গুঁতোকাত
গণিতের গুঁতোয় কুপোকাত কম বেশি কে না হয়েছে? যত গণিতের মাস্টারমশাইকে আমি গুঁতোকাত হতে দেখেছি, তেমনটা কোনও ছাত্রকে দেখিনি, সত্যি বলছি। তেমন কিছু অঙ্কের মাস্টারমশাইদের কথা বলব বলেই এ বিষয়ের অবতারণা। আমার মনে কোনওই সন্দেহ নেই, এ গুঁতোয় সর্বাপেক্ষা আহত হয়েছেন আমাদের পাড়ার সাধুনাথবাবু। তবে তাঁর কথা বলবার আগে না দেখা আরেকজন গণিতশিক্ষকের কথা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না।
গল্পটা আমার বন্ধু অর্জুনের কাছে শোনা। তার ছেলেবেলার প্রাইভেট টিউটর আজীবন অকৃতদার রয়ে গেলেন, সে তো অঙ্কের গুঁতোতেই, না কি? আরেকটু খোলসা করার আগে অন্য একটা ঘটনা বললে তাঁর চরিত্র চিত্রায়ন কিছুটা সহজ হবে। একবার নাকি অর্জুন তাঁকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল। সেই ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক তাহলে।
গড়িয়া স্টেশনে স্যারকে নিয়ে রেললাইন পার হতে হতে অর্জুনের কানে এল আশেপাশের মানুষজনের চিৎকার। অর্জুন হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখে স্যার নেই। সে কী কথা, স্যার কোথায়? আশেপাশে একটু চোখ বোলাতেই ওর চক্ষু চড়কগাছ! লাইনে ট্রেন ঢুকছে। অথচ সেই লাইনের ওপরেই, কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে স্যার যেন মাথা নিচু করে কী সব এলোপাথাড়ি কাগজ কুড়িয়ে চলেছেন। কাঁধের ঝোলাব্যাগে যত কাগজ কুড়িয়ে ভরছেন, তা থেকে বেরিয়ে আসছে তার চেয়েও বেশি প্রতিবাদী কাগজের মেলা। ঐ কাগজগুলো অর্জুনের হাতের তালুর মতন চেনা। স্যারের ছাত্রদের জন্য মনগড়া, বংশদণ্ড সদৃশ অঙ্কগুলো ঐ ব্যাগের মধ্যেই আশ্রয় পায়।
স্যারকে এই মুহূর্তে বাঁচাতে গেলে অর্জুনের প্রাণসংশয়। তবু গুরুদক্ষিণার এত বড় সুযোগ ছাড়াও যায় না। কোনরকমে কাছে পৌঁছে অর্জুন স্যারকে মারল এক মোক্ষম ধাক্কা। স্যার বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু ট্রেনের চাকার নীচে নিজেদের মিশিয়ে দিয়ে মুক্তি পেল অনেক কাগজ। আর অর্জুন?
অর্জুনের আশা ছিল ট্রেন চলে যাবার পর স্যার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। কিন্তু কোথায় কী? উল্টে গালের ওপর এসে পড়ল বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়, সঙ্গে এক ঘৃণাজর্জরিত কণ্ঠস্বর, “তোর জন্য আমার কতগুলো অঙ্ক ট্রেনের তলায় হারিয়ে গেল জানিস?”
তো এই স্যারেরই নাকি বহুদিন বিয়ে থা’র ইচ্ছে ছিল না। ঘরওয়ালি, বাহারওয়ালি সবই ঐ অঙ্ক। তা বললে কী আর বসন্ত জীবনে উঁকি দেবে না? স্যারের জীবনেও দিয়েছিল বইকি। এক কন্যেকে দেখে এমন পাগলপারা অবস্থা যে স্যার এসে মনের কথা অকপটে জানিয়ে ফেললেন নিজের মা’কে। শুনে মা তো একেবারে আনন্দে আত্মহারা। ছেলেকে নিয়ে পাকা কথা বলতে হাজির হলেন মেয়ের বাড়িতে।
স্যার নত মস্তকে ঘরের ভিতর কথা বলছেন হবু পত্নীর সঙ্গে। একটু বাদে হন্তদন্ত হয়ে সেই হবু পত্নী ভদ্রমহিলা এসে খবর দিলেন যে, বাথরুমে যাবার নাম করে স্যার নাকি পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছেন। দরজায় একটুকরো কাগজ কাঠের টুকরো দিয়ে ঢাকা দেওয়া। সেই কাগজে লেখা, “এ বিয়েতে আমার মত নেই।”
তাই বলে কি এ ঘটনার পর স্যারের মনে বিন্দুমাত্র দুঃখ হবে না? হয়েছিল বইকি। আর সে দুঃখ কমাতেই ফেরার পথে অর্জুনকে খেলার মাঠ থেকে প্রায় অপহরণ করে, ছুটির দিনে এক্সট্রা ক্লাস করাচ্ছিলেন স্যার।
চরম অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরে স্যারের মা দেখেন স্যার পড়াচ্ছেন ছাত্র অর্জুনকে। ছেলের মান অপমানের তোয়াক্কা না করে কষালেন গালে এক চড়। অর্জুন তো এসব দেখে আনন্দে আত্মহারা! এই হয়েছে ঠিক প্রতিশোধ। স্যার কিছুক্ষন গালে হাতটাত ঘষে মাকে জানালেন, “যে বাড়িতে কেশব চন্দ্র নাগের বই নেই , সে বাড়িতে আমি বিয়ে করব না।”
এবার সময় হয়েছে সাধুনাথবাবুর কথায় আসার। পাড়ার এমন কোনও ছেলে মেয়ে নেই যারা ওঁকে চেনে না। যখন তখন অঙ্কের সমাধানে মাথাব্যথা হলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পৌঁছে যাওয়া যায় তাঁর বাড়ি। সে অঙ্কের সমাধান হবেই হবে। কিন্তু ঐ যে, অঙ্কের গুঁতোয় এমনই কুপোকাত তিনি যে জীবনের অঙ্কে প্রায়শই উত্তরে ভুলচুক করে ফেলেন। এই যেমন, সেই ঘটনাটার কথাই ধরা যাক।
রবিবারের সকালবেলায় কচি পাঁঠার মাংস কিনে বাজারের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে মনের খুশিতে বাড়ি ফিরছি । রাস্তায় দেখা সাধুনাথবাবুর সঙ্গে। হাতে একখানা পিঁড়ি নিয়ে যথারীতি কী যেন ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন। কলকাতায় এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে বসতে হলে নিজের একটা পিঁড়ি নিয়ে যেতে হয়। অতএব একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, “স্যার কোথায় যাচ্ছেন?”
প্রথমটায় এমনভাবে তাকালেন আমার দিকে যেন চিনতেই পারেননি। তারপর বললেন, “কেন, বাজার?”
“কিন্তু আপনার হাতে ওটা…?”- আমার অবাক প্রশ্ন ।
এবার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে তিনিও চমকালেন, “এই দেখেছ কাণ্ড? আসার আগে আমার ছোট মেয়ে এমন একটা অঙ্ক জিগ্যেস করল, সেটা ভাবতে ভাবতেই বাজারের ব্যাগের বদলে… কী কাণ্ড বল দেখি!”
তিনি হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। তারপর আবার কী মনে হতে দু’পা পিছিয়ে এসে আমায় বলে গেলেন, “এসব কথা যেন পাঁচকান কোরো না, কেমন?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম এবং একেবারেই কথার খেলাপ করিনি। তবে কিনা ব্যস্ত রাস্তায় কানের সংখ্যা, এবং মুখের সংখ্যা কোনটাই কম নয়। তেমনই কোনও কান ও মুখের দৌলতে এ কথা সারা পাড়ার লোকেরই জানা হয়ে গেল, অল্প সময়ের মধ্যেই।
এই সাধুনাথ বাবুর সঙ্গেই কিছুদিন আগে এক জামাকাপড়ের দোকানে দেখা। চিরটাকাল ওঁকে মোটামুটি দু-তিনখানা জামাকাপড়েই দেখেছি। অথচ সেদিন ভদ্রলোক গোটা দুয়েক প্যান্ট নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে। কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার স্যার, শুধু প্যান্ট কিনলেন, জামা কই?”
তিনি অমায়িক স্বরে বললেন, “আর বোলো না। আমি তো জামা বা প্যান্ট, কোনটাই খুব বেশি কিনি না। মেয়ের বাড়ি যাব, আমেরিকা। আর তার আগেই একটা কাণ্ড ঘটল। আমার বেল্টটা যে কর্পূরের মতো কোথায় উবে গেল? তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। বলব আর কী, বেল্ট ছাড়া তো প্যান্টগুলো ফিট হয় না ভালো করে। তাই একটু ছোট কোমরের প্যান্ট কিনতে এসেছি।”
“সে তো ভালো কথা স্যার, কিন্তু আপনি শুধু একটা নতুন বেল্ট কিনলেও তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত!”
“দেখেছ কাণ্ড, এই সহজ ব্যাপারটা মাথায় আসেনি কেন বল দেখি? যাই, প্যান্টগুলো রেখে দিয়ে একটা বেল্ট নিয়ে আসি।”
আমি রে রে করে উঠলাম, “আহা, তা কেন? তা কেন? বেল্টটাও কিনুন, প্যান্টদুটোও না হয় কিনে নিন। অতো দূর দেশে যাবেন, দু’একখানা বেশি থাকলে ক্ষতি কী? ওখানে তো আবার ডলারে কিনতে হবে!”
এটা আমি সবসময় খেয়াল করেছি, অঙ্কের মাস্টাররা সংসারের অন্যান্য ক্ষেত্রে অঙ্কে খারাপ ছেলেমেয়েদের কথা মেনে চলতে পছন্দ করেন। এ ব্যাপারেও সাধুনাথবাবু তার ব্যতিক্রম হলেন না। বেল্টের সঙ্গে প্যান্টদুটোও কিনে ফেললেন।
তাঁর এই আমেরিকা সফর সম্পর্কেই আরেকটি কথা কীভাবে যেন রটে গিয়েছিল।
ওখানকার এক কালীমন্দিরে গিয়েছিলেন সাধুনাথবাবু, মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে। সে মন্দির সামলান এক বাঙালি পুরোহিত একলাই, একেবারে রাজার মতো। ঠাকুরের পুজোর পাশাপাশি ভোগ রান্না, মন্দিরের কাজকর্ম সবকিছুতে একাই কান্ডারী। সেসব দেখে সাধুনাথবাবু মুগ্ধ। কিন্তু এমন ফাঁকা জায়গায় মন্দিরে একলা যে নির্ভয়ে থাকা যায়, এটা যেন তাঁর ঠিক হজম হয়নি! এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সাধুনাথবাবুর ভূতের ভয় প্রবল। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, “এখানে আপনি একাই থাকেন?”
পুরোহিত হেসে উত্তর দিলেন, “আহা, একলা কোথায়? মা তো আছেন।”
সাধুনাথবাবু কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মন্দিরটা আপন মনে খানিক ঘুরে এলেন। তবু কী যেন একটা জিজ্ঞাসা মনে। তারপর বাড়ি ফেরার পথে মেয়ে জামাইকে সরল মনে প্রশ্ন করলেন, “সারা মন্দিরে ঘুরে এলাম, কই পুরোহিতের মা’কে তো দেখতে পেলাম না?”
শুনেছি এ প্রশ্ন শুনে জামাইবাবাজিকে দুর্ঘটনা এড়াতে হাইওয়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হেসে নিতে হয়েছিল।
ঘটনাচক্রে সাধুনাথবাবু ছিলেন রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এর গুরুত্ব হল এই যে তিনি কারোর দরকার পড়লে অ্যাটেস্টেশন করতে পারতেন। সে সময়ে হামেশাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে গেজেটেড অফিসারকৃত অ্যাটেস্টেশনের প্রয়োজন পড়ত। এমনই এক প্রয়োজনে আমার শ্যালিকা, টুটুল, একবার গেল সাধুনাথবাবুর কাছে ।
বাড়ির বাইরের যে ঘরটায় সাধুনাথবাবু ছাত্র পড়াতেন, সেখানেই তাঁকে পাওয়া গেল। একা বসে একখানা কাগজে কীসব আঁকিবুঁকি কাটছেন। কোনও বিশেষ অঙ্কের সমাধানে ব্যস্ত ভেবে সেও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছু সময় পর সাধুনাথবাবু মুখ তুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ওনার চোখে জিজ্ঞাসা বুঝতে পেরে সে বলল, “আমি টুটুল, অর্ণবদার শালি। আপনার কাছে আগেও কয়েকবার এসেছি। এই কয়েকটা ডকুমেন্ট অ্যাটেস্টেড করানোর ছিল। আপনার কি সময় হবে? না’হলে পরে আসব। ”
“আরে না না, তোমায় চিনি না? অর্ণবের শালি বলে কথা! দাঁড়াও, আমার স্ট্যাম্প আর কালিটা নিয়ে আসি।”
কিছুক্ষণের মধ্যে সে কাজ সম্পন্ন করে ফটোকপি এবং অরিজিনাল ডকুমেন্টগুলো টুটুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাধুনাথবাবু বললেন, “একবার চেক করে নাও।” একথা বলে আবার তিনি কাগজে আঁকিবুঁকি কাটায় মন দিলেন।
টুটুল সব আবার ফাইলে গুছিয়ে নিচ্ছে, এমন সময় সাধুনাথবাবু মুখ তুলে বললেন, “আচ্ছা, তুমি যেন কার মেয়ে বললে?”
টুটুল অবাক চোখে তাকিয়ে কিছু বলবে বলে মুখ খুলছে, হঠাৎ নিজের ছোটমেয়ের নাম ধরে ডেকে উঠলেন তিনি, “পিকু, তোর অঙ্কটা হয়ে গেছে?” এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। টুটুলও আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে বাড়ির পথে রওনা দিল ।
সাধুনাথবাবুদের আসলে অঙ্কের জগতেই বিচরণ। তাই সংসারের অঙ্কে হয়তো সাধু সন্ন্যাসী হয়ে থাকাতেই ওঁদের সার্থকতা। অন্দরমহলে এই নিয়ে অসন্তোষ যে কম থাকে তা নয়, কিন্তু মানুষগুলোকে বাদ দিয়ে চলা যায় না। কথার মাঝে এক আধবার তাঁরা উঠে আসবেনই আসবেন। আমরাও যেন চাই ওঁরা নিজেদের চলন বলন দিয়ে গল্প বলে যান আজীবন। আমাদের অনেক কথার মাঝে হঠাৎ উদয় হয়ে হাসি ফুটিয়ে যান অনেক ঠোঁটে।