কোলকাতায় বিশ্বকাপ টেবিল টেনিস ও এক কিশোরের স্মৃতিরোমন্থন

কলকাতায় বিশ্বকাপ টেবিল টেনিস ও এক কিশোরের স্মৃতিরোমন্থন

১৯৭৫ সালে কোলকাতায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম বিশ্বকাপ টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে উদ্বোধন হয়েছিল। সারা বাংলায় তুমুল সাড়া পড়ে গিয়েছিল এই ইভেন্টকে ঘিরে। এর আগে আমাদের সোনারপুরে একটি কি দুটি ক্লাবে খেলাটা হতো, তারপর যেন পাড়ায় পাড়ায় টেবিল টেনিস খেলার ধুম পড়ে গেল। তখন আমার তেরো কি চৌদ্দ বছর বয়েস। সবে তখন দু-এক মাস হলো খেলাটা ধরেছি। তার আগে খেলাটা কিছু কিছু দেখেছি এখানে ওখানে।বাবার হাত ধরে কোলকাতায় একবার দু-বার খেলা দেখতে গেছি, আর আমাদের এখানে সোনারপুর স্পোর্টিং ইউনিয়নে খেলা দেখেছি। তখন খেলাটা দেখে মনে হয়েছিল এ তো খুব সহজ খেলা, বল আসবে আর দুম করে মেরে দেবো, কেউ আমার সঙ্গে পারবে না।

যেদিন প্রথম খেলা শুরু করি সেদিনের কথা খুব মনে আছে। আমাদের ক্লাবের এক সিনিয়র প্লেয়ার বাবার কথায় আমাকে খেলা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনি আমায় স্টান্স, গ্রিপ ইত্যাদি প্রাথমিক টেকনিক্যাল দিকগুলো খেলা শুরু করার আগে বোঝাচ্ছিলেন, আমি তখন ছটফট করছি, কখন খেলা শুরু করব আর তাক লাগিয়ে দেবো ওঁকে। অত টেকনিক্যাল কচকচি ভালো লাগছে না তখন।
উনি সার্ভ করতেই দুম করে বলটা মেরে দিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে বলটা টেবিলের অনেক ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে প্রায় ঘরের সিলিং-এ গিয়ে লাগল। উনি মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “খুব আস্তে মারো, আগে টেবিলে বল রাখা অভ্যেস কর, তারপর কন্ট্রোল এসে গেলে জোরে মারতে পারবে। আগে অন্তত ছ’মাস ধরে বল টেবিলে রাখা প্র‍্যাক্টিস কর, পরে দেখব তুমি কত জোরে মারতে পার।”
জোরে মারা তো দূরের কথা, সেদিন খুব আস্তে মেরেও খুব কম বলই টেবিলে রাখতে পেরেছিলাম। সব বলই দেখি বাইরে চলে যায়। প্রথম দিনের খেলা শেষ হতে একেবারে মুষড়ে পড়েছিলাম। কত আশা নিয়ে এসেছিলাম প্রথম দিনেই একেবারে মাত করে দেবো! হাড়ে হাড়ে বুঝে নিলাম, খেলাটা মোটেই সহজ নয়, প্রচুর প্রচুর প্র‍্যাক্টিস দরকার, তবে যদি কিছুটা আয়ত্তে আসে।

এর কিছুদিন পরেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ টেবিল টেনিস শুরু হবে। আমার তো দেখার খুব ইচ্ছে, কিন্তু খবরের কাগজে টিকিটের দাম দেখে আক্কেল গুড়ুম! অত্যন্ত চড়া দাম টিকিটের! সে সময় এই খেলা উপলক্ষেই সবে কোলকাতায় টিভি এসেছে, কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু ধনী লোক ছাড়া আর কারো টিভি ছিল না তখন। বাবাকে আবদার কর‍তেও ভরসাও পাচ্ছি না। কিন্তু দু-একদিন বাদেই বাবা বললেন, ” চল, আমরা নেতাজি ইন্ডোর থেকে ওয়ার্ল্ড কাপের টিকিট কেটে বাবুঘাট থেকে বেড়িয়ে আসি।” আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি এ কথা শুনে। নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।

আজকের নেতাজি ইনডোর
আধুনিক স্টেডিয়ামের ভিতরে

এদিকে খবরের কাগজে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে তুমুল আলোড়ন পড়ে গেল। বিশ্বের তাবড় সব খেলোয়াড়দের ছবিসহ নানা খবর বেরোচ্ছে। আমি স্বচক্ষে সেসব তারকা খেলোয়াড়দের খেলা দেখব–এ কথা ভাবতেই রোমাঞ্চে দারুণ তেতে উঠেছিলাম। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে প্রচুর আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। ট্রেনে, বাসে, চায়ের দোকানের আড্ডা আলোচনায় সরগরম থাকত।

এই প্রতিযোগিতা ঘিরে আর একটা বিতর্ক খুব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সে সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। বিরোধীরা আদাজল খেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে লেগে পড়লেন। তাঁদের যুক্তি হলো, একটা গরীব রাজ্যে খেলার নামে এই বিলাসিতা মেনে নেওয়া যায় না। সেই চিরকেলে কাঁদুনি! আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজ্যই এই ধরনের নেতিবাচক রাজনীতির রাজধানী। যাই হোক, এইসব লোকদেখানো সস্তা রাজনীতি পাত্তা পেল না, পাত্তা পাওয়ার কথাও ছিল না। ঠিক দিনেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল।

এক রবিবার বাবা আমাকে আর আমার বোনকে নিয়ে গেলেন টিকিট কিনতে। সেই প্রথম বাবার হাত ধরে নেতাজি ইন্ডোরে যাওয়া। একদম আনকোরা ঝকঝকে স্টেডিয়াম দেখে মফস্বল থেকে আসা আমার চোখ তো চড়কগাছ! বিরাট স্টেডিয়ামে থরে থরে সাজানো সুদৃশ্য সব চেয়ার। মাঝখানে দুর্দান্ত খেলার কোর্ট। ঐ স্টেডিয়ামের চেয়ারে বসে এই কোর্টে বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়দের খেলা দেখব, এটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। টিকিট কাটা হয়ে গেলে বাবার হাত ধরে আমরা গেলাম বাবুঘাটে গঙ্গার পাড়ে। বাবুঘাটে নৌকো, লঞ্চ ইত্যাদি দেখে আমার খুব লোভ হলো নৌকো চড়ার। বাবা আমার আবদার রাখতে লঞ্চে করে বাবুঘাট থেকে অন্য একটা ঘাটে নিয়ে গিয়ে আবার আমরা বাবুঘাটে ফিরে এলাম। বাবুঘাট থেকে শিয়ালদার বাসে উঠে টিকিট কাটার জন্য পকেটে হাত দিতেই দেখলাম বাবার মুখ শুকিয়ে গেল। খেলার টিকিট তো নেই! এ পকেট ও পকেট হাতড়েও যখন পাওয়া গেল না তখন বোঝা গেল যে লঞ্চের ভিড়ে টিকিটগুলো পকেটমারি হয়েছে! অত টাকা দাম টিকিটের, অত চাহিদা! পকেটমারটা টিকিটগুলো হাফদামে বিক্রি করে দিলেও অনেক টাকা পেয়ে যাবে। এতক্ষণ মনটা আনন্দে থৈ থৈ করছিল, এক মুহূর্তে বুকটা যেন খালি হয়ে গেল। খেলা দেখতে যাবার সব আশাই মাটি হয়ে গেল।

নিয়মমাফিক বাবা লোক্যাল থানায় একটা জি ডি করলেন। আমার সদ্যকিশোর মন তাতেই আশান্বিত হয়ে উঠল। কেমন যেন মনে হয়েছিল পুলিশ ঠিক পকেটমারটাকে ধরে টিকিটগুলো উদ্ধার করবে, বাবার এত কষ্টের রোজগারের টাকা! প্রতিদিন রাতে বাবার বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকতাম, নিশ্চয়ই আজ বাবার মুখে সুখবর শুনতে পাবো, কিন্তু প্রতিদিনই নিরাশ হতাম। কিছুদিন পরে বুঝে নিলাম ও টিকিট ফিরে পাবার আর কোনো আশাই নেই। হতাশায় বিষাদে বড় বিমর্ষ হয়ে পড়লাম আমি। খেলাধুলো, বন্ধুবান্ধব, স্কুল–সবকিছুই পানসে লাগে। সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত সেই বিবর্ণ দিনগুলির কথা আজও আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়।
তারপর খেলা শুরুর দিন তিনেক আগে রাতে বাড়ি ফিরে বাবা দুটো খাম আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিষ্পৃহ মুখে বললেন, “খুলে দেখো।”
খাম খুলতেই আনন্দে শিউরে উঠল আমার শরীর মন। বিশ্বকাপ টেবিল টেনিসের দলগত ইভেন্টের খেলা দেখার দুটো টিকিট! আমার উচ্ছ্বাস দেখে বাবা হাসি হাসি মুখে আমার মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিলেন। তখনই অনুভব করলাম, আমার যন্ত্রণা বাবা সহ্য করতে না পেরে অনেক কষ্ট করে বাবা আবার এত দামি দুটো টিকিট কিনেছেন! এ কথা মনে হতেই উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আমার মন ভরে উঠল।
খুব যত্ন করে টিকিটটাকে রেখে দিলাম। মাঝেমাঝে গিয়ে দেখে আসছি সুদৃশ্য টিকিটটা। এতদিনের মন খারাপ, কষ্ট সব উধাও হয়ে আনন্দে ভরে উঠেছে আমার মন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ছে টিকিটটার কথা, ছুট্টে গিয়ে দেখে আসছি।

বাবার সঙ্গে সকালে কলেজ স্ট্রিটের দোকানে গিয়ে সন্ধে নাগাদ বাবার সঙ্গে খেলা দেখতে যাবো–এমনটাই কথা হলো। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না। সকাল থেকেই খেলা শুরু হয়ে যাবে আর সেই সন্ধেতে খেলা দেখতে যাওয়া! কতক্ষণই বা খেলা দেখতে পাবো! ঐ টুকুতে কী মন ভরে! বাবা শুনে বললেন,” এছাড়া আর কী করা যাবে, তুমি তো একা যেতে পারবে না, আমিও দোকান বন্ধ করে খেলা দেখতে যেতে পারব না। অগত্যা…”
তারপরেই বাবা বললেন, “একটা কাজ যদি করতে পার তাহলে সকাল থেকেই খেলা দেখতে পারবে।” আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী কাজ?”
বাবা বললেন, “আমাদের এখান থেকে ৮০বি বাসটাতে উঠে বসে পড়বি, ওটা যায় এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত। ওখানে নেমে পড়ে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেতাজি ইন্ডোরে যেতে পারবে? তাহলেই তো হয়ে গেল।”
আমি বললাম, “খুব পারব। ঐ বাসেই তো রোজ স্কুলে যাই আসি। ঠিক পারব।”
বললাম বটে পারব, কিন্তু মনে মনে বেশ ভয় ছিল। স্কুল তো বাড়ির কাছেই, অত দূরে সেই এসপ্ল্যানেডে একা একা যাওয়া…কিন্তু ভাবতে ভাবতেই দেখলাম ভয়টা কমে গিয়ে রোমাঞ্চটাই আমায় নাচিয়ে তুলল। একা, একা অত দূরে গিয়ে প্রমাণ করে দেব যে আমি আর ছোটটি নেই…
দেখতে দেখতে এসেই গেল খেলা শুরুর দিন। সকাল সকাল স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসে উঠে বসলাম। দলগত ইভেন্টের খেলা। পাঁচদিন ধরে হবে। কিন্তু বাস যেন আর চলতেই চায় না। বার বার কন্ডাকটরকে জিজ্ঞাসা করছি,” এসপ্ল্যানেড আর কত দেরি? কত দেরি?”
কন্ডাকটর একসময় বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “এখনও ঢের দেরি আছে। চুপচাপ বসে থাকো। ওটাই লাস্ট স্টপ, সবাই যখন নামবে তুমিও তখন নেমে যাবে।”
যেন সারারাজ্যি ঘুরে অবশেষে বাসটা এসপ্ল্যানেডে এসে পৌঁছল। অন্তত ঘণ্টাদুয়েক সময় লেগেছিল মনে হয়। কিন্তু স্মৃতি কী অদ্ভুত! সম্পূর্ণ অচেনা জায়গা এসপ্ল্যানেড থেকে কীভাবে নেতাজি ইন্ডোর–ঐ সিকি মাইল রাস্তাটা চিনে এসেছিলাম–তার আর কিছুই মনে নেই।
স্টেডিয়ামে ওঠার সিঁড়িতে পা দিতেই টেবিলে বল পড়ার রক্ত গরম করা টকাটক আওয়াজ আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস আমাকে দারুণ চনমনে করে তুলল। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়েই বিস্ময়ে আমি যেন পাথর বনে গেলাম! আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া বিশাল চত্বরটায় অন্তত গোটা কুড়ি ঝকঝকে নতুন টেবিল! বেশির ভাগ টেবিলেই ম্যাচ চলছে। দর্শকরা পছন্দমতো টেবিলে খেলা দেখে আনন্দ করছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন খেলোয়াড়দের। আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! খানিকক্ষণ পরে মনে হলো এখানে তো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না, সিট নম্বর খুঁজে সিটে বসতে হবে। টিকিটে লেখা সিট নম্বর খুঁজে বসলাম সিটে। কিছুক্ষণ বসার পরে ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা যেন একটু কাটল।
প্রথমেই যেটা নজরে পড়ল মানুষের গাত্রবর্ণের বিচিত্রতা। একই জায়গায় সাদা, কালো, ঈষৎ হলুদ…একটা জায়গায় একসঙ্গে এত রঙের মানুষ এ যুগেও কম খুব নজরে পড়ে। এই ছোট জায়গাটা যেন গোটা পৃথিবীর একটা মিনিয়েচার। একটা অসম্ভব ভালোলাগায় ভরে উঠেছিল আমার মনপ্রাণ। জাত পাত, ধর্ম বর্ণ নিয়ে হিংসা হানাহানি নেই, মারামারি নেই আছে শুধু এক সামিয়ানার তলায় সুস্থ প্রতিযোগিতা। বাস্তবে যদি সত্যি আমাদের পৃথিবীটা এমন হতো। তখন ঐ বয়েসে যে এমন গুছিয়ে ভাবতে পেরেছিলাম তা নয়, তবে অনুভূতিটা ছিল এমনই।
একটু একটু করে ধাতস্থ হচ্ছি আর বুঝে নিচ্ছিলাম স্টেডিয়ামের পরিবেশ। আমার ধারণা ছিল চিন, জাপান, কোরিয়া এরাই বুঝি টেবিল টেনিসের একচ্ছত্র শাসক, বাকিরা এলেবেলে। কিন্তু খেলা দেখতে দেখতে আর আশেপাশের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম যে আমার ধারণা কতটা ভুল ছিল। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ দুর্দান্ত টেবিল টেনিস খেলে। জার্মানি, গ্রিস, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি–সেবার যিনি ব্যক্তিগত ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনিই তো হাঙ্গেরির খেলোয়াড়–ইস্তভান জনিয়ার।
সন্ধেবেলা বাবা আসতেন, বাবার কাছে খেলাটার খুঁটিনাটিগুলো বোঝার চেষ্টা করতাম, কিন্তু নিজের হাতেকলমে অভিজ্ঞতা না থাকায় বুঝতে অসুবিধে হতো।
এখন আফসোস হয় যে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপটা যদি আর অন্তত একটা বছর পরে হতো! এই খেলাটা যেমন দ্রুতগতির তেমনি টেকনিক নির্ভর। সব খেলাই টেকনিক্যাল কিন্তু এই খেলাটা দ্রুতগতির হওয়াতে এর টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো বোঝার আগেই র‍্যালিটা শেষ হয়ে যায়। সেই জন্যেই সাধারণ মানুষ এই খেলাটা সম্বন্ধে একটা কথা বলে থাকেন যে খেলাটা এত ফাস্ট যে স্ট্রোকগুলো ঠিক বুঝে ওঠা যায় না।
এ ছাড়াও একটা ব্যাপার আছে। টেবিল টেনিসে দুটি একটি স্ট্রোক ছাড়া বাকি সব স্ট্রোকেই স্পিন মেশানো থাকে। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় সেই স্পিনটাকে বুঝে তাঁর স্ট্রোক নেন। সেই কারণেই যাঁরা এই খেলাটা কিছুটা অন্তত না খেলেছেন তাঁরা এই স্পিনের কারিকুরিটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। বিশেষ করে খেলাটা অত্যন্ত দ্রুতগতির হওয়াতে সমস্যাটা আরও বেশি। তাই আমার, আফসোস যে যদি আর একটা বছর পরে এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হতো আমি অনেক বেশি উপভোগ করতে পারতাম। আমি তখন সবে খেলাটা ধরেছি, বয়েসও ছিল কম, তাই খুব যে বুঝেছি তা কিন্তু নয়।
বাবার সঙ্গে ফেরার সময় বাবুঘাট থেকে শিয়ালদার বাসে উঠে শিয়ালদায় নেমে ট্রেনে সোনারপুর চলে এলাম। এতে সময় অনেক কম লাগল। বাবাকে বললাম,”আমিও তো এভাবে সকালে আসতে পারি, সময় অনেক কম লাগবে।”
বাবা বললেন, “যদি চিনে আসতে পারো তো এতেই অনেক সুবিধে।”
তার আগে বাবার সঙ্গে অনেকবার কলেজ স্ট্রিট যাবার সুবাদে শিয়ালদা অঞ্চলটা চেনা হয়ে গিয়েছিল। তাই ওভাবেই যেতাম, বাসে অতটা রাস্তা যাবার ঝক্কি আর নিতে হয় নি।
আগেই বলেছি, কম বয়েস আর কম অভিজ্ঞতার দরুন টেকনিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার বুঝতাম না বলেই অফেন্সিভ প্লেয়ারদের সঙ্গে ডিফেন্সিভ প্লেয়ারদের খেলা হলে খুব মজা পেতাম।
এই ধরনের খেলায় প্রচুর র‍্যালি হয়, যা দেখতে সাধারণ দর্শকের খুব ভালো লাগে। ডিফেন্সিভ খেলায় জাপানের খেলোয়াড়দের খুব সুনাম আছে। একটু পিছিয়ে গিয়ে ওঁরা চপ বা কাট করে প্রতিপক্ষের টপস্পিনের জবাব দিতে থাকেন, কিছুতেই যেন এঁদের হার মানানো যায় না। যাঁরা এই খেলাটা কিছুটা অন্তত খেলেছেন তাঁরা জানেন, টপস্পিন করতে বেশ পরিশ্রম হয়, সেক্ষেত্রে চপ করে সে মার ফেরত দিতে তেমন কিছু পরিশ্রম নেই। 

এই ক্ষেত্রে ডিফেন্সিভ প্লেয়াররা তুলনায় সুবিধেজনক অবস্থায় থাকেন। এই ধরনের ম্যাচে এক একটা পয়েন্টের জন্যে পনের কুড়িটা র‍্যালি হরহামেশাই হয়। তখন আবার গেম হতো একুশ পয়েন্টে। এবার যদি একটা ম্যাচে পাঁচটা গেমই হয় (আকছারই হয়) তাহলে ভেবে দেখুন অফেন্সিভ প্লেয়ারটিকে কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করতে হয়! তাই শেষের দিকে অনেক প্লেয়ার দমেই কাহিল হয়ে পড়ে হার মেনে নিতে বাধ্য হন। আপনারা জাপানি ডিফেন্সিভ প্লেয়ার তাকাশিমা-র নাম শুনে থাকবেন। টেবিল টেনিস জগতে ওঁর নাম চিরস্থায়ী হয়ে আছে।

নরিও তাকাশিমা
Jacques_Secretin

 

জাপানি প্লেয়াররা ছাড়া আর একজন ডিফেন্সিভ প্লেয়ার সেবার কোলকাতাকে মাতিয়ে তুলেছিলেন, তবে ইনি জাপানি নন, ফরাসি প্লেয়ার, জাঁ সেক্রেতা (Jacques_Secretin) ওঁর নাম। এঁর খেলার ধরন ছিল একেবারে আলাদা ঘরানার। বিপক্ষ প্লেয়ার যে টপস্পিন মারতেন, তার উত্তরে উনিও টপস্পিন মারতেন অনেকটা পিছনে সরে গিয়ে, লুপ ড্রাইভের মতো করে। অনেক সময়েই উনি নিজের সীমানা-সূচক বোর্ডটাকে বাঁ হাতে সরিয়ে অন্য খেলার আঙিনায় ঢুকে পড়তেন, এ যেন নিজের খেলার মাঠ ডিঙিয়ে অন্যের মাঠে ঢুকে পড়া! এ নিয়ে মজা হতো খুব।

এই খেলায় রেডিওতে বাংলা ধারাবিবরণীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল আর তা নিয়ে হাসাহাসি হতো খুব। কমল ভট্টাচার্য মশাইরা টেস্ট ক্রিকেটের ধারা বিবরণী দিতে অভ্যস্ত ছিলেন, দারুণ জনপ্রিয়তা ছিল এঁদের। সেই অভ্যাস নিয়ে টেবিল টেনিসের রিলে করতে গিয়ে বড় নাকাল হয়েছিলেন এঁরা। খেলার রিলে করতে করতে এঁরা গল্পগুজবে মেতে উঠতেন, হঠাৎ খেয়াল হতো, এইরে, ম্যাচটাই তো শেষ হয়ে গেছে! রেডিওর শ্রোতারা বিরক্ত হয়ে উঠতেন, ধারাভাষ্যকাররাও নিশ্চয়ই খুব বিব্রত হতেন।

আর বিশেষ কিছু তেমন বলার নেই। শুধু সেই টুর্নামেন্টের ফলাফল কী হয়েছিল জানিয়ে দিই। ওহ! সেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে ভারতীয় ডাকঘর একটি স্ট্যাম্পও প্রকাশ করেছিল। তার ছবিও রইল। 

খেলার চূড়ান্ত ফলাফল
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে ভারতীয় ডাকঘরের প্রকাশিত স্ট্যাম্প
ফাইনাল খেলছেন ইস্তভান জনিয়ার (István Jónyer - Hungary) এবং আন্তান স্টিপানচিচ (Antun Stipančić - Yugoslavia)
জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ই অগাস্ট। সোনারপুর দক্ষিণ ২৪ পরপগণায় থাকেন। খেলাধূলার সঙ্গে যুক্ত। সাহিত্যপ্রেমী। অনুবাদ করতে ভালোবাসেন। দুটি মুদ্রিত বই ও একটি 'ই বই' প্রকাশিত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হয়। ঐতিহ্যময় প্রকাশনা সংস্থা অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দিরের বর্তমান কর্ণধার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *