অভিসার

অভিসার

অনেকদিন বাদে ঘোর বর্ষা কাটিয়ে সেদিন সকালে দেখা দিল ধারাস্নাত চোখ ধাঁধানো নীল আকাশ, আর অমনি ভেজা পৃথিবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো একঝাঁক রোদ্দুরের তীর। আজ শনিবার, কাজে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। বাইরের চাতালে পুরনো ক্যাম্প খাটটা পেতে ঠিক করলাম আজ বইগুলিকে রোদ খাওয়াবো। সকালের প্রথম পেয়ালা চা খেয়েই তাই বৃহৎ গোদরেজ আলমারির মোকাবিলায় নামা গেল ঝাড়ন, পুরনো কাগজ আর ন্যাপথালিনের ঠোঙ্গা হাতে।
সবচেয়ে উপরের তাকে রাখা লেনিন গ্রন্থাবলী ঝেড়েঝুড়ে তৃতীয় তাকে হাত দিতে প্রথম যে বইটা বেরোল, সেটা আমার প্রিয় বইগুলির অন্যতম ম্যাক্সিম গোর্কির গ্রন্থাবলীর একটা খণ্ড। বেঁটে, মোটা, চমৎকার বাঁধাই আর ভারী কাগজে ছাপা বইটা গত ত্রিশ বছরে বিন্দুমাত্র টসকায়নি। আনমনে বইটা ওলটাতে ওলটাতে হাত স্থির হল এসে ‘লোয়ার ডেপথস’-এর উপরে, আমার মতে যেটি গোর্কির অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। হঠাৎ হাত থেমে গেলো, ‘লোয়ার ডেপথস’ নামটি যেন টাইম মেশিনে উড়িয়ে নিয়ে ফেলল কুড়ি কুড়ি বছরের পারের দিনগুলিতে, বিগত সেই কৈশোরে, যেখানে স্মৃতি সততই সুখের।
দক্ষিণ কলকাতার এক অধুনা বিখ্যাত ইশকুলে কাটানো আটটা বছর সম্ভবতঃ আমার জীবনের সবচাইতে আনন্দের দিন। পাড়ার মেয়েদের ইশকুলে বকুল দিদিমণির তত্ত্বাবধানে তিনটে বছর কাটানোর পর উচ্চশিক্ষার্থে আমার বেপাড়া যাত্রা। নতুন ইশকুল আবার সহশিক্ষামূলক, একইসঙ্গে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে স্বাভাবিকভাবে বড় হবে, ভবিষ্যতের শুভ নাগরিক হবে, এমনই মহান আদর্শ নিয়ে এই ইশকুল গড়ে তুলেছিলেন একদল নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাব্রতী। এঁদের কথা মনে আসলেই শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নীচু হয়ে আসে। এঁদের কল্যাণে একদিকে অসম্ভব ঔদার্য, ততোধিক সহনশীলতা, অনুকরণীয় রসবোধ, আবার অন্যদিকে ব্রাহ্মসমাজীয় অনুশাসন এবং বামধারার রাজনীতির এক আপাত পরস্পরবিরোধী ব্যবহারিক পরিমণ্ডলে আমরা বড় হয়েছিলাম। কথায় বলে শিক্ষার প্রাথমিক দিনগুলিই মানুষের চরিত্র গঠন করে; সে যুগের সেই ইশকুলের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে সেটা খুব বেশী ভাবেই প্রযোজ্য।
সেই ইশকুলে পড়াশুনা ছিল এক দারুণ আনন্দের বিষয়। পঞ্চম শ্রেণী অবধি পরীক্ষার বালাই ছিল না। ফলে সুশিক্ষা এবং কুশিক্ষা সমানভাবেই আমাদের মস্তিষ্কের উর্বর জমিতে শিকড় গেড়ে বসেছিল। আমাদের দিন কাটতো মহানন্দে। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই চুকে যেতো। সঙ্গে ছিল বছর ধরে কখনো সাহিত্য সভা, কখনো অঙ্কন প্রদর্শনী, কখনো বৃক্ষরোপণ, আবার কখনো বা নাটকের মহড়া। তার মানে এই নয় যে একদল ছাড়া গরুর গোয়াল ছিল ইশকুলটা। মিঠেকড়া শাসনে আমাদের মতো তে-এঁটে বদমায়েশ ছাত্রও খুব বেশী মাথা তোলার সুযোগ পেতো না। বুঁদির কেল্লায় হানা দিয়ে ফেরা হামু রাজার মতো চারদিক টহল দিয়ে বেড়াতেন চায়না দিদিমণি, কথিত আছে ছেলেবেলায় যাঁর চিল-চীৎকারে অতিষ্ঠ কবিগুরুর কলম থেকে ‘কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত’ শব্দবন্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলো। এনাকে দেখে বাঘা বাঘা বদমায়েশেরও ঊরুসন্ধিতে ঘন ঘন গুরু গুরু ম্যারাকাস মন্দ্রিত হতো। শ্যেন দৃষ্টিতে ছাত্রছাত্রীদের চালবেচালের দিকে লক্ষ্য রাখতেন পুরু চশমা পরা ছিপছিপে ছোটখাটো চেহারার বন্দিতা দিদিমণি, যাঁর ‘ওখানে কি চলছে?” শুনলে শিরায় শিরায় তরল নাইট্রোজেনের স্রোত বয়ে যেতো। বাংলা শিক্ষক সার্থকদার পরিশুদ্ধ বাংলায় বিতরিত সুভাষিতগুলিতে কর্ণকুহর প্রহরশেষের আলোর মত রক্তিম হত না, এমন পাষণ্ড খুবই কম ছিল। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও ইশকুল ছিল আমাদের প্রাণের আনন্দ, মনের আরাম, আত্মার শান্তি। চাইলে প্রায় প্রতিদিনই ইশকুলের লাইব্রেরি থেকে পাওয়া যেত পাঁজা করা বই, পাওয়া যেত ভাল কোন রচনা লিখলে বা কঠিন কোন অঙ্ক কষে উঠতে পারলে শিক্ষক শিক্ষিকাদের পিঠ চাপড়ানি। আর পাওয়া যেত নানাবিধ বদমায়েশির এক প্রশস্ত সহর্ষ মৃগয়াক্ষেত্র।

পরিসর সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে পাঠককে আপাতত নিয়ে যাব এই রচনার উপজীব্যের সন্নিকটে – ইশকুলের নবম শ্রেণীর ‘খ’ অনুভাগে। যে কোন বর্গের ‘খ’ অনুভাগ মার্কামারা ছেলেপুলেতে ভর্তি থাকে, এ আমার সারাজীবন ‘খ’ অনুভাগে কাটানোর অভিজ্ঞতা। নবম শ্রেণীও এই মহান ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম ছিল না। অনুভাগে সর্বসমেত আঠাশজন ছাত্রছাত্রী, যার মধ্যে কুড়িটি বালক এবং আটটি বালিকা। ইশকুলের একতলার প্রান্তিক কক্ষটি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট। আদতে এটি ছিল স্নানঘর। বেশ প্রশস্ত ঘর, যাতে পাশাপাশি তিনটি সারে মোট চৌদ্দটি বেঞ্চিতে ২৮ জনের বসবার ব্যবস্থা (চিত্র ১)। ঘরের বাঁ দিকের কোণে ঘরে ঢোকার দরজা, যা সুখ্যাত ‘বাঁদোর’ নামে। ডানদিকে দুটি প্রমাণ মাপের পুরনো দিনের সাবেক বসতবাড়ির ধাঁচে গড়া চমৎকার চওড়া তাক সম্বলিত গবাক্ষ; তাক থাকার ফলে গবাক্ষের ভিতরের দু দিকে পাওয়া যেতো চওড়ায় দেড়ফুট এবং উচ্চতায় ছয়ফুট দুটি দেওয়াল। এই দুটি দেওয়ালের বৈশিষ্ট্য হল যে সামনের দিক থেকে দেখা না গেলেও ঘরের পিছনের দিক থেকে সেদুটি স্পষ্ট দেখা যেত। আর পিছনের জানালার লাগোয়া চারটি বেঞ্চে ছিল তাদের অবস্থান, এই আখ্যায়িকার মূল কুশীলব যাঁরা। (চিত্র ১ দ্রষ্টব্য)
মানবসমাজের মত আমাদের এই ক্ষুদ্র বর্গটিও ছিল শ্রেণীবিভক্ত। সামনের দুটি সারির চারটি বেঞ্চি ডাকসাইটে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের দখলে। মাঝের সারির তিনটি এবং বাঁদিকের সারির দুটি বেঞ্চিতে ভালমানুষ, উদ্যমী এবং সুশীল বালকবালিকাদের অবস্থিতি। আর গবাক্ষ ২ সন্নিহিত একটেরে চারটি বেঞ্চিতে বর্গের নীচের মহল। চিত্র ১ অবলোকনে এই বিন্যাসের সঙ্গে সুধী পাঠক পরিচিত হয়ে নিন।
লোয়ার ডেপথস বা নীচের মহল নামকরণের কৃতিত্ব বাংলা শিক্ষক সার্থকদার। কোন এক বসন্তের অপরাহ্ণে একান্তই প্রকৃতিগত প্ররোচনায় বর্গের – বিশেষত শেষ চারটি বেঞ্চির বালকগণ যখন কিঞ্চিৎ উচাটন এবং বেপথু, এবং তাদের কর্মকাণ্ড ইশকুলের শৃঙ্খলার গৃহীত গণ্ডী ছাড়িয়ে সুদূরের পিয়াসী, তখনই সার্থকদার প্রবেশ। ক্লাসে পুনরায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর অননুকরণীয় আনুনাসিক উচ্চারণে তিনি সর্বজনের অবগতির জন্য জানালেন যে ‘Each with each shall take its flight / The dove with dove, the kite with kite’[এবং পৃথিবীতে এই নিয়মই নাকি সতত ক্রিয়াশীল। সেজন্যই নাকি বর্গের কৃতী ছাত্রদের অবস্থান সামনের সারিতে, উদ্যমী এবং সুশীল ছাত্রছাত্রীরা জোটবদ্ধ শ্রেণীর মধ্যমভাগে। বাকী যেগুলি ঝড়তি-পড়তি, সেগুলি জুটেছে একসঙ্গে, ক্লাসের শেষ অংশে। নীচের মহল বা ‘লোয়ার ডেপথস’-এ বসবাস কারুর কারুর পক্ষে নিশ্চয়ই আনন্দের…..কিন্তু সুশীল সমাজের পক্ষে তা যে চূড়ান্ত দুর্ভোগের, সেটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিতে ভুললেন না সার্থকদা।

চিত্র ১

সেই থেকে পাকাপাকিভাবে মহলে বিভক্ত হয়ে গেল নবম শ্রেণীর ‘খ’ অনুভাগ। আর কিছুদিনের মধ্যেই সংক্ষেপে মহলগুলি — কৃম (ক্রিম)’ ‘সুম’ এবং ‘ নীম (নিম)’ নামে পরিচিতি লাভ করলো। সুধী পাঠক নামকরণের সঙ্গে চরিত্রের অদ্ভুত মিল নিশ্চয় লক্ষ্য করে ফেলেছেন এতক্ষণে।
নীচের মহলের আটটি বালকের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কি ভাবে হেসে খেলে মজা মেরে ইশকুলের সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। বলাই বাহুল্য পড়াশুনা ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে তাদের উৎসাহ প্রবল। বৃক্ষরোপণ বা উৎপাটন-এর অনুষ্ঠানে প্রথম সারির সৈনিক তারা। জ্যামিতি বাক্সের কাঁটাকম্পাস সোজা করে দুমুখো বল্লম বানিয়ে ইশকুলের গানবাজনার ঘরের দেওয়ালে প্রলম্বিত তানপুরার খোলে শরানুসন্ধানে তাঁরা অর্জুনের সমকক্ষ। পারুক বা না পারুক, নাটকের মহড়াতেও তারাই আগে। নিজেদের মধ্যে প্রগাঢ় সখ্যতা। বহু গুণেরও অধিকারী এরা। যেমন প্রবালঃ অসাধারণ চিত্রকর, যার পেন্সিলের ছোঁয়ায় সমস্তকিছুই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বা জিষ্ণু, এই বয়সেই মার্ক্স এবং স্তানিশ্লাভস্কির সঙ্গে যার পরিচিতি ঘটে গেছে এবং বাদল সরকারের বহু নাটক দেখে যে ইশকুলময় অতুল কীর্তি স্থাপন করেছে। তালঢ্যাঙা ধলা সুমিত এবং কালা রঞ্জন বন্ধুর পিছনে লাগা কিম্বা বিনাপয়সায় বাসে ঝুল দেওয়া কিম্বা গড়িয়াহাটের মোড়ে ট্রামের টিকি ওভারহেড তার থেকে সরিয়ে ছুট লাগানো – এইধরনের যে কোন গঠনমূলক কাজে প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একই নামের অধিকারী প্রবীরদ্বয় (রায় ও রায়চৌধুরী) বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিণ নানা কৃৎকৌশলে পারঙ্গম। প্রথমজন কিঞ্চিত তোতলা, ফলে গম্ভীর ও মিতবাক। দ্বিতীয়জন প্রবলভাবে সবাক। কাঠ বাঙ্গাল সঞ্চয়ন নীচের মহলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বজায় রেখেও সুশীলমহল থেকে নীচের মহলে স্বচ্ছন্দে সতত সঞ্চরণশীল। এবং এই বিবিধ মৌলের সমাহারে গঠিত উপদলটিকে সৎ ও সঠিক পথে পরিচালনা করার গুরুদায়িত্ব ছিল আমার উপর।

চিত্র ২

প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে এই কক্ষের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অংশের সঙ্গে সুধী পাঠকের পরিচিতি ঘটানোটা প্রয়োজন। কক্ষের পশ্চাতবর্তী গবাক্ষের পূর্ববর্ণিত দেওয়ালদুটি ছিল নীচের মহলের ছাত্রদের কল্পনা এবং অঙ্কন প্রতিভার সাক্ষী (চিত্র ২ দ্রষ্টব্য)। বাঁ দিকের দেওয়ালের উপরের অংশটি বরাদ্দ খ্যাতনামা সমস্ত কবি সাহিত্যিকদের জন্য। এই অংশের শীর্ষে বিরাজমান পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বিদ্যালয়খ্যাত শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার বড়ালের, ‘মধ্যাহ্নে’ নামক অপূর্ব খণ্ডকাব্যে যিনি তৎকালীন মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে দীর্ঘদিন যাবৎ মোহিত করে রেখেছিলেন। দেওয়ালচিত্রে অবশ্য শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার বড়াল থেকে বেড়ালে পরিণত হয়েছেন প্রবালের পেন্সিলের জীবন্ত আঁচড়ে, একটি থাবা তুলে এলানো হৃদয়ের ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন দূরে……বহুদূরে যেখানে তাঁর স্ববর্ণিত ‘গাভী শুয়ে তরুতলে, হংসী ডুবে উঠে জলে, ডিঙ্গাখানি বেঁধে তীরে জেলে ঘরে যায়’ প্রবালের কল্পনায় সম্পূর্ণ অন্য রূপ ধারণ করেছে। সেই সুদূরে দৃষ্টিপাত করলে পাঠক দেখতে পাবেন হৃষ্টপুষ্ট একটি সম্রাজ্ঞী হংসী গাছের তলায় পক্ষ বিস্তার করে গভীর আলস্যভরে শুয়ে আছে, সাধারণ হাঁসের মাপের একটি গাভী পশ্চাৎদেশ ঊর্ধ্বমুখ করে জলের মধ্যে খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত, এবং গামোছাপরিহিত কৃশকায় নিরীহ এক জেলেকে নদীর তীরের খুঁটিতে বেঁধে রেখে বৃহৎ এক ডিঙ্গা দৃপ্ত পদক্ষেপে রওয়ানা হচ্ছে নিকটবর্তী গ্রামের দিকে। এরই পাশাপাশি এক বিস্তৃত গুদামঘরে একাধিক বস্তার মধ্যে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে মোহিতলাল মজুমদারকে; চিত্রে অবশ্য তাঁর নাম লোহিতমাল মজুতদার। এর পরবর্তী চিত্র অষ্টম শ্রেণীতে পঠিত কৈলাস গিরির নিসর্গদৃশ্য। প্রবালের হাতের নিপুণ আঁচড়ে ‘অতি মনোহর শত শশী পরকাশ / গন্ধর্ব কিন্নর যক্ষ বিদ্যাধর অপ্সরাগণের’ বাসস্থান কৈলাস ভূধর প্রায় নরকের চেহারা নিয়েছে। নীচে লেখা ‘কৈলাস গিরি / অতি বিচ্ছিরি আহা কি রূপের ছিরি’। এহেন নানা ধ্রুপদী উপস্থাপনার সন্নিকটেই সুররিয়্যালিস্ট প্রতিবেদন জীবনানন্দ দাসের ‘ঝরে না’ক বনে’ কবিতার চিত্রকল্প। পর্ণমোচী এক বিশাল অরণ্যের প্রতি বৃক্ষ থেকে স্খলিত হচ্ছে বিভিন্ন মাপের বিভিন্ন আকারের নাক চোখা নাক, বোঁচা নাক, খ্যাঁদা নাক, মোটা নাক, নোলক পরা নাক, সিকনি গড়ানো নাক, নাসারন্ধ্র থেকে বেরিয়ে থাকা চুলসুদ্ধ নাক এমন হাজার নাক…ফলে বনতল নাকে নাকে ঢাকা। এই সিরিজের শেষ ছবি কবি কালিদাস রায় বিরচিত ‘বৃন্দাবন অন্ধকার’ অনুসারে সৃষ্ট। এটি মূলত অন্ধকারাছন্ন. এবং যথেষ্ট সজেস্টিভ। ছবির পরিচিতিতে লেখা ‘বৃন্দাবনে লোডশেডিং”।

চিত্রশালার পরবর্তী অংশটি উৎসর্গীকৃত জাতীয় ইতিহাসের নানা ঘটনার বিবরণে। এখানে প্রথমেই দেখা যাবে মায়ের কোলে শায়িত কন্ধকাটা শিশু কনিষ্ক পা দাপাচ্ছেন। শ্রাবস্তীপুরে হা হা শব্দে জেগে ওঠা দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় ডাকা সভাকক্ষে ডিসপেপসিয়াগ্রস্ত শীর্ণকায় রত্নাকর শেঠ এক বিশাল উদরের দিকে হস্ত প্রসারিত করে কাতরকণ্ঠে বুদ্ধদেবকে বলছেন ‘ক্ষুধার্ত বিশাল ভুঁড়ি / এর ক্ষুধা মিটাইব আমি এমন ক্ষমতা নাই স্বামী’। ঘটনাটি এই ছবিতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত এবং সভাকক্ষের ডিটেল দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। পরবর্তী ছবিটির নায়ক দুর্গেশ দুমরাজ। চারটি অংশে বিভক্ত এই চিত্রপট রাজস্থানি শৈলীতে আঁকা। অংশ ১-এ বর্ণিত দুম অর্থাৎ ল্যাজের সম্রাট দুমরাজের শৈশব; এখানে হামা দেওয়া শিশু দুমরাজ তাঁর ক্ষুদ্র লাঙ্গুলটি নিজেই তাড়া করে ফিরছেন। অংশ ২-এ দুমরাজ গোঁফ চুমরোতে চুমরোতে তোলা উনুনে জোয়ারি রুটি সেঁকায় ব্যস্ত এক রাজপুত তরুণীর দিকে ফালুক ফুলুক তাকাচ্ছেন। তরুণী যে সেই সপ্রশংস দৃষ্টিতে বিমোহিত এবং যারপরনাই পুলকিত তা সহজেই বোঝা যায়। এদিকে একটু নজর করে দেখলেই বোঝা যাবে যে যার উপর দুমরাজ অধিষ্ঠিত তা প্রকৃতপক্ষে তাঁর নিজের ল্যাজেরই পাকে পাকে গঠিত পিরামিডাকৃতি একটি মোড়া। তৃতীয় অংশে পাঠকের দৃষ্টিতে ধরা পড়বে মারাঠা দস্যুকে আজমীঢ় গড় ছেড়ে দেওয়ার আদেশে দারুভূত দুমরাজ। মুখ স্তম্ভিত, ব্যথিত, প্রস্তরবৎ, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে ক্ষোভের অশ্রু, এতটাই অপমানিত যে ল্যাজের প্রান্তে ধরা চৌখুপী নোংরা রুমালটা ব্যবহার করার কথাও ভুলে গেছেন তিনি। শেষ অংশটি চূড়ান্ত বিয়োগান্ত। ‘প্রভুর কর্মে বীরের ধর্মে বিরোধ মিটাতে আজ । দুর্গদুয়ারে ত্যজিয়াছে প্রাণ দুর্গেশ দুমরাজ’। আজমীঢ় গড়ের প্রশস্ত দরজার আড়কাঠ থেকে ঝুলন্ত দুর্গেশ দুমরাজের নিষ্প্রাণ দেহ। গলায় প্যাঁচানো সেই ল্যাজ। বিরাট ক্যানভাসের এই ছবিটি ‘দুমরাজ অথবা লেজের প্রিভিলেজ’ নামে আখ্যায়িত।

নীচের মহলের বাসিন্দারা যে কেবলমাত্র জাতীয় ইতিহাসেরই সুধী ছাত্র এমন ভাবার কোন কারণ নেই। তার স্বাক্ষর ছয় ফুট উচ্চ এবং দেড়ফুট প্রশস্ত দেওয়ালের অন্য এক অংশে, যেখানে চিত্রায়িত দেলাক্রোয়ার “লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ অনুকরণে প্রবালের অসাধারণ পেন্সিল স্কেচ। প্রবাল নেপোলিয়নের পরম অনুরাগী, সুতরাং বেশ কয়েকটি ছবি তার সেই হিরোর প্রতি উৎসর্গীকৃত। অষ্টম শ্রেণীতে পঠিত Incident of the French Camp অনুসরণে প্রথম ছবিতে নেপোলিয়নের দণ্ডায়মান উপস্থাপনা। 

“You know, we French stormed Ratisbon:
A mile or so away,
On a little mound, Napoleon
Stood on our storming-day;
With neck out-thrust, you fancy how,
Legs wide, arms locked behind,
As if to balance the prone brow
Oppressive with its mind.”

বিজয়ের মুহূর্তে নেপোলিয়নের এই ছবির পাশেই বিজিত নেপোলিয়নের অভিব্যক্তি বিধৃত। সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত নেপোলিয়ন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ফেনায়মান দক্ষিণ অতলান্তিক সাগরের বুকে বিন্দুর মত আয়তনের সেন্ট হেলেনা দ্বীপ। ইনসেটে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট সেই দ্বীপটিতে গভীর অবসাদভরে অর্ধশায়িত নেপোলিয়ন, তাঁর পৃষ্ঠদেশ একটি ক্ষুদ্রাকৃতি আগ্নেয়গিরিতে ন্যস্ত, পা দুটি দ্বীপের সীমানা অতিক্রম করে অতলান্তিকের জলরাশিকে প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছে। শ্রান্ত, হতোদ্যম নেপোলিয়নের মাথার উপর অঙ্কিত শ্বেত বসনধারী সন্ত দেবী হেলেনা, দক্ষিণহস্তের তর্জনী হেলনে তিনি নেপোলিয়নকে অবসাদ থেকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। কমিক বইয়ে কথোপকথনের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ আকৃতির মধ্যে লেখা দেবীর সতর্কবাণী

চিত্র ৩

এর বেশ কিছুদিন বাদে যখন ‘দ্য লিটল প্রিন্স’ বইটি পড়ার সুযোগ আসে, তখন বুঝেছিলাম যে ঔৎকর্ষের বিচারে প্রবালের এই বিশেষ চিত্রায়নটি সাঁৎ একজুপারীর চেয়ে কোন অংশে খাটো তো নয়ই, বরং সমগোত্রীয়।
কমিকের কথায় মনে পড়ল গ্যালারি অফ মাস্টার্স-এর ‘ বিবিধ’ উপভাগের কথা। এখানে নানা বিষয়ের সহাবস্থান। জিষ্ণুর আঁকা ‘পাদপদ্মে’ বায়বীয় একটি উপাদানকে পদ্মের রূপ ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে বিপন্ন নানাবিধ নাক। আমাদের শৈশবে (ভাগ্যিস ) টেলিভিশন ছিল না…..অ্যানিমেটেড কমিকও ছিল না, তাই সময় বেতাল, ডায়ানা, গুরন, কিলাউয়ির সোনাবেলা, জেড পাথরের চূড়াকৃতি ঘর, ম্যান্ড্রেক, নার্দা, কার্মা, লোথার এদেরকে নিয়ে কেটে যেতো। অরণ্যদেব বা বেতাল সপ্তাহে সোম থেকে শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকার দ্বিতীয় পাতার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আত্মপ্রকাশ করতেন। বেতাল কেন রবিবার বেরোন না, তা নিয়ে গূঢ় এক কূট প্রশ্ন ছিল। এর উত্তর ছিল যে বেতালের সম্বল মাত্র একটিমাত্র চাড্ডি, সারা সপ্তাহ তাই ব্যবহার করে রবিবারে তিনি গুঁড়ো সাবানে কেচে সেগুলি মেলে দেন। ‘বিবিধ’ পর্যায়ে খুলি গুহার জানালায় দেখা যাচ্ছে বেতালকে, তাঁর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি বাইরে, প্রবল বর্ষণে সেখানে ভিজছে তাঁর চাড্ডি, মুখোশ, ইত্যাদি……সোমবার বেতাল বেরুবেন কি পরে? দ্বিতীয় কূট প্রশ্ন ছিল যে ডায়ানার সঙ্গে বিবাহের পরে কি বেতাল নিজের চাড্ডি নিজেই কাচতেন, না কি ডায়ানা কেচে দিতেন? জনশ্রুতি ছিল যে বেতাল নাকি দ্বিতীয় এক সেট চাড্ডির লোভেই বিয়ে করেছিলেন।

পাঠক, এই সেই কক্ষস্থান প্রান্তবর্তী গ্যালারি অফ মাস্টার্স, মতান্তরে শয়তানের কর্মশালা।

সম্পাদকীয় টীকা

পাঠকদের দুর্ভাগ্য তাঁরা এমন একটি সুখপাঠ্য স্মৃতিকথা ও রম্যরচনার নিয়মিত পাঠ থেকে বঞ্চিত হবেন। 

এই সম্পর্কে বিশদে জানা যাবে যে লেখাটিতে তা হলঃ https://abasar.net/soumya-sensharma/

সৌম্য সেনশর্মা (১৯৬১ - ২০২৪) পাঠভবন থেকে ১৯৭৭ এ মাধ্যমিক, ১৯৭৯ তে সেন্ট লরেন্সে উঃ মাধ্যমিক এবং ১৯৮৩ তে যাদবপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। সমাজ সচেতন সৌম্য যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল নাম। দুর্গাপুরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন ও সৌম্য বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকায় লেখালেখা করেন। নানা সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন, এন আই টি দুর্গাপুরের রেজিস্ট্রার হিসেবেও সফলভাবে কাজ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *