিয়াম-এর (U) অ্যাটমিক নম্বর ৯২। এই সংখ্যাটা সমস্ত আইসোটোপের বেলায় সমান কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন। ইউরেনিয়াম-এর তিনটি প্রধান আইসোটোপে নিউট্রনের সংখ্যা হল ১৪৬, ১৪৩, এবং ১৪২। যে কোন মৌলিক পদার্থকে এই প্রতীক ব্যবহার করে নির্দেশ করা যায়: , যেখানে A হল ভর সংখ্যা (mass number) = প্রোটনের সংখ্যা + নিউট্রনের সংখ্যা। সুতরাং —

  • U২৩৮: ১৪৬ নিউট্রন
  • U২৩৫: ১৪৩ নিউট্রন
  • U২৩৪: ১৪২ নিউট্রন
নিউক্লীয় ফিশন

এবারে ফিরি ফিশন-এ। পারমাণবিক বিক্রিয়ার সাহায্যে একটা নিউক্লিয়াসকে দুটি কিম্বা একাধিক ছোট ছোট নিউক্লিয়াসে ভেঙ্গে ফেলার পদ্ধতি হল ফিশন। একটা ফিশন প্রক্রিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়। সেই শক্তির তেজ বিদ্যুৎ উৎপাদন (শুভ দিক) বা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে (সংহারক দিক) ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিভাজন বা ফিশন বিক্রিয়া শুরু হয় যখন একটি নিউট্রন কণার ধাক্কায় একটা বিভাজনযোগ্য (fissionable) নিউক্লিয়াস অস্থায়ী অবস্থায় চলে যায়। আচমকা ধাক্কায় মূল নিউক্লিয়াসটি ভেঙ্গে ছোট দুটি নিউক্লিয়াস সৃষ্টি হয়। এই নিউক্লিয়াস দুটি প্রায় একই আয়তনের হলেও আকারের সামান্য তারতম্য থাকা স্বাভাবিক। বিক্রিয়া থেকে একাধিক নিউট্রনেও অনেক সময় তৈরি হতে পারে। এই নিউট্রনগুলো যদি অনেকগুলো নতুন ফিশন বিক্রিয়া আরম্ভ করতে পারে, তবেই চেইন রিঅ্যাকশন বা শৃঙ্খলি বিক্রিয়া শুরু হতে পারে।

ফিশন বিক্রিয়ায় শক্তির উৎস হল ‘নিউক্লিয়ার বাইন্ডিং এনার্জি’ – যা একটি নিউক্লিয়াসকে স্বাভাবিক অবস্থায় ধরে রাখতে পারে। নিউক্লিয়াসটি ভাগ হয়ে গেলে বাইন্ডিং এনার্জি নিঃস্বরিত হয় তাপ এবং বিকিরণের আকারে।

এবার দেখা যাক U২৩৫ এর ফিশন বিক্রিয়াটি কেমন:

চিত্র ৪: নিউক্লিয়ার ফিশন হল পারমাণবিক বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভক্ত হয় ছোট দুটি অংশে। ছবিতে একটি নিউট্রন কণার সঙ্গে একটি U২৩৫ নিউক্লিয়াসের বিক্রিয়া দেখান হয়েছে। ফলে U২৩৫ নিউক্লিয়াসটি ভেঙ্গে তৈরি হয়েছে Ba১৪১ ও Kr৯২ আর সেই সঙ্গে ছিটকে বেরিয়েছে তিনটি নিউট্রন। এই নিউট্রনগুলো পরে অন্য U২৩৫ নিউক্লিয়াসের সঙ্গে নতুন বিক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে চেইন রিয়্যাকশন শুরু করতে পারে।

এখানে U২৩৫ নিউক্লিয়াস একটি নিউট্রনের ধাক্কায় দুটি ছোট নিউক্লিয়াসে (বেরিয়াম-১৪১, Ba১৪১, এবং ক্রিপ্টন-৯২, Kr৯২) বিভক্ত হয়েছে। বিক্রিয়াটি থেকে তিনটি নিউট্রনও নির্গত হয়েছে আর উৎপন্ন হয়েছে ২০০ MeV শক্তি। U২৩৫-এর বিভাজনের সময় Ba১৪১ কিম্বা Kr৯২ সবসময় উৎপন্ন হয় না। তা নির্ভর করে নিউক্লিয়াসটি কী ভাবে ভেঙ্গেছে তার ওপর। এছাড়া অন্য ফিশন প্রোডাক্টও তৈরি হতে পারে, তবে Ba১৪১ এবং Kr৯২ নিউক্লিয়াস দুটোই সবচেয়ে সহজে পাওয়া যায়।

২০০ MeV প্রচুর শক্তি। এই শক্তি কেবল একটিমাত্র বিক্রিয়া থেকে বেরিয়েছে! তাহলে ভেবে দেখুন, একাধিক ফিশন-বিক্রিয়া থেকে কী পরিমাণ শক্তি নির্গত হতে পারে! এই কারণে ফিশন বিক্রিয়াই হল পারমাণবিক বোমার শক্তির উৎস। আবার শৃঙ্খলি বিক্রিয়াকে সেলফ-সাস্টেইনিং বা স্বাবলম্বী করে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। অর্থাৎ, অনিয়ন্ত্রিত ফিশনই হল পারমাণবিক বিস্ফোরণের মূলে। বিভাজন বিক্রিয়ার থেকে নির্গত শক্তি বিদ্যুতে পরিণত করা যায়, মহাকাশযান বা ডুবো জাহাজ চালানতে অথবা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, ইত্যাদি।

নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর বা পারমাণবিক চুল্লি

ফিশনের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হল নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর বা পারমাণবিক চুল্লির কাজ। বিক্রিয়া থেকে উৎপন্ন তাপ জল গরম করে বাষ্পে পরিণত করে। এই বাষ্প টারবাইনের ওপর চালনা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। 

১৯৪২ সালে, পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি প্রথম নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর-এর নকশা পেশ করেন। রিয়্যাক্টর-এর নাম পাইল-১। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফার্মি এটি নির্মাণ করেন। কৃত্রিম চুল্লিটি বানানো হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। নিউক্লীয় বিভাজন আদৌ সম্ভব কিনা দেখানোই ছিল এই প্রকল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য। প্রকল্পের সফলতা পারমাণবিক অস্ত্র ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পথ সুগম করেছিল। পারমাণবিক পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে এ এক বড় অগ্রগতি। এতে বোঝা গেছিল চেইন বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং বিভাজনের শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারও সম্ভব। এই উন্নয়নের প্রভাব সারা বিশ্বে গভীর ভাবে পড়েছে।

অন্যান্য পদার্থবিদ যাঁরা প্রথম নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের নকশায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে লিও সিলার্ড, ওয়াল্টার জিন, এবং হার্বার্ট অ্যান্ডারসন-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এধরনের চুল্লির প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলেন সিলার্ড। শিকাগো পাইল-১-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপনে ফার্মির সঙ্গে তিনিই মুখ্যত কাজ করেছেন। জিন ছিলেন পাইল-১-এর প্রধান প্রকৌশলী। চুল্লি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁরই ওপর। পদার্থবিদ অ্যান্ডারসন-এর অবদান হল পাইল-১-এ নিউট্রন প্রবাহ পরিমাপ করা।

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বহু দেশই এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর ব্যবহার করে। আমেরিকার রিয়্যাক্টারগুলোয় জ্বালানি হিসাবে ফিসাইল আইসোটোপ U২৩৫-এর ব্যবহারের চলই বেশি। অবশ্য অন্য জ্বালানি ব্যবহারও করা হয়েছে – যেমন, প্লুটোনিয়াম-২৩৯ (Pu২৩৯) ও থোরিয়াম-২৩২ (Th২৩২)। এখানকার পারমাণবিক চুল্লিতে সচরাচর ব্যবহৃত জ্বালানিগুলোর শতাংশ নীচের টেবিলতে দেওয়া হল:

প্রকৃতিতে মাত্র ০.৭% U২৩৫ পাওয়া যায়। অতএব, নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে চেইন রিয়্যাকশন বজায় রাখতে গেলে U-আকর (ore) সমৃদ্ধ করে U২৩৫এর পরিমাণ বাড়ানো দরকার। একে বলা হয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ।
 
U সমৃদ্ধ করার দুটি উপায় আছে: (১) গ্যাস ডিফ্ফুসিং বা বিস্তার এবং (২) গ্যাস কেন্দ্রিকরণ (gas centrifugation)। গ্যাস ডিফ্ফুসিং পুরোনো পদ্ধতি। ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড (UF6) গ্যাসকে একটা আধা-ভেদ্য ঝিল্লির মধ্যে দিয়ে চালালে U২৩৫-এর হালকা পরমাণুগুলি সহজেই ঝিল্লির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভারী U২৩৮ পরমাণুগুলো জমা পড়ে ঝিল্লির এক দিকে আর অন্য দিকে বাড়তে থাকে U২৩৫-এর পরিমাণ। গ্যাস সেন্ট্রিফিউগেশন পদ্ধতিটা নতুন এবং পুরোনো গ্যাস ডিফ্ফুসিং পদ্ধতির চেয়ে বেশি কার্যকরী। একটি সেন্ট্রিফিউজে UF6 গ্যাস দ্রুত ভাবে ঘোরালে হালকা U২৩৫ পরমাণুগুলো সেন্ট্রিফিউজের বাইরের দিকে জমা হয় আর ভারী U২৩৮ পরমাণুগুলো থাকে কেন্দ্রের দিকে।
চিত্র ৪-এ দেখানো রিয়্যাক্টরের প্রধান উপাদানগুলির কাজ নীচে বর্ণনা করা হলঃ
 
  • জ্বালানী। বিভাজন বিক্রিয়ায় তাপ উৎপাদন হল জ্বালানীর কাজ। আমেরিকাতে বেশিরভাগ নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরের জ্বালানী হল U২৩৫
  • মডারেটর। মডারেটর এমন উপাদান দিয়ে তৈরি যা বিভাজনের বিক্রিয়া থেকে নিঃসৃত নিউট্রনের কণার গতি কমাতে সাহায্য করে। ফলে কণাগুলো আশেপাশের U-২৩৫ নিউক্লিয়াস নিয়ন্ত্রণে আনে এবং তা সংগ্রহ করতে পারে। সাধারণ মডারেটরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জল, ভারী জল (heavy water), এবং গ্রাফাইট।
  • কন্ট্রোল রড। রিয়াক্টরের মধ্যে চেইন রিয়্যাকশন শুরু হয়ে গেলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। চেইন প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চাই নিয়ন্ত্রণ দণ্ড বা কন্ট্রোল রড। এই রডগুলো নিউট্রন কণাকে সহজেই শুষে নিতে পারে। কণাগুলো যদি অত্যধিক ভাবে U২৩৫ নিউক্লিয়াসের পাশে বন্দি হয়, তাহলে চেইন রিয়্যাকশন আরম্ভ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কন্ট্রোল রডের কাজ হল তা বন্ধ করা।
  • কুলান্ট। কুলান্ট তরল বা গ্যাসীয় হতে পারে। এর কাজ, জ্বালানী থেকে তাপ শুষে নিয়ে বাষ্প জেনারেটরে স্থানান্তরিত করা। সাধারণত, জল এবং ভারী জল কুলান্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

  • বাষ্প উৎপাদক। কুলান্ট থেকে নির্গত তাপ দিয়ে জল বাষ্পে পরিণত করে বাষ্প উৎপাদক। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে বাষ্প দিয়ে টারবাইন চালানো হয়।

এবার ফিশনের উপকারিতা এবং ঝুঁকির কথা বলি। উপকারিতার তালিকা নীচে:

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন;
  • পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি; এবং
  • চিকিৎসায় ইমেজিংয়ের জন্য আইসোটোপ উৎপাদন।
ঝুঁকি:
  • পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি;
  • পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো; ও
  • পারমাণবিক দুর্ঘটনার ফলে বড় রকম বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।
নিঃসন্দেহে ফিশন একটা শক্তিশালী প্রক্রিয়া। তবে তা যথেচ্ছ ব্যবহারের আগে ঝুঁকি আর সুবিধাগুলি বিবেচনা করা দরকার।
 

নিউক্লীয় ফিউশন

ম্যানহাটন প্রোজেক্টের গবেষণায় জানা গেল নিউক্লীয় ফিউশন প্রক্রিয়াও শক্তির উৎস হতে পারে। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে, প্রোজেক্টের একটি আলোচনা সভায় পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফিউশন রিয়্যাক্টর বা ফিউশন চুল্লির কথা প্রথম বলেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শিকাগো শহরে প্রথম ফিশন চুল্লি নির্মাণ প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফার্মি। কিন্তু ফিউশনের শক্তি নিয়ন্ত্রণে আনা এখনো সম্ভব হয়নি। আশা করা যায়, যদি নিয়ন্ত্রিত ভাবে ফিউশন-প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করা বিজ্ঞানীরা আয়ত্ত করতে পারেন, তবে বিশ্বে বিদ্যুৎ উত্পাদনের খরচ অনেকটাই কমে যাবে।
ফিউশন প্রক্রিয়ায় দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু প্রচণ্ড উত্তাপে গলিয়ে একটি হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত করা হয়। সৌরশক্তির মূলে রয়েছে এই ফিউশন প্রক্রিয়া। নক্ষত্রের আলোর উৎসও এই ফিউশনে। হাইড্রোজেনের মতো হালকা দুটি নিউক্লিয়াসকে এভাবে এক সঙ্গে আনলে, বিক্রিয়া থেকে নির্গত হয় প্রচুর শক্তি। কিন্তু ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ সম্পন্ন বলে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। ফলে যে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক ক্ষেত্রটা তৈরি হয়, তার বাধা অতিক্রম করা সহজ নয়। বাইরে থেকে প্রচণ্ড চাপ এবং তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। তবে বিজ্ঞানীরা যদি ফিউশনের জ্বালানিকে এক জায়গায় আবদ্ধ রাখতে পারেন, তবেই প্রতিক্রিয়া থেকে নির্গত শক্তি বিক্রিয়াকে সেলফ-সাস্টেইনিং বা স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে। জ্বালানির (হাইড্রোজেনের দুটি ভারী আইসোটোপ, ডিউটেরিয়াম (D) এবং ট্রিটিয়ামের (T) প্লাজমা মিশ্রণ) ব্যাখ্যা পরে করেছি। তার আগে ভাবতে হবে, সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার থেকে কয়েকগুণ বেশি, প্রায় ১০০ মিলিয়ন কেলভিন, তাপমাত্রার প্লাজমাকে কীভাবে এক জায়গায় ধরে রাখা যায়। আর এই কঠিন কাজের দায়িত্ব থাকে ফিউশন রিয়্যাক্টরের ওপর।
 
ফিউশন রিয়াক্টর
 
ফিউশন বিক্রিয়া দু’ধরনের। প্রথমটির নাম D-T ফিউশন। বিক্রিয়াটি ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়ামের মধ্যে ঘটে। ফলে উৎপন্ন হয় হিলিয়াম (He) এবং একটি নিউট্রন কণা (n):
বাঁ দিকে (প্রতিক্রিয়ার আগে) দুটি প্রোটন এবং তিনটি নিউট্রনের সমষ্টি (নীচের টেবিলে দেখুন)। ডানদিকেও তাই।
 
 
অন্য বিক্রিয়াটি ঘটে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে। অর্থাৎ, তারার দীপ্তির জন্য এই বিক্রিয়াটি দায়ী। দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস জোড়া দিয়ে (fuse) তৈরি হয় ডিউটেরিয়াম (H-H ফিউশন বিক্রিয়া):
 
 
বিক্রিয়ার আগে রয়েছে দুটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস, অর্থাৎ দুটি প্রোটন। পরে, একটি নিউট্রনকে (ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াসের মধ্যে একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন কণার বাস) সঙ্গ দিচ্ছে একটি পজিট্রন (β+) এবং একটি নিউট্রিনো (ν)। শেষের দুটি কণার প্রসঙ্গ এখানে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।
D-T আর H-H ফিউশন দুটিই শক্তি উৎপানকারী প্রক্রিয়া। জার্মান-আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী হ্যান্স বেথে ১৯৩০-এর দশকে H-H ফিউশন প্রক্রিয়াটির বিশেষত্ব শনাক্ত করে বলেছিলেন, এটি নক্ষত্রের আলো ও তাপের উৎস হতে পারে। ফিউশন রিয়্যাক্টরে শক্তি উৎপাদনের মূলে রয়েছে D-T প্রক্রিয়া। এর কারণ দুটি: প্রথমত, ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়ামের মধ্যে বিক্রিয়ার হার প্রোটনের তুলনায় অনেক বেশি; দ্বিতীয়ত, D-T বিক্রিয়া থেকে মোট নির্গত শক্তি H-H বিক্রিয়ার তুলনায় ৪০ গুণ বেশি।
এবার ফিউশন রিয়্যাক্টারের প্রসঙ্গে আসা যাক। এর দুটি নকশা বানানো হয়েছেঃ ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট এবং ইনর্শিয়াল কন্ফিনেমেন্ট।
১) ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট। উতপ্ত প্লাজমাকে একটা সীমিত জায়গার মধ্যে বন্দি রাখতে শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্রের ব্যবহারকে ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট বলে। এ কাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল টোকামাক নামে একটা বিশেষ ধরণের চুল্লি। ডোনাট আকারের চুল্লির মধ্যে রেডিও তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ দিয়ে প্রচণ্ড উতপ্ত প্লাজমাকে আবদ্ধ রাখা হয় একটা শক্তিশালী চৌম্বক জালে। উদ্দেশ্য, প্লাজমাকে দেয়াল স্পর্শ করতে না দেওয়া।
২) ইনর্শিয়াল কন্ফিনেমেন্ট। লেজার বা উচ্চ শক্তি সম্পন্ন পারমাণবিক কণার রশ্মি ব্যবহার করে একটি ছোট পেলেটকে (ফিউশনের জ্বালানি) অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ একটা স্থানে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আটকে রাখার পদ্ধতিকে বলে ইনর্শিয়াল কন্ফিনেমেন্ট। এই অবস্থায় জ্বালানি-পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো এক সঙ্গে জুড়ে (fuse) যায়। ফলে বিক্রিয়াটা থেকে নির্গত হয় অপর্যাপ্ত পরিমাণের শক্তি। এই কাজের জন্য উপযুক্ত রিয়্যাক্টর হল ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি-র (NIF) ইনর্শিয়াল কনফিনমেন্ট রিয়্যাক্টর। ইগনিশন প্রক্রিয়া শুরু করতে, এই যন্ত্র ১৯২-টি লেজার রশ্মি ব্যবহার করে, সীসার ঘনত্বের প্রায় একশ’ গুণ বেশি ঘনত্বে পেলেট সংকুচিত রাখে।
 
এই দু’ধরনের চুল্লির সুবিধা এবং অসুবিধা দুইই আছে। ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট চুল্লি তুলনামূলক ভাবে কম কর্মদক্ষ বা এফিসিয়েন্ট, এবং এগুলোর প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল ও নির্মাণ ব্যয়বহুল। তুলনায় ইনর্শিয়াল কনফাইনমেন্ট রিয়্যাক্টর তৈরি করা সহজ এবং কম ব্যয়বহুল। কিন্তু এগুলি ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট চুল্লির মতো এফিসিয়েন্ট নয়। বর্তমানে ইনর্শিয়াল কনফাইনমেন্ট রিয়্যাক্টর গবেষণা এবং উন্নয়ন পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে কোন প্রযুক্তিটি বেশি সফল হবে তা সুস্পষ্ট নয়। তবে মানবজাতির কল্যাণে দু’ধরণের চুল্লিই অফুরন্ত পরিমাণে পরিচ্ছন্ন শক্তি (clean energy) সরবরাহ করতে পারবে।
 
নীচের টেবিলতে দুটি ফিউশন রিয়্যাক্টরের মুখ্য বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম:
ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট ও টোকামাক বিজ্ঞান
যদি প্লাজমাকে ঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, ফিউসন বিক্রিয়াগুলো থেকে অপর্যাপ্ত শক্তি পাওয়া যাবে। এখন প্রশ্ন হল সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তাপমাত্রার প্লাজমাকে আত্ততে কীভাবে আনা যায়?
মুশকিল হল, মানুষের জানা কোনও মৌলিক পদার্থ এই ধরনের চরম তাপমাত্রা বরদাস্ত করতে পারে না; এমনকি টাংস্টেনের মতো তাপ-প্রতিরোধী ধাতুও না। তাহলে চুল্লি বানানো হবে কী করে? শেষ অবধি যে নকশা বেছে নেওয়া হয়েছিল, তার মূলে রইল ম্যাগনেটিক কন্ফিনেমেন্ট প্রক্রিয়া। একটা শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রর সাহায্যে বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত প্লাজমাকে এমন ভাবে একটা “চৌম্বক বোতলে” ধরে রাখা হয় যে তপ্ত প্লাজমা ফিউশন চেম্বারের দেয়াল স্পর্শ করে না। ১৯৫০ সালে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা টোকামাকের নকশা পেশ করেছিলেন। একটি টরয়েডাল (বা ডোনাট-আকৃতির) পাত্র ব্যবহার করার কথা এঁরাই প্রথম বলেছিলেন (চিত্র ৭)।
 
মোট কথা, প্রক্রিয়াটা সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। প্রচণ্ড তাপে প্লাজমা স্থির অবস্থায় থাকে না। অচিরেই একটা বড়সড় তাপমাত্রার গ্রেডিয়েন্ট তৈরি হয়। ফলে, সৃষ্টি হয় একটা শক্তিশালী কনভেকশন কারেন্ট আর তখন সেই অশান্ত প্লাজমাকে পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন। এই অবস্থাটা অনেকটা ছোটখাটো সোলার ফ্লেয়ারের মতো – প্লাজমাকে অনবরত চেম্বারের দেয়ালের সংস্পর্শে আনার চেষ্টা করতে থাকে ফ্লেয়ার। কৃতকার্য হলে দেয়ালটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনিবার্য। আবার এই অশান্ত পরিস্থিতির জন্য প্লাজমার মধ্যে ইলেকট্রনের শক্তিশালী প্রবাহও তৈরি হয়। ফলে চেম্বারের ক্ল্যাডিং (কভারিং বা লেপ) অসংখ্য ক্ষতচিহ্নে ভরে ওঠা সম্ভব। টোকামাক ডিজাইনারদের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হল এইসব পরিস্থিতি যথাযথ ভাবে মোকাবিলা করা।
 
ইনর্শিয়াল কন্ফিনেমেন্ট ফিউশনের বহু বাধার মধ্যে একটা হল গলিত প্লাজমার প্রভাব সহ্য করতে পারে এমন উপাদান জোগাড় করা। বিশেষ করে যখন ডিউটেরিয়াম-ট্রিটিয়াম ফিউশন প্রক্রিয়ার জন্য একটা উচ্চ-শক্তি-সম্পন্ন নিউট্রনের তীব্র প্রবাহ তৈরি হয়। নিউট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ধাতব দেয়াল এবং ক্ল্যাডিংয়ের গায়ে ক্রমশ ফুটে ওঠে গলে যাওয়া ধাতুর ছোট ছোট অঞ্চল। এই জায়গাগুলোতে দেওয়ালের ধাতু পুনরায় দানা বেঁধে দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ধাতুর পরমাণুগুলি তাদের প্রাথমিক অবস্থান থেকে স্থানান্তরিত হয়। ফিউশন চুল্লির জীবদ্দশায় ক্ল্যাডিংয়ের প্রতিটি পরমাণু একশ’ বারেরও বেশি স্থানচ্যুত হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, ধাতব দেয়ালের গায়ে নিউট্রন সংঘাতের পরিণতি এখনো ভালভাবে জানা যায়নি, কারণ ফিউশন বিক্রিয়ার সময়কাল আজ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি। রিয়্যাক্টর চালাতে হলে ফিউসন বিক্রিয়াকে দীর্ঘস্থায়ী করা দরকার, নয়তো অপর্যাপ্ত বিদ্যুত সরবরাহ হবে না।
 
বিশ্বের বৃহত্তম ফিউশন প্রকল্পের নাম ITER (ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিয়্যাক্টর; ল্যাটিনে ITER মানে “পথ”)। দক্ষিণ ফ্রান্সে অবস্থিত এই প্রকল্পের বিশাল টোকামাক-এর প্লাজমা ব্যাসার্ধ ৬.২ মিটার, ওজন ২৩,০০০ মেট্রিক টন। ITER-এর সমর্থক রাষ্ট্রগুলো হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরিকল্পনা অনুযায়ী সমাপ্ত হলে ITERই হবে প্রথম ফিউশন রিয়্যাক্টর যেখান থেকে ক্রমাগত প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট (MW) বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ২০০৭ সালে এই প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। আশা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে ফিউশন চেম্বারে প্লাজমা উৎপন্ন হবে। দুর্ভাগ্যবশত ITER প্রকল্পের কাজ বারবার দেরি হয়েছে। ফলে ৫.৪৫ বিলিয়ন ডলার নির্মাণের বাজেট বেড়ে চতুর্গুণ হয়েছে। প্রকল্পের নেতারা সম্প্রতি আরও বিলম্বের সম্ভাবনা ঘোষণা করেছেন। আশা ছিল ২০৩৫ সাল নাগাদ রিয়্যাক্টরটা কাজ করতে সক্ষম হবে। এখন মনে হচ্ছে তা ২০৪০-এর দশকে আগে হবে না। মনে রাখতে হবে ITER-এর উদ্দেশ্য বাণিজ্যের জন্যে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা নয়। এটি একটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস। প্রথম থেকেই এর উদ্দেশ্য ফিউশন প্রযুক্তি রুপায়িত করতে বিজ্ঞানীরা যেসব প্রযুক্তি জড়িত সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তা সমাধান করা। এবং সেই সঙ্গে একটি কার্যকর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পথ সুগম করা।
 
ইনর্শিয়াল কন্ফিনেমেন্ট গবেষণার অবস্থা
সম্প্রতি (ডিসেম্বর ২০২২), ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটির (NIF) বিজ্ঞানীরা ফিউশন প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছেন। পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা যে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি করেছেন, তার নাম ইগনিশন।
মটরের সাইজের সোনার তৈরি একটি নলাকার ক্যাপসুলের মধ্যে রাখা হয়েছে একটি ছোটো পেলেট। হিমায়িত এই পেলেট হাইড্রোজেনের জোড়া আইসোটোপ, ডিউটেরিয়াম, আর ট্রিটিয়াম, দিয়ে তৈরি। পেলেটটিকে ২.০৫ মেগাজুল শক্তি সম্পন্ন ১৯২-টি লেজার বিমের সংস্পর্শে আনা হয়েছে। লেজার শক্তির স্পন্দনে পেলেটটা সম্পূর্ণ ভাবে “বিনষ্ট” হয়েছিল। ক্যাপসুলটিকে যে তাপমাত্রায় আনা হয়েছে তা কেবলমাত্র একটা নক্ষত্রের ভেতরে কিম্বা থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রের প্রয়োগেই সম্ভব। প্রচণ্ড তাপে হাইড্রোজেন আইসোটোপগুলি ফিউজ করে গিয়ে তৈরি হয় হিলিয়াম।
 
প্রক্রিয়াটা শুরু করার জন্য যতটা শক্তি দরকার ছিল, শেষ হবার পর নির্গত হল তার থেকেও বেশি। আর মুক্ত হল একাধিক ফিউশন বিক্রিয়ার ঝরনা। বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, বিক্রিয়াটি থেকে প্রায় ৩.১৫ মেগাজুল বাড়তি শক্তি নির্গত হয়েছে (পেলেটের উপর ২.০৫ মেগাজুল শক্তি লেজার বিম দেওয়া হয়েছিল)। অর্থাৎ, উৎপাদিত শক্তি বাইরের থেকে প্রদান করা শক্তির থেকে প্রায় ৫৪ শতাংশ বেশি। এই কারণেই মনে হয় পরীক্ষাটিতে ইগনিশনের পরিবেশ সত্যিই সৃষ্টি করা গিয়েছিল। ফিউশন বিক্রিয়ার এটি একটি বিশেষ সন্ধিক্ষণ। গবেষকরা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন পরীক্ষাগারে ফিউশন-এর ইগনিশন সৃষ্টি করা সম্ভব। এই গুরুত্বপূর্ণ সূচক ভবিষ্যতের ফিউশন পাওয়ার প্ল্যান্টের আবির্ভাবের পথ প্রশস্ত করেছে। কিন্তু কৃতকার্য হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন ফিউশন রিঅ্যাক্টরের প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হতে এখনো দেরি আছে। প্রথমত, ফিউশন বিক্রিয়ার কার্যকারিতা বহু মাত্রায় বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফিউশন পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ ও পরিচালনার প্রযুক্তিগত বাধাগুলি এক-এক করে অতিক্রম করতে হবে।
 
NIF-এর পরীক্ষাটি সত্যতার একটা প্রমাণ বলা চলে। কিন্তু এর ফলাফল বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ফিউশন শক্তি উৎপাদনে কী ভাবে কাজে লাগানো হবে তা এখনও স্পষ্ট নয় । বলা বাহুল্য বিশ্বের অন্যান্য ফিউশন গবেষণা কেন্দ্রগুলোর লক্ষ্যও ইগনিশন প্রক্রিয়ার কাজে লাগানো। এখন পুরোদমে তাই নিয়ে কাজ চলছে। ফিউশন শক্তির কারখানা স্থাপন একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তবে নিঃসন্দেহ NIF-এর ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ফিউশন যে একদিন পরিচ্ছন্ন শক্তির (clean energy) একটা উৎস হবে, সে বিশ্বাস NIF-এর গবেষকরা জোরদার করছেন।
 
ইতিমধ্যে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে, ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা ডিসেম্বরের পরীক্ষাটির থেকেও বেশি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও ফিউশন ব্যবহার করে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনও নাগালের বাইরে, পরিষ্কার এবং প্রায় অপর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তির সন্ধানে এই পরীক্ষাটি একটা বড় পদক্ষেপ।
 
জুলাই মাসের গবেষনায়, আগের বারের মতো সমান সংখ্যক লেজার বিম (১৯২) ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এবারে ফোকাস পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, ফলে শক্তির ফলন বেড়েছে। এই প্রবন্ধ লেখার সময় গবেষকেরা তাঁদের তথ্য বিশ্লেষণের কাজ পুরোপুরি শেষ করেননি। তবু প্রায় ৫৯ মেগাজুল বাড়তি শক্তি (ডিসেম্বরের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি) উৎপন্ন করা যে সম্ভব হয়েছিল, বিজ্ঞানীরা তা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন।
 

শেষের কথা

হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বোমা বর্ষণে ওপেনহাইমার নিজের ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তিনি পরে স্বীকার করেন বোমার তৈরিতে যে সব পদার্থবিদরা মেতেছিলেন, তাঁরা এই গবেষণার পাপের জালে আবদ্ধ হয়েছেন। নিজেকেও এই অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই দেননি। কিন্তু যে জ্ঞানের জানলা তাঁরা খুলেছিলেন, তা আবার বন্ধ করলে চলবে না।
 
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর (AI) জগতে ওই রকম এক মোড়ে এসে পৌঁছেছি আমরা। বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)। ‘মেশিন লার্নিং’ (ML) নামে এক ধরনের AI-অ্যালগরিদমের (কোন গণনা বা কম্পিউটার প্রোগ্রামকে অনুসরণ করার নিয়মের সেট-কে অ্যালগরিদম বলে) ব্যবহার ইদানিং খুব জনপ্রিয় হয়েছে। ML-এর বিশেষত্ব হল ঐতিহাসিক তথ্য ব্যবহার করে নির্ভুল ‘আউটপুট’ (বা ভবিষ্যৎ আচরণ) স্বয়ংক্রিয় ভাবে অনুমান করা (মানুষের সাহায্য ছাড়া)। বলা বাহুল্য এ বিষয়ে গবেষণা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শক্তিশালী প্রয়োগপন্থা। আশা করা যায় ক্রমশ এই ব্যবহারিক প্রয়োগ মানুষের জটিলতম সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ইতিমধ্যে AI-প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রখর প্রভাব ফেলেছে। তবে এই প্রযুক্তি ক্ষতিকারক দিকও আছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বহু উপযোগিতা থাকা সত্বেও, AI-কে মানবকল্যাণে ব্যবহার করার বদলে দুর্বৃত্তরা বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
 
এখন প্রশ্ন হল, AI গবেষণা লাগামহীন ভাবে চলতে দেওয়া কি উচিত? AI-এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলি পুরোপুরি বিশ্লেষণ না করেই কিছু বিশেষজ্ঞ এ সম্পর্কে গবেষণা স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। আবার অনেকে মনে করেন, যদি এই প্রযুক্তির বিকাশ দায়িত্বপূর্ণ ভাবে সংগঠিত হলে AI-কে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা যেতে পারে । AI-এর সমাধান মানবিক মূল্যবোধকে যাতে লঙ্ঘন না করে, সেই ব্যাপারেও আমাদের তৎপর থাকতে হবে।
 
সম্প্রতি একটা খবরে জানা গেছে, সিলিকন ভ্যালির ইঞ্জিনিয়াররা AI-এর সামরিক অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কাজ করতে নারাজ। অবশ্য ওঁরা কাজ বন্ধ করলেও অন্য দেশ এই গবেষণা চালিয়ে যাবে। অনেকের কাছে এই অনিচ্ছা উদ্বেগজনক, বিশেষত যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। AI-গবেষণায় আধিপত্য না থাকলে দুর্বৃত্ত ঠেকানো যাবে না।
এমনই মনোবৃত্তি কাজ করেছিল ৭৮ বছর আগে! ম্যানহাটন প্রোজেক্টের গবেষণায় নিযুক্ত বিজ্ঞানীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নাৎসিদের সামরিক বিস্তার ঠেকানো। তাঁরা স্তম্ভিত হলেন যখন ধূলিসাৎ হল হিরোশিমা আর নাগাসাকি। AI জগতে একই পরিস্থিতি আসন্ন। এখনই সাবধান না হলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়াও অসম্ভব নয়। পরমাণু বোমার বিস্ফোরণের পর মানুষের শুভ চেতনায় গড়ে উঠেছিল নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক ভাবে তা সফল হয়েছে। এর ফলে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কে জনমত গড়ে উঠেছে। তাই আজ ভাবার সময় হয়েছে কী ভাবে AI প্রযুক্তিকে সুপথে চালনা করা যেতে পারে।
কৌশিক সেনগুপ্ত একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু প্রশিক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে। প্যাশন হল পপুলার লেভেলে এ বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের SUNY-বাফেলো এবং লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন বহু নামি আন্তর্জাতিক জার্নালে। আর সহযোগিতা করেছেন সর্বদেশীয় এবং NASA বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন গাণিতিক কম্পিউটিং এবং সফটওয়্যার ডিজাইনে। অবশেষে IBM সংস্থায় যোগদান এবং অবসর গ্রহণের পর ফুল টাইম লেখার কাজে হাত। প্রথম বই, 'Are We Alone? Humankind's search for extraterrestrial civilizations।' মহাবিশ্বে আমরা একা কিনা, অর্থাৎ মানবসদৃশ আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কিনা, সে সব প্রাচীন প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রয়াসের কথা এই বইয়ের বিষয়।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Joana Schmitt , February 10, 2024 @ 2:13 am

    Its like you read my mind You appear to know so much about this like you wrote the book in it or something I think that you can do with a few pics to drive the message home a little bit but other than that this is fantastic blog A great read Ill certainly be back

  • Milania Robinson , February 10, 2024 @ 5:37 pm

    I loved as much as you’ll receive carried out right here. The sketch is tasteful, your authored material stylish. nonetheless, you command get bought an nervousness over that you wish be delivering the following. unwell unquestionably come more formerly again since exactly the same nearly a lot often inside case you shield this hike.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *