সময় ও অবসর

সময় ও অবসর

নিউ জার্সিতে কল্লোল-ক্লাবের দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শেষ

“সেদিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই, হয় নাই।” আজ ‘অবসর’-এর জন্যে লিখতে বসে সুজনের কথা মনে পড়ছে। সে সময় আমার নিজের লেখার পেশাগত ব্যস্ততা আর চাপের মধ্যে থেকে ‘অবসর’-এর জন্যে লেখা হয়ে ওঠেনি। আজ সময়, অবসর সবই আছে। শুধু হারানো বন্ধুকে দেওয়া কথা রাখা হয়নি।

আজ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। এই সেই উৎসবের মাস, যখন বোধন থেকে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে প্রবাসী বাঙালির দুর্গাপুজো সাড়ম্বরে উদযাপিত হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই এক অভিনব শারদোৎসব হয়ে গেল নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে। বাংলাদেশী হিন্দুদের উদ্যোগে আয়োজিত সেই পুজোর দুর্গাপ্রতিমা, ঢাক ঢোল কাঁসর ঘণ্টার বাজনা, ঘনঘন শাঁখের আওয়াজ, মঞ্চে লোকগানের আসর – ম্যানহ্যাটানের মধ্যে যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ। বিশ্বের সেরা মহানগরের রাজপথে দুই বাংলার মানুষ ওই পুজোর আনন্দ উৎসবে যোগ দিলেন। ‘বাংলাদেশের’ বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে দুর্গাপুজোর আয়োজন সম্ভব হত কিনা, উদ্যোক্তারা হয়তো সে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন, যদিও বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশী সংগঠনের উদ্যোগে নিউ ইয়র্কের কুইন্স-এ দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে। তবে টাইম স্কয়ারের শান বাঁধানো চত্বরে সিংহবাহিনী ত্রিশূল হাতে অসুর নিধন করছেন! তাঁকে ঘিরে অজস্র মানুষের আনন্দ, উচ্ছ্বাস – এ দৃশ্য কখনও দেখিনি। আমার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ভিডিও দর্শনে যতটুকু দেখা যায়।

ম্যানহ্যাটানের টাইমস স্কোয়ারে দুর্গাপুজো – ২০২৪

সারা আমেরিকা জুড়ে বাঙালি সংগঠনগুলির শারদ উৎসবের প্রচারের ছবি ভেসে আসছে। নিউ জার্সিতে আমাদের ‘কল্লোল’ ক্লাবের পুজোর প্রস্তুতিও শেষ।

এত কিছুর মাঝেও মন ভালো নেই। কোভিডের দুঃসময়ে মনে হয়েছিল, একদিন মহামারী শেষ হবে। সে ছিল মারণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই। রোগের আতঙ্ক, স্তব্ধ হয়ে থাকা জনজীবন, প্রিয়জন হারানোর শোক, দুঃখ। সেদিন মনে পড়েছিল কবিতা সিংহর লেখা “মানুষ যখন লড়ে, তখন সবাই মিলে লড়ে / মানুষ যখন মরে তখন একা।” আমার বন্ধু প্রণতি যখন হাসপাতালের মর্গে শুয়ে আহচে, সেদিন সকালে ‘করোনা’র প্রথম ভ্যাক্সিন নিতে গিয়েছিলাম। চোখে জল এসেছিল, হাতের ব্যথার জন্যে নয়। প্রণতি যদি সময়ে ওষুধটা পেতো!

মহামারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনুযোগ ছিল না। সুসময়/অসময় নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবন। আমরা সেই দুঃসময় পার হয়ে এসেছিলাম।

এবছর ‘মহালয়া’র ভোর এল। শুধু একটি গানের কথা, “অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো” – এক তীব্র প্রতিবাদ, প্রতিরোধের বার্তা নিয়ে এল। গত ৯ই অগাস্ট কলকাতায় আর. জি. কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এক নির্মম ঘটনা, একটি নির্ভীক মেয়ের ধর্ষণ, হত্যা, ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের চক্রান্ত আমাদের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। যদিও অবাক হয়ে বলিনি – কলকাতায় এমন ঘটল? শহরটা তো দিল্লী, উত্তরপ্রদেশের তুলনায় মেয়েদের জন্যে নিরাপদ! তবু বিকৃতকাম মানুষজনের অবাঞ্ছিত আচরণ, ট্রামে, বাসে, এমনকি চেনা পরিচয়ের সুবাদে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা – আমাদের কৈশোরের স্মৃতি সতত সুখের ছিল না।

আর কতকাল?

কিন্তু আর কতকাল এমন অশালীন বিকৃত আচরণ, যৌন আক্রমণ, বালিকা থেকে শুরু করে অসহায় প্রৌঢ়াকে ধর্ষণ, নৃশংস হত্যাকাণ্ড – একের পর এক ঘটে যাবে? ‘অভয়া’র জন্যে সরকারের কাছে ন্যায় বিচারর দাবিতে আজ হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছে। জুনিয়ার ডাক্তার, ছাত্রদের আমরণ অনশন ধর্মঘট চলেছে। শিশুহত্যার দায় কে নেবে? জয়নগরের সেই অসহায় বালিকার অন্তিম মুহূর্তের যন্ত্রণার মুখ অবচেতনে ভেসে ওঠে। এদেশে/ ওদেশে সুরক্ষার ব্যবস্থা না রাখলে মেঘবালিকারা কোথাও নিরাপদে নেই। লক্ষ্মণরেখার গণ্ডির ওপারে কখন যে ছদ্মবেশী রাবণ এসে দাঁড়ায়!

এবারের দুর্গোৎসবে অসুরবিনাশিনী মায়ের কাছে পারিবারিক মঙ্গলকামনার সঙ্গে আরও এক বিশেষ প্রার্থনা। অন্যায় অত্যাচার অবিচারের প্রতিকার করো। যে ‘অভয়া’র অকাল বিসর্জন হয়ে গেছে, আদালতে তার হত্যার ঘটনার যেন সুবিচার হয়।  

———-

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে লেখিকা প্রবাসী। ১৯৮২ সালে ইত্যাদি প্রকাশনী তাঁকে ‘পরিবর্তন’ পত্রিকার আমেরিকা প্রতিনিধি নিযুক্ত করে। সেই সময় থেকে অভিবাসী জীবনযাত্রা নিয়ে সাপ্তাহিক কলাম লিখেছেন। ১৯৯১ সাল থেকে সাপ্তাহিক বর্তমানে লিখেছেন। এছাড়াও দেশ, আনন্দমেলা, আন্তরিক, অতলান্তিক, উদয়ন, দুকূল, ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। বহু বইও প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম দিকপাল আলোলিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *