কতিপয় ভারতীয় বাণীকুমারবৃন্দ: কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

কতিপয় ভারতীয় বাণীকুমারবৃন্দ: কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

কে বা শুনাইল ‘ক্রিকেট-নাম’

শঙ্করীপ্রসাদ বসু-র লেখা “ইডেনে শীতের দুপুর” বইটা পড়েছেন? মনে আছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বম্বে-টেস্টে পঙ্কজ রায়-এর প্রথম টেস্ট-শতরানের সেই বর্ণনা?
“চশমা-পরা সজলনয়ন সেই বৃদ্ধটির কথা আজও মনে আছে। পাড়ার এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই রেডিও শুনছিলাম। পঙ্কজের সেঞ্চুরিতে যখন রেডিও ফেটে যাবার জোগাড়, বৃদ্ধটি পাশে-দাঁড়ানো এক তরুণের থুতনি ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলেছিলেন, ‘দীর্ঘজীবী হও বাবা, বাঙালির প্রথম টেস্ট-সেঞ্চুরি!’” সময়কাল – ডিসেম্বর, ১৯৫১।
অথবা, ইডেন-টেস্টের শেষ দিনের সকালে সেলিম দুরানি-র বলে ইংল্যান্ড-অধিনায়ক টেড ডেক্সটার এল-বি-ডব্ল্যু হয়ে যেতেই প্রতিবেশীর রেডিওতে কান-পাতা বাড়ির পেছনের পুকুরঘাটে রাশীকৃত ময়লা জামাকাপড় কাচতে ব্যস্ত সেই গৃহবধূটির মন্তব্য: “গিয়েছে বেশ হয়েছে, বড্ড জ্বালাচ্ছিল!” সময়কাল – জানুয়ারি, ১৯৬২।
কিংবা, বাড়ির সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমের রেডিওতে রোহন কানহাই-এর ধাঁই-ক’রে-মারা একখানা চারের বর্ণনা শুনতে শুনতে “সুনন্দর জার্নাল”-এর ডিভানে-অর্ধশায়িত ভজুদার সেই উক্তি: “কানহাইয়ের হাতে তো ব্যাট নয় – যেন বাঁশি, কানাইয়ের বাঁশি!” সময়কাল – ডিসেম্বর, ১৯৬৬।
ভুলে গেছেন বম্বে-টেস্টের চতুর্থ দিনের শেষ-দুপুরে আম্পায়ার শম্ভু পান-এর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত [অজি পেসার অ্যালান কনোলি-র বলে উইকেট-রক্ষক ব্রায়ান ট্যাবার-র হাতে ভেঙ্কটরাঘবন-এর কট-আউট] নিয়ে জনৈক ভাষ্যকারের বেফাঁস মন্তব্যের জেরে একশ্রেণীর দর্শকদের মাঠের কাঠের গ্যালারি ও ত্রিপলের ছাউনিতে অগ্নিসংযোগ এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা? সময়কাল – নভেম্বর, ১৯৬৯ (সঙ্গের ছবি)। হতাশ হবেন না পাঠক, এই জনৈক ভাষ্যকারের কথা যথাস্থানে আসবে, এখন শুধু একটু কৌতূহল জাগ্রত করে গেলাম।

 

মাঠের কাঠের গ্যালারি ও ত্রিপলের ছাউনিতে অগ্নিসংযোগ
ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামের কিছু অংশ বিদ্ধস্ত

বুঝতেই পারছেন যে ওপরে উল্লেখ-করা ঘটনাগুলোর মধ্যে এক বা একাধিকের অভিজ্ঞতা স্বচক্ষে-স্বকর্ণে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন পাঠকের সংখ্যা আজ খুবই অল্প। তাহলে কেন তার অবতারণা? কারণ, স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে ক্রিকেটের কয়েকজন ভারতীয় চরিত্রের মাঠের বাইরের এক ঐতিহাসিক ভূমিকার পরম্পরার কথা মনে করিয়ে দিতে চাই আজকের ভারতীয় ক্রিকেট-প্রেমী প্রজন্মসমূহকে। তাঁরা তো আজকের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে দুই ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ম্যাচের সরাসরি প্রসারণ (ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ) উপভোগ করতে অতিমাত্রায় অভ্যস্ত, কেউই “নৃপতি কর্ণেন পশ্যতি” এই প্রবাদবলে ‘রাজা’ নন। কেউ কেউ অবশ্য স্নেহে (নাকি ভক্তিতে?) অন্ধ হ’লেও ধৃতরাষ্ট্র তো কোনোভাবেই নন!
আমার বেড়ে ওঠার কালে, প্রায় দেড় দশক ধ’রে, মানে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের শেষ অবধি ক্রিকেট উপভোগের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল ম্যাচের ‘আঁখো দেখা হাল’ – (পরের মুখে ঝাল খেয়ে) নিজের কানে শুনে ম্যাচের নাটকীয়তা অনুভব করা। আর সেইসব ‘মহাভারত’-এর সঞ্জয়-এর ভূমিকা যাঁরা পালন করতেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয়কে নিয়েই আজকের লেখা। ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি বাংলাভাষী প্রবাদপ্রতিম ত্রয়ী কমল ভট্টাচার্য, অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার এঁদেরকে, বাদ রেখেছি চতুর্থ রথী প্রেমাংশু চট্টোপাধ্যায়-কেও।

বাংলাভাষী প্রবাদপ্রতিম ত্রয়ী কমল ভট্টাচার্য, অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার
চতুর্থ রথী প্রেমাংশু চট্টোপাধ্যায়

‘ইংরেজদের খেলা’ নিয়ে ইংরেজিতেই বলা

এখানে জানাই ইংরেজি ভাষায় ক্রিকেটের ধারাবিবরণী-দেওয়া কয়েকজন বেতার-ভাষ্যকারের কথা, যাঁরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘টিভি-মুখী’ হয়ে যাননি। তবে তারও আগে বিবিসি-র অবদানের কথাও একটু বলতে হবে।
ভারতের প্রথম দুই টেস্টম্যাচ-সফর – ইংল্যান্ড-১৯৩২ ও ইংল্যান্ড-১৯৩৬ – বেতার-ধারাবিবরণীর আনুকূল্য পায়নি, দেশের লোকদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাসি খবর পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্বাধীনতা-উন্মুখ ভারতের ইংল্যান্ড-সফরের আগেই, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীনই বিবিসি খানিকটা আন্দাজ পেয়েছিল ভারতের ‘বেতার-শ্রোতা বাজার’ সম্বন্ধে – তাদের পূর্বাঞ্চলীয় পরিষেবায় অংশ নিতেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল।

আর তাই ইংল্যান্ড-১৯৪৬ সফর নিয়ে বিবিসি প্রতিদিন দু’টো ক’রে পাঁচ-মিনিটের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করল ভারতীয় শ্রোতাদের জন্য – হিন্দিতে বলতেন আব্দুল হামিদ শেখ এবং ইংরেজিতে বলতেন এক ইংরেজ তরুণ যিনি পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়াবেন ‘ইংল্যান্ডে ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর’ জন আর্লট। হোকনা কেন দিনে মাত্র দশ মিনিট, ইংল্যান্ড থেকে তাজা ক্রিকেট-প্রচারের একটা মহিমা আছে তো! ভারতে বসবাসকারী ইংরেজরা নাক সিটকালে কী হবে, হাজার হাজার ভারতীয়-ক্রিকেটপ্রেমী সেই অনুষ্ঠান নিয়মিত শুনতেন।

জন আর্লট

তথ্যানুযায়ী ভারতে প্রথম বেতারে ক্রিকেট সম্প্রচার নাকি হয়েছিল ১৯৩৪ সালে বম্বে পেন্ট্যাঙ্গুলার প্রতিযোগিতায় পার্সি দল বনাম মুসলিম দলের এক ম্যাচে। এই সূত্রেই উঠে এলেন এক অগ্রপথিক, যাঁকে দিয়েই শুরু করি।

‘ববি’ তালইয়ারখান
১৯৩৩-৩৪ মরশুমের পর থেকে ১৯৪৮-৪৯ মরশুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সফরের আগে পর্যন্ত ভারতে কোনও টেস্ট-ম্যাচ হয়নি। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না থাকলেও এই সময়কার ঘরোয়া ম্যাচগুলোর সারাদিনের সরাসরি সম্প্রচার কিন্তু মাঝেমধ্যেই হ’ত। কে ছিলেন তৎকালীন সেই ‘বাণীকুমার’? আসুন, তাঁর কথা একবার স্মরণ করা যাক।

ফারদোরজি সোহরাবজি (ওরফে ‘ববি’) তালইয়ারখান

‘এ.এফ.এস.টি’ নামে পরিচিত সঙ্গের ছবির আরদেশির্ ফারদোরজি সোহরাবজি (ওরফে ‘ববি’) তালইয়ারখান [জন্ম ১৮৯৭ – মৃত্যু ১৯৯০] ছিলেন ভারতে ক্রিকেট বেতার-ধারাবিবরণীর পথিকৃৎ। সেই আমলে মাত্র একজনই ভাষ্যকার থাকতেন, তাই মাত্র একজন স্কোর-রক্ষক-এর সহায়তা নিয়েই ববি গোটা ম্যাচের দিনের খেলা নিয়ে ব’লে যেতেন। তাঁর সুন্দর কণ্ঠস্বর ও বিশিষ্ট বাচনভঙ্গিমা দিয়ে দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা তিনি ভাষ্য দিয়ে যেতেন – থামতেন বা বিশ্রাম নিতেন কেবল খেলার মধ্যবর্তী বিরতিগুলোতে, অর্থাৎ মধ্যাহ্নভোজন ও চায়ের বিরতিতে! এমনই ছিল ধারাভাষ্যদানের প্রতি তাঁর আত্মমগ্নতা।

বম্বে পেন্ট্যাঙ্গুলার ম্যাচগুলোর এত জনপ্রিয়তার পেছনে ববি-র এই অবদানটা অবশ্যই ছিল। ম্যাচ চলাকালীন পাওয়া ক্রিকেট-সংক্রান্ত কিছু কিছু বেতার-বার্তার (টেলিগ্রাম) উত্তরও তিনি দিতেন ভাষ্য দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই – এখন যেমন টিভি-ভাষ্যকাররা শ্রোতাদের রকমারি অনলাইন ক্রিকেটীয় প্রশ্নের জবাব দেন, খানিকটা তেমনই। ইংরেজি ভাষায় তাঁর ভাল দখল ছিল, ছিল পরিচ্ছন্ন বাচনভঙ্গি, আর কণ্ঠস্বরে ছিল নাটকীয়তা সৃষ্টির ক্ষমতা। সব মিলিয়ে তিনি এক আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করতে পারতেন তাঁর ধারাবিবরণীর মাধ্যমে।
১৯৪৮-৪৯ মরশুমে, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বারো বছর পরে, অল ইন্ডিয়া রেডিও (AIR) কর্তৃপক্ষ স্থির করেন যে তিনজন ভাষ্যকার মিলে ভাগাভাগি ক’রে ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট-সিরিজের ম্যাচগুলোর ধারাবিবরণী দেবেন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় ববি রাজি হননি, তিনি ধারাভাষ্যকারর এই কাজ ছেড়ে দেন। আর এভাবেই ভারতীয় বেতার-ধারাভাষ্যের এক গৌরবময় অধ্যায়ের অকাল পরিসমাপ্তি ঘটে।
পরবর্তীকালে, ১৯৫৪-৫৫ মরশুমে, ভারতের প্রথম পাকিস্তান-সফরে অবশ্য তিনি ধারাভাষ্যকারের দায়িত্ব ভাগ ক’রে নেন মাত্র একবারই। ঐ সফরের প্রথম টেস্টে, ঢাকা-তে , তাঁর সহ-ভাষ্যকার ছিলেন (পরবর্তীকালের প্রবাদপ্রতিম পাকিস্তানি) ওমর কুরেশি।

সফরের প্রথম টেস্টে, ঢাকা-তে
ওমর কুরেশি

তার দীর্ঘকাল পরে, ১৯৭২-৭৩ মরশুমে, ভারত বনাম ইংল্যান্ড টেস্ট-সিরিজের পঞ্চম-তথা-শেষ টেস্টে, বম্বে-তে, তিনি দিনশেষে-খেলার-সারাংশ অনুষ্ঠানটি নিবেদন করতে রাজি হন, তাও কর্তৃপক্ষের বহু সাধ্যসাধনার পর। ১৯৯০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর দৈনিক কলম “Do you get me, Steve!” তিনি চালিয়ে গেছেন! ববি সম্বন্ধে শেষ করি দু’টো উদ্ধৃতি দিয়ে:

• বিখ্যাত ভারতীয় লেখক রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন: “He (AFST) brought to cricket broadcasting a rich, fruity voice, and a fund of anecdotes. He was ambitious and opinionated, with a voice that was beer-soaked, cigarette-stained. His self-control was superhuman, for he would speak without interruptions, except for lunch and tea.”

• (১৯৫৪ সালে) জনপ্রিয় পাকিস্তানি ভাষ্যকার জামশিদ মার্কার বলেন: “Would you like a painter painting, and joined by another in the same room? A commentator is like a painter, and he should be left alone in the box.” – ধারাভাষ্যকার ‘সঞ্জয়’ তাঁর ভাষ্যের বিবরণী দিয়েই মাঠের ‘কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ’-এর ‘ছবি’ ফোটাবেন ‘অন্ধ’ শ্রোতাদের জন্য, তখনকার ভাবনা হয়ত এমনই ছিল – কী জানি!

‘বেরি’ সর্বাধিকারী

১৯৭৬ সালের বড়দিনের সপ্তাহখানেক আগে বম্বে শহরে এক আত্মহত্যার খবরে ভারত-তথা-বিশ্বের ক্রিকেট-মহল স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। ৭২ রানের মাথায় নিজের জীবনের ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন বিজয় চন্দ্র ‘বেরি’ সর্বাধিকারী , যাঁর রক্তে ছিল ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী-র ক্রীড়াপ্রেমের উত্তরাধিকার, এবং যিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত একমাত্র ভারতীয় ক্রীড়া-সাংবাদিক।
দেশে ও বিদেশের ক্রিকেট-জগতে সকলের প্রিয় ও সম্মানিত, সুভদ্র ও অমায়িক এবং কঠোর পরিশ্রমী স্বভাবের বেরি তাঁর প্রায় অর্ধশতবর্ষ-ব্যাপী সাংবাদিক-জীবনে শতাধিক টেস্ট-ম্যাচের সাক্ষী থেকেছিলেন, ১৯৩২ সাল থেকে আরম্ভ ক’রে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতের খেলা প্রায় সমস্ত টেস্ট-ম্যাচ সমেত। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ও ওরেল-পত্নী ভেল্ডা। বেরির বিখ্যাত বই “My World of Cricket”-এর ভূমিকাও লিখছিলেন স্বয়ং ওরেল। ১৯৭৪-৭৫ মরশুমে ভারত-সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল তাঁর সম্মানে সফরশেষে বম্বে-তে আয়োজিত এক সম্বর্ধনা-সভায় উপস্থিত ছিল।
সাংবাদিকতায় আসবার আগে, ছাত্রজীবনে, বেরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে উইকেট-রক্ষক ও ওপেনিং ব্যাটার হিসেবে খেলেছেন। নিজেরই আয়োজন-করা কোনও এক ক্রিকেট-ম্যাচে একজন পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসেবে খলতে নেমে তিনি নাকি নিজের নাম লিখেছিলেন “John Berry” [বিখ্যাত ক্রিকেটার Jack Hobbs-এর আসল নাম], আর সেই থেকে নাকি তাঁর ডাকনাম হয়ে যায় ‘Berry’! ১৯৩৫ সালে “ইউনিভার্সিটি অকেশনালস”-দলের হয়ে তিন-সপ্তাহের এক আমন্ত্রণী সিংহল-সফরে তিনি যান উইকেট-রক্ষক হিসেবে, সহ-খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন ওয়াজির আলি, বিজয় মার্চেন্ট, কার্তিক বসু, শুটে ব্যানার্জি, দেবরাজ পুরী, প্রমুখ।

‘বেরি’ সর্বাধিকারী

 

কাঁচাপাকা চুলে-ভরা মাথা এবং সুরেলা কণ্ঠস্বর নিয়ে বেরি ধীরগতির মাপা ভঙ্গীতে কথা বলতেন। কেবল AIR-ই নয়, ১৯৫৩ সালে ভারতীয় দলের প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তিনিই ক্যারিবিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (CBC)-এর সক্রিয় প্রতিনিধিও ছিলেন। সেই সফরে তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল যাঁদের সঙ্গে কাজ করবার তাঁদের মধ্যে ছিলেন – আর্নেস্ট এইটল, স্যার লিয়ারি কনস্ট্যানটাইন, অ্যালান রে, জেফ স্টলমেয়ার ও জেরি গোমেজ।

১৯৪৭-৪৮ মরশুমে ভারতের অস্ট্রেলিয়া-সফরে বেরি কাজ করেন প্রবাদপ্রতিম অজি-ভাষ্যকার অ্যালান ম্যাকগিলভ্রে-র সঙ্গে, ছিলেন জনি ময়েস-ও। ১৯৪৬ সালে ভারতের ইংল্যান্ড-সফরে ম্যাচের দৈনিক সারাংশ তৈরি করবার সময় তিনি যাঁদের সঙ্গ পান তাঁদের মধ্যে ছিলেন – জন আর্লট, রেক্স অ্যালস্টন, ফ্রেডি ব্রাউন, নর্ম্যান ইয়ার্ডলি, আর্থার গিলিগ্যান, জর্জ ডাকওয়ার্থ, বিল বাওয়েস, অ্যালফ গোভার, জিম সোয়ানটন ও পিটার ওয়েস্ট।
১৯৪৫ সালে অস্ট্রেলীয় সেনাদলের ইডেন ম্যাচে কিথ মিলার ভিনু মানকড-এর বলে যে চারটে বিশাল ছয় মেরেছিলেন, তার মধ্যে দু’টো উড়ে যায় ময়দান-প্রান্তের বেতার-ভাষ্যকারদের কুঠরির ওপর দিয়ে। সেখানে তখন ছিলেন ধারাভাষ্যরত বেরি, পাশে সহ-ভাষ্যকার পিয়ার্সন সুরিটা ও অতিথি (তরুণ বয়সের) কোচবিহারের মহারাজা।
তাঁর এইসব অভিজ্ঞতার কথা তিনি নিজেই লিখে গেছেন তাঁর “My World of Cricket” বইয়ের “The Press and the Radio” অধ্যায়ে। ১৯৭২ সালে তিনি AIR থেকে অবসর নেন। আর তার কয়েক বছরের মধ্যেই সেই তিন-পৃষ্ঠার চিঠি লিখে রেখে তাঁর স্বেচ্ছা-বিদায়! সুপরিচিত ভারতীয় ক্রিকেট-সাংবাদিক ও “Sportsweek” পত্রিকার সম্পাদক খালিদ আনসারি ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭৬ তারিখে ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত এক শোকবার্তায় লিখেছিলেন:

“Berry-da belonged to a fast-vanishing species. He personified the very best aspects of old-world charm and grace. The Maker does not cast his children in the same mould any more. RIP.”

পিয়ার্সন সুরিটা

স্পোর্টিং ইউনিয়নের মাঠে চলছিল বাংলা স্কুল দলের সিলেকশন। দুজন সাহেব মন দিয়ে দেখছিলেন। একজন সাহেব একটি ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি করা হয়? ব্যাট?’ ছেলেটি উত্তর দিল ‘হ্যাঁ, বলও করি, লেগ ব্রেক’। সাহেব চমৎকৃত হয়ে বললেন ‘আচ্ছা, লেগ স্পিন – তা দেখাও দেখি’। ছেলেটি দেখালো। সাহেব খুব খুশি। ছেলেটির লেগ স্পিন বোলিংভঙ্গির সঙ্গে তিনি এক কিংবদন্তি ব্রিটিশ লেগ স্পিনারের বোলিংভঙ্গির মিল খুঁজে পেলেন। তিনি (এবং অপর সাহেবটিও) ছেলেটিকে সেই নামেই ডাকতেন।

 

যাঁর বোলিংভঙ্গির সঙ্গে মিল পেয়েছিলেন সেই লেগ স্পিনার ছিলেন বিখ্যাত ‘টিচ’ ফ্রিম্যান – যিনি ইংল্যান্ডের প্রথম-শ্রেণী মরশুমে অনেক বার দ্বিশতাধিক উইকেট নিয়েছেন, নিয়েছেন আড়াইশো, এমনকি তিনশো উইকেটও। আর সেই ছেলেটি? তিনি পরবর্তী-জীবনে স্পিনের থেকে মিডিয়াম পেস-ই বেশি করতেন, ব্যাটের হাতটাও ভালই ছিল. রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলের অধিনায়কত্বও করেছেন – তাঁর নাম সুবিমল ‘চুনী’ গোস্বামী। প্রথম সাহেবটি ছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেট-প্রশিক্ষক বার্ট ওয়েনসলি। আর অপর সাহেবটি, আদতে ইঙ্গ-বঙ্গ, ছিলেন পিয়ার্সন সুরিটা।

পিয়ার্সন সুরিটা

আর্মেনিয় বংশোদ্ভূত কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স-এর পড়ুয়া সুরিটা ছাত্রজীবনে বাঁ-হাতি স্পিনার হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে, এবং পরবর্তীকালে “ইউনিভার্সিটি অকেশনালস’ দলের হয়ে খেলেছেন। কোচবিহারের মহারাজা একাদশের হয়েও তিনি খেলেছেন ১৯৩৫-৩৬ মরশুমে ভারত-সফরকারী জ্যাক রাইডার অস্ট্রেলীয় একাদশের বিরুদ্ধে কলকাতার উডল্যান্ডস গ্রাউন্ড-এ (বর্তমান আলিপুরের বিখ্যাত উডল্যান্ডস হাসপাতালের কাছেই), ঐ দলে তাঁর সহ-খেলোয়াড় ছিলেন শুটে ব্যানর্জি ও ফিরোজ পালিয়া। ১৯৪৪-৪৫ মরশুমে করাচি-তে প্রেসিডেন্সি প্রতিযোগিতায় অবশিষ্ট (The Rest) দলের হয়ে পার্শি দলের বিরুদ্ধেও তিনি খেলেছিলেন, যে দলের অধিনায়ক ছিলেন জামশেদ ইরানি। ত্রিশের দশকের শেষদিকে সুরিটা লালা অমরনাথের বিরুদ্ধেও খেলেছিলেন।
ধারাভাষ্যকার হিসেবে তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল সাহেবি উচ্চারণ, আকর্ষক কণ্ঠস্বর ও বলিষ্ঠ বাচনভঙ্গি। তাঁর শব্দচয়ন ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা শ্রোতাদের কাছে বেশ প্রিয় ছিল। ১৯৫৯ ও ১৯৬৭ সালে ভারতের ইংল্যান্ড-সফরকালে বিবিসি (BBC) তাঁকে অতিথি-ভাষ্যকার হিসেবে আমন্ত্রণ করেছিল। প্রখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক-ভাষ্যকার হেনরি ব্লোফেল্ড-এর মতে সুরিটা ছিলেন ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেট-ধারাভাষ্যকার।
তাঁর ইংরেজি উচ্চারণের আরোপিত-সাহেবিয়ানা নিয়ে অবশ্য অনেকরকম সমালোচনাও হয়েছে। ভারতে বিবিসি-র দীর্ঘকালের বসবাসকারী প্রতিনিধি মার্ক টুলি-র কথায়: “Surita was eventually barred by All India Radio because his English was too ‘pukka’.” আবার ১৯৭৪ সালে ভারতের ইংল্যান্ড-সফরকালে ভাষ্যকার হিসেবে তাকে বাদ দেওয়া হ’লে সংসদে সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাঙালি রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী সাংসদ (পরবর্তীকালের কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী) ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত।
কলকাতার চা-ব্যবসায়ী সংস্থার কর্মচারী সুরিটা সত্তরের ও আশির দশকে সিসিএফি (CCFC), বেঙ্গল ক্লাব ও আরসিটিসি (RCTC) এইসব ক্রীড়াসংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। অকৃতদার এই ক্রীড়া-ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয় কলকাতায়, ১৯৯৫ সালে, ৮২ বছর বয়সে।

দেবরাজ পুরী

১৯৪৮-৪৯ মরশুমে ভারতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সফরকালে AIR-এর বেতার-ভাষ্যকারদের দলে ছিলেন দেবরাজ পুরী [জন্ম ১৯১৬ – মৃত্যু ১৯৭১] – সেই সিরিজের দিল্লি টেস্টে পতৌদির নবাব ইফতিকার আলি খান-এর সুপারিশে তিনি নাকি এই ভূমিকায় প্রথম সুযোগ পান। খেলাটা ভালমতন বুঝতেন এবং প্রতি-বল-মাফিক ধারাভাষ্যটাতে বেশি নজর দিতেন – বোলারের হাত থেকে বেরিয়ে আসা বলটার মোকাবিলা ব্যাটার কেমনভাবে করলেন, তার বর্ণনা তিনি বেশ গুছিয়েই করতেন।
পুরী-র জন্ম লাহোরে, বেড়ে-ওঠা তৎকালীন উত্তর ভারতে। নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন এবং দ্রুতগতির বোলার হিসেবে কিছুটা নামও করেছিলেন। উত্তর ভারত দলের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে ১৯৩৪-৩৫ মরশুমে তিনি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে পদার্পণ করেন। পরের মরশুমে রোহিন্টন বারিয়া ট্রফিতে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়কত্ব করেন।

দেবরাজ পুরী

১৯৩৫-৩৬ মরশুমে ভারত-সফরকারী জ্যাক রাইডার অস্ট্রেলীয় একাদশের বিরুদ্ধে তৃতীয় বেসরকারি ‘টেস্ট-ম্যাচ’-এ লাহোরে তিনি মহম্মদ নিসার-এর সঙ্গে ভারতীয় একাদশের বোলিংয়ের সূচনা করেন। প্রায় ত্রিশ-গজী রান-আপ নিয়ে তিনি নাকি নিসার-এর মতন দ্রুতগতিতেই বোলিং করেছিলেন, যদিও তাঁর নিশানা নিসার-এর মতন অত নিখুঁত ছিলনা। ১৯৩৬ মরশুমে ইংল্যান্ড-সফরকারী ভারতীয় দলের দিল্লির ট্রায়াল-শিবিরে সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত সফরে তাঁর জায়গা হয়নি। ১৯৫২-৫৩ মরশুম পর্যন্ত তিনি ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলেন – বাংলা, দিল্লি, উত্তর ভারত এবং যুক্ত প্রদেশ (পরবর্তীকালের উত্তর প্রদেশ) রাজ্যের হয়ে। ১৮ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৫৪টা উইকেট (দু’বার ইনিংসে-পাঁচ-উইকেট ও একবার ম্যাচে-দশ-উইকেট সমেত), সেরা বোলিং ৬/২৮, গড় ২০.৪৮ – নেহাৎ হেলাফেলার নয়, তখনকার নিরিখে।

তাঁর দু’দশক-ব্যাপী সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাওয়া সম্মানজনক ভাষ্যকার-জীবনে একটাই বড় কলঙ্ক রয়ে গেছে – ১৯৬৯-৭০ মরশুমে ভারত-সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে বম্বে-র প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিন আম্পায়ার-এর ঘোষিত এক বিতর্কিত আউটের সিদ্ধান্তকে বেতারভাষ্যে সরাসরি ভুল বলে দেওয়া। মাঠে উপস্থিত কতিপয় রেডিও-বহনকারী দর্শকদের মাধ্যমে এই কথা গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং দর্শকদের এক উচ্ছৃঙ্খল অংশ ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামের কিছু অংশের চেয়ারে, বেড়ায় ও শামিয়ানাতে আগুন ধরিয়ে দেন। ম্যাচটা প্রায় পণ্ড হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। ব্রেবোর্ন-এর তদারককারী ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়া (CCI) কর্তৃপক্ষ এই দর্শক-খ্যাপানোর জন্য বেতার-ভাষ্যকারদের দায়ী করেন এবং পঞ্চম দিন ভাষ্যকারদের মাঠে ঢোকা থেকে বিরত করেন যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রচারের কথা বিবেচনা ক’রে পরে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়। অর্থাৎ শুরুতেই যে ‘জনৈক ভাষ্যকারের বেফাঁস মন্তব্যের’ তিনি আর কেউ নন, ইনিই।
এরপর পুরী AIR-এর হয়ে আর কখনও ধারাভাষ্য দেওয়ার সুযোগ পাননি। ১৯৭১ সালের শেষদিনে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। রঞ্জি ট্রফিতে উত্তরাঞ্চলের রাজ্যদলগুলির মধ্যে সেরা দলকে তাঁর নামাঙ্কিত এক ট্রফি দেওয়া হ’ত। পরবর্তীকালের সুপরিচিত বেতার-ভাষ্যকার নরোত্তম পুরী তাঁর ছেলে – পিতা-পুত্রের আন্তর্জাতিক-ক্রিকেটে বেতার-ধারাভাষ্যকার হওয়ার এমন উদাহরণ বেশ বিরল।

সিডনি ফ্রিস্কিন

স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বসবাসকারী কয়েকজন ইংরেজ নাগরিকও AIR-এর হয়ে ধারাভাষ্য দিতেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন সিডনি ফ্রিস্কিন। বেরি ও সুরিটা ছাড়া কলকাতার ভাষ্যকারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। AIR-এর সত্তর দশকের সুপরিচিত সংবাদ-পাঠক দিল্লি-র বিজয় ড্যানিয়েল-এর কথায়:

“The training that I got with exposure to [the news and] cricket commentary of stalwarts like Pearson Surita and Sydney Friskin, helped me realise that [the] correct use of voice, pronunciation, tone and tenor were imperative for good broadcasting.”

ফ্রিস্কিন নামকরা ক্রীড়া-সাংবাদিকও ছিলেন। পরে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান।

ডিকি রত্নাগর

ভারতের সেরা বেতার-ভাষ্যকারদের অন্যতম ছিলেন জামশেদ সোহরাব ‘ডিকি’ রত্নাগর [জন্ম ১৯৩১ – মৃত্যু ২০১৩], যিনি তাঁর সুদীর্ঘ ভাষ্যকার-তথা-সাংবাদিক জীবনে সব মিলিয়ে শ’তিনেকের বেশি টেস্ট-ম্যাচ দেখেছেন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বিজয় মার্চেন্ট-এর মতন বিশেষজ্ঞ, ও সত্তর দশকে একাধিকবার টনি কোজিয়ার-এর (বাঁ-দিকের ছবিতে ডান-দিকে) মতন সুবিখ্যাত ভাষ্যকার এঁদের সঙ্গে ডিকি (বাঁ-দিকের ছবিতে বাঁ-দিকে) কাজ করেছেন। সত্তর দশকের গোড়ায় – ১৯৭০-৭১ মরশুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ১৯৭১ মরশুমে ইংল্যান্ড – ভারতের দুই সিরিজ-জেতা সফরেই তিনি ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন।
তাঁর দৃঢ় কণ্ঠস্বর, ক্রিকেটীয় জ্ঞান ও রসিক বাচনভঙ্গির কারণে ক্রিকেট-প্রেমীরা তাঁকে বেশ খাতির করতেন। Caribbean Radio কর্তৃপক্ষ সুযোগ পেলেই তাঁকে ধারাভাষ্য দিতে আমন্ত্রণ করতেন, যদিও AIR-এর কোনও কোনও কর্তাব্যক্তির সঙ্গে তাঁর একেবারেই বনত না।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই ইংল্যান্ড-নিবাসী ডিকি “Daily Telegraph” ও “Guardian” পত্রিকায় প্রায় চার দশক ধরে নিয়মিত লিখে গেছেন। তাছাড়া “Times of India” ও “Hindustan Times” এই দুই সংবাদপত্রেও তিনি নিয়মিত লিখতেন। পক্ষপাতহীন মন্তব্য ও সমৃদ্ধ ভাষা ব্যবহারের কারণে সাংবাদিক হিসেবে তিনি বেশ সম্মানিত ছিলেন। ১৯৭৬-৭৭ মরশুমে ইংল্যান্ড-দলের ভারত-সফর নিয়ে তাঁর বই আছে, “Test Commentary”; ২০১০ সালে Indian Journalists’ Association (IJA) তাঁকে জীবনকৃতী সম্মান দিয়েছিল।

'ডিকি' - সহ ভাষ্যকার টনি কোজিয়ারের সঙ্গে
ডিকি রত্নাগর - প্রৌড় বয়সে

ডিকি সম্বন্ধে কয়েকজন প্রাক্তন ভারত-অধিনায়কদের তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি তুলে দিলাম:

• নরি কন্ট্রাক্টর: “He knew the game well. There was nothing hanky-panky about him. He would write what he observed and heard.”
• অজিত ওয়াদেকার: “He was a very polished man. He was a true Indian, always batting for our team even when we were down in the dumps.”
• গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ: ‘He used to be part of the Indian team whenever he was covering matches. … In those days, there were a few journalists who travelled with the team and were regarded as part of the team. Dicky was one of them.”

অনন্ত সেতলবাদ

মার্জিত বাচনভঙ্গির ক্রিকেটবোদ্ধা ও স্বচ্ছন্দবক্তা বেতার-ভাষ্যকার ছিলেন অনন্ত সেতলবাদ [জন্ম ১৯৩৫ – মৃত্যু ২০১৯], যাঁর “… as we wait for Kapil Dev to come in to bowl.” হয়ত সেই সময়কার কোনও কোনও ক্রিকেট-প্রেমী শ্রোতার মনে পড়তেও পারে। কেউ কেউ ওঁকে ‘ভারতীয় ক্রিকেট-ধারাভাষ্যের জন আর্লট’ ব’লেও অভিহিত করতেন।
তরুণ বয়সে মিডিয়াম-পেস বোলিং-করা অনন্ত ১৯৬১-৬২ মরশুমে ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়া (CCI) দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া-সফরে গেছিলেন, যে সফরে তাঁর অধিনায়ক ছিলেন জি এস রামচাঁদ, আর সহ-খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মাধব ও অরবিন্দ আপ্তে, কুমার ইন্দ্রজিৎসিংজি, পদ্মাকর শিভালকর ও সুধাকর অধিকারী এমন সব বম্বের নিয়মিত ক্রিকেটাররা। পরবর্তীকালে তিনি CCI-র সাম্মানিক সম্পাদক পদেও কিছুদিন ছিলেন।

ষাটের দশক থেকে শুরু ক’রে সত্তর-আশির দশক হয়ে নব্বই-দশকের গোড়ার দিকে ভারতের মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট-সিরিজ অবধি তিনি বেতার-ধারাভাষ্য চালিয়ে গেছিলেন। বিজয় মার্চেন্ট, কে এন প্রভু এবং রে রবিনসন এঁদের মতন প্রখ্যাত ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছেন (ছবি)। তাঁর সমসাময়িক বেশ কয়েকজন বেতার-ধারাভাষ্যকার পরের দিকে টিভি-ধারাভাষ্যের দিকে সরে গেলেও তিনি কিন্তু তেমন করেননি, বরং ধারাভাষ্য দেওয়াই ছেড়ে দিয়ে নিজের ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ফিল্মস ডিভিশন অফ ইন্ডিয়া-র তৈরি ভিনু মানকড়-এর ওপর এক তথ্যচিত্রে তিনি ভিনু-র সাক্ষাৎকারও নেন।

তরুণ অনন্ত সেতলবাদ - একদম ডানদিকে

তাঁর সম্বন্ধে দুয়েকজন ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞের মন্তব্য মনে করিয়ে দিই:

• হর্ষ ভোগলে (ভারতীয় ভাষ্যকার ও সাংবাদিক): “As a young man, I imagined I was Anant Setalvad, and I would try to copy his style but could never get the lilt and authority that his distinguished voice produced. He was always the commentator I wanted to be. The brightest light in the finest era of radio broadcasting in India.”
• রিচার্ড ক্যাশম্যান (অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট-ঐতিহাসিক): “Setalvad was never over the top, did not believe fuelling passions that ran high with spectators at the ground or outside. … The commentary of Anant Setalvad has also been praised because it is restrained, accurate, to the point and based on sound cricket knowledge which he built up as a club cricketer. … He urged the (Calcutta) crowd to remain calm and to accept the verdict of the umpire (during the Test against Westy Indies in 1978-79 season).” – দর্শক-শ্রোতাদের ‘উত্তেজনায় মাতিয়ে-তোলা’ হুজুগের যুগে ধারাভাষ্যকার-দের এই দরকারি ভূমিকাটার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই – এই আন্তরিক কামনা!

সুরেশ সরাইয়া

এই রচনার প্রথম দিকে উল্লেখ-করা ১৯৬৯-৭০ মরশুমের বম্বে-টেস্টে আন্তর্জাতিক-স্তরে বেতার-ধারাভাষ্যে অভিষেক করেন সুরেশ পুরুষোত্তমদাস সরাইয়া [জন্ম ১৯৩৬ – মৃত্যু ২০১২], যিনি সঙ্গ দিয়েছিলেন মার্চেন্ট, পুরী ও রত্নাগর এই ত্রয়ীকে। সেই থেকে আরম্ভ ক’রে ২০১১-১২ মরশুমের মুম্বাই-টেস্ট অবধি মোট শ-খানেকের বেশি টেস্ট-ম্যাচ এবং (বিশ্বকাপ-সমেত) শ’দেড়েকের বেশি ওডিআই-ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়ে গেছেন। এই কাজের সূত্রে AIR, অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (ABC), ক্যারিবিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (CBC), রেডিও নিউজিল্যান্ড এই সব সংস্থার হয়েও তিনি ভাষ্য দিয়েছেন, ক্রিকেট-দুনিয়ার বহু মাঠ থেকে। ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গেও কাজ করবার সুযোগ তিনি পেয়েছেন (ছবি)।

পেশাগত জীবনে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র মুখ্য জনসংযোগ অধিকর্তা এই ভদ্রলোকটি নিজের ধারাভাষ্যের কাজটাকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে বাড়িতে তাঁর কাজের প্রস্তুতির সময় তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও গৃহভৃত্য এঁদের সবাইকে নাকি ‘মৌনব্রত’ অবলম্বন করতে হ’ত। সঙ্গের একটা খাতায় নানারকম ক্রিকেটীয় ঘটনা ও তথ্যপরিসংখ্যান তিনি লিখে রাখতেন এবং ভাষ্য দেওয়ার সময় মাঝেমধ্যেই বুদ্ধি ক’রে সেগুলোর সুযোগমতন ব্যবহার করতেন। ফলে তাঁর ভাষ্য ছিল সুচর্চিত, পাণ্ডিত্যময় ও তথ্যপূর্ণ। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় সুরেশ অনর্গল কথা ব’লে যেতেন – এটা ছিল তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য – সেটা যাঁরা তাঁর ধারাভাষ্য শুনেছেন তাঁরা হয়ত মনে করতে পারবেন।

ক্রিকেট-সম্প্রচারে যখন টিভির প্রাধান্য বাড়ল, তখনও তিনি বেতার-মাধ্যমেই থেকে গেছিলেন। তিনি হয়ত বিশ্বাস করতেন যে ক্রিকেট-ধারাভাষ্যের প্রকৃত চর্চা বেতার-মাধ্যমে, যেখানে ভাষ্যকারকে কথার সাহায্যে শ্রোতাদের মনশ্চক্ষে ক্রিকেট-মাঠের জীবন্ত ছবি ফুটিয়ে তুলতে হয় – সেই ‘চ্যালেঞ্জ’ তিনি ছাড়েননি!

তাঁর সম্বন্ধে বর্তমানকালের একজন ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞের মন্তব্য দিয়ে শেষ করি:

• হর্ষ ভোগলে (ভারতীয় ভাষ্যকার ও সাংবাদিক): “I worked with so many commentators – few with his desire and preparation. He loved cricket. All India Radio was Suresh Saraiya’s heart and soul.”

সবশেষে, আমার এই অকিঞ্চিৎকর রচনার এক বড় প্রেরণার কথা উল্লেখ করি: শঙ্করীপ্রসাদ বসু-র লেখা “ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট” বইয়ের “ক্রিকেটের চার হৃদয়, এক চোখ” নামক রচনাটি, বাংলাভাষী ক্রিকেট-প্রেমীদের কাছে যা অবশ্যপাঠ্য ব’লেই আমি মনে ক’রে থাকি।


ছবি ও তথ্যসূত্র:

শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, অভিষেক মুখার্জি, রবি চতুর্বেদি, রামচন্দ্র গুহ, খালিদ আনসারি, ডেভিড ফ্রিথ, বেরি সর্বাধিকারী], সুব্রত সরকার, সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়, রুস্তম দেবু, ক্লেটন মুর্জেলো, সুধীর বৈদ্য।

কলরব রায়ের জন্ম কলকাতায়, ১৯৫৯ সালে, কর্মজীবনের বেশির ভাগও সেখানেই অতিবাহিত। স্কুল-জীবন কাটে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক অঞ্চলের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। পাড়ার ক্লাবে ও স্কুলের ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলবার অভ্যাসটা ছিল। কলেজ-জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র – ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে স্নাতক, কম্প্যুটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর। তিন দশক তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসূত্রে দেশে-বিদেশে প্রচুর ঝাঁকিদর্শন করে, তারপর সপ্তবর্ষব্যাপী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপনা অন্তে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ‘ক্রিকেট-প্রেমিক’। বর্তমানে ‘নন-ফিকশন’ বইয়ের প্রতিই বেশি আকর্ষণ, যদিও সবচেয়ে প্রিয় তিন বাংলা কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিবরাম চক্রবর্তী। ক্রিকেট-বিষয়ক বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক, সংগ্রাহকও বটে। প্রিয় ক্রিকেট-লেখকদের মধ্যে আছেন শঙ্করীপ্রসাদ বসু, রে রবিনসন, টনি কোজিয়ার, ডেভিড ফ্রিথ, প্রমুখ। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে লেখকের প্রথম বই "ক্রিকেটের খেরোর খাতা", এই বছর এল “ক্রিকেটের খেরোর খাতা: ফলো-অন”, আর লিখেছেন “Our Cricketing Odyssey with Kapil”, ভাস্কর বসু-র সঙ্গে যুগ্মভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *