চাল-চিত্র

চাল-চিত্র

চাল যে তাঁর জীবনে এত বিষম বস্তু হয়ে উঠতে পারে তা এতদিনে বোঝেননি বিদ্যানিকেতন বালিকা বিদ্যালয়ের হেড দিদি অমিয়া সেন। এখন তিনি আজীবন শুনে আসা সেই প্রবাদবাক্যটির মর্ম হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। ‘কত ধানে কত চাল!’  

অথচ টগবগে ফুটন্ত গরম জলে দুই মুঠা চাল ফেলে দিয়ে খানিক সবুরের ফল কতই না মিঠা হয়!

ভাবুন দিকিনি একখানা জম্পেশ ছুটির দিনে সাদা জুঁইয়ের মতন ভাতে গন্ধরাজের রস মেখে চিংড়ি ভাপা সহযোগে হালুম হুলুম কিংবা পাঁঠার ঝোলের সাথে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত!  

তা হলে কী করে এ হেন চাল এমন বিষম বস্তু হতে পারে?

কিন্তু এই নিরীহ চালই অমিয়া সেনের মতো নিরীহ  নিরুপদ্রব মানুষের নিস্তরঙ্গ জীবন ঘিরে কী  বিভীষণ তরঙ্গহিল্লোল তুলতে পারে, তার কোনও ধারণাই ছিল না তাঁর। কদাচ কল্পনাও করেননি তিনি। 

চাল নিয়ে যে এতো চুলোচুলি, এতো চুল চেরা বিশ্লেষণ করতে হবে, জিন্দেগিতে দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি  বড়দি অমিয়া সেন। 

যে তিনি জীবনেও বাড়ির চালের হিসেব রাখেননি – সে দায় রাঁধুনির হস্তে অর্পণ করে নিশ্চিন্তে থেকেছেন বছরের পর বছর – সেই তিনিই কি না জীবিকার খাতিরে বিগত পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে মাসের পর মাস বিদ্যালয়ের ‘মিড ডে মিলের’ খাদ্যশস্যের হিসেবের খাতায় চাল ডালের হিসেব রেখে চলেছেন নিয়ম মাফিক! 

অবশ্য চালের হিসাবের লেখালেখি করতে হয় না বিদ্যালয়ের প্রধানদের। তা করেন নোডাল টিচার। কিন্তু শেষমেষ হিসাব দাখিলের সব দায় ওই বিদ্যালয় প্রধানদেরই ঘাড়ে।

অগত্যা আরও বড়-ছোটো হাজারটা দায়দায়িত্ব সামলিয়ে হেড দিদি তাঁর গণিতে মাস্টার ডিগ্রির প্রয়োগ করে চলেছেন নিত্য চাল ডালের হিসাবের খেরোর খাতা পর্যবেক্ষণে।

টুং টুং টুং টুং শব্দে টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই কচি কচি ফুলের মতো  ছাত্রীদল এক ছুটে মাঠে লাইন করে দাঁড়ায়।  ডেকচি ভর্তি সাদা চুড়ো করা ভাত। যদিও সাইজে একটু মোটা, গোলগাল, দলা দলা, চ্যাটচেটে। তার সঙ্গে এক হাতা ট্যালটেলে ডাল আর এক ডাবু সব্জি। সপ্তাহে একদিন সোয়াবিন,  একদিন ডিম। ওরা তাতেই খুশি। আর ওদের সেই খুশিতে খুশি ওদের বড়দি অমিয়া সেনও।

অমিয়া সেনদের ছোটবেলার ইস্কুলের সাথে মেলে না এখনকার এই সব ইস্কুল ইস্কুল খেলা। স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে আস্ত একখানা হেঁশেল। তা না হয় ঢুকুক। খালি পেটে তো আর ধর্ম হয় না! লেখাপড়ার চেয়ে বড় ধর্মাচরণ আর কীই বা আছে ছাত্রাবস্থায়।

সকাল থেকেই সরকার নিয়োজিত রাঁধুনিকুল ফোড়ন আর সম্বরার ঝাঁঝে ঝাঁঝায়িত করে তোলে স্কুল চত্বর।

তবে শুধু এই মধ্যাহ্নকালীন আহারের নিমিত্ত হেঁশেলই নয়। স্কুল এখন মাল্টিফাংশানিং সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। একাধারে রেশন শপ, হেল্থ সেন্টার, মায় টেলারিং শপের সহাবস্থান এই এক ছাদের নীচে। সাইকেল, বই, ব্যাগ, জুতো, ছাতা আরও কত কী যে বিলি বন্টনে  নামতে হয় শিক্ষককুলকে, তার ফিরিস্তি দিলে খাতার পাতার দফা গয়া। সব তীর্থ শেষে কি  না এই স্কুল প্রাঙ্গণে এসে মেশে।

কখনও কখনও কয়েকদিন ধরে চলে চাল, ডাল, আলু বিতরণ। কোনও কোনও দিন বা “বাবাগো মাগো” করতে থাকা ছাত্রীদের প্যাট প্যাট করে ভ্যাকসিন ফোঁড়েন হেলথ সেন্টারের আশাকর্মী দিদিরা।

ওদিকে একগুচ্ছ দিন ধরে সরকারি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় গলায় মেজারিং টেপ ঝুলিয়ে টেলার মাস্টার এসে ইউনিফর্মের মাপ নেয় ছাত্রীদের।

এছাড়াও খেলা, মেলা, ‘পরিবেশ সপ্তাহ’, ‘তুলি ধরো দেওয়াল ভরো’ – এমন নানান কিসিমের  উৎসবের ছড়াছড়ি। 

বর্তমানে পড়ার চেয়ে আগডুম বাগডুমই বেশি।

অমিয়া সেন আজ বছর পাঁচেক হল প্রধান শিক্ষিকা হয়েছেন। রীতিমতো অঙ্ক, ইংরাজি আর জেনারেল নলেজের দুরূহ সব প্রশ্নবাণের চোখা চোখা উত্তর দিয়ে। কিন্তু আজ বড়ো গাড্ডায় পড়েছেন তিনি।

আগষ্টের বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যা কখন যেন গড়িয়ে গেছে রাতে। চারিদিক শুনশান। সামনের টেবিলে মেলা আছে খাদ্যশস্যের হিসাব খাতা। আর হাতে মাত্র এক সপ্তাহ। মিড ডে মিল পর্যবেক্ষণের নোটিশ জারি হয়েছে। হিসাবের খাতা রেডি রাখতে হবে।

মুশকিল হয়েছে কী, মধ্যিখানে পেরিয়ে গেছে করোনা কালীন  দু দুটো বছর। স্কুল বন্ধ ছিল। মিড ডে মিলের রান্না বন্ধ ছিল। কিন্তু বন্ধ ছিল না বস্তা বস্তা চালের জোগান। কারণ ততদিনে সরকারি স্কুলগুলো রেশন দোকানের শিরোপা পেয়েছে। ছাত্রী পিছু বরাদ্দ চাল-ডাল-ছোলা-সাবান সব বিতরণের ঢালাও ব্যবস্থা। 

ট্রাক ট্রাক চাল ঢুকেছে রাতের বেলা। দারোয়ান আর ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু প্রাপ্ত, বন্টিত আর স্টকের চালের হিসেব মেলানো দায়। প্রায় দুই হাজার কেজি চালের হিসাব গরমিল। খাতা বলছে বিলি বন্টনের পর স্কুলে মজুত থাকা উচিত দুই হাজার কেজি চাল। কারণ এ হেন বিতরণ যজ্ঞের কু ঝিক্ ঝিক্ লাইনে সব পড়ুয়াদের অভিভাবক তো আর দাঁড়াননি! 

কিন্তু বর্তমানে স্কুলের ভাঁড়ার তো শূন্য! দু চারটি বস্তা চাল লাজুক মুখে  পড়ে আছে স্কুলের চাল রাখার ঘরের এক কোণে। 

অমিয়া সেনের রাতের ঘুম উড়েছে। যেন তেন প্রকারেণ মিলিয়ে দিতে হবে হিসাব।

হিসাবে ক্ষতবিক্ষত অমিয়া সেনে পেন কামড়ে তলিয়ে যান ভাবনার রাজ্যে। মনে হয় সব ব্যাটা চালই কি এমন ধারা বিষম বস্তু!

‘নমুনা নম্বর ওয়ান’এ মনে পড়ে কৈশোরে দেখেছেন দাদুর ডিসপেন্সারিতে নিয়মিত দাবার আসর বসত। চৌখুপি ছকের দুই পাশে দুই যুযুধান চিন্তাশীল বৃদ্ধ। এক একটা চাল দেবার আগে তাঁরা যে পরিমাণে সময় নিতেন, তাতেই মালুম হত ‘দাদা অঙ্ক (চাল) কী কঠিন!’ 

‘নমুনা নম্বর টু’ টি হল, চাল নিয়ে আরও একখানা বিষম মিম, যা ইদানিং নজর কেড়েছে নেটিজেনদের।  দেশের পঁচাত্তুরে বুড়ি স্বাধীনতা দিবস আসন্ন।  ‘ঘর ঘর তিরঙ্গা’ উড়ানোর ফরমান জারি হয়েছে। প্রতি ঘরের চালের টঙে বিজয় কেতন বাতাসে উড়বে ফড়ফড়িয়ে। সরকারি আপিসের বারান্দায় টেবিল চেয়ার পাকড়ে বসে আছেন আপিসার। টেবিলের সামনে বিশাল লাইন।  তিরঙ্গা বিলি বণ্টনে নিয়োজিত  আর্দালি জানাল, “বাবু এই ইনাদের সব্বাইকার তিরঙ্গা আছে। কিন্তু তিরঙ্গা উড়ানোর জন্য চাল নাই। অস্থায়ী চুলো অবশ্য আছে,  তবে তা খোলা ফুটপাথে। ইনারা তাই তিরঙ্গা উড়ানোর জন্য চালচুলো সহ একটুকরো মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠাঁই চান।”

নমুনা নম্বর তিন, পুরুষদের “চাল” চলন নিয়ে সমাজের ঠিক ততটা মাথাব্যথা নেই যতটা না মেয়েদের “চাল” চলন নিয়ে থাকে। তাই ছোটবেলা থেকে দেখছেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে এই “চাল” চলন বড়ই বিষম ঢেঁকি।

চটকা ভাঙে অমিয়া সেনের। ধুস! কী সব ভাবছেন বসে বসে।

এইসব চালচুলো, চালচলন ছেড়ে বস্তাবন্দি সেই মহার্ঘ বস্তুর হিসাবে মন দিতে হবে যে।

কী কপাল! যার জন্য ভেতো বাঙালির দুপুরের ভাতঘুমের আমেজ জগৎপ্রসিদ্ধ,  আজ সেই চালের খলনায়কগিরির জন্য তাঁর চোখে ঘুম নেই!

আবার মন দেন হিসাবে। কোথায় কীভাবে গোঁজামিল দিয়ে মিটিয়ে ফেলা যায় ব্যাপারটা! তবে বেশিক্ষণ মনঃসংযোগ করতে পারেন না। আবার খেই হারান নিজের চিন্তার জগতে।

দুম করে উচ্ছব নাইয়ার কথা মনে পড়ে যায়। সেই যে মহাশ্বেতা দেবীর ‘ভাত’ গল্পের উচ্ছব নাইয়া। ‘পিং হরি চরণ নাইয়া।’ দুমুঠো ভাতের জন্য যে বাড়িতে কাজে লেগেছিল সে, তাঁদের ভাঁড়ার বোঝাই ছিল হরেক রকমের চাল। নিরামিষ ডাল তরকারি সাথে খাওয়ার জন্য ঝিঙাশাল চাল, মাছ মাংসের পদের সাথে রামশাল চাল, এ ছাড়াও ঢেঁকিশাল, ইত্যাদি প্রভৃতি। এ ছাড়াও চাকর বাকরদের জন্য মোটা, খেটো চাল। এত কিসিমের চালের হিসেব রাখতেন পরিবারের বুড়ি পিসি। আর তিনি কিনা দোর্দণ্ডপ্রতাপ অমিয়া সেন, গণিতে এম এস সি, মাত্র এক রকমের সরকারি ‘কাঁকড়মণি'( প্রতি গালে কাঁকড়  ও কুটির জন্য এ শুভ নাম তাঁরই দেওয়া) চালের হিসাব রাখতে পারছেন না! কী লজ্জা!

ক্লার্ক আর দারোয়ানকে  তলব করেছিলেন। তাদের একটাই উত্তর, “ইঁদুরের জ্বালায়  কিচ্ছুটি থাকার উপায় আছে দিদি!”

অমিয়া সেন সব বোঝেন। মানে দেরিতে হলেও বুঝেছেন সব। কীভাবে এবং কোন পাজি ধেড়ে ইঁদুরের বাড়িতে ঢুকেছে খাদ্য সংরক্ষণের হিমায়ক যন্ত্র, আর কোনটির জুটেছে একখানি পক্ষীরাজ। শুধু  প্রমাণের অভাবে টিকিটি ছুঁতে পারেন না তাদের।

কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। সরকার বাহাদুরের ঘরে নিঁখুত এবং যথাযথ হিসেব দাখিল করতে হবে তাঁকেই। অণু-পরমাণু-জীবাণুবৎ গরমিলেও হয়ে যেতে পারে কোর্ট মার্শাল! সরকারি মালের  পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব মিলিয়ে দেওয়াই দস্তুর।

অগত্যা গোঁজামিলের পথ খুঁজে চলেছেন রাত দিন।

আজকাল রাতে নিশ্চিতে ঘুম হয় না তাঁর। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন কোথায় যেন খুরখুর করে শব্দ হচ্ছে! কান খাড়া হয়। স্নায়ু টানটান হয়। দুঃস্বপনের দেশে ছোট, বড়, মেজো, সেজো, কুলীন এবং অনামী, বেনামী, গুমনামী, নানান  সাইজের ও মানের ইঁদুরের পেছনে ম্যারাথন দৌড়ে অবতীর্ণ হন তিনি আজকাল।

অবশেষে হিসাব মেলে। বাঁচিয়ে দেয় আম্ফান আর যশ সাইক্লোন।

রিপোর্টে লেখা হয়: কুড়ি সালের বিধ্বংসী আম্ফান এবং একুশ সালের যশ ঝড়ে আটশত কেজি করিয়া চাল বিনষ্ট হইয়াছে। আর বাদবাকি চাল নষ্ট হয় নাই। তাহা পুষ্টি যোগাইয়াছে ধেড়ে ইঁদুরকুলকে। তবে ভবিষ্যতে বিধ্বংসী ইঁদুরকুল ধ্বংসে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব সহকারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট থাকিবে।

 
জন্ম হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত ডায়মন্ড হারবারে। গণিতে লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজ থেকে স্নাতক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের একটি সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির নেশা। লেখালেখির পেছনে মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কবিতা লেখা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ভূতের, হাসির এবং রহস্য গল্পই লেখা বেশি হয়ে থাকে। বেশ কিছু গল্প বিভিন্ন পূজাবার্ষিকী, গল্প সংকলন এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং আরো কিছু প্রকাশের অপেক্ষায়।

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Jhilik Mukherjee Goswami , October 16, 2022 @ 8:54 am

    বেশ লাগল, দিদি।
    চাল নিয়ে আরও যা হচ্ছে, কীই বা বলি।
    কেমন জানি মনে হচ্ছে, আপনার জীবনের কোনো একটা গল্প হয়তো এটা।
    আপনিও প্রধান শিক্ষিকা কিনা! 😀

  • JHILIK GOSWAMI , October 16, 2022 @ 9:03 am

    বেশ ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *