পুস্তক পর্যালোচনা - হার্ট ল্যাম্প (নির্বাচিত গল্প)
২০২৫ সালে বুকার প্রাইজ পেয়েছে বানু মুশতাক লিখিত ‘হার্ট ল্যাম্প‘ যার অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি। প্রথমে দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। এই বই সম্পর্কে লিখতে গেলে শুরু করতে হবে, প্রথম কন্নড় ভাষার সাহিত্যিক বুকার প্রাইজ পেল, একই সঙ্গে প্রথম কোনও ছোটোগল্প সংকলন এই পুরস্কারে ভূষিত হল। কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে অনুবাদক হিসেবে দীপা ভাস্তি প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেন। যদিও ২০২২ সালে ‘Tomb of Sand’–এর জন্য গীতাঞ্জলিশ্রী এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। যে বই সম্পর্কে এতগুলো ‘প্রথম‘ যুক্ত হয়েছে সে বই যে পাঠকমহলে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসবে এটাই স্বাভাবিক। বইতে মোট ১২টি গল্প আছে। বেশিরভাগ গল্পই নারীকেন্দ্রিক কিংবা নারী প্রধান চরিত্র অথবা প্রথম পুরুষে নারীর কন্ঠে কাহিনি রচিত হয়েছে। ইদানীং নারীকে কেন্দ্র করে কোনও গল্প, উপন্যাস লেখা হলেই তাকে ‘নারীবাদী‘ লেখা বলে অনায়াসে দাগিয়ে দেওয়া হয়। এখানকার গল্পগুলোকে কোনও ‘বাদী‘ আখ্যায়িত না করে বলা যায় নারীদের কথা বলা হয়েছে।

বই: হার্ট ল্যাম্প (নির্বাচিত গল্প)
লেখক: বানু মুশতাক
কন্নড় থেকে অনুবাদ: দীপা ভাস্তি
প্রকাশক: পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস
নারীদের নিয়ে তো আগেও প্রচুর গল্প লেখা হয়েছে। তাহলে এই সংকলনটি নিয়ে আলাদা করে গুরুত্ব পাচ্ছে কেন! আসলে বানু মুশতাক এমন একটি সমাজের প্রতিনিধি এবং এমন চরিত্রদের কথা বলেছেন যাঁরা প্রত্যেকেই একটি বিশেষ ধর্মের – আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে মুসলিম ধর্মের প্রতিনিধি। এই ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতা, নারীদের অধিকার অনেকটাই খর্ব, যেখানে প্রতিনিয়ত নারীদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, সমাজের গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকে। কিন্তু জীবন সংগ্রাম আর কষ্টের মধ্যে থেকেও প্রতিটি নারী কীভাবে নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি খুঁজে পেয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠে সেটাই বানু মুশতাকের প্রতিটি গল্পের মূল বিষয়। বারোটি গল্পের বিভিন্ন নারী চরিত্র, উদ্ভূত হওয়া বিভিন্ন পরিস্থিতি, কিছু সমস্যা, ঘটনার প্রেক্ষাপট, তাদের অসহায় অবস্থার কথা যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় তখন আর সেই চরিত্রদের এই বিশেষ গণ্ডীতে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। সেখানে সেই চরিত্রদের মুখের কথা, তাদের যন্ত্রণা, তাদের সঙ্গে ঘটা প্রতিটি অন্যায়, অবিচার, অমানবিক আচরণ, পাশবিক অত্যাচার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নারী উপলব্ধি করতে পারে। এমনকি সেই উপলব্ধি কখনও কখনও দেশ-কালের সীমানাও অতিক্রম করে যায় বলেই আন্তর্জাতিকস্তরে ঝড় তুলে পুরস্কার গ্রহণ করতেও সক্ষম হয়। আসলে এখানে নারীদের এমন কিছু কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে যা শুধুমাত্র কোনও একটি অঞ্চলের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। প্রত্যেকটি গল্পের প্রতিটি গল্পের চরিত্র প্রতিবাদী হয়ে কিছু বলতে চেয়েছে, কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চেয়েছে। ধর্মীয় মোহের আবরণে এমনকি আল্লাহর নামেও ভয় দেখিয়ে প্রতিনিয়ত নারীদের অনগ্রসর করে রাখা হয় সেই প্রথার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছেন বানু মুশতাক।
ধর্মান্ধতার মোড়কে শুধু যে নারীকে মুড়ে ফেলা হয়েছে তা নয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘Red Lungi’ গল্প। খতনা বা সুন্নত প্রথার বীভৎসতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেদের যন্ত্রণাও প্রকাশ্যে এনেছেন তিনি। এই প্রথা নিয়ে নিজের ছেলের জন্য বাবার মনেও যে একটা দ্বন্দ্ব অহরহ চলতে থাকে পাশাপাশি সেটাও প্রকাশ করেছেন যখন লতিফ তার নিজের রুগ্ন ছেলের কথা চিন্তা করতে থাকেন আর স্ত্রী রাজিয়ার কথামতো ছেলে সামাদের খতনা কোনও না কোনও বাহানা দিয়ে পিছিয়ে দিতে থাকেন। এই গল্পের হাত ধরেই উঠে এসেছে শ্রেণী বিভাজনের প্রসঙ্গও সেখানে দেখা যায় সুন্নত হয়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলেটিকে তার মা আরও একবার নিয়ে এসেছে কিছু খাদ্যদ্রব্য পাওয়ার আশায়। এক কথায় বলা যায় দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য বাচ্চাদের বলি দিতে এসেছে তার মা।
এই শ্রেণীবিভাজন আরও স্পষ্ট হয় ‘The Shroud’ গল্পে। প্রত্যেক নিষ্ঠাবান মুসলিমদের কাছে হজ যাত্রা একটি পবিত্র কাজ। তাই তার আগে মনের দীনতা, হিংসা, দ্বেষ দূর করে সবার কাছে ক্ষমা চাইবার রীতির কথা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন লেখিকা। ইয়াসিন বুয়া সাজিয়ার বাড়িতে কাজ করে। তার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে সাজিয়াকে পবিত্র জমজম জলের স্পর্শ পাওয়া একটি কাফন যা মৃতদেহের সঙ্গে কবরে দেওয়া হয় সেই কাপড়ের টুকরো বা চাদর এনে দিতে বলেন। এখানে ধনী-দরিদ্রের পৃথকীকরণ ঘটে যায় ইয়াসিন বুয়ার চেহারার মতো তার আনা টাকাগুলোর মধ্যেও যখন সাজিয়া দেখে:
It was when the notes passed from Bua’s hands into her own that Shaziya understood. Money from the pockets of poor people was, just like them, broken, shattered, crumpled, wrinkly, diminished in essence and form. She had at times felt that even if the poor were given crisp notes, the money would turn into something strange and ugly; now she had become sure of it. ‘OK, Bua, you go and come,’ she said, and sent her off. Shaziya immediately went to the en-suite bathroom, placed the money on top of the sink, and washed her hands thoroughly with a disinfecting soap before lying down on her bed.
একই সঙ্গে তার ধনী আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ব্যবহার এবং তাদের জন্য হজ থেকে ফেরার পথে কিনে আনা জিনিসপত্রের বহরেও এই শ্রেণীবিভাজন বজায় থাকে। কিন্তু গল্পের শেষে সাজিয়ার যে মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব চলে, যে কারণে সে কষ্ট পেতে থাকে এবং সেই কষ্টের তীব্রতা বাড়তে থাকে এই অনুভূতিই জিতিয়ে দেয় মানবিকতাকে। আত্মসচেতনতা, আত্মসম্মানবোধ বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে প্রতিটি গল্পে। ইয়াসিন বুয়াও তার ব্যতিক্রম নন। সাজিয়ার কাছে অপমানিত হয়ে ইয়াসিন বুয়া আর কোনদিনও সে বাড়িতে পা দেননি।
আল্লাহর দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন বোকা বানানো মৌলভী, মুতওয়ালিরাও বানু মুশতাকের কলমের কষাঘাত থেকে রেহাই পাননি। কোরানে পুরুষদের যে চারটে বিয়ের কথা আছে তার স্বপক্ষে যুক্তিও আছে:
Zulekha Begum lifted her head from her book and said, ‘Look, for any man to marry four wives, there has to be right reason for it. If it is wartime, if many men are dying in the war, then a man can marry more than once. If the wife is suffering from a long-term incurable disease, or if she cannot have children, then he can marry again. Else, if he cannot get satisfaction from one…’ She couldn’t finish the sentence.
Aashraf suddenly exploded in anger. ‘I don’t fall into any of these categories. Don’t I have children? Isn’t it wrong that he left me? Isn’t it wrong that he made me and our children destitute?’ ‘Look, according to Sharia, even if he marries again, he has to ensure that he does not make even a little distinction between the two wives and treats them both equally.’
‘That means… how, Apa?’
‘That means if he builds you a house, he has to build a similar house for her. If he buys you a saree, one for her too. If he spends one night with you, he has to spend one night with her.’
Aashraf’s eyes welled up. ‘I don’t want all that, Apa. If he spends a little money for my child and saves her life.
এক মায়ের শাশ্বত এবং চিরন্তন কথা তাকে তার স্বামী পরিত্যাগ করলেও সে শুধুমাত্র তার সন্তানদের জন্যই কিছু টাকা চায়, কিন্তু সেটুকুও দিতে নারাজ পুরুষ।
কোরানের কথাগুলো বিকৃত করে শুনিয়ে দিনের পর দিন ধর্মান্ধতার মুখোশ পরিয়ে নির্বিবাদে নারীদের ওপর যে অত্যাচার করা হয় তা শুনিয়েছেন ‘Black Kobra’ গল্পে:
Amina was listening to their conversation from behind the door, and mima used him wholeheartedly. “Ah! Look at him buttering up. For his own satisfaction, he will even bring down God. He will bring up the Qur’an, quote from the Hadith But if he is told to give something to feed that poor woman, then he begins to shirk his responsibilities. God, when will you ve some sense to this fellow?’ She quietly slid behind the door and went inside.
এই গল্পেই দেখানো হয়েছে কীভাবে একজন মুতওয়ালি সাহেব কুকুরের জন্য চিন্তিত অথচ এক মহিলাকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে তার সংসার ধ্বংস হতে বসেছে অথচ তার প্রতি কোনও ন্যায় বিচার করা হচ্ছে না। গল্পের শেষে সমস্ত মহিলাদের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে লেখক এখানে একটা ভীষণ পজিটিভ বার্তা দিয়েছেন। সব মহিলাদের যে যন্ত্রণা একটা জায়গায় এটাই তাদের কাছে এনে দিয়েছে। পর পর কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীদের ওপর কীভাবে অত্যাচার করা হয় এবং তাদের কীভাবে কথা শোনানো হয় সেটা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে লেখকের নানা গল্পে।
ঈশ্বরের প্রতি সরাসরি অভিযোগও এনেছেন ‘Be A Woman Once, Oh Lord!’ গল্পে। আমরা কথায় কথায় বলি নারী হয়ে তো জন্মাওনি। একবার নারী হয়ে জন্মালে তার কষ্টটা উপলব্ধি করো। বস্তুতপক্ষে এই গল্পটি সবচেয়ে মারাত্মক এবং এখানে বর্ণিত নারী চরিত্র সমস্ত নিপীড়িত নারীদের প্রতিভূ। বানু মুশতাক এখানে সরাসরি অভিযোগ জানিয়েছেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে:
“That means society has accepted what he’s doing. They even say that you help with these things! It is in your name that he does this, because I am your incomplete creation, hey Prabhu? Can you hear my grievances? Are y cries reaching you? What will I do… what will I do…“
এ গল্পে উঠে এসেছে পুরুষরা নির্বিবাদে, নির্বিচারে যা খুশি তাই করতে পারে। তীব্র ব্যঙ্গ সহকারে তিনি লিখেছেন যে স্বামীকে তার বিবাহিত স্ত্রীর কর্তব্য হিসেবে কী কী করতে হয়:
Come to think of it, for us Muslims, it is said that, other than Allah above, our pati is God on earth. Suppose there comes a situation where the husband’s body is full of sores with pus and blood oozing out from them, it is said even if the wife uses her tongue to lick these wounds clean, she will still not be able to completely repay the debt she owes him. If he is a drunkard, or a womaniser, or if he harasses her for dowry every day- even if all these ifs’ are true, he is still the husband. No matter which religion one belongs to, it is accepted that the wife is the husband’s most obedient servant, his bonded labourer.
অথচ এই প্রতিটি কাজ করার পরও শারীরিক সুখ দিতে পারছে না বলে স্বামী নির্বিকার চিত্তে তার স্ত্রীকে এবং সন্তানদের উপেক্ষা করে পুনরায় বিবাহ করতে পারে। প্রাক্তন বিবাহিত স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্বও অস্বীকার করতে পারে। সমাজপতিরাও সে বিধান দেন। যদি মনে করে শারীরিকভাবে তার স্ত্রী তাকে সুখ দিতে পারছে না তাহলে আরও একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তার জবাবদিহি সে করবে না তার স্ত্রীর কাছে:
“Should I give you an explanation also? OK, listen then. I do not wish to waste my life with a beggar like you. What is the use of a sick person? I am marrying a good girl from a good family.”
তাই নিরুপায় হয়ে সেই নারী সর্বশক্তিমান কাছেই তার অন্তরের আকুতি জানায় ‘Be A Woman Once, Oh Lord!’
বিভিন্ন গল্পে যেভাবে তিনি ‘তালাক‘ শব্দটিকে ব্যঙ্গ করেছেন এতে বোঝায় একজন নারীর জীবনে এর থেকে বড় অপমানজনক শব্দ আর কিছু হয় না। এই একটা শব্দ যে নারীর জীবনকে কীভাবে বিধ্বস্ত করে দেয় তা বোঝার ক্ষমতা পুরুষদের থাকে না যার প্রতিফলন ঘটেছে শেষ গল্পে।
‘দেশ‘ পত্রিকায় লেখকের দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তাঁর গল্পগুলোর চরিত্ররা তাঁর চারপাশে থাকা পরিচিত মানুষদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে। তাঁরা যেভাবে প্রতিদিন অত্যাচারিত হন, যন্ত্রণা সহ্য করেন সেইসব যন্ত্রণার কথা, অসহায়তার কথা স্পষ্টভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। তবে শুধু এ কথা বললে এই গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে ধরা যাবে না। এর সঙ্গে বানু মুশতাকের জীবনের দিকে যদি একটু আলোকপাত করি তাহলে দেখতে পাই তিনিও একসময় তাঁর চারপাশের সমাজ থেকে নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে হুমকিও পেয়েছেন। কিন্তু পাশাপাশি তার একান্ত আপনজনরা সব সময় তার পাশে থেকে সাহসও দিয়েছেন। ছোটোবেলা থেকে পড়াশোনার জন্য তাঁর পিতা তাঁর পাশে সবসময় ছিলেন কিন্তু পারিবারিক সদস্যদের কাছে ছোটোবেলা থেকে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন। উর্দুভাষী স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁকে তার বাবা এক কন্নড় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, যেখানে স্কুলের প্রিন্সিপাল মনে করতেন উর্দু শুধুমাত্র মুসলিমদের ভাষা এবং কন্নড় হিন্দুদের। কিন্তু বানু মুশতাক তাঁর এই ধ্যান-ধারণা ভেঙে দিয়ে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই কন্নড় বর্ণমালা শিখে ফেলেছিলেন যার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর রেজাল্টে এবং তাঁকে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফোরে সরাসরি প্রমোশন হয়েছিল।
ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী এবং নির্ভীক। পরবর্তীকালে পেশায় আইনজীবী হওয়ার ফলে তাঁর এই নির্ভীকতার আরও নিদর্শন পাওয়া যায়। আইনজীবীর পাশাপাশি তিনি নানা ধরনের আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত। সাহিত্যিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বান্দায়া সাহিত্য।’ বাড়ির অমতে বিয়ে করার জন্য শ্বশুরবাড়িতেও তাঁকে এমন অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল যেখানে ঘিরে ছিল গোঁড়ামি, অন্ধ সংস্কার এবং ধর্মান্ধতা। তাঁর লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য তিনি একদিন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর স্বামী তিন বছরের মেয়েটিকে নিয়ে এসে তার কাছে অনুরোধ করেছিলেন তাদের ছেড়ে তিনি যেন চলে না যান। এইসব টুকরো টুকরো ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ‘Heart Lamp‘ গল্পে। স্বামী ব্যভিচারী হওয়ার জন্য স্ত্রী বাপের বাড়িতে কোনও রকম সাহায্য না পেয়ে অবশেষে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই কাজ সে আর করতে পারে না। সম্পূর্ণভাবে না হলেও কিছুটা যেন তাঁর জীবন কাহিনি প্রতিফলিত হয়েছে ‘Heart Lamp‘ গল্পে। পাশাপাশি বহুমুখী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ফলে তিনি অনেক কিছু দেখেছেন, জেনেছেন, বুঝেছেন যার ফলে তাঁর লেখায় নানাভাবে বারবারই ফিরে এসেছে নির্ভীকতা আর প্রতিবাদের কথাও। অন্য অর্থে বলা যায় বানু মুশতাক মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং ভবিষ্যতেও এই লড়াই জারি থাকবে।
লেখকের পাশাপাশি অনুবাদক দীপা ভাস্তিরও প্রশংসা করতে হয়। তাঁর সহজ সরল সাবলীল অনুবাদের জন্য গল্পগুলো পড়তে কোনও অসুবিধা হয় না। তাঁর কথামতো লেখক বানু মুশতাক যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা বেশ অভিনব। কন্নড়, উর্দু, আরবি, দাখনি (যা আবার ফার্সি, দেহ্লাভি, মারাঠি, কন্নড় এবং তেলুগুর মিশ্রণ) এবং হাসান জেলার বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশেষ ধরনের কন্নড়ের মিশ্রণে কিছু কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানেই অনুবাদক দীপা ভাস্তিও একটু অভিনবত্বের পরিচয় দিলেন। তিনিও অ-ইংরাজি শব্দ, যেমন কাফন, সেরাগু (আঁচল/পাল্লু), নিয়াত (আল্লাহকে খুশি করার জন্য সংকল্প) সরাসরি ব্যবহার করেছেন। ভাই, সাহেব ইত্যাদি সম্বোধনও একই রেখেছেন ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করেননি, বরং সেগুলোকে একই রেখেছেন পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্য।
বানু মুশতাকের এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার জন্য ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষ যে জানতে পারল এটা একটা ভীষণ আশাজনক বার্তা এবং গর্বের বিষয়। ভবিষ্যতে ভারতবাসী হিসেবে আবারও এমন গর্বিত মুহূর্তের সাক্ষী থাকব এই আশা রাখি।