শতবর্ষে আবোলতাবোল ও সমকালীন বং সোসাইটি

শতবর্ষে আবোলতাবোল ও সমকালীন বং সোসাইটি

দেশের তখন চরম দুরবস্থা। মাত্রাহীন এক অচলায়তন ঘিরে ছন্নছাড়া অবস্থা! চারপাশে হরতাল চলছে। মানুষ একটা বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে! সমস্ত “সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া!” রাজ্যের এলোমেলো চিন্তাভাবনা মানুষগুলোকে কেমন যেন উথালপাথাল করে দিয়েছে।

“হ য ব র ল” হয়ে যাওয়া জীবন “আবোলতাবোল” বাঁকে যখন অন্য খাতে বইছে, ঠিক তখনই তিনি এলেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো। তিনি এলেন, দেখলেন এবং ভাঙলেন একের পর এক নিয়ম!

হুলোর গান শুনিয়ে তিনি এক বিদঘুটে জীবের সন্ধান দিলেন। মুন্ডুতে ম্যাগনেট ফেলে তিনি “ফুটোস্কোপ” দিয়ে স্টাডি করলেন মগজের ভেজাল!

আয়ানেস্কো যদি লিখতে পারেন, “ছিল মানুষ,হল গন্ডার!”

কাফকা যদি লিখতে পারেন গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাওয়ার গল্প, তাহলে তিনিও আছেন তাঁর “ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল”এর জন্য!

ঝাঁকিয়ে দিলেন আবোলতাবোল বাঙালির সেই ভেতরের ‘আমি’ সত্তাটিকে – যে মাসের শুরুতে আম্বানি ও শেষে দেউলে, এবং মাঝখানে মধ্যবিত্তের শাঁখের করাতের চাপে ভোগে! যেখানে একটা ‘আমি’র শেষ হয়, ঠিক সেখানেই নিত্যনতুন “ম্যাট্রিক ফেল” ননসেন্স শব্দচয়ন আমাদের চূড়ান্ত যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়!

“কাঠ বুড়ো”, “হেড অফিসের বড়বাবু”, “পাগলা জগাই”, “ন্যাড়া”, “হিজিবিজবিজ” – যাদের ভুলভাল কাজকর্ম উদ্ভট গোলমেলে অদ্ভুতুড়ে নিয়মে পরিচালিত হয় বলে আমরা হেসে উঠি, তাঁর শিল্পের ছোঁয়া যেন তাদেরকেই নবজীবন দান করে!

আমি পালোয়ান স্যান্ডো সমান

তুই ব্যাটা তার জানিস কি?

কোথায় লাগে বা কুরোপাটকিন

কোথায় রজেদস্তভেনিস্কি!

সময় সমাজ এবং রাজনীতি সম্পর্কে এই মানুষটা বরাবরই ছিলেন অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন!

১৯০৫ সালের রাশিয়া-জাপান যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ছিলেন তৎকালীন যুদ্ধমন্ত্রী কুরোপাটকিন!

আর নৌবাহিনীর সেকেন্ড প্যাসিফিক স্কোয়াড্রনের চিফ কমান্ডার ছিলেন রজেদস্তভেনিস্কি!

ওপরের কবিতার লাইনগুলো আবার পড়ুন আর ভাবুন একবার লোকটার রেঞ্জ!

বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!

কোনদিন ফাঁসি যাবে

নয় যাবে জেলে!

একটা সে ভূত সেজে

আঠা মেখে মুখে

ঠাঁই ঠাঁই শিশি ভাঙ্গে

শ্লেট দিয়ে ঠুকে

অন্যটা হামা দিয়ে

আলমারি চড়ে

খাট থেকে রাগ করে

দুমদাম পড়ে।

এই ডানপিটে ছেলে দুটি মনে হয় ‘যুগান্তর’ এবং ‘অনুশীলন সমিতি’! পদ্ধতিটা হতেই পারে নেহাতই চরমপন্থা! লাইনগুলো পড়লে কল্পনা করে নিতে সমস্যা কোথায়! ডানপিটে শব্দটা তো তিনি বিপ্লবীদের ভেবেই মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন!

দুই শতকের সন্ধিক্ষণে ভারতবর্ষ এমন একজন শিল্পীকে পেয়েছিল, যিনি সাড়ে বত্রিশ ভাজার দেশে সব অচলায়তন ভেঙে নিয়ম এবং বিদ্রোহের সীমানা ছাড়িয়ে এক সম্পূর্ণ অন্য ধারণার অবতারণা করেছিলেন যা রোমান্টিক নয়, বরং ফ্যান্টাসি!

অথচ নিদারুণ বাস্তব!

শিশুদের জন্য ক্যাপসুলের মোড়কে তখন তিনি লিখছেন আদ্যোপান্ত বড়দের লেখা!

বাবুরাম সাপুড়ে আর যাই হোক শুধুমাত্র বাচ্চাদের কবিতা নয়! ইংরেজ চাইত বরাবরই এমন সাপ, যে কখনওই ফোঁস করবে না! সেই সাপকে ডান্ডাপেটা করে যেন ঠান্ডা করে দেওয়া যায়!

মেটাফরটা ভাবুন!

আর ‘একুশে আইন’ তো বলতে গেলে মহাকাব্য!

“শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে

কেউ যদি যায় পিছলে পড়ে/প্যায়দা এসে পাকরে ধরে”

এর থেকে বড় বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক কবিতা আর কিছু হতে পারে কি?

কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে আজকের দিনে যখন ওঁর এই প্রকাণ্ড সারকাসম সবচেয়ে বেশি করে প্রণিধানযোগ্য, ঠিক তখনই ওঁকে নিয়ে চর্চাটা সাংঘাতিক কম। আজকে যখন মুখের চেয়ে মুখোশের সংখ্যা বেশি (অবশ্য এখানে করোনা মাস্কের কথা বলা হয়নি!), তখন সৎসাহস এর বিশেষ প্রয়োজন। তাই তো উচ্চারণ হওয়া চাই ঋজু অথচ উইট, বুদ্ধির দীপ্তি ভরে থাকবে তাতে!

“আরশুলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে,

আর করে না বুক দুর্ দুর্ জুজুর নামটি শুনে!”

চারপাশে তো আর আরশোলা, জুজু কিংবা কুমড়োপটাশ কম নেই! কাঠবুড়ো কিংবা বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাইয়ের উদাহরণও আশেপাশের অমুক দাদা কিংবা কেষ্ট বিষ্টুর ভিতর টইটম্বুর!

মাসী গো মাসী/পাচ্ছে হাসি

নিম গাছেতে হচ্ছে শিম

হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা

কাগের বাসায় বগের ডিম!

বেবাক লোক বুঝুক আর না বুঝুক, তাঁর কবিতায় সর্বদাই দুটো জগৎ থেকেছে। একটা আপাত আর একটা সুপ্ত। ক্যামোফ্লেজ আর স্বাভাবিকের সুস্থ এবং অসুস্থ দুধরনের প্রতিযোগিতায় মানুষের খোলনলচে বদলানোর অনেকগুলো আঙ্গিক একসাথে নিয়ে খেলা করেছেন সুকুমার। সেখানে প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে শক্তিশালী ও দুর্বলের মধ্যেকার বিভেদ। আজ যখন মানুষ প্রতিটা মুহূর্তে নিজের সত্তাকে তুলে ধরছে সকলের সামনে, যখন নিজের যাবতীয় সমস্ত কিছুকে ‘আপডেট’ করতে গিয়ে নিরন্তর নিজেকে নিজের কাছেই নামিয়ে আনছে, সেইসময় সুকুমারের থেকে বেশি প্রাসঙ্গিক আর কেই বা হতে পারেন!

এই মাঝের একশো বছরে যত পরিবর্তনই আসুক না কেন, সেখানে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বদলটাই হচ্ছে মুখ্য। আগে বাঙালির চাহিদা কম ছিল। সে বই পড়ত, ছবি আঁকত, যাত্রা দেখত, পালাগান শুনত। আর যেটা সম্পদ ছিল, সেটি হল উইট, বুদ্ধির দীপ্তি! আবোলতাবোল তো আর কেবলই শিশুপাঠ্য নয়, তাতে সুকুমারের নিজস্ব বস্তুবাদী দর্শন মিশেছে প্রতিটা ছত্রে। দেশ কাল সময়ের গণ্ডী অচিরেই পেরিয়ে গিয়ে সমস্ত অধিকরণ কারকে সুকুমার রায়ের সন্তান আবোলতাবোল ফ্রেমে সব বয়সের মানুষকেই ফ্রিজ করে দাঁড় করিয়ে দেয়। আপাতভাবে হাসি এলেও অবচেতনে চৈতন্য আনার জন্যে এর থেকে ভালো অনুঘটক আর হয় না। সাতচল্লিশটি কবিতার প্রতিটিই উচ্চপর্যায়ের আবোলতাবোল যেখানে “নীল ও লাল সুর” গুলিয়ে যায়! এখন সেগুলি পাঠ করে আপনি “ডানপিটে” বা “আহ্লাদী” হবেন, নাকি “রামগরুড়ের ছানা” হয়ে শাসনের নামে বিশেষ কিছু জিনিসকে নিষিদ্ধ করবেন, সেটা আপেক্ষিক!

চিত্রঋণ: অন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *