কর্পোরেট কন্যারা: পর্ব ১: জননী জন্মভূমিশ্চ

কর্পোরেট কন্যারা: পর্ব ১: জননী জন্মভূমিশ্চ

আশ্বিনের এক শারদপ্রাতে টুং করে বেজে উঠল ল্যাপটপ। মেলবক্সে ইমেইল ঢুকল। ঢুকুক, সারাক্ষণই ঢুকছে তারা। বিরাম, বিশ্রাম নেই। অলস নয়নে একবার চোখ বোলাতেই গায়ের লোম খাড়া! শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা ভয়ের স্রোত! কুলকুল করে ঘামছি! সামনের স্ক্রিনে বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে রয়েছে তিনটি লাইন। তাদের বক্তব্য বেশ সোজাসাপটা, সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই!

Ms. Y has tendered her resignation with immediate effect. Her last working day will be… 

এসব কী? এর অর্থ কী? 

শ্রীমতী ওয়াই আমার কাছেই কাজ করে, আমারই টিম মেম্বার। মেম্বার বলা অবশ্য ঠিক হবে না, কারণ শ্রীমতী ইতিমধ্যেই  কলেজ থেকে সদ্য-আগত একঝাঁক ছেলেমেয়েকে সামলায়। তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে কর্পোরেটে চালু করাটা শ্রীমতীর দায়িত্বে। টিম লিডার বলাটাই ঠিক। 

কর্পোরেট কন্যা

ঝকঝকে মেয়ে, তুখোড় বুদ্ধি, লেখাপড়ায় বরাবরের চৌখস। এখন কর্পোরেটের একজন দক্ষ কর্মী ও জুনিয়র ম্যানেজার। শ্রীমতী ওয়াইকে আমার বরাবরই পছন্দ। তার হাতে দায়িত্ব দিয়ে চোখ বুজে ভরসা করা যায়, যে যত কঠিনই হোক, কাজটা হবে। এই আশ্বাসটি দিতে পারে এমন লোক তো বেশি দেখি না!  

এ কথা শুনে অবশ্য অনেকে আড়ালে ঠোঁট ওল্টায়। তাদের ধারণা মেয়ে বলেই শ্রীমতী ওয়াইয়ের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্ব আছে। আমি কান দিই না। কর্পোরেটে আমার এত বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেয়েরা বেশি পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল। লেগে থাকতে পারে, মাঝপথে পালিয়ে যায় না। ব্যতিক্রম কি নেই? অবশ্যই আছে। সংখ্যায় তারা নগণ্য। 

সেই শ্রীমতী ওয়াই চাকরি ছেড়ে দিল? এই সময়? যে সময় তার ভরসাতেই বড় একটা প্রজেক্ট সই করতে চলেছি! সেও বিলক্ষণ জানে সে কথা। গত কয়েকমাস আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। ওয়াই ছাড়া আর কে-ই বা এমন জটিল কাজ তুলতে পারবে?

নাহ, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হচ্ছে। ওয়াইকে ডেকে পাঠাব? বাইরে কোথাও লাঞ্চ খেতে খেতে কথা বলাই মনে হয় ভালো হবে।            

ওয়াই এল। মুখ নীচু। চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। সতর্ক হই, প্রথমেই রেজিগনেশন প্রসঙ্গ তোলা যাবে না। প্রজেক্ট নিয়ে এ কথা সে কথা পাড়ি। স্টেটমেন্ট অফ ওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। ওয়াই তাতে অনেক সাহায্য করছে। বিরাট ও জটিল প্রজেক্ট, বেশ উচ্চ আর্থিক মূল্যের কাজ। কোম্পানির বড়কর্তারা নজর রাখছেন। সবসময় খোঁজ নিচ্ছেন, কী হল? কতদূর এগোল? কন্ট্রাক্ট সই হল? হাই ভিজিবিলিটি যাকে বলে। 

ওয়াই নিজেই একসময় বলল, “আমার রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে ভাবলে কিছু? মানে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে যাব তো, তাই…”

এই সুযোগে আমিও চেপে ধরি, “ব্যাপারটা কী বলো তো? চাকরি ছাড়ছ কেন? কাজের সুনাম আছে, উন্নতি করছ, ছাড়ার কী হল? অন্য জায়গায় বেশি টাকার অফার? সে না হয় আমরা ম্যাচ করে দেব…”

কেঁদে ফেলল। 

“আমার কেরিয়ার শেষ। আর কিচ্ছু হবে না আমার, কোনও রাস্তা খোলা নেই!”   
“সে আবার কী? কেন?” আমি হতবাক!
“আমি প্রেগন্যান্ট, কনসিভ করেছি।” 

এবার যেন একটু আলো দেখা যাচ্ছে। সেই শাশ্বত বিরোধ – eternal conflict! মা হওয়া আর কর্পোরেট কেরিয়ার দুটো একসঙ্গে হতে পারে না!

“সে তো আনন্দের খবর, তাতে চাকরি ছাড়ার কী হল?” 
এবার মুখ তুলে তাকিয়েছে, “প্রজেক্টের মাঝখানে আমায় ছুটিতে চলে যেতে হবে। কোম্পানির রেভিনিউ লস হবে, তুমি কত সমস্যায় পড়বে! তারপর তো এমনিতেই আমার চাকরিটা যাবে! তার থেকে আমিই বরং সরে যাই। আমার স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা – সব শেষ!” আবার চোখ ছলছল করে উঠল।  

এবার একটু কড়া হতেই হয়, “কী করে জানলে যে তুমি মেটারনিটি লিভে গেলে এগুলোই হবে? কেউ তোমায় কিছু বলেছে?”
“সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকেই তো শুনছি এসব। ক্যাম্পাসিংএ আমরা মেয়েরা ভালো চাকরি পেলাম তো টিটকিরি ভেসে এল। ‘সেই তো বাবা মেটারনিটি লিভ নিয়ে আর কচি ছেলের ন্যাপি পাল্টে দিন কাটাবি! কেন যে তোরা কর্পোরেটের টেবিলগুলো আটকে রাখিস!'” ওয়াইয়ের গলার স্বর হতাশ শোনায়। 

নিজের কথা মনে পড়ে যায়। বেশ কয়েকবছর আগে মা হয়েছি, সন্তানের জন্ম দিয়েছি। মাতৃত্বকালীন জটিলতার জন্যে ছ’মাসেরও বেশি ছুটি নিতে হয়েছিল। আমার গ্ৰুপ লিডার ছিলেন একজন সুভদ্র, সহৃদয় মানুষ। নিয়মিত আমার শরীরের খোঁজ নিয়েছেন। ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়ে অন্য লোক দিয়ে কাজ করিয়েছেন। নবজাতক পুত্রকে দেখতে এসেছেন নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে করে। এমনটাই তো হওয়ার কথা, তাই না? 

সবটুকুর পরেও কিন্তু কথা থেকে যায়।

কাজে ফেরার পর আমার পদোন্নতি পিছিয়ে গিয়েছিল। হিউম্যান রিসোর্স গ্ৰুপের কর্ণধার মহিলা – হ্যাঁ, তিনিও একজন মহিলাই ছিলেন – সেই তিনি মিষ্টি করে তার কারণ জানিয়ে দিলেন। যুক্তি দিলেন, অভিজ্ঞতার নিরিখে আমি ছ’মাস পিছিয়ে পড়েছি! 

পাঠক বিশ্বাস করুন, এই পরিণত বয়েসে এসে আমিও জানি যে কয়েক মাস প্রোমোশন পিছিয়ে গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় না, not the end of the world! পয়ঁত্রিশ বছরের কর্পোরেট জীবনে কয়েক মাস তো সমুদ্রে বিন্দুবৎ! কিন্তু তখনকার সেই নবীন কর্মীর কাছে তা ছিল মৃত্যুতুল্য অপমান! সব বন্ধুরা একধাপ এগিয়ে গেল, আমি রইলাম পড়ে! এ যেন সেই ক্লাসে ফেল করে চেয়ে চেয়ে দেখা, সহপাঠীরা সবাই নতুন ক্লাসে চলে গেল!

বর্তমানে ফিরি। সামনের মেয়েটিকে এখন সাহস দেওয়া দরকার, তার ভাবনার ভুলটা ভাঙানো দরকার। একজন মেয়ে হিসেবে আরেকজন মেয়ের পাশে থাকা দরকার। 

কর্পোরেট কর্মী ও মাতৃত্ব – বৈপরীত্য?

সেদিন লম্বা কথাবার্তা চলেছিল। শ্রীমতী ওয়াই তার পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নেয়। কিছুটা দ্বিধায়, কিছুটা সংকোচে। কোথায় যেন আত্মবিশ্বাস টাল খেয়েছে। চটপটে, স্মার্ট মেয়েটি সামান্য হলেও জবুথুবু। সামনের কয়েকটা মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েটির খেয়াল রাখতে হবে।

“এইচ আর (হিউম্যান রিসোর্স) কে জানিয়েছ?” প্রশ্ন করলাম একদিন।

মাথা নীচু করল। 

“শোনো, তোমার কয়েকসপ্তাহ ছুটির দরকার হবে। এই ছুটি তোমার প্রাপ্য, মৌলিক অধিকার। যতটা সম্ভব আগে থেকে ছুটির দরখাস্তটা করে দাও। গ্রুপ লিডার হিসেবে আমার অ্যাপ্রুভাল থাকবে।” 

তাও দেখি মুখ নীচু করে আছে। 

হাসি পেল। আবার মনে পড়ে নিজের কথা। প্রেগন্যান্সির সময় বেবি বাম্প লুকোবার একটা অলিখিত চেষ্টা চলত। সহকর্মীরা যাতে বুঝতে না পারে। যতদিন চেপেচুপে, ঢেকেঢুকে রাখা যায়। বরাতজোরে আমার প্রেগন্যান্সির মধ্যেই পড়ল শীতকাল। শাল আর চাদর দিয়ে অনেকদিন ম্যানেজ করা গেল। তারপর কালের নিয়মেই শীত উধাও, চাদর উধাও! নবীন বসন্তে সহকর্মীরা আমায় দেখে চোখ কপালে তুলল, “ওমা, এ কী, কবে?” 

তখন মুখ লুকোতে পারলে বাঁচি!

এ মেয়ে যেন সেই অস্বস্তিতে না পড়ে! ওকে বুঝতে হবে, এতে গুটিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। বরং মাথা উঁচু করে সগর্বে ঘোষণা করুক, ওর দেহে নতুন প্রাণের জন্ম হয়েছে।   

দিন যায়। ওয়াই-এর শরীরে মাতৃত্বের লক্ষণ। আর টিমের অনেকের মুখেচোখে স্পষ্ট বিরক্তি। ভাবখানা এমন, দু’দিন বাদেই তো ছুটিতে চলে যাবে, কবে ফিরবে তার ঠিক কী? বাড়তি কাজের বোঝা এসে পড়বে আমাদের ঘাড়ে! 

ডাক্তারের পরামর্শে ওয়াই এখন দফায় দফায় খাবার খায়। লাঞ্চের আগে একপ্রস্থ মরশুমি ফল, বিকেলে হালকা স্ন্যাক্স। বাড়ি থেকে ফলের বাক্স আনে সঙ্গে করে। খোলামাত্রই বাক্সবন্দী ফলের সামান্য ফার্মেন্টেড গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশের জনতা নাক সিঁটকোয়! এ সবই ওয়াইকে খুব অস্বস্তিতে ফেলে। 

একদিন সবাইকে ডেকে একটা মিটিং করলাম। ওয়াই প্রেগনেন্ট, তার জন্যে অভিনন্দন। সেই সঙ্গে রিপ্লেসমেন্টের ব্যবস্থা। ওয়াই যতদিন ছুটিতে থাকবে, অন্য কর্মী তার জায়গায় কাজ করবে। শুনে চারপাশের মুখগুলো খানিক স্বস্তিতে। 

কেক আনানো ছিল, সবার শেষে সেই কেক কাটা হল। ওয়াই লজ্জা লজ্জা মুখ করে সবাইকে কেক খাওয়াল আর ধন্যবাদ জানাল। সেই প্রথম বরফ গলে বেরিয়ে এল জলের ক্ষীণ ধারা। ওয়াই মুখে আসন্ন মাতৃত্বের সুষমা মেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। এই প্রজেক্টের ভিত তারই হাতে গড়া। সে ই মূল স্থপতি – chief architect। একই সঙ্গে সে নিজের দেহের অভ্যন্তরের প্রাণেরও স্থপতি। তার মুখে দেখি সেই গৌরবের প্রকাশ।

যে সোমবার থেকে ওয়াইএর ছুটির শুরু, তার আগের শুক্রবার বিকেলে টিম থেকে আবদার এল, একটু তাড়াতাড়ি ছুটি চাই! 

বলে কী? আমার চোখ কপালে! প্রজেক্টে এখন কাজের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আর দু’মাস বাদেই ‘গো-লাইভ’ যখন ক্লায়েন্টের পুরো ব্যবসাটাই আমাদের তৈরি প্ল্যাটফর্মে চালু হয়ে যাবে। তার মধ্যে আবার শ্রীমতী ওয়াই ও থাকবে না! গ্রুপ লিডার হিসেবে ভেতরে ভেতরে টেনশন তো একটু আছেই!

“ও সব জানি না, চারটেয় ছুটি চাই। আর তোমাকেও চাই আমাদের সঙ্গে।” নাছোড়বান্দা সব। 

রাজি না হয়ে উপায় কী? 

চারটের সময় সব্বাই এসে পাকড়াও করে নিয়ে গেল নীচের ক্যাফেটেরিয়াতে। 

বিরাট ক্যাফেটেরিয়ার এক অংশ বেলুনে বেলুনে ছয়লাপ। সুন্দর করে সাজানো একটা চেয়ারে বসে আছে ওয়াই। স্ফীতোদর, পূর্ণগৰ্ভা। মুখে মিষ্টি হাসি। হাতে ফুলের তোড়া। সামনের টেবিলে রাখা একবাটি পায়েস। সঙ্গে আরও নানা কিছু। ক্যাফেটেরিয়া স্পেশাল অর্ডার নিয়ে বানিয়ে দিয়েছে।

সহকর্মীদের দেওয়া সারপ্রাইজ বেবি শাওয়ার!     

যথাসময়ে ওয়াই ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তানের মা হল ওয়াই।   

তারপর পেরিয়ে গেল অনেক বছর। নিজের পেশায় অত্যন্ত সফল মেয়েটি, সুনামের অধিকারী। কর্মক্ষেত্র বদলে গেলেও যোগাযোগ আছে। সেই সঙ্কটমুহূর্তে তার দরকার ছিল একটু মনের জোর, একটু আশ্বাস – সে একা নয়, পাশে মানুষ আছে। সেই সামান্য সহমর্মিতাই ছিল তার কাছে জাদুকাঠির ছোঁয়া।        

এ গল্প মেয়েদের অচেনা নয়। কর্পোরেটে দীর্ঘ পয়ঁত্রিশ বছর কাটিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমেছে অনেক কাহিনি। তারই কিছু কিছু ভাগ করে নিতে এই লেখা। 

মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পরের পর্বে আসবে নবীন কর্পোরেট মায়েদের জীবনযুদ্ধ। এখানে এসে পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, সব ছেড়ে আগে মাতৃত্ব নিয়ে কেন পড়লাম? 

কারণ এ সমস্যাটা মেয়েদের একচেটিয়া, কিন্তু সমাধান করতে নারী, পুরুষ সবাইকে লাগে। একটু সহমর্মিতা, হাতটা একটু বাড়িয়ে দেওয়া – ব্যস, তাহলেই দেখবেন, 

“দেখ আলোয় আলোয় আকাশ, 

দেখ আকাশ তারায় ভরা…”

———-
ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 
বিদ্যায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কনসালট্যান্ট, নেশায় লেখিকা। নিউ জার্সির পারসিপেনি শহরে বাসিন্দা । শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শিল্পী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *