আমার দুর্গাদি
দুর্গাদিকে আমি ছোটো থেকে চিনতাম – এখন শুধু স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে।
‘পথের পাঁচালি’ পড়েছি এই বয়েসের অনেক পরে। তবে দুই দুর্গার একটা মিল ছিল। দুজনেই চুরি করতে ওস্তাদ। মাঝেমাঝে আমাদের পুজো মন্ডপে চার আনা দিয়ে ঘটা করে নমঃ করত। আমি ওর ফ্রক টেনে বলতাম, “কী চাইলি রে দুর্গাদি?” আমাকে বগল দাবা করে হাঁটতে হাঁটতে বলত, “চল, তোকে সাঁতার শেখাই।”
দুর্গাদি আমার পাড়াতুতো দিদি। সৎমায়ের কাছে অনাদরে বড়ো হওয়া এক ডাকাবুকো মেয়ে। ভূত বলে কিছু নেই এই বিশ্বাস সবচেয়ে আগে ওর থেকেই পেয়েছিলাম। রাতবিরেতে পাড়াময় ঘুরে বেড়াত। প্রায় রাতে ওদের বাড়ি থেকে চিৎকার মারধোরের আওয়াজ পেতাম। খুব কান্না পেত। ঠাকুমার বুকে মুখ গুঁজে বলতাম, “দুর্গাদিকে মারছে কেন?” ঠাকুমা মাথায় হাত রেখে বলতেন, “কাঁদিস না, মধুসূদনদাদা সব ঠিক করে দেবে।” আমি জানতাম মধুসূদনদাদা কেবল গল্প। দুর্গাদির চোখের তলায় গালে পিঠে কত কালসিটে দেখেছি। তবু নাছোড় হাসি মুখে লাগিয়ে বলত, “আরে শোন কাঁকন, মার খেতে বেশি সাহস লাগেনা, সাহস লাগে যে কারণে মার খেলাম সেটা আবার করতে।”
এই অবধি সাহস লড়াই বোধহয় তেমনটা বোঝা গেল না, তাই না! আসলে আমার কেন যেন মনে হত দুর্গাদি যা করে তাই দুঃসাহসিক। ও যখন এক ডুবে অঞ্জনার মাঝখানে গিয়ে ভুস করে ভেসে উঠত, ভাবতাম, ‘উফ্ কী সাহস!’ তবে ওর ভেতরে যে কতটা অসীম শক্তি আছে তা বুঝলাম বিজনদা আসার পর। গঞ্জের কেচ্ছা কাহিনি আমাদের চৌকাঠ পেরিয়েও কখনো কখনো ঢুকে পড়ত। যেমন একদিন ডালসেদ্ধতে লঙ্কা ডলতে ডলতে মা-ঠাকুমা ফিসফিস করল দুর্গাদি নাকি খারাপ। আমার খুব ভয় হয়েছিল। ক’দিন পালিয়ে থাকলাম। তারপর স্কুল থেকে ফেরার পথে হাসপাতালের পাঁচিল ভাঙায় ড্যানা চেপে ধরল।
“কী হয়েছে তোর? আমার দিকে তাকাস না, কথা বলিসনা?”
“তুই খারাপ হয়েছিস?” এই অবধি বলে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিলাম।
বুকে জড়িয়ে বলল, “ধুস্ তুই না পাগলি, ভালোবাসলে কেউ খারাপ হতে পারে? যারা বলে তারা শয়তান।”
কিন্তু এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই বিজনদা হাটে যাবার সময় ম্যাটাডোর উল্টে এক পা-কাটা ল্যাংড়া হয়ে গেল। সবাই বলল ‘এবার মেয়েটার আসল চেহারা দেখা যাবে।’ দেখা গেল, সত্যি দেখা গেল। আনন্দময়ীতলায় বিয়ে করে নিল বিজনদাকে। আমাদের পাড়ায় একটা এক কামরার টিনের ঘরে ওরা থাকত। সারাদিন গেঞ্জি কাটত বিজনদা, উদাস হয়ে বসে থাকত আর জানি না কেন, মাঝেমাঝে দুর্গাদিকে মারত। দুর্গাদি কাটা গেঞ্জি রণ সাহার বাড়ি পৌঁছে দিত, মুড়ি লঙ্কা মেখে উদাস বিজনদার গায়ে হাত রাখত আর মার খাওয়ার পরের দিন আমায় বলত, “অন্যের উপর নির্ভর করে বাঁচে তো, তাই মাঝেমধ্যে নিজেকে ঝালিয়ে নেয়। তাই বলে ভাবিস না আমায় ভালোবাসে না।”
ঝকঝকে ফর্সা দুর্গাদি বাদামি হয়ে গেল, আমি পাশ করে সিক্সে উঠলাম। ও এখন বেলডাঙার বাজারে সব্জি বিক্রি করে। একদিন অনেক ক’জন লোক ওদের টিনের ঘরটার সামনে ঝামেলা করছিল। আমার বাবা এগিয়ে গেলেন। দিদি নাকি পাড়ার সবার বাড়ি থেকে কৎবেল, কাঁঠাল, আম চুরি করে বাজারে বিক্রি করে।
দুর্গাদি কোমরে হাত রেখে আমার বাবাকে বলল, “কাকা ওদের বলে দ্যান আমার বরের এক-পা কাটা বলে আমায় অসহায় ভেবে যা ইচ্ছা তাই যেন না বলে। হাতেনাতে ধরে যেন বলে।”
ওর চোখ জ্বলতে দেখেছিলাম সেদিন। আমি জিজ্ঞাসা করতেই বলল, “ইচ্ছা তো করে রে চুরি করে সব ফাঁক করে দিই, কিন্তু করি না। এতে আমার অসহায়তা প্রকাশ পাবে।”
আমি দেখেছি, গর্ভবতী দুর্গাদি কত সহজে হেসে আমার মায়ের দেওয়া চাল, ডাল ফিরিয়ে দিয়েছে।
“ও কাকি যখন সত্যি আর উপায় থাকবে না, দিও, নেব।”
বিজনদার টিবি ধরা পড়ল। সবাই বলল বাচ্চার ক্ষতি হবে, সরে যেতে। বারান্দায় চৌকি পেতে দুর্গাদি শোয়, ঘরে বিজনদা। দরজা বন্ধ। ঠোঙা বানিয়ে মাল কেটে ধূলিধূসরিত দুর্গাদি স্নান সেরে কপালে সিঁদুর ফোটা দিত, আমার মনে হত আমাদের বাড়ির মাটির ঠাকুরের এটাই রক্ত মাংসের রূপ। আমার মা অনেক সাহায্য করেছিল। হাসপাতালে নেওয়া। আতুরে ওদের দু’জনকেই খাবার দেওয়া। কিন্তু অভাব যে আমাদেরও!
মেয়েটা বড়ো হল, বিজনদা সেরে উঠল, দুর্গাদি কষ্ট করে যোগাড় করল একটা ঠ্যালা তাতেই হবে লুচি আর তরকারি। বিক্রি করবে কৃষ্ণনগর স্টেশনে। আমরা তখন কল্যাণী আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। চোখ ছলছল করে দিদি বলেছিল, “আমায় মনে রাখিস। ভুলে যাস না।”
যতবার ফিরেছি কৃষ্ণনগরে দিদির সঙ্গে দেখা করেছি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, গানবাজনা, আঁকা সব শিখিয়েছে। বিজনদাকে একটা হুইল চেয়ার কিনে দিয়েছে। ওদের দোকানে এখন অনেক কর্মচারী। একতালা ছিমছাম বাড়িটার প্রতিটা ইঁটে দিদির পরিশ্রম আর লড়াইয়ের ঘাম মিশে আছে। ঠাকুমা চলে যাবার পর কৃষ্ণনগর যেতে ইচ্ছা করত না, ফলে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। একদিন এক মর্মান্তিক খবর এল। সে খবর আজ বলতে প্রাণ চায় না। আমার দুর্গাদি চ্যালেঞ্জ নিতে জানতো, লড়তে জানতো, আমি ওর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। বিপদ এলে মনে মনে আজও ভাবি দুর্গাদি হলে কী বলত?
“আরে বিপদ কোনো ব্যাপার না ও ঠিক কেটে যাবে। সমস্যা হল পরের বিপদটা সম্পর্কে কিছুই এখন জানা যাচ্ছে না।”
———
ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আন্তর্জাল .
1 Comment