ফুড বুটিক
মশাইরা, আপনারা ফুড বুটিক আর ফুড জয়েন্টের তফাত বোঝেন কি? আর কাকেই বা বলে মাল্টি ইয়ে রেস্তোরাঁ? আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এই ব্যাপারে গুগল স্যারের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিঞ্চিৎ জ্ঞানার্জন করা গেল। অথবা গেল না।
কারণ? আজ্ঞে, তেমন কিছু না।
আমার উচ্চাকাঙ্খী কন্যারত্নটি অসতর্ক মুহূর্তে তার অনেক অবরুদ্ধ বাসনার মধ্যে একটা বাসনা খুব সিরিয়াসলি জানাল,
– বুঝলে বাপি, একটা ফুড বুটিক খুলব, কলকাতায় কিম্বা অন্য কোনও মেট্রোয়।
জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকাতেই বুঝিয়ে বলল।
– এই ডাক্তারিটাক্তারির লাইনে পড়াশুনো করে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। সারা দিন সারা রাত হাড় ভাঙা খাটুনির পর, চিরজীবী মনুষ্য প্রজাতির একটিও মারা গেলে ক্যালাকেলি ভাঙচুর কমপেনসেশন মায় ডিগ্রি নিয়ে টানাটানি। তার চাইতে ব্যবসা ভালো। কর্পোরেট ব্যবসা।
– তাহলে যা জানিস, যে বিদ্যেটি, সেই ব্যবসাই খোল না বাপু। কর্পোরেট ব্যবসা যদি করতেই হয়, তবে ওই হাসপাতালের ব্যবসা কর। আমি আছি তো।
– না বাপি, খুব ঝামেলা ওতে। পাবলিক সামলাতে বাউন্সার মস্তান পোষা, দাদা-দিদি-পুলিশ সবাইকে খুশি রাখা, ইন্সিওরেন্সে আর ফলস বিলিংএর হ্যাপা, সব মিলিয়ে পুঁজিপাটা বেলেঘাটা হয়ে যাবে। তোমার তো ব্যবসার জ্ঞান ওই প্রি মেডিকেলে সখ করে বেলুন বিক্রি আর বই মেলায় ভিখিরির মত লিটলম্যাগের লোকসান খাওয়া। তোমার সঙ্গে এগোন যাবে না।
– তবে?
– মাকে পার্টনার করে এগোব। মা তো শুধু আজ বলে নয়, চিরকালই উঁচু স্ট্যান্ডার্ডে রেঁধে গেল। মার অ্যাক্টিভ হেল্প নিয়ে একটা ফুড বুটিক খুলব।
আমি গেঁয়ো মানুষ। ছোটবেলায়এই বুটিক না বাটিক বলতে আঁকাবাঁকা ছাপ শাড়ি কাপড়জামা হয় জানতাম। তারপর ক্রমে জেনেছি বড়লোকদের মেয়েবউরা বুটিক নামে এক রকমের দোকান দোকান খেলা করে। কাপড় জামা জাঙ্ক-জুয়েলারির। কেউ কেউ প্রচুর লাভের মুখও দেখে নাকি। তো এই ফুড বুটিক বস্তুটা কি?
মেয়ে বোঝাল,
– কিচ্ছু খোঁজ রাখোনা বাপি তুমি। এই কলকাতা আর সাবার্বেই কতগুলো ফুড বুটিক রমরমিয়ে চলছে তুমি জানো?
না, তা জানি না। সত্যিই না।
আমার কলকাতা আর মফস্বলি পাইস হোটেল অবধি দৌড়। শেয়ালদার আশেপাশের ফুটের হোটেলেও দেদার খেয়েছি এককালে। উন্নাসিকের দল যাকে বলত ভিখিরি হোটেল। চিনা খাবার বলতে বুঝতাম মাম্মিস্ কিচেনের পর্ক চাউমিন আর মোগলাই খাবার বলতে পার্ক সার্কাসের বিফ বিরিয়ানি আর রোল।
চাংওয়া,নিজাম আমিনিয়া সাবির… আড়চোখে দেখে এড়িয়ে যেতাম, যেমন আড়চোখে এড়িয়ে যেতাম সিনেমাহলের সামনে সাড়ম্বরে সাজানো হেমা মালিনী আর হেলেনের ছবি। অবশ্যি চাংওয়া থেকে হেলেন সবার সঙ্গেই নিষিদ্ধ স্বপ্নে দেখা হত কখনও। যাক, নিম্নবর্গীয় সেই সব আমিষ মেশানো বিলাস-কথা।
তো এখনের এই ফুড বুটিক ব্যাপারটি কী? জিজ্ঞেস করতে মেয়ে আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল,
– বললে তুমি বুঝবে?
– আহা বলই না! দেখি বুঝি কি না…
– না বাপি, এই আইডিয়া এমনকি তোমাকেও বলা যাবে না। তুমি তো ফুড বুটিক আর ফুড জয়েন্টের তফাতই বোঝো না। তোমার ডেলিকেসির ধারণা আটকে আছে রথতলার কাদা প্যাচপেচে মেলার জিলিপি আর পাঁপড়ে। তোমার ব্রেকফাস্টের বিলাসিতা মানে রামুর ডিমটোস্ট, আর চূড়ান্ত লোভ মানে সন্ধ্যের চপ মুড়ি। তুমি এই সব উঁচু ভাবনা জাস্ট অ্যাসিমিলেট করতে পারবে না।
কিছুতেই সে তার আবিষ্কৃত খাদ্য-ব্যবসার গোপনতম রহস্যময়তা ভাঙল না। যা সে শেয়ার করবে জননীদেবী আর তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। তার সেই ফুড বুটিকের নানান কোণায় থাকবে বহুতর আয়োজন। চর্ব্যচোষ্য আর লেহ্যপেয়র এক খানদানি আয়োজন।
শুধু অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে তার সেই ফুড বুটিকের দুটি কোণের ভার, তাও আংশিক, আমায় দিতে রাজি হল।
এক কোণে চার পাঁচটা নকল তালগাছের নীচে যে টেবিল, সেখানে দিশি মুরগির নাড়িভুড়ির আগুন-ঝাল চাটের সঙ্গে বিশুদ্ধ তাড়ি সার্ভ করা হবে। তালের রস গেঁজিয়ে তৈরি সে জিনিস এক্কেবারে যাকে বলে অর্গানিক। সেটাও বিজ্ঞাপিত থাকবে। আসলেই তো তালগাছে ইনসেক্টিসাইড কিম্বা সার দেয়না কেউ!
আর একটা টেবিলের পাশের দেওয়ালে আঁকা থাকবে নাগাল্যান্ডের থ্রি ডি মনোরম পাহাড়-দৃশ্য। সেই টেবিলেরই একটা আইটেমের ভার আমি পেলেও পেতে পারি।
কন্যার ভাবী ব্যবসার এই দুটি মূল্যবান ভার পাবার সৌভাগ্যের কারণ দুটি যথাক্রমে বলি। দুটিই তার কাছে জমা দেওয়া সিভিতে দাখিল করেছি।
প্রথমটি হল, ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন মুর্শিদাবাদ-বীরভূম সীমান্তের হিলোরা বলে এক গ্রামে এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। আমার মা ওই গ্রামে চাকরি করতেন।
তো সেই মাস্টারমশাই পরিমিত পরিমাণ তাড়ি যা কিনা আদতে গেঁজানো তালের রস, সেবন করতেন পড়ন্ত দুপুরে, স্কুল থেকে ফিরে।
তাঁর মেয়েরা আমার সমবয়সী।
তাদের কাছে জেনেছিলাম, তাদের বাবা,
–ও কিছু না, তালের রস খায় একটু।
সে সময়ে আমার তালের রস সম্বন্ধে জানা ছিল না। তাল মিছরি জানতাম আবছা আবছা। কিন্তু খেজুর রস বিষয়ে জ্ঞান ছিল সম্যক।
খেজুর রস পাওয়া যেত বারাসতের মামাবাড়িতে। শীতকালে। আহা, মনোরম তার স্বাদ।
তালের রস কিন্তু শীতে না। গ্রীষ্মের পানীয় এটি। নিশ্চয়ই খেতে খেজুর রসের মতই অমৃতোপম হবে! সেই লোভে পড়ে এক বিকেলে মাস্টার মশাইয়ের সেই তালরসামৃত চুরি করে আকণ্ঠ পান করেছিলাম।
আমি জানতামই না, তালের রস তার সংগ্রহের হাড়িতেই গেঁজে যায়। জীবাণু প্রভাবে সেই তরল তখন বেশিটাই অ্যালকোহল।
সেই তীব্র ঝাঁঝালো, কিঞ্চিৎ বিকর্ষণকারী গন্ধযুক্ত তরল আদৌ খেতে ভালো ছিল না। খেজুর রসের মত মনোহারিণী নয় বলাই বাহুল্য। কিন্তু পান করার পর তার দ্রব্যগুণ যাবে কোথায়? ফলত সেই লোভী চোর বালক সন্ধ্যের মুখে নেশায় টুপভুজঙ্গ। বমনরত বলে তীব্র দুর্গন্ধ তার পোষাকে ও গায়ে। ফলতঃ তার চৌর্যবৃত্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এবং অপমানিতা ক্রুদ্ধ এক মহিলা, যাকে আমি মা বলে জানতাম, তার হাতে গোবেড়েন। ওঃ, এখনও শিউরে উঠি। পাড়া পড়শী চমকিত।
শুধু মেল শভিনিস্ট মাস্টারমশাই বলেছিলেন মাকে,
– আর মেরেন না গো দিদিমণি। পুরুষ বাচ্চা উ সব একটু আধটু না খেলে চলে?
তো তাড়ি সেবনের সেই অনন্য গল্পটা এক চির বালক তার কন্যার কাছে জমা দেওয়া কারিকুলাম ভাইটিতে গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিল।
এবারে নাগাল্যান্ড সংক্রান্ত দ্বিতীয় সৌভাগ্যের কথা। তার মূলেও আছে আমার জীবনের এক খণ্ড গল্প। ঠিক আমার একার গল্প না।
আমি আর আমার মেডিকেল কলেজে তিন বছরের জুনিয়র বন্ধু রফি আমেদের যৌথ যাপনের গল্প। অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটু বিস্তারে বলি।
আমরা মাসের কুড়ি তারিখ পেরোলেই এজরা ওয়ার্ডে স্টুডেন্টস কেবিনে ভর্তি হয়ে যেতাম। অনাহারের হাত থেকে রক্ষা পাবার আর কোনও উপায় থাকত না যখন। গরিব কেরানি বাবার কাছ থেকে মাস পয়লার আগে টাকা আসার সম্ভাবনা ছিলনা। যে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারতাম না, আমার আগেই সেই মহার্ঘ বেড দখল করে ফেলেছে আমার চেয়েও তৎপর কেউ, সেই কঠিন সময়ে অন্য উপায় নিতে হত।
তখন কৌশল হিসেবে অনেক রাত জেগে পড়াশুনো শুরু করতাম। ফলে সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙত। উঠেই আর সময় নেই, তাই প্রাতরাশ না খেয়েই দৌড়োতাম ক্লাসে। একপেট খিদে নিয়ে পড়ন্ত দুপুরে ফিরে হোস্টেলে প্রচণ্ড লাঞ্চ করতাম যা কিনা প্রকৃত প্রস্তাবে হত টু ইন ওয়ান… লাঞ্চ কাম ডিনার। কেননা বিকেল আর প্রথম রাত্রিটুকু ঘুমোতাম। ঘুম ভাঙত রাত সাড়ে দশটায়। ডাইনিং রুম বন্ধ হয়ে যায় ততক্ষণে। সে’ই আন্দাজে রাতের মিল আগের থেকেই অফ করে দেওয়া থাকত। অর্থাৎ দুপুরের একটা মিলের খরচায় চব্বিশ ঘণ্টার ক্ষুণ্ণিবৃত্তি।
আমরা দু’জনেই ছিলাম সর্বভূক। কলকাতা চষে যত রকমের সস্তার খাবারের সুলুক সন্ধান বার করতাম। গরু শুয়োর নির্বিশেষে যা সস্তায় পেতাম নির্দ্বিধায় খেতাম। রফিদের তখন সবে প্যারাসাইটোলজি ক্লাস শুরু হয়েছে। ও টেপ ওয়ার্ম মানে ফিতাকৃমির কথা জেনে মাঝে মাঝে ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ত বটে, কিন্তু লোভ আর খিদে আমাদের অকুতোভয় করে তুলেছিল।
খাদ্যসন্ধানে কোথায় কোথায় না যেতাম আমরা। শেয়ালদা’ চত্বরে ভিখিরিদের হোটেল, ফিয়ার্স লেনে সস্তার পর্ক চাউমিন, মেট্রোগলির ধোঁয়াশা মাখা রহস্যময়তা। আসলে তো পয়সার টানাটানি। সস্তা না খুঁজে উপায় কী?
একবার রফি খবর আনল খিদিরপুরে একজায়গায় ছ’আনায় মাংসভাত দিচ্ছে। আমরা পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে খেয়েও এলাম। রান্না খেয়ে দুজনেই মুগ্ধ। গেলাম কয়েকবারই।
ওই অঞ্চলে পরে খোঁজ খবর করে সন্দেহপ্রবন রফি জেনে এল, ব্যাপারটা কুকুরের মাংসও হতে পারে। আর অত সস্তায় দিচ্ছে কাজেই রফি ভেবেচিন্তে বার করল,
– অরুণাচলদা’ এমনি কুকুর না, সিয়োর অ্যাকসিডেন্টে মরা কুকুর।
সেই চিন্তায় বমি শুরু হল তার। হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন দিতে হল কুড়ি বোতল।
রান্না করা অনাস্বাদিত সেই সারমেয় মাংসই পাবেন আমার ভাগের দ্বিতীয় টেবিলে।
আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল আমাদের পারিবারিক এই কল্পিত কর্পোরেট ফুড বুটিকে। অন্য কোন টেবিলে কী থাকবে, তা আমার জানা নেই। শুধু আমার ভারপ্রাপ্ত টেবিলদুটোয় আমি সার্ভ করব। নো জিএসটি।
আর ইয়ে, ব্লাড ব্যাঙ্কে যেমন ডোনেশনের কার্ড থাকলে রক্ত ফ্রিতে মেলে, তেমনই পাড়ার কোনও নেড়িকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসতে পারলে নাগাল্যান্ডের টেবিলে, হেঁ হেঁ, আপনারও এক প্লেট ফ্রি…
আসবেন কিন্তু।
1 Comment