গ্রামের নামটি উমোজা
এক যে আছে গ্রাম। আর পাঁচটা গ্রামের মতোই দেখতে। পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে যায় নদী। বেশিরভাগ সময়ই জল থাকে না মোটে। এদিক ওদিক ঝোপঝাড়ে ফুটে থাকা নীলচে বেগুনি ফুল ধূসর ল্যান্ডস্কেপের একরত্তি বৈচিত্র্য। মাটির বাড়িগুলোর সামনে বাঁশের খুঁটি টাঙানো। খটখটে রোদে লম্বা লম্বা পোশাক হাওয়ায় ওড়ে। হাওয়াটা খুব বেগে আসে, লাগামহীন ঘোড়ার মতো টগবগ করে ছুট লাগায়, অবাধ স্বাধীনতায় আপন মনেই উড়তে থাকে মেলে রাখা কাপড়গুলো। কী উজ্জ্বল রঙ তাদের! গ্রামটার চারপাশে কাঁটাতারের তৈরি বেড়া আছে। অনুপ্রবেশকারীদের আটকাতে এই ব্যবস্থা। কাদের জন্য এই কন্টকাকীর্ণ প্রবেশ নিষেধ? আসলে কোনও কোনও বেড়া হয় ‘ফাল্গুনের ক্ষত।’ ‘ক্ষুব্ধ হিম’-এর মতো জেগে থাকে। উত্তর কেনিয়ার সাম্বুরুর উমোজা গ্রামের এই সামান্য কাঁটাতারের বেড়াটা আবহমান কাল ধরে হয়ে চলা আসা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত এক গগনচুম্বী মিনার। এই মিনার ডিঙিয়ে যারা ঢুকতে পারে না, তারা হল পুরুষ।
কেউ যদি দুপুরবেলা হঠাৎ এসে পৌঁছায় এই গ্রামে, দেখবে খুদে খুদে ছেলে মেয়েরা মাটির উঠোনে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাদের গাঢ় বাদামি গালে মায়েদের আদর লেগে আছে। কোঁকড়ানো চুলের জট ছাড়িয়ে দিতে দিতে স্নেহময়ী নারী কণ্ঠের ঘুমপাড়ানিও শোনা যায়। তারা মাটির উনুনে আগুন দিয়ে কালো বিন-এর দানা ফুটতে দিয়েছে। সুগন্ধ বেরোচ্ছে। একটু পরে ছেলেমেয়েদের খেতে দেবে, তার আগে হাতের কাজ নিয়ে বসেছে। রঙিন পুঁতি তারে গেঁথে গেঁথে অপূর্ব সব গয়না তৈরি করছে। কেনিয়ার সাম্বুরা ন্যাশনাল পার্কে যারা বেড়াতে আসেন তারা যেমন লম্বা গলার জিরাফটা দেখে বিমোহিত হন, তেমনই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া এই গ্রামের মেয়েগুলোকেও একবার দেখতে চান। কী বিশেষত্ব তাদের? বাকিদের থেকে কেন তারা আলাদা? আসলে এরা সবাই মিলে এক ইতিহাস রচনা করেছে। আফ্রিকার দর্পিত পৌরুষের বুকে স্থাপন করেছে একখণ্ড মাতৃতন্ত্র।
কী ভাবে সম্ভব হল এই অসম্ভব? রিফ্ট ভ্যালির ধারে সাম্বুরু উপজাতিদের গ্রামে প্রায়ই ব্রিটিশ সৈন্যরা আসে, তাদের মিলিটারি প্রশিক্ষণ দেয়। পুরুষদের জন্য এই সব ট্রেনিং। মহিলারা তো অন্দরমহলে – তাদের জীবনযুদ্ধ শেখার জন্য কোন প্রশিক্ষণের দরকার হয় না। তাছাড়া পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের প্রয়োজন সীমাবন্ধ। গ্রামের কোনও জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা চলাকালীন পুরুষরাই গোল হয়ে বসে। মেয়েদের সেই বৃত্তে কোন স্থান নেই। তারা বাড়ির বাইরে বের হয় শুকনো কাঠ জোগাড় করতে কিংবা গৃহপালিত পশুকে সজীব তৃণভূমি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। এর বাইরে তাদের যাওয়া নিষেধ। সাম্বুরু ট্রাইবের কিশোরী মেয়ের বাবারাই তাদের জন্য পাত্র খুঁজে আনেন।
বেশির সময়ই দেখা যায় তেরো বছরের মেয়ের বর হল সাতান্ন বছরের প্রৌঢ়। কিন্তু ‘না’ বলার উপায় নেই। তেরোটা গরু, আর চারটে ছাগলের কন্যাপণে মেয়েটিকে বিয়ে করে নেয় মধ্যবয়স্ক পুরুষটি। তারপর? স্রোতঃরাত্রির বুক থেকে উঠে আসা অনন্ত আগুনের আঁচ একটু একটু করে পোড়াতে পোড়াতে সাম্বুরুর মেয়েদের পাথর করে ফেলে।
কিন্তু পাথরেরও বোধহয় সহ্যের সীমা থাকে। সালটা ১৯৯০। কিছু ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিতা হয় চোদ্দজন সাম্বুরু মেয়ে। কৃষ্ণকায়া এই মেয়েদের শরীরগুলোকে সেই সব ব্রিটিশ সৈনিকরা সাজিয়ে রাখা উল্লাস ক্ষেত্র ভেবেছিল। সোনার মকর মাছের মতো তাদের আঁশ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খেয়ে ফেলে দিয়েছিল আফ্রিকার তৃণভূমিতে। পৃথিবীর সব ধর্ষণের ঘটনাগুলোতেই শেষ পর্যন্ত মেয়েদেরই দোষ হয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। সাম্বুরুর মেয়েগুলো কাঁদল, হাত জোড় করে বিচার চাইল। ধর্ষণের প্রতিরোধের সময় ধুলো মাখা পাথরে পা কেটে গিয়ে যে ঘা হয়েছে তার রক্তাক্ত মুখটাও দেখাল কিন্তু তা সত্ত্বেও সুবিচার পেল কই? শুধু লাঞ্ছিতই হল। এই চোদ্দজন মেয়েকে কে বিয়ে করবে? ধর্ষিতা স্ত্রী নিয়ে ঘর করা যায়?
এদেরই উদ্ধার করতে এলেন রেবেকা লোলোসোলি। ‘এলেন’ মানে আকাশ থেকে নামেননি তিনি। যদিও এ হেন নারীকে একটি মেঘ নির্মিত রাস্তাতেই মানায়, যে রাস্তাটার অভিমুখে জ্বলতে থাকে সহস্র সূর্য। সাম্বুরু গ্রামের সামান্য এক গৃহবধু ছিলেন রেবেকা। তিনি একাই এই চোদ্দজনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাদের বোঝাতে লাগলেন ধর্ষণের গ্লানি ধর্ষিতার নয়। বাড়ির বউয়ের এত সাহস! সাম্বুরুর প্রবল প্রতাপশালী পুরুষরা তাকে উচিত শিক্ষা দিল। বেধড়ক মার। কিন্তু পুরুষ দেখল মার খেয়েও দমে গেলেন না মহিলা বরং সারা শরীর থেকে আলোককণা বিচ্ছুরিত হল। ঝলসে উঠলেন রেবেকা লোলোসোলি এবং চোদ্দ জন নির্যাতিতা। গ্রাম ছাড়লেন তাঁরা। এতদিন পুরুষের অধীনে থাকা সামান্য কয়েকজন নারী কাদা মাটি দিয়ে ঘর বাঁধলেন। চোদ্দ নারীর নিজস্ব বাসভূমি, নিজস্ব আইন কানুন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য পালন করলেন গবাদিপশু, শুরু করলেন চাষের কাজ, হস্তশিল্প। সাম্বুরু ট্রাইবের মেয়েরা গলায় রঙবেরঙের পাথরকুচির তৈরি নেকলেস পরে, স্থানীয় ভাষায় ওটাকে কাংগা বলে। জীবনের প্রথম কাংগাটা বাবা দেয়। এখানে বড় হওয়া ২০০ জন ছেলেমেয়েদের কোন বাবা নেই। এদের আছে মা।
লোলোসোলিও একজন গর্বিত মা। তাঁর মেয়েকে জার্মানিতে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। দেশবিদেশ থেকে অনেকেই আসেন তার ইন্টারভিউ নিতে। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে যান তাঁকে দেখে। বিদ্রোহীসুলভ কাঠিন্য তার চেহারায় নেই। কথায় কথায় হেসে ওঠেন, আবার পরক্ষণেই তার চোখ ভিজে যায় মায়ায়। তবে যে লোকে বলে বড় অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। পুরুষরা তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে বহুবার। তার গোটা জীবনটাই নাকি রক্ত ভরা সুন্দর পিরিচের মতো। এত সয়েও এত সহজ থাকা যায়? যায় তো। লোলোসোলি বলেন, “Women are like flowers, we are like light. We are making the world bright.”
লোলোসোলির আজও মনে আছে মার খেয়ে হাসপাতালে কী অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছেন তিনি। তার আগেও অবশ্য কিশোরী অবস্থায় একবার হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সময় তাঁর FGM হয়েছিল। FGM অর্থাৎ ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন। মহিলাদের যৌনাঙ্গের কিছু অংশ কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। হাতদুটো চেপে ধরে একজন। কিছু বোঝার আগেই দুটো পায়ের মাঝখানে শরীর অবশ করে দেওয়া যন্ত্রণা। এই রক্তাক্ত যোনিপথে আর কোনদিন তেমন খিদে জাগে না। পুরুষ তার অধিকৃত স্ত্রীর সতীত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে। আফ্রিকাসহ পৃথিবীর আরও কয়েকটা দেশে এই প্রথা চালু আছে। রেবেকা এই প্রথাটার বিরুদ্ধেও লড়েছেন, লড়ছেন।
বিগত বছরগুলোতে উমোজা তার নিবিড় আঁচলে অনেক স্নেহঋতু বুনেছে। একে গ্রাম না বলে অভয়ারণ্য বলাই ভালো। তেরো বছরের জুডিয়া পালিয়ে এসেছিল এখানে। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল ওর পরিবারের লোকেরা। লোক মুখে গল্প শুনেছিল এমন একটা আজব গ্রাম আছে যেখানে নাকি মেয়েরা স্বাধীন, তারাও মানুষের মতো বাঁচে। গাছের নীচে বসে গলা ছেড়ে গান গায়, খিলখিলিয়ে হাসে। উমোজা নামের মানে একতা। ব্যথাই এক করেছে মিমোসা, নাগুসি, জুডিয়াদের।
নাগুসির তো খুশির সীমাই থাকে না যখন বিদেশি টুরিস্টরা ওর হাতের তৈরি মালা দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। নীল প্লাস্টিকের বালতিতে ছোটো ছেলেটার জামা ভিজিয়ে তেত্রিশ বছরের মিলকা জানায় এই গ্রামে পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই কিন্তু তাই বলে মেয়েরা পুরুষ বঞ্চিত নয়। ইচ্ছে করলে তারা পুরুষসঙ্গী খুঁজে নিতে পারে, মা হতে পারে। গর্ভের সন্তান না থাকা বড় কষ্টের। তার পাঁচটি ছেলেমেয়ে। পাঁচজনেরই বাবা আলাদা আলাদা মানুষ। তাদের কারও সঙ্গেই সে থাকেনি। থাকবেও না। তবে সবকটা সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছে। স্কুলে পাঠায়। মিলকা স্বপ্ন দেখে ওর ছেলে যখন বড় হয়ে উমোজা গ্রাম ছাড়বে তখন যেন প্রবল প্রতাপশালী পুরুষ না হয়ে ওঠে। কেমন হবে ছেলে? বিদেশিনী সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে নিজের লম্বা কালো বিনুনিটাকে পিঠের উপর ফেলে মেয়েটি লাজুক হাসে। ছেলেটা এখন বড্ডই ছোটো, বুকের দুধ খায়। তেত্রিশ বছরের মিলকাকে ওর বয়সে তুলনায় বেশি বয়স্ক দেখায়। ক্লান্ত যাযাবর চোখদুটো নামিয়ে বলে, ছেলে “ভালো মানুষ হোক” এটাই ও চায়। কখনও যেন কোন মহিলাকে অসম্মান না করে। এর বেশি কিছু বলার আগে কান্নায় গলা বুজে আসে মিলকার।
এখানকার মেয়েদের যত বোবা কান্না আছে সেগুলো “tree of speech” এর কাছে এলেই রূপান্তরকামী হতে চায়। আশ্চর্য ক্ষমতাশালী এই Tree of speech। এর বাংলা অনুবাদ কী হয়? কথা গাছ? গ্রামের মাঝামাঝি এই গাছটা এখানকার আকর্ষণ বিন্দু। এরই তলায় বসে মেয়েরা আলোচনা করে, সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত কখনও ঠিক, কখনও ভুল। কিন্তু তার জন্য কোনও পুরুষ তাদের চোখ রাঙাতে পারে না, পাথুরে জমির ওপর ফেলে ডুমো ডুমো যন্ত্রণায় শরীর ভরিয়ে দেয় না। কথা গাছ উমোজা গ্রামের উপর তার ডালপালা মেলে দিয়েছে। দেহ শীর্ষে ফুটিয়ে রেখেছে অসংখ্য স্বপ্নের কুঁড়ি। একে ঘিরে ধর্ষিতা নারী, অত্যাচারিতা ঘরের বউ, বালিকা বধূ, যৌনাঙ্গ বাঁচাতে চাওয়া কিশোরী, সবাই হাত ধরাধরি করে নাচে। নাচের তালে তালে ওদের সমস্ত শরীর দোল খায়। কাংগাটাও। সে এক অপূর্ব আনন্দ দৃশ্য। কাঞ্চনরঙা আফ্রিকার মরু সিক্ত হয়ে ওঠে অদম্য সাহসের চুরমার করা খরস্রোতে।
———-
তথ্যসূত্র
Bindel, J. (2015, August 16). “The village where men are banned.” The Guardian. Available at: https://www.theguardian.com/global-development/2015/aug/16/village-where-men-are-banned-womens-rights-kenya
Dansky, J. E. and Anderson, E. N. (2022). Feminism at its apex? Village without men: Discussing Kenya’s Umoja women. Independently published by authors.
Higgins, J. (ND). “No country for men: Umoja, an all-female village in northern Kenya.” The Wilson Quarterly. Available at: https://www.wilsonquarterly.com/quarterly/_/no-country-for-men-umoja-an-all-female-village-in-northern-kenya
Wax, E. (2005, July 9). “A place where women rule.” NBC News. Available at: https://www.nbcnews.com/id/wbna8516812
ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত