সুকুমার রায়ের (১৮৮৭-১৯২৩) “সুকুমার রায়” হওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিলো না। তার প্রথম কারণ হলো তিনি ছিলেন কোলকাতায় রায়চৌধুরী বাড়ীর ছেলে, তাঁর জীবন উনিশ-বিশ শতকের মধ্যে সেতুর মতো। বাংলা সাহিত্য আর সংস্কৃতির কথা ধরলে সেসময়ে ঠাকুরবাড়ীর পরেই এই রায়চৌধুরীদের নাম করতে হয়। বিশেষ করে শিশুসাহিত্যের রাজ্যে।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই বাংলাদেশে ছাপাখানা এসে গেছে আর এসেছেন বিদ্যোৎসাহী মিশনারীরা। তাঁরা আগ্রহ করে শিশুশিক্ষার বই লিখতে, ছাপতে, প্রচার করতে শুরু করেন, কালক্রমে অন্যান্য জনহিতসংস্থাও সে উদ্যোগে যোগ দেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি বটতলার কল্যাণে নানা ধরণের ছাপা বই সুলভ হয়ে জোয়ার আনে শিশু আর কিশোর সাহিত্যে। অনেক খ্যাতনামা লেখক শিশুদের জন্য লিখতে আরম্ভ করেন, বিদ্যাসাগর স্বয়ং বর্ণপরিচয়, বোধোদয় ইত্যাদি বই লিখেছিলেন উনিশ শতকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। সে সময়ের অন্য্যন্য বইতে কিছু কিশোরকাহিনীর দেখা পেলেও তার বেশীর ভাগই ছিলো শিক্ষামূলক — পুরাণের কথা বা নীতিশিক্ষা।
বাংলাদেশে ব্রাহ্মসমাজের স্থাপন উনিশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তারপর নানা মতবিরোধ আর ভাঙাচোরার মধ্য দিয়ে এসে সত্তর-আশির দশকে প্রতিষ্ঠা সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের — যেটিকে তৎকালীন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে উদার, চিন্তাশীল, প্রগতিকাঙ্ক্ষী সংস্থা বলা যায়। এই শিশু-কিশোর শিক্ষা আর সাহিত্যের ব্যাপারটা তাঁরা সযত্নে বুকে তুলে নিয়ে লালন-পালন করেন — বিশেষত সমাজের উৎসাহী তরুণ সভ্যের দল। শিশু-কিশোরদের উপযোগী পত্রপত্রিকা প্রকাশ থেকে আরম্ভ করে রূপকথা, লোকসাহিত্য, পৌরাণিক বা নিছকই কিশোরভোগ্য কাহিনী, বীরেদের কথা, শৌর্যের গল্প, বিজ্ঞানের আলোচনা — তা সে সরাসরি দেশী উৎসই হোক বা অনুবাদেই হোক — এঁদের কল্যাণে বাঙালীদের কাছে এক প্লাবন হয়ে পৌঁছোয়। এটা অবশ্যই বলা দরকার যে সে প্লাবনে ঠাকুরবাড়ীর দানও কম ছিলো না, যদিও তাঁরা ছিলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের সভ্য। অন্যরাও ছিলেন।
তখন ছেলেমেয়েদের জন্য দুরকমের বই পাওয়া যেতো — এক শিক্ষার আর দুই মজার। উপেন্দ্রকিশোর দুটোকে একত্র করতে চাইলেন, দেখলেন একদিকে আমাদের পুরাণাদির গল্প আর অন্যদিকে বিজ্ঞানের কথা ঠিকমতো লিখলে এই চাহিদা মেটানো যায়। তাই করলেন। বাড়ীভর্তি ছেলেমেয়েদের তিনি যেসব সেকালের গল্প শোনাতেন, সেসব একত্র করে তাঁর বই ছাপালেন, “সেকালের কথা” — সে বই শুধু কাহিনীতে নয়, তাঁর নিজের ছাপাখানার উৎকৃষ্ট ছাপা আর ছবির কল্যাণে নিখুঁত, তার কদর হলো খুব। উৎসাহিত হয়ে উপেন্দ্রকিশোর আস্তে আস্তে প্রকাশ করলেন “ছেলেদের রামায়ণ”, “ছোটদের মহাভারত” আর কিছু সময় পরে “মহাভারতের গল্প”, কবিতায় লেখা “ছোট্ট রামায়ণ” আর বিজ্ঞানভিত্তিক “আকাশের কথা” — লেখা আর ছাপার গুণে আবার দিক্প্রদর্শক। নিছক মজার কথা বললেন “টুনটুনির বই” আর নাটক “বেচারাম আর কেনারাম” বা “গুপী গাইন ও বাঘা বাইন”-তে। সুকুমারের এক কাকা কুলদারঞ্জন, তিনি প্রথমে পৌরাণিক কাহিনী আর পরে ইংরেজী থেকে কিছু অসাধারণ অনুবাদ প্রকাশ করে নাম কিনেছিলেন। আর এক কাকা প্রমদারঞ্জন লিখেছিলেন “বনের গল্প”। দিদি সুখলতা রাও লিখেছিলেন বহু বই, তার মধ্যে অন্য দেশের রূপকথা আর যারা সবে পড়তে শিখছে তাদের জন্য লেখা বই উল্লেখযোগ্য।
সুকুমারও সেই দলে ভিড়লেন, লেখবার আর ছাপাবার একটা তৈরী জায়গা পাওয়া গেলো। কিছুদিনের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর তাঁকেই সম্পাদনার ভার নিতে হলো, তখন আর স্বভাবঅলস সুকুমারের ছাড়ান নেই, প্রতি মাসে পত্রিকার জন্য তাঁকে লিখতেই হবে। লিখলেনও। বাবার প্রতিভার অঙ্কুর নিয়ে সুকুমার জন্মালেন, পরিবারের পরিবেশের জলহাওয়া তাঁকে বড়ো করলো, বড়ো হয়ে ছায়া ছড়াতে শুরু করলেন, পরে তাঁর আশ্রিতদের মুখ চেয়ে তাঁকে বাড়তেই হলো। “সুকুমার রায়” না হয়ে তাঁর উপায় কী?
“সুকুমার রায়” বললেই কী ছবিটি মনে আসে? মনে আসে এক হাস্যরসিকের ছবি, বেশীর ভাগ রচনাতেই হাসি উচ্ছ্বসিত আর সব রচনাতেই তা অনাবিল। ছোটোদের উদ্দেশ্য করে লেখা কিন্তু বড়োরাও বিনা দ্বিধায় পড়তে পারেন, পড়ে প্রাণ খুলে হাসতে পারেন। যেখানে হাসির মাত্রা ব্যাপক নয় সেখানে গভীরতর একটা কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ব্যঙ্গ আছে কিন্তু তা জ্বালায় না, মানুষগুলোকে আমরা চিনতে পারি, মুচকি হেসে, একটু ঘাড় নেড়ে তাদের উপস্থিতি স্বীকার করে নিই। কিছু নীতিশিক্ষা আছে বই কি, তবে তা কখনোই তেতো ওষুধ গেলানো নয়। বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে বড়োদের জন্য গভীর আর গম্ভীর রচনাও আছে, তবে সেসব মনে আসার আগেই আমরা এই চেনা সুকুমারের স্রোতে ভেসে যাই।
ভিক্টোরীয় যুগে ইংরেজী সাহিত্যে “ননসেন্স” নামের এক সাহিত্যশৈলীর উল্লেখ শুরু হয়। তার প্রকৃত সংজ্ঞা কী তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি আছে, সে সব আমাদের প্রয়োজনের বাইরে। তবে তার কয়েকটা বিশেষত্বের কথা লেখা দরকার। তার কারণ সুকুমারই বাংলা সাহিত্যে ননসেন্স শৈলীকে প্রথম পূর্ণগৌরবে প্রতিষ্ঠা করার দাবী করতে পারেন — ত্রৈলোক্যনাথকে (কঙ্কাবতী আদি কাহিনী) পূর্বসূরির স্বীকৃতি দেবার পরেও আমাদের বিশ্বাস যে তাঁর এই কৃতি আজও কেউ ছুঁতে পারেননি। ননসেন্স শৈলীর বড়ো ভক্ত জি কে চেস্টারটন, তাঁর মতে এই শৈলীর সব রচনাই বিশ্বজোড়া এক ছেলেবেলার কথা বলে থাকে, যদিও বলার কায়দা অনেক রকম হতে পারে — একদিকে ব্যঙ্গাত্মক থেকে অন্যদিকে সম্পূর্ণ আজগুবি। ননসেন্সের এক নিজস্ব যুক্তির ওপর খাড়া, নিজস্ব নিয়মে চলা এক জগৎ আছে সেখানে এই রোজকার জগতে আমরা যে যুক্তি খাটাই তা কাজ করে না। সুকুমার নিজে এই শৈলীর সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন, একটু তলিয়ে দেখলে যেটা খুবই খাঁটি — “আজ্গুবি চাল্, বেঠিক বেতাল … অসম্ভবের ছন্দেতে।” অদ্ভুত সে জগৎ, তার অদ্ভুত নিয়মে ঠিক-বেঠিক বোঝা যায় না, গল্প তালছুট, কবিতার ছন্দ মেলে ঠিকই কিন্তু অসম্ভব রকমের গোলমেলে। নামও দিযেছিলেন “খেয়াল রস।” এডওয়ার্ড লিয়ার আর লুইস ক্যারলকে এই দ্বিতীয় শ্রেণীটির উদ্ভাবক বলে প্রায় সবাই স্বীকার করেন। সুকুমার তাঁর অনেক রচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন এঁদের লেখা থেকে, কিন্তু সেই প্রেরণা যখন তাঁর কলম মারফৎ প্রকাশ পেয়েছে তখন তা একেবারে সুকুমারের নিজস্ব।
আর থাকা দরকার শব্দের জাদু, সুকুমার রায় নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে চমক লাগানো জাদুকর। শব্দ তিনি শুধু ব্যবহার করতেন তাই নয়,সৃষ্টিও করতেন, তার কিছু তো আজকাল প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর লেখা কবিতা অনুপ্রাস, অন্ত্যমিল, মধ্যমিল, ধ্বন্যাত্মক শব্দের নিপুণ প্রয়োগে সালঙ্কারা তো বটেই, কিন্তু সে সব ছাড়িয়েও এক অনির্বচনীয় কাব্যগুণ আছে যা আর কারুর এধরণের রচনায় নেই। সব মিলিয়ে এমন চিকণ কথার খেলা সুকুমারের আগে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় না।
স্বল্পায়ু সুকুমার লিখেছেন কিন্তু অনেক — ছড়া, কবিতা, গল্প, ছোটো উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, কী নয়। এই রচনায় আমরা সুকুমার রায়ের নাটক নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা করবো। নাটককে বলা হয় দুই পুরুষের রচনা, অর্থাৎ একটা নাটক রচনার দুই পুরুষ পরে তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। অবশ্যই নাটক কালজয়ী হতে পারে, হয়েও থাকে, কিন্তু একটা সাময়িক প্রসঙ্গ ঘিরে যে নাটক, তার সাময়িকতা চলে গেলে তা অপ্রাসঙ্গিক, আর প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেললে তার স্থান অনবধান। সাময়িকতাটা নাটককে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করে, রঙ্গব্যঙ্গের নাটকের পক্ষে তা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সুকুমার রায় এই রঙ্গব্যঙ্গের নাটকই লিখেছিলেন, তাই আজকাল তাঁর নাটকের দেখা পাওয়া যায়না কোথাও। এই বিস্মরণের জন্য লীলা মজুমদার আবার বাংলা সাহিত্যের ধারাকেই কিছুটা দোষ দেন, — “এই বড় দুঃখের কথা যে বাংলা সাহিত্য, অন্য সব দিক দিয়ে এত সমৃদ্ধ হলেও, নাটকের ক্ষেত্রে সে তুলনায় অতিশয় দুর্বল।” [১] সম্পর্কে লীলা মজুমদার সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন — উপেন্দ্রকিশোরের পরের ভাই প্রমদারঞ্জনের কন্যা।
সুকুমার রায় নাটক লিখেছিলেন নটি, আটটি বলা ঠিক হবে কেননা তাঁর প্রথম নাটক “রামধন বধের” পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায়না, শুধু অন্যের স্মৃতিচারণে উল্লেখ আছে। লীলা মজুমদার আক্ষেপ করেছেন, “যে বিশেষ ক্ষেত্রে সুকুমারের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল. সেখানেই তাঁর হাত পাকার কাজ সবচেয়ে কম এগিয়েছিল।” [ঐ] একটু প্রসঙ্গ বহির্ভূত হলেও উল্লেখ করি যে লীলা মজুমদার নিজে এই ফাঁকটি ভরাবার চেষ্টা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন, লক্ষ্যণীয় “বকবধপালা”। এর মধ্যে তিনটি নাটক বড়োদের জন্য আর বাকী পাঁচটি কিশোর-কিশোরীদের পড়ার আর অভিনয় করার উপযোগী। সুকুমারের অন্যান্য অনেক রচনার মতো এসব নাটকের কিছু লেখার অনেক পরে ছাপা হয়ে বার হয়, সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপির তারিখই ভরসা।
ক্লাবের জন্য লেখা হলো হারিয়ে যাওয়া “রামধন বধ” আর তারপর “ঝালাপালা” আর “লক্ষণের শক্তিশেল” — দুটিরই পাণ্ডুলিপি ১৩১৭, সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশ ১৩৩১। শেষ নাটকটির নাম প্রথমে ছিলো “অদ্ভুত রামায়ণ”, শান্তিনিকেতনে সুকুমার রায় প্রথম সবাইকে পড়ে-গেয়ে শোনান। বাকী তিনটির — “অবাক জলপান”, “হিংসুটি” আর “মামা গো” — প্রকাশ ১৩২৭ সালের সন্দেশ পত্রিকায়। ১৩৫২ সালে সিগনেট প্রেস “মামা গো” বাদে আর চারটি নাটক একসঙ্গে বই করে প্রকাশ করেন, নাম “ঝালাপালা”।
বড়োদের জন্য প্রথম লেখেন “ভাবুক সভা”, ১৩১৯ সালে প্রথম অভিনয় হয়েছিলো, ১৩২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ। তারপর “শব্দকল্পদ্রুম”, ১৩২১ সালে প্রথম অভিনয়, তারপর তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে অলকা পত্রিকায় প্রকাশ — সালতারিখ জানা নেই। শেষ নাটক “চলচিত্ত-চঞ্চরি” [যল্লিখিতং], পাণ্ডুলিপিতে তারিখ নেই, আন্দাজ করা হয় ১৩২৪ সাল নাগাদ। তাঁর মৃত্যুর পর ১৩৩৪ সালে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ। এই তিনটি নাটকের বই হয়ে বার হতে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়, ১৩৬৮ অর্থাৎ ১৯৬২ সালে সিগনেট প্রেস পূর্বপ্রকাশিত “ঝালাপালা” বইয়ের সঙ্গে এই তিনটি নাটক যোগ দিয়ে “ঝালাপালা ও অন্যান্য নাটক” বলে নতুন সংস্করণ বার করেন।
“ঝালাপালা” তাঁর শিক্ষানবিশীর রচনা, এতে সুকুমার রায়ের রচনায় যেমন অফুরান আর পরিচ্ছন্ন কৌতুক আশা করা যায় তা আছে কিন্তু পরিবেশনে তখনো যথেষ্ট সূক্ষ্মতা আসেনি। নাটকের পরিস্থিতিটা যেকালের কথা সেকালের মাপে নিশ্চয় সম্ভব, জোড়াতাড়ার কাহিনী, ঘটনা অতিরঞ্জিত, থেকে থেকে এ ওকে প্রহার করছে, যাকে স্ল্যাপস্টিক বলা যায়, তবে সংলাপে ভবিষ্যতের সুকুমার রায় দানা বাঁধতে শুরু করেছে। নামেই বলা হয়েছে এটি একটি “পালা”, অতএব নির্ভয়ে জুড়ির গানও জোড়া যেতে পারে — ভালোমানুষ জমিদার চণ্ডীচরণকে ঘিরে একদল নিষ্কর্মা পরগাছার দল তাঁকে উত্যক্ত করে যাচ্ছে। তার মধ্যে সশিষ্য এক টুলো পণ্ডিত, এক বেসুর গাইয়ে, গ্রামের গুণ্ডা আর ঠকবাজেরাও আছে। সামন্ততন্ত্রের অস্তকালে এমন পরিস্থিতি কিছু অবাস্তব ছিলো না। চণ্ডীচরণ অতি ভদ্রলোক, সরাসরি চাকর দিয়ে এদের তাড়াতে পারেন না, শেষপর্যন্ত তাঁর মামা কেদারকৃষ্ণের শরণাপন্ন হতে হলো। তিনি এসে নিজের রচনা শুনিয়ে পণ্ডিতের কান ঝালাপালা করে আর বাকী সকলকে সাজানো পুলিসের ভয় দেখিয়ে তাড়ালেন। কিশোরদের নিয়ে ঘরোয়া সৌখীন প্রযোজনার পক্ষে যথেষ্ট।
“লক্ষ্মণের শক্তিশেল” ওরফে “অদ্ভুত রামায়ণ” নাটকে ননসেন্স অল্পবিস্তর ঢুকতে শুরু করেছে। রামায়ণের খোলসটা ঠিক আছে বটে কিন্তু ভেতরের মালমশলায় ওলটপালট। কিছু কিছু চরিত্র ঠিকই আছে, আবার কিছু কিছু চরিত্রের আচার ব্যবহার একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অন্তত আমাদের কাছে। এ নাটকের সব চরিত্র নামে আর চেহারায় পৌরাণিক হতে পারে কিন্তু চরিত্রে খাঁটি মধ্যবিত্ত বাঙালী আর এই বেভুল যুক্তির কারণেই এ নাটক খেয়াল-রসের নাটক। পবিত্র রামায়ণ নিয়ে ইয়ার্কি মারার জন্য সুকুমারকে বকুনিও খেতে হয়েছিলো। ননসেন্সের কায়দামাফিক কুশীলবদের কিন্তু কোনো বিকার নেই। যেমন বিভীষণ রাক্ষস হলেও রাজকুমার, তাঁর দাড়ি তো থাকতেই পারে, কিন্তু সে দাড়িতে বদ গন্ধ থাকবে. এ ব্যাপারটা আমাদের ধাক্কা দেবে। জাম্বুবান কিন্তু শুধুই বিরক্ত, যেমন হওয়া উচিত। এদিকে লেখা হয়েছে মহাকাব্যের ধাঁচে, মাইকেলী অমিত্রাক্ষরে সংলাপ আছে, চারটি দৃশ্যের প্রতিটির শেষে সংস্কৃতে সমাপ্তিবাক্য আছে। স্বচ্ছন্দে যাত্রা করে অভিনয় করা যায়। ঘটনা এইরকম: ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে রামচন্দ্র লঙ্কায় শিবির ফেলে সপার্ষদ বহাল, জাম্বুবান মন্ত্রী, হনুমান, বিভীষণ, সুগ্রীব — এঁরাও সব আছেন। রাবণের অপমৃত্যু নিয়ে রামচন্দ্র কী এক স্বপ্ন দেখেছেন, তারই কথা আলোচনা হচ্ছে, এমন সময় পুঁইশাকের চচ্চড়ি আর কুমড়ো ছেঁচকি দিয়ে ভাত খেয়ে ভগ্নদূত দুঃসংবাদ নিয়ে উপস্থিত। কী সংবাদ — না সশস্ত্র রাবণ মহা ধুন্দুমারে এদিকেই আসছে, এসে পড়লো বলে। সুগ্রীব আর লক্ষ্মণ চললেন তার মোকাবেলা করতে।
দ্বিতীয় দৃশ্যে রাবণের আবির্ভাব ও ঠেঙিয়ে সুগ্রীবের বিষ ঝাড়া, সুগ্রীব পালালেন। কিন্তু লক্ষ্মণ ছাড়বেন কেন, তেড়েফুঁড়ে এলেন বটে কিন্তু তারপর রাবণের শক্তিশেল খেয়ে পতন ও মূর্চ্ছা। রাবণ তাঁর পকেট মারতে গিয়ে হনুমানের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে পালালেন। তৃতীয় দৃশ্যে শেলাহত লক্ষ্মণকে রামের শিবিরে আনা হলো, উপস্থিত সকলে হায় হায়, তার মধ্যে ভাইয়ের শোকে রামচন্দ্র মূর্চ্ছিত। নিষ্কর্মা হবার কারণে হনুমানের আট আনা জরিমানা করলেন সুগ্রীব, তারপর রামচন্দ্রের মূর্চ্ছা ভাঙ্গলে পর লক্ষ্মণের ওষুধের ব্যবস্থা হতে লাগলো। জাম্বুবান প্রেস্ক্রিপশন লিখে দিলেন, অনেক গাঁইগুঁই করার পর হনুমানকে ওষুধ আনতে পাঠানো গেলো। বিভীষণ রইলেন সেনাপতি হয়ে। ইতিমধ্যে যমালয়ে লক্ষ্মণের সম্ভাব্য মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁকে নিয়ে যেতে চতুর্থ দৃশ্যে দুই গোবেচারা যমদূত এসেছে, সেনাপতি বিভীষণ তাদের আটকেছেন। দূতের বিলম্ব দেখে যমরাজ স্বয়ং হাজির, আর ঠিক তখনই হনুমান ফিরে জায়গা না পেয়ে গন্ধমাদন পাহাড় দিয়ে যমকে চাপা দিয়েছে। হনুমানের আনা অতি শক্তিশালী স্বদেশী ওষুধের প্রয়োগে লক্ষ্মণ চেতনা ফিরে পেলেন, হনুমানও পাহাড় সরিয়ে যমকে মুক্তি দিলেন। লক্ষ্মণকে জীবিত দেখে নিজের ভুল বুঝে অনুতপ্ত যমের প্রস্থান। বাকী সবাই ঘুমের ব্যবস্থা করতে গেলো; যবনিকা। সহজ সাবলীল কৌতুক, নাটক দেখে হাসতে হাসতে বাড়ী ফেরা যায়, ঝামেলার কথা নেই কিছু। কারুর প্রতি অসূয়া নেই, শ্রদ্ধেয় রামচন্দ্র আর লক্ষ্মণ ব্যঙ্গের ঊর্ধে, মজা যা তা বানর, রাক্ষস আর সাধারণ্যকে নিয়ে। দুয়েক জায়গায় একটু কঠিন ব্যঙ্গ আছে বটে, যথা “স্বদেশী ওষুধ”, তবে শুনতে গেলে কান খাড়া করে রাখতে হয়।
এর পরের প্রহসন “অবাক জলপান” যখন সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশ হলো ততোদিনে শব্দচতুর সুকুমার তাঁর অভীষ্টে পৌঁছে গেছেন। অনেক পণ্ডিতের মতে শব্দ নিয়ে খেলা হচ্ছে ননসেন্সের এক বিশেষত্ব। “আবোল তাবোলের” অনেক কবিতা সন্দেশে বেরিয়েছে, বড়োদের নাটকও লেখা হয়ে গেছে, শব্দ আর তার অর্থ নিয়ে খেলা করা সুকুমারের কাছে তখন জলভাত। তারই প্রয়োগপ্রসূত এই ছাপার চার পৃষ্ঠা এক দৃশ্যের এই প্রহসন, শুধু নির্মল শব্দচাতুরীতে ভাস্বর তাই নয়, জীবনের দুয়েকটা সত্যের কথাও বলা আছে। পথশ্রান্ত পথিক এক অচেনা জায়গায় এসে তার তৃষ্ণা মেটাবার জন্য একটু জল খুঁজছে। মুস্কিল হচ্ছে যার কাছেই পথিক কোনো কথা বলে খাবার জল চায় সে লোকই তার অর্থ করে তার নিজের পেশা, নেশা বা খুশীমতো — যার কোনোটার সঙ্গেই তৃষ্ণার্তকে খাবার জল দেবার কোনো সম্পর্কই নেই। গোড়া থেকে দেখলে এদের পরম্পরা — ফলওয়ালা, স্মার্ত এক বৃদ্ধ, আরেক বৃদ্ধ যিনি বৈয়াকরণিক হতে পারেন, এক উঠতি কবি আর এক পরিস্রবণ বৈজ্ঞানিক। পথিক অবশ্য শেস পর্যন্ত জল পেলেন আর আমরা শুধু “জল” শব্দের ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় কতো কী বোঝানো যায় তা জেনে চমৎকৃত হয়ে বসে রইলাম। আড়ালে অবশ্য “যাদৃশী ভাবনার্যস্য” ধরণের একটা নীতিকথা থাকতে পারে, তবে তা না বুঝলেও ক্ষতি নেই, আর যাদের জন্য লেখা, সেই কিশোরেরা নীতিকথার ধার ধারে না, অন্তত সুকুমারের কাছে নয়। তৃষ্ণার্তের জন্য ফটিকজলের মতোই অনাবিল, স্বচ্ছ, রসাল, চিত্তহারী।
এ পর্যন্ত সুকুমারের সব কিশোরনাটক ছেলেদের নিয়ে লেখা, তারই প্রতিকার করার জন্য বোধহয় “হিংসুটে” নাটিকা লিখেছিলেন — কুশীলব সব মেয়ে। এ নাটিকাটি তাঁর রচনায় যা দেখা যায়না বললেই হয় , সেই ধরণের নীতিকথা মূলক। একটি গান আছে চমৎকার, আর বেশী কিছু বলার নেই। “মামা গো” একটা দেড় পাতার স্কেচ, বোধহয় ফরমায়েসী লেখা। যেসব নাটকের কথা হলো সেসব সরাসরি তাঁর রচনা, কিন্তু তাঁর রচিত অন্য গদ্যেরও চমৎকার নাট্যরূপ দেওয়া যায়, পোষাকী রঙ্গমঞ্চে না হোক শখের পরিবেশনার জন্য তো বটেই। “পাগলা দাশুর” গল্পগুলোর বেশীর ভাগই ঘটনায় আর সংলাপে একেবারে রসস্থ, শুধু দরকার মঞ্চনির্দেশনা। “হ-য-ব-র-ল”-এর এক প্রথম শ্রেণীর নাট্যরূপ আর পরিবেশনা আমরা এই আমেরিকাতে বসেই দেখেছি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো যে পরশুরাম রচিত “লম্বকর্ণ” কৌতুককাহিনী পড়ে অবনীন্দ্রনাথ এতোই খুশী হয়েছিলেন যে সেটি তিনি নিজে নাট্যরূপ দেন — “লম্বকর্ণ পালা”, যুগপৎ পরশুরাম আর অবনীন্দ্রনাথের প্রতিভায় সমুজ্জ্বল। সুকুমার রায়ের রচনা নিয়েও তা হয়ে থাকতেও পারে, আমাদের জানা নেই।
সেকালে যাত্রা, সং আর নক্সার দেশ বাংলাদেশে প্রহসনের অভাব ছিলো না। মাইকেল, দীনবন্ধু, অমৃতলাল– সবাই প্রহসন লিখেছেন, তাতে রঙ্গ তো আছেই, ব্যঙ্গের, বিশেষ করে কোনো সমাজব্যবস্থা বা কোনো গোষ্ঠীকে নিয়ে ব্যঙ্গের মাত্রাও কম নয়। মাইকেল কঠোর ব্যঙ্গ করেছেন, দীনবন্ধুর আত্মসমালোচনা “সধবার একাদশী”তে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের নিছক কৌতুক, অমৃতলাল হেনেছেন ব্যঙ্গের কড়া চাবুক। কাজেই সুকুমারের কালে প্রহসনের জন্য বাংলা নাট্যসাহিত্য প্রস্তুতই ছিলো। সুকুমার তাতে মাত্র তিনটি প্রহসন যোগ করতে পেরেছিলেন, অবশ্য স্বল্পায়ু সুকুমারের প্রতিভার কথা চিন্তা করলে সবক্ষেত্রেই তাঁর অবদান আরো কতো হতে পারতো, তা নিয়ে খেদ করা যায়। তবে কিশোরসাহিত্যের বাইরে প্রাপ্তবয়স্কদের রাজ্যে তাঁর স্বল্পস্থায়ী প্রবেশ এই তিনটি প্রহসনে, তার মধ্যে আয়তনে পূর্ণাঙ্গ নয়, অর্ধাঙ্গের কাছাকাছি আসতে পারে একটিই, সে নাটকটির নাম “চলচিত্ত-চঞ্চরি”। মাত্র ওই একটি নাটক পড়েই আন্দাজ করা যায় যে সুকুমারের অম্লমধুর নাটকের দানে বাংলাসাহিত্য কতো সমৃদ্ধ হতে পারতো।
শব্দ নিয়ে ভানুমতীর খেল দেখানোর যে কথা আগে বলা হয়েছে তার যে নমুনা আগে মনে আসতে বাধ্য তা হলো “খাই-খাই” কবিতা, পরে তাঁর একটা বইয়েরও নাম। এ এক আজব ভোজ, খাবারেরও বটে শব্দেরও বটে — একই শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, নতুন মশলায়, নতুন মোড়কে এক উপাদেয় আর অন্তত বাংলাভাষার উপাদানপ্রসূত পুষ্টিকর ভোজ। এই শৈলীই উপচে পড়লো তাঁর তিনটি নাটকে। “অবাক জলপান” তো একেবারে ছোটো ভাই, পদ্যে নয় গদ্যে, তাই বৈমাত্রেয় বলা যেতে পারে। “ভাবুক সভা” আর “শব্দকল্পদ্রুম”, দুই নাটকই এই শব্দের খেলা, এবং শব্দের খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। শেষেরটি বিস্তারিত আর অপেক্ষাকৃত জটিল। “চলচিত্ত-চঞ্চরি”-তে শব্দের খেলা দুয়েকবার মুখ দেখিয়ে গেছে, অনেকটা ক্যামিও রোলের মতো। মনে রাখতে হবে এ ধরণের খেলায় যমকালঙ্কার বা “পান্” নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়, আর তার ঝুঁকি অনেক, একটু এদিক ওদিক হলে ঘোর রসচ্যুতি। সুকুমার সে পরীক্ষায় সগৌরবে সফল। একটা ছোট্টো আপশোষ যে যদিও আমরা তাঁর কাছ থেকে “হাঁসজারু” পেয়েছি, সুকুমার কিন্তু যাকে বলে জোড়কলমের শব্দ, পোর্টম্যাণ্টো ওয়ার্ড — লুইস ক্যারলের জ্যাবারওকি কবিতা স্মরণ করুন — আমাদের উপহার দিলেন না। তাঁর হাতে এ যে কী হতে পারতো, তা ভেবেই রোমাঞ্চ হয়।
“ভাবুক সভা” সম্পূর্ণ কবিতায় লেখা, সাড়ে তিন পৃষ্ঠার একটি প্রহসন। শব্দের খেলা তো আছেই, তাছাড়া নাটিকাটি ব্যঙ্গাত্মক, ব্যঙ্গের লক্ষ্য ভাবুক লোকেরা, অর্থাৎ তাঁরা, যাঁরা বাস্তবের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেন না, ভাবের ঘোরে বুঁদ হয়ে জীবনের পথ চলেন। “শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ ‘ভাবুক সভা’ পড়ে সুকুমারকে হেসে বলেছিলেন, ‘এ তুমি নিশ্চয় আমাকে মনে কতে লিখেছ!’ ” [১]। সুকুমারের কী জবাব তা জানা যায় না, কিন্তু আমাদের মানসপটে যে ছবিটি ভেসে ওঠে সেটি পেলব রায়ের (পরশুরাম, কচি সংসদ, যতীন্দ্রনাথ সেন বিচিত্রিত)। মধ্যে মধ্যে বেকুবেরা সেই ঝিম ধরাকে ঘুম দেওয়া বলে ভুল করে থাকে কিন্তু ভাবুক তা সংশোধন করে দেন ঝটিতি। তিনটি মুখ্য চরিত্র আর এক নির্বাক জনতা — এই হলো কুশীলব, দৃশ্যপট যেখানে খুসী হতে পারে। নিদ্রিত নায়ক ভাবুকদাদাকে দিয়ে শুরু, জাগ্রত দাদার “ভাবের নামতা” পড়া দিয়ে শেষ, মধ্যে ভ, ব, ভাব, ভব, ভাবনা ইত্যাদির অনুপ্রাস আর শব্দের কারিগরি দিয়ে ঠাসা, আর কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। মোদ্দা কথা, ভাবটাই আসল, অর্থ-টর্থের কোনো প্রয়োজন নেই, “অর্থ তো অনর্থের গোড়া।” কাজেই অর্থের কোথায় জন্ম, কোথায় শেষ — এসবের খোঁজে শ্রমব্যয় করা ভাবুকের কর্ম নয়। তার কর্ম সবাইকে ভাবের নামতা শেখানো: “ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগুণে ধোঁয়া / তিন ভাবে ডিসপেপ্শিয়া … চারভাবে চতুর্ভুজ … পাঁচভাবে পঞ্চত্ব” প্রাপ্তি। ওপরে ওপরে নিছক কৌতুক আর তার মধ্যে আমাদের সন্ধানী মনের অনুসন্ধিৎসা — কোথায় কখন সুকুমার কায়দা করে একটু ননসেন্স, একটু উদ্ভটরস, একটু শব্দের জাদু মুক্তার মতো করে লুকিয়ে রেখেছেন।
“শ্রীশ্রীশব্দকল্পদ্রুম” তিন দৃশ্যের নাটক, পাত্রদের তালিকায় মানুষ তো আছেই, কিছু সুরলোকবাসীদেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে। মোট ব্যাপারটা একটু জটিল, তবে সারমর্মটা হচ্ছে যে গুরুজির মতে অর্থই শব্দের বন্ধন, প্রতিটি শব্দ তার অর্থের মধ্যে ঘুরে মরে, তাই এক একটি শব্দ এক একটি চক্র। শব্দকে যদি এই অর্থের বন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়া যায় তবে সে কুণ্ডলীক্রমে ঊর্ধ্বমুখে ওঠে, আর সেই কুণ্ডলীতে সামিল হলে স্বর্গবাস নিশ্চিত, নান্যঃ পন্থা। তিনটি শব্দের –অ, উ আর ম, একত্রে বললে ওম্ — ওপর ভিত্তি করে যে ধর্মের ধ্বজা উড়ছে, সে ধর্মের গুরুজির পক্ষে এমন সত্য শিক্ষা দেওয়াটা কিছু বিচিত্র নয়।
গুরুজির আশ্রমে শিষ্যরা বাজে কথা বলে, এঁড়ে তর্ক করে সুখেই আছে, কিন্তু মুস্কিল এই যে তাদের মধ্যে বাইরের এক উটকো লোক এসে উপস্থিত, তার নাম বিশ্বম্ভর। সে আবার কবি, তার ছেলেবেলায় লেখা একটা পদ্য উদ্ধৃত করার লোভ কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। সেটা এই রকম:
ভব পান্থবাসে এসে, কেঁদে কেঁদে হেসে হেসে ভুগে ভুগে কেশে কেশে, দেশে দেশে ভেসে ভেসে কাছে এসে ঘেঁষে ঘেঁষে, এত ভালোবেসে বেসে টাকা মেরে পালালি শেষে!
গুরুজি এসে তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে দিয়ে শিষ্যদের শব্দসংহিতা থেকে শিক্ষা দিলেন, অমাবস্যা রাত্রে শব্দমার্গ ধরে স্বর্গে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন।
পরের দৃশ্যে গুরুজি দেখেন অন্ধকারে শব্দদৈত্যেরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিপত্তারণের জন্য নানান মন্ত্র পড়ে স্তোত্র গেয়ে তিনি দেবগুরু বৃহস্পতিকে ডেকে আনলেন। বৃহস্পতি অবশ্য খুব একটা আশ্বাস দিতে পারলেন না, শুধু বললেন যে মরার আগে “যার যা কিছু দেবার থাকে দাও না লিখে আমার নামে।” এর মধ্যে নারদমুনি হঠাৎই এসে চেঁচামেচি লাগালেন, গোলমাল শুনে এলেন অশ্বিনী আর ইন্দ্র। কার্তিক এলেন তার পর, টেরি, গোঁফ, কোঁচানো ধুতি এসব চোস্ত করতে গিয়ে একটু দেরী করে। ঢুকেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে নানান অকাট্য যুক্তি দিলেন, ইন্দ্রের অস্ত্রেশস্ত্রে মরচে পড়েছে, নারদের অস্থি নিয়ে বজ্র বানানো হবে শুনে তিনি মূর্চ্ছা গেলেন, শেষে জ্যান্ত বড়ি খাইয়ে অশ্বিনী আবার তাঁকে ফেরৎ আনলেন। বৃহস্পতি দেখেন যে শব্দ আর অর্থ বিশ্বে মহাপ্রলয় ঘটাতে উদ্যত, এদিকে লড়াই দেবার মতো নেই কেউ। ব্যাপার গুরুতর দেখে সশিষ্য গুরুজি সেখান থেকে পালালেন।
অমাবস্যার রাত্রে শব্দের বন্ধন ভেঙে কুণ্ডলী চড়ে শিষ্যের দল নিয়ে গুরুজিকে স্বর্গের দিকে যেতে দেখা গেলো শেষ দৃশ্যে। বিশ্বম্ভরও আসছে, তবে অনেকটা পিছনে পড়ে গেছে। তার কারণ যে সে কিছু নিয়ে চিন্তা করছে, আর শব্দের ঘাড়ে চিন্তা চাপাবার তার এই অপচেষ্টা সারা দলকেই এগোতে বাধা দিচ্ছে। এদিকে স্বর্গে বিশ্বকর্মা টের পেয়ে গেছেন যে হঠাৎ অনেক শব্দ চক্রাবর্ত মোচন করে ওপরে উঠছে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তিনি তখন সেদিকে শব্দকল্পদ্রুম (কোন দৈব অস্ত্র বোধহয়) মারলেন, ফলং “‘দ্রুম’ শব্দে সশিষ্য গুরুজির স্বর্গ হইতে পতন।” আর সেই সঙ্গে যবনিকা। এই উদ্ভট নাটকের মূল ঘটনাপ্রবাহই তো ননসেন্স, অম্লমধুর ব্যঙ্গ আছে, তার খানিকটা মানবচরিত্র নিয়ে আর অনেকটা দেবতাদের ঘিরে। যদিও তাঁরা ব্যঙ্গের ঊর্ধ্বে বলে আমাদের শেখানো হয়, তবু আচারব্যবহারে তাঁরা মানুষের থেকে বেশী তফাতে নয়, এটা মজার। নাটকের অর্ধেক সংলাপ গদ্যে আর অর্ধেক পদ্যে, আর সেই পদ্যে ছন্দের খেলা দেখবার মতো। সমঝদার যাঁরা তাঁরা এখানে পাঁচালী থেকে রবীন্দ্রনাথ — তখনকার প্রচলিত অনেক পদ্যরীতির দেখা পেয়ে পুলকিত হবেন। আর শব্দের কারসাজি তো আছেই, পুরো কল্পনাটাই শব্দ ঘিরে। নাটিকা নিশ্চয় অভিনীত হবার উপযোগী, সাক্ষ্য আছে ১৯১৭ সালে শান্তিনিকেতনের প্রযোজনায় — সুকুমার নিজে পরিচালনা আর অংশগ্রহণ করেছিলেন।
হাজার হাজার বছরের পুরানো হিন্দু ধর্মের আচার আর দর্শনের বিকল্প হিসেবে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। সেখানে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা আসেন, চিন্তাশীল মানুষেরা আসেন, ধর্ম, দর্শন, সমাজরীতি আদি নানা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে, সমাজের উদ্দেশ্য-বিধেয় নির্ধারণ করতে। শতকের মাঝামাঝি সমাজের হাল ধরেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মনীষী বলে তাঁর খ্যাতি ছিলো। শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সমাজে যোগ দেন কেশবচন্দ্র সেন — এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। প্রথমদিকে কেশবচন্দ্র মহর্ষির প্রিয়পাত্র ছিলেন, সমাজের বহু গুরুভার কাজের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্শায়। কিন্তু কিছুদিন পরে মহর্ষি আর কেশবচন্দ্রের মধ্য সমাজের উদ্দেশ্য, ব্রত, পরিচালনার রীতি ইত্যাদি নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিতে আরম্ভ করে। বহু চেষ্টা করেও সে বিভেদ জোড়া লাগানো যায়নি, শেষে কেশবচন্দ্র আদি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নববিধান ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেন। তার সামান্য সময় পরে নববিধান গোষ্ঠীর কিছু তরুণ সভ্য আবার কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতানৈক্য হবার দরুণ আর এক ব্রাহ্ম সমাজের পত্তন করেন — সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ। অবশ্যই এসব ঘটনা সেসময়ের বুদ্ধিজীবী মহলে অনেক তর্কবিতর্ক আর উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আমরা বলেছি উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তরুণ সুকুমার সমাজের ছিলেন নেতৃস্থানীয়, ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের আচার্য নির্বাচন উদ্যোগের সাফল্যের মূল তাঁর দান আছে। ব্রাহ্ম সমাজ, তার ইতিহাস, সে ইতিহাসের ভিতরের খবর আর তার সঙ্গে জড়িত মানুষদের কীর্তিকলাপ নিয়ে সুকুমার সমুদয় ওয়াকিবহাল ছিলেন।
চারটি দৃশ্যের প্রহসন চলচিত্ত-চঞ্চরির এর শুরু সাম্য-সিদ্ধান্ত সভার ঘরে, সেখানে এক বিশেষ দিনে এক বিশেষ মানুষকে অভ্যর্থনা করার জন্য সদস্যদের সঙ্গে সভার দুই নেতা — চিন্তাশীল সত্যবাহন আর কবি ঈশান স্ব স্ব ধামাধারী সহ উপস্থিত। এই আসরে শ্রীখণ্ড নামের এক ব্যক্তি সদলে কেন এলেন না, তাই নিয়ে গরম আলোচনা চলতে চলতে বিশেষ মানুষটি এসে পড়লেন। তাঁর নাম ভবদুলাল, এতো ঘটা করে তাঁকে অভ্যর্থনা করার কারণ তিনি জিলিপিপ্রসন্ন-চামচিকেপালক আলাভোলা বাবাজীর অতি প্রিয় শিষ্য। তিনি আবার একটা বই লিখছেন, চলচিত্ত-চঞ্চরি, তার নাম, মলাট, বাঁধাই, পৃষ্ঠাসংখ্যা, মূল্য — এসব ঠিক হয়ে গেছে, এখন সেই পাতা ভর্তি করার উপাদান প্রয়োজন, ভবদুলাল এসেছেন তারি খোঁজে। নেতারা খণ্ডসিদ্ধান্ত, অখণ্ডসিদ্ধান্ত, খণ্ডাখণ্ডসিদ্ধান্ত, সমসাম্যভাব, কেন্দ্রগতং নির্বিশেষম্ আদি অতি কঠিন বিষয়ের মাধ্যমে ভবদুলালকে তাঁদের সভার মূল চিন্তাধারা বোঝালেন, এবং আশ্চর্যের কথা যে ভবদুলালকে একটু খ্যাপাটে মনে হলেও ভবদুলাল তা অক্লেশে বুঝে নিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন। পরে ঈশান পরিচালিত এক সমীক্ষা (ভবদুলালের ভাষায় মক্ষিকা) চক্রের নিমন্ত্রণ জানিয়ে প্রথম দৃশ্যের শেষ। একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে এঁদের সব আলোচনাতেই বারবার কোনো না কোনো ছুতোয় শ্রীখণ্ডপ্রসঙ্গ এসে পড়ে, এবং তা শ্রীখণ্ডবাবুদের পক্ষে খুব প্রীতিকর নয়। এটা জানা গেলো যে শ্রীখণ্ডবাবু এক আশ্রমের প্রধান, সেখানে ছাত্রদের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বৈজ্ঞানিকমতে শিক্ষা দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় দৃশ্যে ঈশানের উদ্ভট সমীক্ষা চক্র, অনেকটা প্রেতচক্র বা সিয়ান্সের মতো ব্যাপার। ভবদুলাল তাঁর বইয়ের জন্য কিছু উপাদান সংগ্রহ করলেন। চক্র শেষ হবার পর শ্রীখণ্ডবাবুর এক দূত এসে ভবদুলালকে আশ্রমে নিরিবিলিতে আলোচনা করার নিমন্ত্রণ জানালো। এদিকে ঈশান ও সত্যবাহন ভবদুলালকে শ্রীখণ্ডবাবুর সঙ্গে একা দেখা করতে দিতে নারাজ, তাঁরাও যাবেন জানালেন। তৃতীয় দৃশ্য শ্রীখণ্ডবাবুর আশ্রমে, জানা গেলো শ্রীখণ্ডবাবুরা শব্দসন্ধানী, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় শব্দজাত নানান অনুভূতি কেন্দ্র করে তাঁরা ছাত্রদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। সাম্য-সিদ্ধান্তবাদী ও শ্রীখণ্ডপন্থীদের মধ্যে গুরুতর মতভেদ, সেটা স্বল্পসময়ের মধ্যেই বিশেষ প্রকট, বেশ তর্কাতর্কির পর তা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত আক্রমণে গড়ায়, সত্যবাহন আর ঈশান চলে যান। ভবদুলাল থেকে গিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বাণী দেন, যা চলচিত্ত-চঞ্চরির বিজ্ঞাপন বলে অনায়াসে ভুল করা যেতে পারে। ভবদুলাল যথারীতি তাঁর চলচিত্ত-চঞ্চরির উপাদান সংগ্রহ করে নিলেন।
শেষ দৃশ্য আবার সাম্য-সিদ্ধান্ত সভায়, বেশ কয়েকদিন ভবদুলালের দেখা নেই, নেতারা ক্ষুব্ধ। শেষে ভবদুলাল এলেন, শ্রীখণ্ডবাবুদের আশ্রমে ভালোই ছিলেন কয়েকদিন তারপর সুবিধে বোধ না হওয়াতে চলে এলেন। জানা গেলো শ্রীখণ্ডবাবুরাও সাম্যসিদ্ধান্তবাদীদের নিন্দায় কিছু কম যাননা। সভার সদস্যরা তাতে অত্যন্ত বিচলিত। তার মধ্যে ভবদুলালের চলচিত্ত-চঞ্চরি খুলে দেখা গেলো তাতে ভবদুলাল তাঁদের নাম দিয়ে যা-তা কথা লিখেছেন, শেষে টানাটানিতে চলচিত্ত-চঞ্চরি খাতা ছিঁড়ে গেলো। ভবদুলাল আবার নতুন করে চলচিত্ত-চঞ্চরি লিখবেন, এই আস্ফালনের মধ্যে যবনিকা।
প্রথম কথা, চলচিত্ত-চঞ্চরি এমন নাটক যাকে বলা যায় “চায়ের সঙ্গে না” — ইংরেজী nwc:not with coffee-র অনুসরণে। মানে হলো চা খেতে খেতে এই নাটক পড়া উচিত নয় কেননা অকস্মাৎ হাসির ঝোঁকে গলায় চা আটকে বিষম খেয়ে পাঠক বিপর্যস্ত হতে, চাই কি মারাও যেতে পারেন। দুয়েকটি উদ্ধৃতি দেবার ইচ্ছে নিয়ে রচনাটিতে গিয়ে বাঁশবনে ডোম কাণা। পাঠক কষ্ট করে দেখে নেবেন, এ নাটক “আবোল তাবোলের” মতো জনপ্রিয় হলে এর উদ্ধৃতি হতো প্রবাদপ্রতিম। নাটক অবশ্যই ননসেন্স নাটক, আমরা ননসেন্স রচনার যে সংজ্ঞা দিযেছি তার প্রায় সবই পাওয়া যাবে — কিছু কম, কিছু বেশী। যেমন শব্দ নিয়ে খেলা, তা আছে — নজর পড়ার মতো পরিমাণে। শ্রীখণ্ডবাবুর সমস্ত শিক্ষাপদ্ধতির ভিত্তি তো শব্দতত্ত্বের উপর।
এ নাটকের পরিপ্রেক্ষিত আর কুশীলব যে কোনো সময়ের যে কোনো গোষ্ঠীর অনুসরণে হতে পারতো, তবে আমাদের মনে হয় সুকুমার ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস, চিন্তাধারা আর ঘটনাবলী থেকে অনেক ধার নিয়েছেন। ধার নিয়েছেন শুধু কাঠামোর জন্য, কেননা আমাদের স্থির বিশ্বাস যে রঙ্গব্যঙ্গ যোগ হবার আগেই সেই সাদৃশ্যের শেষ। সুকুমার ব্যঙ্গ করতে পারেন কিন্তু লেখায় তিনি ছিলেন অনসূয়, কোনো সত্যকার মানুষকে অসম্মান করার কথা তিনি চিন্তাও করতে পারতেন না। এই সাদৃশ্যের কথা চিন্তা করে এই প্রসঙ্গে প্রযোজ্য হতে পারে, ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস থেকে তেমন কিছু কথা আমরা সংক্ষেপে একটা অনুচ্ছেদে লিখেছি। বুদ্ধিমান পাঠক সেখান থেকে কিছু ইঙ্গিত পেতে পারেন। চলচিত্ত-চঞ্চরির আদি সাম্যসিদ্ধান্ত সভা অস্বচ্ছ সব ধারণার অর্থহীন ব্যাখ্যার কারণে ভেঙে দুই যুযুধান গোষ্ঠীর সৃষ্টি, তাদের মধ্যে ঝগড়া-নিন্দা-সন্দেহের সম্পর্ক — ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসেও এমন ঘটনা ঘটেছিলো। সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে সুকুমার এসব জানতেন, জেনে ব্যথা পেতেন। হয়তো সেই ব্যথার কথাই এই ব্যঙ্গের আড়ালে লুকিয়ে আছে। সুকুমারই কি ভবদুলাল? শ্রীখণ্ডবাবু স্বাধীন চিন্তা করেন, তিনি দলছুট। কেশবচন্দ্রও এমনই ছিলেন। প্রসঙ্গত, উনিশশো আশির দশকে মাদাম ব্লাভিৎস্কির থিয়োসফিকাল সোসাইটি এবং তাদের অলৌকিকচক্র ভারতে, বিশেষত তথাকথিত বিদ্বৎসমাজে বেশ আলোড়ন তুলেছিলো। এই নাটক — এবং “শব্দকল্পদ্রুম” নাটকের — সমীক্ষা চক্রের যে কথা সুকুমার লিখেছেন তার ভিত্তি এই সোসাইটির চক্রেই হবে।
সুকুমারের নাটকের বয়স একশো ছুঁতে চললো, কিছুর তো পেরিয়েই গেছে। সময় পাল্টেছে, বদলেছে সমাজ, সেসব মানুষ আর তাদের জীবনযাত্রা মহাকাল গ্রাস করেছে। জমিদারী উঠে গেছে বটে, কিন্তু মোসায়েব, পরগাছা আর তাদের ঠকবাজিতে তো আজও ভাঁটা পড়েনি। রামায়ণ হচ্ছে অমর কাব্য, আর এতো আক্রমণ সত্ত্বেও মধ্যবিত্তেরা বেঁচে আছে আজও। বাঙালী আজও খাই-খাই করে আর তৃষ্ণায় কাতর হলে কোথায় জল পাই, কোথায় জল পাই করে ঘুরে বেড়ায় — অন্তত এপার বাংলায়। মাওবাদী আর মার্ক্সবিবাদী সব দল আজও আদর্শ নিয়ে বাকযুদ্ধে নামে আর সাধারণ মানুষ, সাধারণবুদ্ধির মানুষ তাতে মজাও পায় আবার নাকানিচোবানিও খায়। ভাবুকরা বাড়ছে ঝাড়ে বংশে, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া আর ব্লগের কল্যাণে তার প্রমাণের অভাব নেই। আর যদিও ডেরিডা আর চোমস্কি সাহেবরা শব্দ আর অর্থের ঝুঁটি ভালোভাবে নেড়ে দিয়েছেন তাও ছন্দের, অনুপ্রাসের আর শব্দকৌতুকের বাজার এখনো গরম। এভাবে দেখলে সুকুমারের প্রায় প্রত্যেকটি নাটক কিন্তু আজও প্রাসঙ্গিক।
সুকুমার রায়কে কেন “সুকুমার রায়” হতেই হতো তার আরো দুটো কারণ আছে। তিনি “সুকুমার রায়” হয়ে পথ না দেখালে বাঙালী ছেলেমেয়েরা লীলা মজুমদার আর সত্যজিৎ রায় [সুকুমারের একমাত্র সন্তান] কোথা থেকে পেতো?
ভাবলেও হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ভাগ্যিস!
[১] “সুকুমার”, লীলা মজুমদার, রচনাবলী-৩, এশিয়া পাবলিশিং, ১৩৬২