শব্দ সংখ্যা

শব্দ সংখ্যা

শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তাঁর, ‘পেতে শুয়েছি শব্দ’ কবিতায় লিখেছিলেন, “শব্দ হাতে পেলেই আমি খরচা করে ফেলি।” ওঁর মতো মহাকবি শব্দ পেতে শুয়ে পড়তে পারেন, হাতে পেলেই খরচাও করতে পারেন, তাতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ সাহিত্যপ্রেমী, সামান্য লেখালেখি করি, তাদের সে বিলাসিতা মানায় না। তাদের সর্বদা সম্পাদকের বেঁধে দেওয়া শব্দ সংখ্যার ভ্রূকুটি মাথায় রেখেই নিজের সাহিত্যসাধনা চালিয়ে যেতে হবে এবং ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, সেটা বিশেষ সহজ কাজ নয়।

ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, শব্দ সংখ্যার সীমাবদ্ধতা ব্যাপারটি আমার ঘোরতর অপছন্দ এবং সবথেকে বেশি আমার লেখালেখিকে প্রভাবিত করে। সব পত্রিকাতেই শব্দ সংখ্যা বেঁধে দেওয়া আছে, এক এক পত্রিকার এক একরকম বায়নাক্কা, ফলে লিখতে বসে যেটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়, সেটি হল, ‘শব্দ’ এবং ওইখানেই লেখা জব্দ। লেখা যখন নিজের গতি নেয়, তখনই আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি, গেল রে, এ বার শব্দ সংখ্যা পেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে! শব্দে লাগাম পরাতে গিয়ে লেখা হয়ে যায় বেলাইন। লেখা আর লেখা থাকে না, হয়ে যায় শব্দ গণনার খেলা, খানিকটা লেখার পরেই শব্দ গুনতে বসি। মসীলিপি, অসি হয়ে ওঠার বদলে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে খসি, বাঁশি হয়ে বাজার বদলে হয়ে যায় পচা-বাসি, লিখি এবং মুছে ফেলি, তারপর ভাবতে বসি, কেন লিখলাম এবং কেন মুছলাম, কোমরের কসি, বাঁধি কষি এবং পুনরায় কোষ সব উজ্জীবিত করি, কোষাকুষি নিয়ে চষি মগজে যা আছে, কিন্তু সে কতক্ষণ আর, আবার ভাবি একটু গুনে দেখা যাক শব্দ সংখ্যা কত হল, হাতে ওই পেন্সিলের মতো থাকে শুধু শব্দ সংখ্যা, সে কেবলই শব্দ করে আর্তনাদের, তাতে মধুর নীরব বাণীটি নেই। যে শব্দ শুধু অনন্ত নক্ষত্রলোকে ভেসে যায়, যে শব্দ শুধু অনুভবে আসে, যে শব্দ মিশে থাকে বৃষ্টিপাতের মূর্ছনায়, সে শব্দ বারংবার গুনতিতে অনেক আগেই পগারপার হয়েছে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে। আমি তাকে খুঁজে চলেছি।

এবং খুঁজতে খুঁজতে সেই শ্রদ্ধেয় মহাকবির কবিতার কাছেই ফিরে যাই। ‘যেভাবে শব্দকে জানি’ কবিতায় শক্তি লিখছেন, “শব্দ গুলিসুতো, তাকে সীমাবদ্ধ আকাশে ভাসাতে আমার পেটকাটি চাই,—-”

লিখতে বসে এই সীমাবদ্ধ আকাশকে চেনা খুব জরুরি, কারণ সম্পাদকেরও হাত-পা বাঁধা, একটি পত্রিকা চালাতে গেলে লেখককে শব্দ সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছাড়া সম্পাদকের উপায় নেই। তাঁকে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনির মতো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে পত্রিকায় স্থান দিতে হবে, বিভিন্ন পাঠকের বিভিন্ন প্রকার রুচির প্রতি সম্পাদককে নজর রাখতে হয়, নয়তো পাঠক বিরূপ হবেন, পত্রিকার বিক্রি হবে না, আর লালবাতি জ্বেলে পত্রিকা উঠে গেলে, লেখক মহোদয় লিখবেন কোথায়? আপনি তো শক্তি চট্টোপাধ্যায় নন। না-না, রাগ করবেন না, ভবিষ্যতে আপনি একজন সুনীল বা শক্তি হয়ে উঠতেই পারেন, তবে তার জন্য তো আগে লিখে হাত পাকাতে হবে আর সেটা শব্দ সংখ্যা মেনেই করতে হবে, তাই আমি যতই শব্দ সংখ্যা নিয়ে হা-হুতাশ করি না কেন, আপনারা সে ভুল করবেন না। 

এখন আমি গদ্যে, শব্দ সংখ্যার সীমাবদ্ধতার মধ্যে সাহিত্যকর্ম বজায় রাখা সম্বন্ধে সামান্য কয়েকটি কথা বলে এই নিবন্ধ শেষ করব। কারণ, এখানেও তো সেই শব্দ সংখ্যার সীমারেখা টানা আছে।

প্রথমেই মাথায় রাখবেন, ভাষা হতে হবে নির্মেদ, সংযত। আমার এই লেখায়, নিজে সে কাজে ব্যর্থ হয়েছি বটে, তবে আপনি যখন অদূর ভবিষ্যতে একজন মহীরুহে পরিণত হবেন, যখন প্রকাশক-সম্পাদকেরা শব্দ সংখ্যা নিয়ে আপনাকে বিব্রত করতে পারবেন না, তখনও আপনার নির্মেদ টানটান গদ্য পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে। অর্থাৎ সীমাবদ্ধ আকাশে শব্দকে ভাসাতে পেটকাটির সন্ধান একবার পেয়ে গেলে, পরে অনন্ত মহাকাশে বিমানপোত ওড়াতে গিয়ে আপনি স্বকীয় কলমের জাদুতে, গদ্য ভাষাতেও কাব্যময়তার নিদর্শন রাখতে পারবেন, তবে সংযমের পাঠটি যেহেতু আপনার নেওয়া হয়ে গেছে, সেহেতু যতটুকু কাব্যভার গদ্য সহ্য করতে পারে, ততটুকুই আপনি প্রয়োগ করবেন। তা পাঠকের কাছে ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে না। এটি বলে দেওয়া যত সহজ, করে দেখানো তত সহজ নয়, তার জন্য প্রয়োজন অনুশীলনের এবং নিরন্তর পাঠাভ্যাসের। বিশিষ্ট লেখকদের বাক্য গঠনের মুনশিয়ানা লক্ষ্য করতে করতেই গড়ে উঠবে আপনার নিজস্ব গদ্যভাষা আর আপনিও শক্তির কবিতার মতো, নিজের শব্দ প্রয়োগের দক্ষতা নিয়ে বলতে পারবেন, যে আপনার, “শব্দেরা একটি নিজস্ব শহর গড়েছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *